।। রণবীর পুরকায়স্থ।।
শেখরকাকুর
গায়ের রং কালো, কালো
রঙের গ্রীক ভাস্কর্য । মনে হয় পাথরে খোদাই মূর্তি । শেখর কাকু কথা বলে কম কিন্তু
হাসে মিষ্টি করে । তিন রকমের হাসি আছে তার,
খুব কৃপণের মতো হাসে, মার সামনে
বেশি হাসলে
যেন তার সব সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাবে,
তাও বাবার সঙ্গে হাসিতে ফাউ দেয় অনেকটাই আর তার সঙ্গের হাসি হল
আগল ভাঙা ঢেউ যেন বিগবাজার আর নাহাজ-এ যা কিছু কেনো আর
যা কিছু খাও এর ফ্রি পাশ । শেখর কাকু শিলচরের বিখ্যাত মানুষ । শেখর কাকু গল্প লেখে,
উপন্যাস লেখে । সিনেমা করে নি, কিন্তু
সিনেমা নিয়ে ভাবনা চিন্তা আছে পড়াশুনা করে । যখন তার লেখালেখির দুরন্ত সময় তখনই
নাকি গল্প লিখত চিত্রনাট্যের আঙ্গিকে । ওকেও খুব উৎসাহ দিয়ে বলত পুণার ফিল্ম
ইন্সটিটিউটকে ভর্তি করিয়ে দেবে । বলত সাই পরঞ্জপে মীরা নায়ার অরুন্ধতী
দেবীদের কথা । ওয়েল্ডিং মিস্ত্রির মেয়ে কান্তার জীবনে চমৎকার খুব একটা কিছু হয় নি
। সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে চলচ্চিত্র পরিচালনা শিখে এসে পিআরসি এনআরসি ডি
ভোটার ডিটেনশন ক্যাম্প নিয়ে সিনেমা তৈরি করে নি । সে যে সাহিত্যিক শেখর
কাকুর এত ভক্ত তাও তার সাহিত্য কর্ম কিছুই পড়ে নি।শৈশবে না বুঝে কথা
দিয়েও তার লেখা ফেরারি গল্প নিয়ে
ছবি করার কথাও মনে নেই । শেখরকাকুকে সে দেখে আসছে ছোটবেলা থেকে, ইটখোলায় তাদের পঞ্চাশ টাকা ভাড়ার বাড়িতে
। কান্তার তখন সাহিত্য টাহিত্য বুঝার বয়স নয় । কান্তার বাবারও তেমন পড়াশুনা নেই । পঞ্চম
সিঙের গ্যারেজে ওয়েল্ডিং এর কাজ করত । শেখর কাকুর হিসেব পত্র দেখার
কাজ । বাবার সঙ্গে খুব অন্তরঙ্গতা,
সেই সূত্রে বাড়িতে আসে,
মা চা করে দেয় । বাবা আর কাকু বিড়ি খায় খুব । ওরা গল্প করে, কান্তা বসে থাকে । শেখর কাকু বাবাকে বলে,
--- দেখে নিও নির্বাসদা, আমি একদিন হলিউড চলে যাব । তোমাদের ঐ
পঞ্চম সিঙের গ্যারেজের কাজ আমার নয় ।
কান্তাকে
তার বাবা বলত ডায়নোসরের ফুসফুস নামে এক গল্পের কথা । চিত্রনাট্যের আকারে লেখা, শিলচরের পাঠক পাবলিক ধরতেই পারল না
গল্পটা । কান্তা যে পড়ে নি শেখর কাকুর লেখা তা নয়,
তবে তার বাবা সব পড়েছে বলে,
---ওরে বাবা কী দারুণ লেখক
!
বিন্দু
বিন্দু জল নামের একটি ছোট উপন্যাসের পরতে পরতে দেশভাগের যন্ত্রণা । কান্তা
ওসব বুঝে না,
দেশভাগ বুঝবে কী করে, ওর
বাবারা তো এদেশের মানুষ । কাটলিছড়া ধলাইমলাই গ্রামে ওদের বাড়ি । ওখানে
একটি বসতবাড়ি আছে।
ব্যাস আর কিছু নেই, অনেক
শরিক, ভাগ
হলে গ্রামের জমি আধকাঠাও পড়বে না ভাগে । কয়েকজন কাকা, জেঠা থাকে এক রক্তের । কাটলিছড়া শহর
থেকে অনেক দূর, প্রায়
দুঘণ্টার হাঁটাপথ । ছোটকাকুর বিয়ের সময় কাটলিছড়া থেকে হেঁটে বাড়ি গেছে কাকু কাকি মুকুট
মাথায় দিয়ে। একটা শুধু হ্যাজাকবাতি জ্বলেছিল
একজন মানুষের হাতে । নদীও
একটা হেঁটে পার হতে হয়েছে, জল ছিল না । সেই ছোটবেলাই বয়স কত জানে না,
ছোটই খুব । শিলচরে থাকত ওরা,
সাপনালার শেষ মাথায় ক্রোজিয়ার কোম্পানির গায়ে ম্যালেরিয়া
অফিসের পিয়ন ছিল ঠাকুর্দা, কাকা
জেঠা সবাই ছিল দোতলার কোয়ার্টারে, একটা
দোকানও ছিল তাদের বিড়ি সিগারেট পান ও মনিহারি জিনিষের । ঠাকুর্দা মরে গেল আর সব
ছেলেরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল এদিক ওদিক । কান্তার বাবা হয়ে গেল ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি ।
এসব
তো তথ্য শুধু বিগত দিনের । কান্তা লস্কর লেখাপড়ায় মন্দ নয়, বিএ পাশ করেছে কাছাড় কলেজ থেকে ।আসাম বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে এমএ । টেট পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে কিন্তু পিআরসি নেই বলে এগোনো যায় নি । আসামে পিআরসি না থাকলে কিছু হয় না,পিআরসিমানে পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট সার্টিফিকেট মানে
আসামে থাকার স্থায়ী শংসাপত্র । তার নেই, তাদের কারও নেই। কান্তা
তার বাবার উপর রাগ দেখায় । বলে,
--- একটা পিআরসি যোগাড় করতে পার না ।
লিগ্যাসি ডাটা নেই কারো । কোন দেশের নাগরিক তুমি বাবা ?মহাপ্রভু
কলোনির মীনাক্ষী
কাকিমার বাপের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গ বলে এনআরসি হয় না
। সুচন্দা নামের ঘরের বৌকে বিনা দোষে ঢুকিয়ে দেয়
ডিটেনশন ক্যাম্পে,
ডিটেনশন না কনসেট্রেশন ? আমরা
কী ইহুদি,
খৃষ্টানেও মারে মুসলমানেও মারে । আমরা কী রামায়ণের সীতা যে এনআরসির জন্য আগুনের
পরীক্ষা দিতে হবে ?
শেখর
কাকু এলে কান্তার বাবার হুঁশ থাকে না,
কে কী বলছে শুনতে চায় না । বাবা শেখর কাকুর রাজকীয় বসার ভঙ্গির
দিকে তাকিয়ে থাকে । শেখর কাকুর কথা বলা অনেক কমে গেছে, বাবাই শুধু বকবক করে আর কাকু শুধু হাসে
। বাবা কিংবা কাকু কেউই এখন পঞ্চম সিঙের গ্যারেজে কাজ করে না, গ্যারেজ ভেঙে পাঁচতলা বাড়ি হয়েছে । ওদের
দুজনেরই অবসর জীবন,দুজনেরই
অসুস্থ শরীর । কিন্তু মনের দিকে এখনও সেই কুড়ি বছর আগের দেখা বাবা কাকা । কাকু
এখনও হাসে,
এখনও বলে
সিনেমা করবে ত্রুফো
বুনুয়েল অ্যাটেনবরোর মতো । কান্তার বাবা সিনেমা টিনেমা বুঝে না, গল্প লিখতে বলে । বলে,
--- তুমি লেখো শেখরদা । আমি প্লট দেব ।
যেন
শেখর কাকু বাবার প্লটের অপেক্ষায় গল্প লিখছে না । কান্তার আবার সব সময় এককথা ভাল লাগে
না । তার রাগের কথায় গুরুত্ব না দেওয়ায় মানুষটাকে চিমটি কাটে । কান্তার বাবা ততক্ষণে
মেয়ের অভিমানে লাগাম দেয় । পিআরসি এনআরসির গঞ্জনা সয়ে শেখর কাকুকে সাক্ষী মানে। বলে,
--- শেখরদা সেবা-কেন্দ্রে কেউ জানাশুনা
আছে তোমার ?
কান্তা
বাপকে থামিয়ে দেয় । বলে,
--- সেবা-কেন্দ্রে মেশিন কথা বলে । তাও
ওদের পিন ৫১ আর ৭১ এ আটকে আছে আধখেঁচড়া । আমার এরকম নাগরিকত্ব চাই না, সারা দেশের সঙ্গে নাগরিকত্ব চাই, ১৯৫৫ র নাগরিকত্ব আইন
মোতাবেক ।
--- আচ্ছা গো রানী দুর্গাবতী । এখন
দুকাপ চা আনতো
দেখি । শেখরদা
একটু চিনি দেবে নাকি ? আচ্ছা
দিস না,
মিষ্টি বিস্কুট একটা খাবে ফিফটি ফিফটি ?
কান্তা
কার উপর রাগ করবে । মান অভিমানের কথা বলবে । যত বুড়ো হচ্ছে মানুষটা শিশুর মতো হয়ে
যাচ্ছে,
চিন্তা নেই ভাবনা নেই । খাও দাও আর শেখরকাকু এলে প্লট প্লট খেলো । শেখর কাকু আর তার
বাবার একটা যুগলবন্দী আছে । কান্তার বাবা গল্প বলে খুব সাজিয়ে গুছিয়ে, কথা দিয়ে ঘটিয়ে দেয় ঘটনা আর পাত্রপাত্রীর নড়াচড়া । তাই
বসে বসে মুগ্ধ হয়ে শোনে । এক মিনিটের মধ্যে দুকাপ লিকার চা বানিয়ে ফিরে আসে । তাও
বাবা বসতে দেয় না তাকে
। বলে,
--- যা তো মা । তোর ঠাকুর্মার ট্রাঙ্ক থেকে
তামার টাটিটা নিয়ে আয় ।
বেশি
হলে একহাত মাপের গোলাকার এক তামার থালার
নাম টাটি । থালার ভিতরে খোদাই করা কয়েকটি নাম,
সবার উপরে লেখা দীননাথ লস্কর ,
তারপর আদিনাথ,
শিবনাথ দুইভাই, সবার
শেষে শিবনাথের পুত্র ত্রৈলোক্যনাথ লস্কর । একটি গাছের অবয়বের নীচে ঝুলে ঝুলে নামছে
যেন ফল, আরো
অনেক জায়গা আছে পরবর্তী নাম খোদাই করার । কান্তা বাবার ইশারায় শেখর কাকুর হাতে দিতেই
কাকু বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় । কথার আগে হাসি ফোটে মুখে । হাসির পর বলে,
--- এই গুপ্তধন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে ? এই বংশ বৃক্ষের ইতিহাস জানো তুমি ?
--- জানি ।
বাবা
প্লটকথা শুরুর আগে মঙ্গলা চরণ করে প্রপিতামহকে স্মরণ করে । বলে,
--- ঠাকুর্দার কাছে শুনেছি গল্প রামভজ
গোস্বামীর । বংশ পরম্পরায় গোস্বামীরা বৈদ্য । বৈদ্য মানে কবিরাজ, হিন্দিতে বৈদজি । রামভজরা আবার
ব্রাহ্মণও বটে । ওদের পৈত্রিক বাসভূমি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে । ওরা নিশ্চিত যে
কনৌজ কিংবা মিথিলার ব্রাহ্মণ নয় । ওরা ওবধি,
ঘাগরা নদীর পারে রামপৈড়ি ঘাটে তাদের তিনতলা বাড়ি কয়েক পুরুষের
বাসস্থান । গোষ্ঠী বেরাদির মানুষ অযোধ্যা নগরে বিশেষ করে ঘাগরা পারে ছড়িয়ে আছে ।
সবাই একবার না একবার কোন না কোন সময় দেশের বাড়ি ঘুরে আসে । দেশে গিয়ে ওদের আদি
বাসস্থানের নতুন নতুন তথ্য নিয়ে ফেরে । ওরা যে বৃন্দাবনের বাসিন্দা ছিলেন সে তথ্যও
বেশ জোরালো । উপকথা পুরাণকথা উদ্ধৃত করে কেউ কেউ বলেন শ্রীকৃষ্ণ মথুরার রাজা হওয়ার
পর ওরাও মথুরা চলে যায় । মথুরা থেকে গুজরাট । বৃদ্ধ
বুজুর্গরা খুব গর্বের সঙ্গে তাদের রাজার গুণকীর্তন করে । বলে কিষণ
মহারাজ রক্তক্ষয় চাইলেন না তাই যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন । কংসের মতো মহাপাপীকে
মেরে যে দুভাই রাজা হয়েছিল তারাই মগধ রাজার ভয়ে চলে গেলেন রাজ্য ছেড়ে । আর একপক্ষ
ইতিহাসের কাছাকাছি নিয়ে আসে যুক্তি । বলে ইব্রাহিম লোদীর ভয়ে তখন সবাই ব্রজ ছেড়ে
পালিয়েছিল, চুরাশি
ক্রোশ হিন্দুশূন্য হয়েছিল । তখন গোস্বামীরাও সরযূর
তীরে এসে ভেসে উঠেছিল । এখন তো জেলা ফৈজাবাদ তখন ছিল সাকেত ।
কান্তা
তার বাবার প্লটগল্পে দীর্ঘ উপক্রমণিকা শুনতে শুনতে খুব বেশি পুরনো না হওয়া রাগটা
আবার মুরুব্বি শেখর কাকুকে ঝাড়ে । বলে,
--- আচ্ছা কাকু । এত যে ঠাঁই নাড়া হল, গোস্বামীরা লিগ্যাসি ডাটা পেয়েছিল ? কিংবা ন্যাশনেল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স
নাম উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে ?
--- আচ্ছা , শেখরদা, আমার মেয়েটা এই লিগ্যাসি আর নাগরিক
পঞ্জি নবায়ন নিয়ে পাগল হয়েছে কেন বলতো ? চোরের
কী থাকে বাটপাড়ের ভয় ? আমাদের
কী ভয় ? এখন
বললে এখনই চলে যাব যে দিকে দুচোখ যায় বৌমেয়েকে নিয়ে । কিন্তু কোথায় যাব ? কে নেবে ?
খেতে পরতে দেবে তো ? ৬৫
বছর আগে, ভিত্তিবর্ষ
১৯৫১ তে আমার ঠাকুর্দা ছিলেন ম্যালেরিয়া অফিসের পিওন, রেকর্ড বের করে দেখতে পারে । তা না হলে
আরো আগে ১২৭০ সালের রেকর্ড ও আছে আমার কাছে এই তামার টাটে । একটু
শোন না চুপ করে,
শেখরদাকে প্লটটা দিই । তো বুঝলে তো দাদা রামভজর পরিবারের কেউ না কেউ যে একবার
ফৈজাবাদ বেড়াতে যায় তা কিন্তু একশ ভাগ শিকড়ের সন্ধানে নয় । সরযূর
তীরে ওদের যে বাড়িটা আছে একটা । ওদের
মানে গোস্বামী পরিবারের । গোস্বামীরা যারাই দেশ ছেড়ে গেছে কেউই কিন্তু পেশা ছাড়ে
নি, বংশানুক্রমে
ওরা বৈদ্য । অযোধ্যার
বৈদ্যবাটি যেন একটি গুরুগৃহ, বিশ্ববিদ্যালয়
এর মতো এর গ্রন্থাগার,
হাতে লেখা পুঁথি, শতায়ূ সব পূর্বপুরুষরা শিক্ষা
দিয়ে থাকেন ভিষক শাস্ত্র । যেহেতু বৃন্দাবনের সঙ্গে তাদের আদি পুরুষের সংযোগ আছে
তাই শ্রীকৃষ্ণের শৈশবলীলার গোকুল নন্দগ্রাম রাধারানীজির বর্ষণা গোবর্ধন পর্বত সহ চুরাশি
ক্রোশ পরিক্রমা এবং জড়িবুটি আহরণও তাদের এক বাৎসরিক কার্যক্রম । বৃন্দাবনের
ঘনজঙ্গলে চোর ডাকাতের উৎপাত থাকায় শ দেড়শ লোকের টুকরি নিয়ে বেরোয় ব্রজ পরিক্রমা ।
পরিক্রমার মাঝপথেই শুরু হয় কলেরা । আর তখনই রামভজর পূর্বপুরুষ বৈদ্যরাজ রামনরেশ
গোস্বামী আর তার স্ত্রীর অক্লান্ত
সেবাও চিকিৎসায় সুস্থ করে তুলে পূণ্যার্থীদের । একজনেরও মৃত্যু হয় না । ধন্য ধন্য
পড়ে যায় যুবক বৈদ্যজি আর বৈদ্যানির । এর মধ্যে দীননাথ লস্কর নামের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি
তার স্ত্রী ও দুই শিশুপুত্র আদিনাথ শিবনাথ এসে রাসনরেশ বৈদ্য আর স্ত্রীর পায়ে
লুটিয়ে পড়ে । ওদের মুখে বিচিত্র ভাষা । কাছাড়ের মানুষ তো, কাছাড়ের ভাষায় কথা বলে । রামনরেশ পা সরিয়ে নেয়
। দীননাথ লস্কর বলে,
--আপনি
ব্রাহ্মণ, আপনি
ভগবানের সঙ্গে লড়াই করেন । বৈদ্যরাজও বলে,--ব্রাহ্মণ হলে কী
হয়েছে, আমিও
মানুষ আপনার মতো । আপনি পিতৃতুল্য । দীননাথ বলে,
--আপনি
সাক্ষাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ । কী করে রক্ষা করলেন এতো ভক্তজনকে !
কবিরাজ বলে,
--বৈদ্যর
কাজই সেবা । আপনাদের ভাষা বড় বিচিত্র । লস্কর জমিদার বলে,--আমরা
বাঙালি, কাছাড়ে
থাকি
। --কাছাড়
কোথায় ?
--আসাম
। --আসাম
কোথায় ?
--তন্ত্রপীঠ
কামাখ্যার নাম শুনেছেন । দেবীর যোনীপীঠ । সিলেট দেশে আছে আরো দুটি বাহান্নপীঠের
। আমরা থাকি হেড়ম্ব দেশে । জেলা কাছাড়,
শহর শিলচর । --জানি,
আসামে যাইনি কোনোদিন । যাব একবার কামাখ্যা দর্শনে । --চলুন এবার আমাদের
সঙ্গে । বৈদ্য বৈদ্যানি দুজনেই রাজি ।
দীননাথ
লস্কর কিন্তু হেলা ফেলার মানুষ নয় । শিলচরের বিরাট ভূস্বামী । এদিকে দীননাথ লস্করও
রামনরেশের দুর্বলতা জেনে গেছে, পায়ে
হাত দিলেই কাবু হয়ে যায় সদাহাস্যময় পুরুষ । দীননাথ জমিদার তাকে
নিয়ে যায় শিলচরে । শহরের বিশালতম বাড়ি ইটখোলা পাড়ায়,
বিরাট সিংদরজা । রামনরেশ বৈদ্যর ভাল লাগে বাড়ি । দীননাথ লস্কর
বলে,
--গুরুজি
এখন থেকে এই বাড়ি আপনার । আমাকে শুধু এককোণে থাকতে দেবেন । রামনরেশ রাজি নয়।
বলে,
--একি
কথা, আমি
অযোধ্যায় ফিরে যাব । --আপনাকে
যেতে দিলে তো । আপনি এখানে আপনার সেবা কর্ম করবেন,
এখানেই আপনার আরোগ্য আশ্রম হবে গুরুদেব । আপনি আমাকে জীবন দিয়েছেন, আমার সর্বস্ব আপনাকে দেব ।
শিলচর
জনপদের বাইরে মেহেরপুর নামের এক গ্রাম,
গ্রামের পূর্ব দিকে লস্কর টিলা,
দীননাথ লস্করের জমিদারি । জমিদার নবীন বৈদ্য
রামনরেশ কে বলে,
--আপনি
চারদিকে তাকিয়ে যা দেখছেন প্রভু সব আপনার । আপনার নামে জমাবন্দি করে দেব সারা জীবন
স্বত্ব ভোগ করবেন । গোস্বামী চিকিৎসক বলে,
--এখানে
তো দেখি চাষ আবাদও হয় না তেমন, একটা
গোশালা করে নাও না কেন ? --তাই
হবে গুরু । মেহেরপুরে
পঞ্চাশটি গরু দিয়ে গোশালা হয়, গোশালার
জমি আর ইটখোলার ভদ্রাসন সব লিখে দেয় অযোধ্যার বৈদ্যরাজকে । স্ত্রীকে বুঝিয়ে বলে, --শূন্য ছিল শূন্য দিয়ে
দিলাম এবার দেখ শূন্যের কেরামতি । কেরামতি কিছু হয় নি লস্কর মহামতির
। কিন্তু রামনরেশ গোস্বামীর বংশ হিন্দিভাষী থেকে বাংলায় রূপান্তরিত হতে শুরু করে ।
রামনরেশের তৃতীয় প্রজন্মের বংশধর, মানে তার নাতি রামভজ পর্যন্ত বংশের
ধারা রক্ষিত হয় । রামভজ কবিরাজ হলেও লাল পালোয়ানের শিষ্য । মস্তোবড়
কুস্তিগীর । নরসিংটোলার গোস্বামী দাওয়াখানায় কিছুদিন কবিরাজি করে মন ভরে না । ভজ
বৈদ্যর তখন কিছু বাঙালি বন্ধুবান্ধব হয় যারা চা বাগানের নেতাগিরি করে । তাকে
শোনায় চা শ্রমিকের দুঃখ দুর্দশার কথা । সে যায় চা বাগানে কাছাড়ে সিলেটে, বৈদ্য হয়ে ঢুকে নেতা হয়ে ফেরে । তখন
দক্ষিণ সিলেটের চা বাগান গুলিতে শুরু হয়েছে আন্দোলন । মুলুক যাওয়ার
লড়াই ।
আবার
কান্তা তার বাবাকে থামিয়ে দেয় । বলে,
--- বাবা, তোমার প্লট কিন্তু
গল্পের নিয়ম মানছে না ।
--- না মানুক, শেখরদার কলমে ঢুকলে সব সাইজ হয়ে যাবে ।
--- গল্পে প্রোটাগনিস্ট থাকে,এন্টাগনিস্ট
থাকে বলেছে কাকু ।নায়ক আর
ভিলেইন। তোমার কথায় নায়ককে এত কম জায়গা দিয়েছ
আর যে লোকটা নায়কের সব ঝেড়ে দিল তার জন্য বাকি গল্প । হল না বাবা, তামার টাটকে তুমি ইচ্ছে করে আটকে দিলে ।
যদি আটকেই দেবে তবে বংশগাছে দীননাথ লস্করের পর আরো তিনটে নাম কেন দিলে অকারণ । এক
লস্করেই শেষ করে দিতে পারত ।
কান্তা
এরকমই । বাবার এই গোস্বামী নিয়ে আদিখ্যেতা পছন্দ নয় বলে থামিয়ে দেয় গল্প বলা ।
কান্তার রাগ কিন্তু ক্ষণিকের, মনে
কোন দুঃখ নেই । বলার পর সব
ভুলেও যায় সঙ্গে সঙ্গে ।
কান্তা
একটি সাইবার কাফে চালায় ,সঙ্গে
জেরক্স মেশিন । তার নিজের নয় কুঞ্জ সিং মালিক । সারাদিনের কাজ নয় । বাঁধাধরাও নয়
যে সকাল দশটা থেকে দুপুর একটা, সন্ধ্যে
পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করতেই হবে । বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় বইখাতা জেরক্স
থাকলে বাড়তি রাতে থেকে করে দেয় । কুঞ্জকাকু দেয় মন্দ
না । কোন কাজ পড়লে দোকান একদিন দুদিন বন্ধ থাকলেও কিছু না । বলে,
--- আমি কম্যুনিস্ট পরিবারের ছেলে । শ্রমিক
দরদি ।
ঘোড়ার
ডিম দরদ । বসে
বসে মুনাফা খায় । তবে দোকানটা মোক্ষম জায়গায়,
নন্দ সিং কমপ্লেক্স কলেজের গায়ে হওয়ায় প্রথম প্রথম জোড়ায় জোড়ায়
ঢুকে যেত ঘেরা দেওয়া ঘরে । ঘণ্টার পর ঘণ্টা । কান্তা বলতেই ঘেরা তুলে দেয়
কুঞ্জকাকু, সাইবার
কাফেতে ভিড় কমে যায়, জেরক্স
কাগজ কলম খাতা বিক্রিতে পুষিয়ে দেয় কান্তা । ইদানীং তো জেরক্স
এর রমরমা । এনআরসি র সাপোর্টিং ডাটা,
আর লিগ্যাসি ডাটা প্রিন্টিং এ পাতা প্রতি দশটাকা । যাদের
লিগ্যাসি ডাটা আছে এগারো সংখ্যার তাদের কী আনন্দ । আর যাদের আধাখেঁচড়া এটা আছে ওটা
নেই,
ওদের রাগ ক্ষোভ বিশ্ব সংসারের উপর,
আর সব কিছুর যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে কান্তা । নীরব হাসিতে সে
সবাইকে সমর্থন করে যায় । হাসি
না বিদ্রূপ বুঝা যায় না । ওর হাসি নিয়ে কেউ একজন ক্লিওপেট্রার হাসি বলে মন্তব্য
করেছিল ।
কান্তা
দেখতে মন্দ নয় । সুন্দরের কথা নয়, ব্যক্তিত্বময়ী
মেয়েটি আবার সদাহাস্যময়ী । বাবার উপর যে কপট রাগ দেখায় ওটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ছে
না । সেই
মেয়েটিও একদিন রাগল, রাগ
থেকে কী কী হল সে তো পরের কথা । ঘটনা একটা ঘটেছিল, খদ্দের লক্ষ্মী হয়ে ঢুকেছিল দুপুর
বারোটা নাগাদ, কান্তা
ড্রয়ারের ভিতর টিফিন কৌটোটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল । একগাদা এনআরসি দলিল জেরক্স হবে
এবং লিগ্যাসি ডাটা ছাপা হবে, এনআরসির
সার্কুলারও এককপি । সবকিছু ছেপে বের করে দিতে হবে তক্ষুনি, ভেরি আর্জেন্ট । ছেলেটিকে চেনে কান্তা, বানীপাড়ার ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দা ।
কোথাকার কোন জমিদারের ছেলে । মানে বড়লোক,
বড়লোক দেখলেই কান্তা একটু ইচ্ছে করেই ঝগড়া করে । আসলে সে
খাচ্ছিল না,
টিফিন কৌটোয় হাত রেখেছিল । বলল,
--- দেরি হব, খেয়ে নিই ।
আর
খেলেই বা কী । দু মিনিটেই শেষ হয়ে যায় । শুকনো রুটি দুটো আর পচা ডালের ঝুরা । মা
ফেলে না কিছুই,
গেঁজিয়ে ওঠা ডালকেই কেমন উপাদেয় ঝুরা বানিয়ে দেয় । একদিন কলেজের এক বান্ধবীকে
বলেছিল, মেয়েটি
অম্বিকাপট্টিতে থাকে, মানে
তার থেকে বড়লোক । তার মতো বিত্তহীন থেকে দু এক ধাপ উপরে । বলেছিল ইলিশ মাছের ঝুরার
কথা । বললে,--কী
অসাধারণ স্বাদরে ! মেয়েটি এবং অন্যরা চুপ থেকে হেসেছে । তখন খেয়াল করেনি, পরে বুঝেছে হাসির মর্মার্থ । ইলিশ মাছ
কেউ ঝুরা করে খায় না, পচে
না গেলে কেন আর পেঁয়াজ রসুন দিয়ে ভাজা করে খাবে । তাই সে এখন তার স্তর বুঝে কথা
বলে । ছেলেটি তার কথা বিশ্বাস করে না । বলে,
--- আপনি খাচ্ছেন না ।
--- কী করে বুঝলেন ? খেয়ে দেখবেন ?
ছেলেটি এবার ফিক করে হেসে ফেলে । বলে,
--- খাওয়াবেন ? এত কাজের চাপ যাচ্ছে সকাল থেকে কিছুই
খাই নি ।
কান্তা
খাইয়ে দেয়,
একটা রুটির ভিতর ঢুকিয়ে পচা ডালের ঝুরো । খেয়ে তো উৎফুল্ল ছেলেটি । বলল,
--- আমার নাম অনিকেত গোস্বামী, গ্লাসডোরে আমার একটা বিজ্ঞাপন লাগিয়ে
দেবেন ?
কান্তার
চোখে চশমা নেই কিন্তু চশমার ফাঁক দিয়ে দেখার মতো দেখে ছেলেটিকে। তার থেকে যথেষ্ট
লম্বা, কিন্তু
কী বলতে চাইছে । ছেলেটিও
বুঝতে পারে কথা শেষ না করায় একটু বিভ্রান্তি হয়ে
গেছে । বলে,
--- না না তেমন কিছু না । বিনি পয়সায়
টিউশানি করব, তার
বিজ্ঞাপন ।
কান্তা
হাসমুখ থাকলেও একটু মুখকাটা তো আছে । বলে,
--- কেন ?
রাজনীতি করবেন নাকি ?
ছেলেটি
চুপ করে থাকে । বোকার মতো হাসে । বলে,
--- এম এ পাশ করেছি পল-সাইন্সে । অরুণ
চন্দ্রয় ভর্তি হয়েছি । পড়ব ।
--- স্বনামধন্য উকিল হবে ? নাকি প্রফেসার ?
--- কোনটাই না । তুমি যা বলেছ তাই ।
রাজনীতি করব ।
--- সে তো অনেক পরে ।লেগে থাকতে হবে ।
তোমার বাইক আছে ?
--- আছে । গাড়িও আছে ।
--- উরি বাবা ।
--- না না, গাড়ি চড়া এখন কিছুদিন বন্ধ রাখব ।
--- কেন ?
দাদার চামচাগিরি করবে ?
বাইক বাহিনী ? রাজনীতির
প্রথম কথাই কিন্তু সমাজ বিরোধী হওয়া । ছুরি চাক্কু বন্দুক চালানো, নেতা মন্ত্রী দাদাদের প্রটেকশন দেওয়া ।
--- আমি অন্যরকম । রেডি হয়ে নামব ।
ফিল্ডওয়ার্ক করছি । এই যে বললাম ফ্রিতে ট্যুইশানি করব, পাবলিসিটি হবে । পিআরসি এনআরসি ব্রডগেজ
মহাসড়ক বরাকের কান্না অবহেলিত বরাক নিয়ে কাজ করব । লইয়ার হয়ে লিগ্যাল এইড দেব ।
--- তুমি কী খুব বড়লোক ?
--- তা আছি, মাটিতে এখনও অনেক টাকা ।
--- কোথায় ?
--- মেহেরপুরে । শিবালিক পার্ক পেরিয়ে
বাঁদিকে টিলাজমির এখন খুব দাম । ডাক্তার উকিল সরকারি কর্মচারিরা কিনছে।
যাদের প্রচুর টাকা ঘুষের ,আর
জানিগঞ্জের ব্যবসায়ী রাও কিনছে । যা দাম হাঁকাচ্ছি কিনে নিচ্ছে ।
--- তুমি কী খুব কৃপণ ? এত যখন টাকা,
বাড়িতেই তো জেরক্স লাগিয়ে নিতে পার । কম্প্যুটার নেই, প্রিন্টার ?
--- ল্যাপটপ আছে । তবে দোকানে এসে
জেরক্স করার অন্য ভ্যালু । তোমার সঙ্গে কথা হল, জনসংযোগ হল ।
অনিকেত
গোস্বামীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বেশ পাকা,
সে আসে প্রতিদিন কান্তার সঙ্গে কথা বলতে । কান্তাকে তার খুব
নির্ভরযোগ্য মনে হয় ।
কান্তারও মন্দ লাগে না,
সেও হাসিতে
এক টুকরো মজা জুড়ে দেয়, বোকা
মানুষটি বুঝতেই পারে নি সে কখন ওকে তুমিতে নিয়ে এসেছে । বড়লোকের ছেলে হওয়ার রাগ
উবে যায়, আবার
রাজনীতির ভূত নিয়ে ওর সঙ্গে শলা পরামর্শ করায় খুশিও হয় । বাবাকে দেওয়ার মতো একটা
প্লট তো জমা পড়ল তার ভাণ্ডারে । ও দোকানে এলেই কান্তার খুব খুনসুটি করার ইচ্ছে হয়
। বলে,
--- তোমার নামটায় একটু ভুল আছে ।
--- আছে তো ।
--- অনিকেত মানে যার বাড়ি নেই । গোস্বামী
অর্থ জানো ? গরুর
মালিক । তুমি তো ভূস্বামী ।
--- গরুও আছে । জমি বিক্রি হচ্ছে গরুও
কমছে । স্থান অসংকুলান
হচ্ছে ।
--- এত শক্ত বাংলা ?
--- কিছু বাংলা কিছু সংস্কৃত । আমরা
উত্তর প্রদেশের মানুষ না ?
--- আবার স্টোরি ? হেভি প্লট হবে ।
--- আরে বাবা, কোন প্লট টট না । আমরা এখন
বাঙালি । আমার বাবা উনিশে মের সত্যাগ্রহী ছিল । ফুল বাঙালি । তবে
সবারই একটা পাস্ট থাকে না ?
উত্তরাধিকার । সবাই পাস্ট তৈরি করে । গাছ ছাড়া ফল তৈরি হয় কী করে ? আমাদেরও একটা গাছ আছে, বলব একদিন । এখন বলো, পিআরসি আছে ? এনআরসি ?
ভোট দাও ?
--- আরে ধুর । কিছু নেই । ওসব দিয়ে কী
করব ? বাবা
বলেছে চোরের নেই বাটপাড়ের ভয় ।
--- চাকরি পাবে না । জমি কিনতে পারবে না
। ছেলে মেয়ে স্কুল কলেজে ভর্তি হতে পারবে না ।
--- চাকরি তো করছি কুঞ্জকাকুর । আর ছেলে
মেয়ে হওয়ার জন্য বিয়ের দরকার । এখনও কোন চিহ্ন নেই কোথাও ।
--- এত নিগেটিভ কেন ? সত্যি নেই লিগ্যাসি ডাটা ? সাপোর্টিং ? বলো তো করিয়ে দিই । আছে লাইন ।
--- লাইনে গিয়ে দরকার নেই ।
--- ওরকম লাইন নয় । চৌদ্দটা ওপশন তো আছে
,একটা
না একটা লেগে যাবে । চলো তোমাকে জেরা করি । জেরা করলে বেরিয়ে যাবে ।
--- আমার কিছু বেরোবে না । আমার বাবা
ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি । ঠাকুর্দা ম্যালেরিয়া অফিসের পিওন ছিল ।
--- তাতে কী হয়েছে । আমার এক কাকাও
ড্রাইভার ছিল সরকারি বাসের । আমরা তো ফোকটে জমিদার হয়ে গেলাম । ঠাকুর্দা শিলচর
বাড়ির দখলদারি ছেড়ে দেওয়ায় মেহেরপুরের অনুর্বর টিলা জমি পেয়ে যায় । কেউ কখনও ভাবে
নি মেহেরপুরের জমির দাম এরকম আকাশছোঁয়া হবে । এখনও আছে অনেক, চলো একদিন দেখে আসবে কর্মকাণ্ড ।
অনিকেত
কান্তা বাইকে করে এদিক ওদিক যায় । যায় অন্নপূর্ণাঘাট । অনিকেত শিলচর রেলওয়ে
স্টেশনের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- দেখবে একদিন শিলচর শহরও মহানগর
হয়ে যাবে । বিশাল বিস্তৃত এক জনপদ । মধুরামুখে
সেতু হবে দুধপাতিলে । হাতিছড়া
উধারবন্দ ঢুকে যাবে শহরে । এদিকে শহিদ স্টেশন থেকে কাটাখাল পর্যন্ত লোকেলট্রেন হবে, ওপারে কাটিগড়া, ধোয়ারবন্দ আর একদিকে । মেহেরপুরের
শিবালিক পার্ক থেকে আতালবস্তি হয়ে যাবে ধর্মতলা,
কনটসার্কাস । বাংলাদেশ টেশও থাকবে না, বর্ডার না থাকলে আর কেন এনআরসি পিআরসি
লিগ্যাসি ডাটা ।
--- বুঝলাম সেই বর্ডারহীন দেশ চালাবে
কোন হিটলার ? অনিকেত
জমিদার ?
--- আমি কোন জমিদার টার নই ? আমরা কবিরাজ, রাজবৈদ্য ।
--- ইন্টারেস্টিং তো, তাহলে আমিই একমাত্র জমিদারনি
। আমাদের বাড়িতে একটা তামার টাট আছে জানো । ঠাকুমার ভাঙা ট্রাঙ্কে । বারবার বিক্রি
হতে গিয়েও নাকি থেকে গেছে । এক টাকায় বিক্রি হয়ে যেত । জানিগঞ্জের শ্রীনিবাস কংসবণিক
ঠাকুমাকে আঠআনা এমনি
এমনি দিয়ে দেয় । বলে রেখে দেবেন বাড়িতে,
কাজে লাগবে । এক কাঠি চালের দাম তখন একটাকা ।
--- সত্যি গল্প নাকি ? কী আছে এমন
আশ্চর্য ঐ টাটিতে ?
--- কিছুই না । ওয়েল্ডিং মিস্ত্রির
বাড়িতে কোন গল্প থাকে না ।
--- আবার নিগেটিভ । অভিমান । বল না কী আছে তামার
টাটে ?
--- বাবু দীননাথ লস্করের নাম আছে গাছের
উপর,
নীচের ডালে আরো তিনটে নাম বাকি সব খালি । শিলচরে শুনেছি বাবু দীননাথের
প্রচুর ভূসম্পত্তি ছিল । সব বিলিয়ে দিয়েছে দানবীর । সিলেট
কাছাড়ের ইতিহাসেও আছে এই গল্প । কে জানে বিলিয়ে দিয়েছে না বিনষ্ট করেছে, আয়েস করে খেয়েছে, বাইজি নাচিয়েছে । এতে আমাদের বিড়ম্বনা
তো কমে নি একরতি । মা আর আমি জানি এসব মিথ্যে,
গল্প কথা । টাটের নামগুলি যদি মিথ্যে না হয়ে সত্যি হয় তবে এসব
লস্করকাহিনি বহন করে কী লাভ । হাস্যকর পরিস্থিতি হয় জানো বাবা যখন গর্ব ভরে বলে সে
জমিদারের উত্তরপুরুষ । আমার মাথা লজ্জায় নুয়ে যায়
।
--- লজ্জার কী আছে ? সবারই একটা পাস্ট থাকে । উত্তরাধিকার ।
সবাই অতীত তৈরি করে । আমাদেরও একটা গাছ আছে,
নিয়ে যাব একদিন । কিন্তু তোমরা তো কাটলিছড়ার ধলাইমলাই এর
বাসিন্দা ?
--- সেই তো, তোমারও সংশয় । তবে
এরও জবাব আছে একটা অর্ধযুক্তির । কোনো মুসলমান রায়ত নিঃস্ব জমিদারকে দয়া করে
নিয়ে যায় শিলচর থেকে দূরে ।
--- বেশ তো । জমির দলিল আছে ? ভোটার লিস্ট কাটলিছড়ায় ? ১৯৫১ র ?
--- একান্ন কোথায় পাব ? ৮৯ এ জন্ম ।
--- ৭১ এর ভোটার লিস্ট ?
--- ধুর ।
--- আরে এনআরসির সার্কুলার তো তাই বলে । ৭১ এর ২৪ শে মার্চ
এর মধ্যরাত পর্যন্ত নাম থাকলেই হবে । তোমার কেন হবে,
তোমার ঠার্কুদা বাবা যে কোনো কারো থাকলেই হবে । আচ্ছা চাকরি
করবে একটা ? টেম্পরারি, মাইনে খারাপ নয় । কলসেন্টারের
কাজ ।
--- না না । কুঞ্জকাকু ভালই দেয়, স্থায়ী চাকরি ।
--- এনআরসির কলসেন্টারে কাজ করতে করতে
একটা উপায় বেরিয়ে আসত ।
--- তুমি এতো ভাবছ কেন বলতো ? আমার নাগরিকত্ব নেই তার জন্য অতিরিক্ত
কোন কাঠখড় পোড়াতে পারব না ।
আর তোমার প্রবলেমটা কোথায়, তোমাকে
তো আমি বিয়েও করব না যে স্ত্রীর আলাদা নাগরিকত্ব চাই ।
--- বিয়ে করবে না ?
--- না,
তা বলিনি । তোমাকে করব না বলেছি ।
--- অপরাধ ? আমি ব্রাহ্মণ তুমি কায়স্থ, নাকি
আমি ধনী তুমি গরিব বলে ?
--- গুড । তোমার পর্যবেক্ষণ ভাল । মানুষ
খারাপ নয়, স্ট্রেট
স্বার্থপর । তোমার রাজনীতিটাও আমি বুঝি । লংটার্ম ইনভেস্টম্যান্ট, রিটার্ন পাবে ভাল । মন্ত্রী টন্ত্রী হয়ে
যাবে । তবে এসব প্রেম বিয়ে ভালবাসা তোমাকে
মানায় না ।
--- স্বার্থপর কাকে বলে জানি না । হয়তো
আছি । তবে ডিসঅনেস্ট নই । আমাদের একটা বংশ পরম্পরা আছে । রাজনীতি আমাদের রক্তে ।
মিথ্যে বলিনি, আমার
বাবা উনিশে মের ভাষা আন্দোলনের সত্যাগ্রহী ছিলেন । আমার ঠাকুর্দার বাবা ছিলেন চা
বাগানের শ্রমিক নেতা । তখন দলে দলে শ্রমিক চলে যাচ্ছে বাগান ছেড়ে । চরগোলার নাম
শুনেছ ? ওদেরই
উত্তরপুরুষ আমি, এসব
পরিকল্পিত বিভাজনের বিরুদ্ধতা
করছি উত্তরাধিকারের ধারায়ই,
মানুষে নাগরিকত্ব হরণ করা তো এক নৃশংস খেলা ।
--- পারবে এসব রুখতে ? সম্ভব ?
--- আমি বলছি সম্ভব । পিআরসি এনআরসির
ক্ষতিকর ভিত্তিবর্ষ রোখা সম্ভব । ব্রডগেজ সম্ভব মহাসড়ক সম্ভব হলে আমাদের বিয়েও
সম্ভব ।
এক
একদিন এক একদিক । এবার
বাইক ছুটল মেহেরপুর । শিবালিক পার্ক পেরিয়ে গেল, এসব তো খুব চেনা
জায়গা কান্তার। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার
সময় রোজ দেখেছে । কিন্তু কিছুদূর গিয়ে যে বাঁয়ে ঘুরে গেল, গলিপথ । চেনে না, অনেক ভিতরে যাওয়ার পর কর্মকাণ্ড নজরে এলো। কী বিশাল বিশাল বাড়ি। নাকি রাজপ্রাসাদ
। অনিকেত বলে বলে যাচ্ছে, ডাক্তার
কুসুমদাম, ডাক্তার
শিব তপন সূত্রধর, অনন্ত
সাহা,বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকাদার একজন।মন্ত্রীর
বাড়ি এখন শুরু হয়নি । সবাইকে শিলচর শহর চেনে একডাকে । আরো
ভিতরে,
মানে আরো উপরের দিকে । টিলার উপর একটি ছোট মন্দির,
মন্দির ঘেরা খাটাল । বেশ কয়েকটি গরু, শন বাঁশের অস্থায়ী ঘর কয়েকটি । মন্দিরের
ভিতর দুভাগ, একভাগে
রামলালা আর সীতা আর এক ভাগে রাধাকৃষ্ণ । প্রতিদিন পূজা হয় হয়তো, অন্তত একটা প্রদীপ আর দু এক
পিস ফুল তো তাই বলে । মন্দিরের গায়ে নোনাধরা ফলক দেখায় অনিকেত । ফলকের লেখা থেকে
দীননাথ লস্করের নাম পড়া যায়, সন তারিখও ১২ ই ভাদ্র ১২৭৫ ।
কান্তা অনিকেতকে বলে,
--- কিন্তু মন্দির বিষয়ে কিছু লেখা নেই দেখছি?
--- না নেই, তবে তোমার লিগ্যাসি ডাটা সাপোর্ট করবে
টাটের সঙ্গে ।
অনিকেত
কান্তা ইতিমধ্যে তাদের পাস্ট মানে অতীতের নির্মাণ কাহিনি নিয়ে কথাবার্তা বলেছে ।
হাসি তামাসাও করেছে কান্তা । অনিকেত কিন্তু উত্তেজিত হয়েছে । আর ঐ উত্তেজনা থেকেই তার উপরোক্ত
সংলাপ । নিরুত্তাপ কান্তা বলে,
--- এনআরসি ডাটা জরুরি । তবে কোন
অপমানজনক শর্তে আমি খাতায় নাম লেখাতে চাই না । ভারত রিপাবলিকের নাগরিক আমি,
নাগরিকত্ব আইন মোতাবেক আমার নাম উঠবে খাতায় । আমার ঠাকুরদাদার এই পুকুরে জল খাওয়ার
রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে না বলে জলের উপর আমার অধিকার থাকবে না, এ কেমন কথা ? এসব
ভোটের রাজনীতি, সংখ্যাগুরু
রাজনীতির বর্জ্য পদার্থ, রাজনীতির
সন্ত্রাস ।
--- আমিও তো তাই বলছি । রাজনীতিকে
রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে ।
--- আমি শুধু রাজনীতি বলিনি জমিদার
মহাশয় । রাজনীতির সন্ত্রাস বলেছি ।
তাহলে কী সন্ত্রাস দিয়ে মোকাবিলা করবে ?
তোমাদের রাজনৈতিক দলবল কিছুই করতে পারবে না জানি । এর জন্যই
চাই জাগরণ, দেয়ালে
পিঠ ঠেকার আগেই মানুষ জাগবে । একষট্টির উনিশে মেতে জেগেছিল এই এনআর সির
প্রহসন নিয়েও জাগবে । তামার টাট আর পাথরের ফলক জোড়া দিয়ে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে
হবে না ।
মুখের
আর মনের হাসি যখন একমাত্রায় পৌঁছে যায় তখন বড় অসহায় লাগে কান্তার । দু-দুটো কারণে
দুজনের প্রতিভার অবিচারের দ্বিধা সঙ্গে নিয়ে হাসিকে জটিল থেকে জটিলতর করে সে । ভাবে, অনিকেত যে তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন এর
জন্য তার ভিতরও এক ভালোলাগার
তোলপাড় চলছে কিন্তু ব্যক্ত করতে পারছে না । আর শেখর কাকুকে বলা বাবার গল্প কথা সে
সম্পূর্ণ করতে দেয়নি বলেও তার গর্ব । টাটের গল্প থামিয়ে সে তো তার বাবার
উত্তরাধিকার বহন করেছে কাঁধ বদলে । বাবার প্লট সম্পূর্ণ করার দায় এখন তার একার ।
(টাইপ করেছেন সুব্রতা মজুমদার +Subrata Mazumdar )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন