“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ১ জুন, ২০১৫

জে এম কোয়েটজির 'এজ অব আয়রন'

       
  ।।  শিবানী দে।।
  শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকীয় সাহিত্যের সঙ্গে সদ্য পরিচয় হল নোবেলবিজয়ী লেখক জে এম কোয়েটজির উপন্যাস এজ অব আয়রন’ দিয়ে । উত্তম পুরুষের উপস্থাপনায় কাহিনিটি, বৃদ্ধা মহিলা মিসেস কারেনের জীবনের শেষ কটা দিনের অভিজ্ঞতা ----তিনি লিপিবদ্ধ করছেন পত্রে, তাঁর বহুদিন প্রবাসী কন্যার কাছে ।
           গল্পটি শুরু হয় বাড়িতেই তাঁর অভিঘাতের চমক দিয়ে----যখন সত্তর বছরের মিসেস কারেন, কেপটাউনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ক্লাসিকস ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপিকা, আবিষ্কার করলেন যে তাঁর বাড়ির গ্যারেজের পেছনে এক ভবঘুরে আস্তানা গেড়েছে । সদ্য তিনি জেনেছেন ক্যান্সারে তাঁর মৃত্যু আসন্ন; মৃত্যু আসন্ন জেনে মাংসভুক শকুন যেমন মৃতপ্রায় পশুর দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে এগিয়ে আসে, তেমনি কি তাঁর ভাবী মৃত্যুর খবর শুঁকে ভবঘুরে তাঁর বাড়িতে আস্তানা গাড়ছে ? এধরণের লোকদের তিনি রাস্তায় দেখেছেন, কাছে থেকে কখনও দেখেননি ; যেমন তিনি প্রত্যক্ষ করেন নি বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকদিন ধরেই চলতে থাকা সংঘর্ষ, এবং তাকে প্রতিহত করতে ঔপনিবেশিক সরকারের ভয়াবহ দমননীতি, যদিও তিনি আজীবন মননে ও আচরণে বর্ণবৈষম্যবাদের মিথ্যা এবং বর্বরতার বিরোধিতা করে আসছেন । জীবনের শেষ প্রহরে তিনি এই বৈষম্যবাদী ব্যবস্থার ফলে উদ্ভূত লৌহ-কঠিন ক্রোধের সঙ্গে সম্পর্কান্বিত হতে বাধ্য হলেন । তাঁর বাড়িতে কাজ করে ফ্লোরেন্স, অত্যন্ত দক্ষ সেই মহিলার উপর তিনি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল । সেই ফ্লোরেন্সের ছেলে, পনেরো বছরের ভেকি, ও তার এক বন্ধু শহরের কৃষ্ণাঙ্গ-অধ্যুষিত অঞ্চল গুগুলেতু থেকে তাঁর বাড়িতে ফ্লোরেন্সের কাছে থাকতে এলে পুলিশ তাদের অনুসরণ করতে থাকে, পুলিশের তাড়া খেয়ে সাইকেলে পালাতে থাকলে অন্য একটা গাড়ির সঙ্গে লেগে দুর্ঘটনা ঘটে । ভেকির আঘাত বেশি না হলেও তার বন্ধুর চোট গুরুতর হওয়াতে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় । আহত হয়ে পড়ে যাওয়া সেই ছেলেটির কাছে গিয়ে প্রথমবার কৃষ্ণাঙ্গ রক্তের মুখোমুখি হন মিসেস কারেন, দেখেন যে তাঁর শ্বেতাঙ্গ জ্ঞাতিরা কত সহজে রক্তপাত করতে পারে । হাসপাতালেও বর্ণবৈষম্য অনুসরণ করা হয়, যার ফলে ছেলেটির জায়গা হয় বয়স্কদের ওয়ার্ডে । ভেকিকে গুগুলেতুতে পাঠিয়ে দেয় ফ্লোরেন্স ।
            ভেকির কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না  এই মর্মে টেলিফোন পেয়ে ফ্লোরেন্স যাবার জন্য প্রস্তুত হয় । মিসেস কারেন তাকে গাড়িতে করে পৌঁছে দিতে গেলে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার শুরু হয় । এই প্রথম তাঁর চোখে পড়ে কালো মানুষদের বস্তি----বেশির ভাগ ঘরবাড়িই ঝুপড়ি----কোন নাগরিক সুযোগ-সুবিধাহীন মনুষ্যেতর  জীবনযাপন । আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করার সরকারি নীতির ফলে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে একতা নষ্ট হয়ে গেছে, লুটতরাজ , বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ চলছে, অসংখ্য লোক গৃহহারা, সর্বস্বহারা, অসহায়ভাবে বৃষ্টিতে ভিজছে, দিগ্বিদিক ছুটছে । কে কাকে মারছে ঠিক নেই, সরকারি পুলিশ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে । মিসেস কারেনের পথ-প্রদর্শক তাঁকে একটা পোড়া বাড়িতে নিয়ে গেল, সেখানে তিনি দেখলেন অন্য আরো কয়েকজনের সঙ্গে শোয়ানো, গুলিতে ঝাঁঝরা ভেকির মৃতদেহ । সাদা পুলিশ তাঁকে ফিরে যেতে বলল, তাঁর সঙ্গে পুলিশ এসকর্ট দিয়ে বড় রাস্তায় পৌছে দেবার প্রস্তাব দিল, তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন এদিকে শ্বেতাঙ্গ  হিসেবে কালোরাও তাঁকে বিশ্বাস করছে নাতাঁর এতদিনের বিশ্বস্ত পরিচারিকাও নয় । কেউ একজন ঢিল ছুঁড়ে তাঁর গাড়ির কাচ ভেঙ্গে দিল ।
           অবসন্ন শরীরে মিসেস কারেন ফিরে এলেন । তাঁর বেঁচে থাকার ইচ্ছেও চলে গেছে । এই দেশে তাঁর মা জন্মেছিলেন । দেশের অস্থিরতার কারণে দশ বছর আগে তাঁর মেয়ে আমেরিকা পাড়ি দেবার পরেও তিনি মাতৃভূমি ছাড়ার কথা ভাবেননি । তাঁর শরীরের মত এই দেশ ও এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত । তিনি এখন লজ্জাবোধ করেন এই দেশে জন্মাবার জন্য, তাঁর জাতির বছরের পর বছর ধরে অপরিবর্তনীয় নৃশংস মানসিকতার জন্য । ভবঘুরে মদ্যাসক্ত ভারকুয়েইল, ফ্লোরেন্সের আপত্তি সত্ত্বেও যাকে তিনি তাড়াননি, একা ঘরে তাকেই তাঁর প্রচণ্ড ক্রোধ ও হতাশার কথা বলতে থাকেন ,যদিও জানেন সে কতটুকু বোঝে তার ঠিক নেই । তাকেই বলে রেখেছেন তাঁর মরবার পর এই চিঠি তাঁর মেয়ের কাছে ডাকে পাঠিয়ে দিতে । তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন কেপ টাউনের ঢালু গড়ানের দিকে, তীব্র হতাশায়, প্রতিবাদের ইচ্ছায় আত্মহত্যার সংকল্প করেন । অবুঝের কৌতূহল নিয়ে ভারকুয়েইল তাঁকে মরতে বলে । কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দ্বে দোলায়িত, এবং জীবনের প্রতি স্বাভাবিক মায়াবশত, তাঁর আত্মহত্যা করা হয় না ।
          মিসেস কারেন ফিরে আসেন যেন  আরো মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার জন্য । ভেকির বন্ধু, প্রতিবাদ আন্দোলনে জড়িত কিশোর, হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেয় । কিন্তু পুলিশ বাড়িতে এসে তাকে গুলি করে হত্যা করে, অনেক বাদানুবাদ, উপরোধ অনুরোধের পর ও মিসেস কারেন তাকে বাঁচাতে পারেন না ।
            প্রচণ্ড আঘাতে, হতাশায় মিসেস কারেন কিছুতেই ঘরে থাকতে পারেন না, গায়ে কম্বল জড়ানো অবস্থায় বেরিয়ে পড়েন  রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তাঁর বাড়িতে ঢুকে পড়েছে, এ বাড়িকে  আর কিছুতেই নিজের বাড়ি বলে তিনি ভাবতে পারছেন না । রাস্তায় নেমেই বা অসুস্থ বৃদ্ধা মহিলা  কতটুক যেতে পারেন? দুটো রাস্তা পেরিয়ে এক ফ্লাই-ওভারের তলায়  শুয়ে পড়লেন । সেখানেও নিষ্কৃতি নেই । অন্ধকারে ভবঘুরে শিশুর দল লুটপাটের উদ্দেশ্যে তাঁর শরীর হাতড়ায়, কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে মুখ খোলে, কিজানি দাঁতে সোনা বাঁধানো থাকেঅবসন্ন শরীরে তাঁর কিছু বলার বা করার ক্ষমতা নেই শেষপর্যন্ত ভারকুয়েইল ও তার কুকুর এসে তাঁকে বাঁচায়তার সাহায্যে  তিনি পরদিন বাড়ি ফিরে যান ।
            এবারে সেই ভবঘুরে মাতাল নোংরা ভারকুয়েইল ও তার কুকুর হয়ে ওঠে তাঁর  সাথী । মৃত্যু দ্রুত এগিয়ে আসছে, তিনি টের পাচ্ছেন । প্রথম যেদিন ভারকুয়েইল এসেছিল,তাকে তাঁর মৃত্যুর গন্ধ পেয়ে আসা শকুনের মত মনে হয়েছিল । তাকে চলে যেতে বলেছিলেনসে ফিরে ফিরে এসেছে ,তারপর আর তার প্রতি কড়া হন নি। যখন ভেকি ও তার বন্ধু তাকে মেরেছিল, তখন ফ্লোরেন্সকে ডেকে ঝগড়া থামিয়েছিলেন । তাকে এমনি এমনি দয়ার ভিক্ষে না দিয়ে কিছু কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক দিতে চেয়েছিলেন যাতে তার মনে স্বাভাবিক আত্মসম্মান জাগ্রত হয় ।টাকা পেলেই সে মদ খেয়ে আসে, কাজের জন্য তাকে সব সময় পাওয়া যায় না। কোন শিষ্টাচার সে জানে না , কিন্তু সে-ই এখন তাঁর অবলম্বন হয়ে ওঠে  অপরিশীলিত মনে তার বুদ্ধি কম, তিনি ভেবেছিলেন । এখন বুঝেছেন, অস্থিরতা আর দমন পীড়নের দেশে তার স্বাভাবিক প্রকাশের ভাষা নষ্ট হয়ে গেছে । অনভিজ্ঞ সে দোকানে যায়, যাহোক কিছু রান্না করেতাঁকে স্নান করতে কাপড় কাচতে সাহায্য করে । তার জন্য তিনি ও চিন্তা করেন, তিনি চলে গেলে তার কি হবে ভাবেন । তাকে স্বাভাবিক জীবনের দিকে ফেরাবার চেষ্টা করেন, ভালোবাসার কথা বলেন । ঠাণ্ডায় যখন শরীর জড়প্রায় হয়ে যায়, তখন তাকে বিছানায় ডাকেন, তার  উষ্ণতায় নিজেকে উষ্ণ করবার চেষ্টা করেন । মনে হয়, এই তাঁর নতুন সংসার । শেষ পর্যন্ত যে কাছে থাকে, তাকেই ভালোবাসতে হয়আপন জন যখন দূর হয়ে যায়, সে তখন আর আপন থাকে না, তাঁর শেষ মুহূর্তের প্রতীতি এটাই হয়ে দাঁড়ায় । দীর্ঘ পত্রের শেষে মেয়েকে তিনি এই কথাটাই লিখেন ।
         উপন্যাসটি বর্ণবৈষম্যবাদের উপর সরাসরি আক্রমণ ।বর্ণবষম্যবাদ জাতির প্রতি জাতির অপরাধ, তার পাপের বোঝা শুধু প্রত্যক্ষ অপরাধীদের নয়, সংশ্লিষ্ট সকলকেই  বইতে হয় । ঔপনিবেশিক সরকার ও শোষিত কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে আছে 'বিবেকবান' শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, যারা সরকারি বর্বর নীতির বিরোধিতা করে,মনেমনে অপরাধবোধে ভোগে, কিন্তু পৃথিবীর সব জায়গার বেশিরভাগ মধ্যবিত্তদের মত সুবিধা-বঞ্চিত হবার ভয়ে সরাসরি সংঘর্ষে জড়াতে চায়না, নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে । মিসেস কারেন তেমনি দেখেছেন কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেরা শ্বেতাঙ্গদের বাগানে মালির কাজ করে, বাড়ির পিছনের আঙ্গিনায় বসে পাউরুটি জ্যাম ও টিনে করে জল খায় । কালোরাই দিনের পর দিন করে পরিচারক পরিচারিকার কাজ, কসাইখানায় পশুপাখি জবাই করার কাজ । শ্বেতাঙ্গ-পাড়ায় বিশাল বিশাল পাঁচিলঘেরা বাড়ি, গাছপালা, বাগান, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের ঘর বাঁধবার অনুমতি নেই । তারা মূল শহরের বাইরে থাকে, সেখানে তাঁর মত মধ্যবিত্তরা পা রাখে না । শেষজীবনে  সেখানে গিয়ে যখন স্বচক্ষে দেখেন, তখনই তিনি উপলব্ধি করেন কেন ভয়ঙ্কর ক্রোধ কৃষ্ণাঙ্গদের লোহার মত অনমনীয় করেছে ।
একদিকে শাসকদের জেদি নৃশংসতা, অন্যদিকে প্রতিবাদী কৃষ্ণাঙ্গদের ক্রোধ, দুয়ের মাঝখানে দেশের অস্থির ভবিষ্যৎ যখন আশাপ্রদ নয়, তখন  মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়ে বিদেশে পালায়, যেমন গিয়েছে মিসেস কারেনের মেয়ে । দেশে পড়ে থাকে  একাকী অসুস্থ বৃদ্ধ, যাদের সাথি বেড়াল, কুকুর, ও ভবঘুরে ছাড়া কেউ থাকে না ।
            ১৯৬পৃষ্ঠার ছোট উপন্যাসটি বহুমাত্রিক, ভাষা কাব্য-ধর্মী, সহজ, এবং শেষ পর্যন্ত এক চরম বোধে পৌছে আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি ।




কোন মন্তব্য নেই: