“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৬ জুন, ২০১৫

সুরমা গাঙর পানি-- ভাটি পর্ব ৬



(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার ষষ্ঠ অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
ছয়

বৈতলের ভয়ডর নেই ।  
জলে নামলে সে মহাবীর ।
লুলা বলেছে সিলেট থেকে দক্ষিণমুখো হাঁটতে হাঁটতে খিত্তা । গ্রামের নাম বেজরঘর । বলেছে,
--- দেখবে বেটা হাকালুকি কেনে কয় । বারিষর সময় মাটি পাইতে না , পানিয়ে পানি, দরিয়া অই যায় । আর মাছ , সিলট কুমিল্লা থাকি আসামর শিলং পর্যন্ত যায় মাছ ।
       দক্ষিণমুখো হলে তো সুরমা দিয়ে যাওয়া যাবে না  নদী থেকে উঠতে হবে ।  সুরমা গেছে পশ্চিম থেকে পূবে । দক্ষিণে তো কুশিয়ারা , পঞ্চখণ্ড , ফেচুগঞ্জ । হাঁটতে হাঁটতে বৈতল পৌঁছে যায় হাকালুকি । মনের টানে বেজরঘরে পেয়েও যায় লুলাকে । বলে,
--- চল ।
      চল বললেই চল । দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়ে অজানার উদ্দেশ্যে । যেখানে রাত সেখানেই কাত ।
     কিন্তু বৈতলের মনের জ্বর কিছুতেই ছাড়ে না । দাড়িয়াপাড়ার ধলা মেয়ে বুড়ির কথা মনে পড়লেই জ্বর বাড়ে । বিকার হয় , লুলাকে মারধর করে । গালাগাল দেয়, বলে, হালার হালা বাঙাল একার দুঃখ বন্ধুকেও দেয় । লুলা হা করে তাকিয়ে দেখে । মার খায় , অকথা শোনে বৈতল লুলাকে সব কথা খুলে বলে । বলে,
--- বিয়া অইব নি বে তাইর । কান ছিড়ি লাইছি ।
--- ছিড়ছছ কেনে । অখন কান্দরে কেনে । তুইন গুনাগার অই গেচছ দোস্ত ।
--- ঠিক আছে, আমি পাপী অইছি অই গেছি  তুই পুণ্যাত্মা অইলেউ চলব । চল কুনুখানো যাই, কিচ্ছু একটা করি ।
--- চল, ক কই যাইতে ।
--- তুই যেখানো কছ । খালি সিলটো যাইতাম নায় ।
--- অয়, পুলিশ আর পেশকারর পুড়ি তরে ধরত করি বই রইছে ।
--- কিন্তু আমার আর ইতা বালা লাগে না ।
--- কিতা বালা লাগে না বে ।
--- ইতা ভাগাভাগি , দৌড়াদৌড়ি । মারে কইছলাম কিচ্ছু একটা করতাম । মায় কইছলা উঝা বানাইবা । কইছলা তর অত বালা গলা , নাচতেও পারছ দেখছি শ্রাবণীর সময় । আমারও খুব হাউশ জানছনি । লেখাপড়া না জানলে ইতা হয় । লেখাপড়া কেমনে শিখতাম ক চাইন ।
---  অখন আর পারতে নায় ।
--- পারমু । তুই শিখাই দিবে । অ আ তো জানি । নাম লেখতাম পারি ।
--- আমিও তো জজ মেজিস্টর । হিন্দু বাড়ি থাকিয়া আমিও ক অক্ষর শিখছি
--- অইব । এতেউ অইব । আমি পুথি গাওয়া শিখতাম ।
        দুই বন্ধুতে কাছাকাছির দক্ষিণভাগে ভাটেরা কুলাউড়া বিয়ানিবাজার অনিপণ্ডিত , জলঢুপ ঢাকাদক্ষিণ দিয়ে শুরু করে তাদের গন্তব্যহীন ভ্রমণ । রাতের পর রাত হাঁটতে থাকে । লাউড় , বানিয়াচঙ , জগন্নাথপুর হয়ে আদমটিলায় এসে লুলা বলে,
--- চল ঘুরি লাইছি সব অখন মাইর কাছে যাই ।
বৈতলের মনটাও মা মা করছিল । বলে,
--- অয় যাইতাম । আগে হুন এক গপ । মার কাছে হুনছি । গণেশ ঠাকুর আর কার্তিক দুই ভাই ।
--- অউ যে হাতির শুড় ।
--- অয় বেটা হুন । মায় কইলা দুই ভাইয়ে যাও তীর্থ ভ্রমণ করি আও । যাও কাশী যাও গয়া , সবখানো যাও । পারলে মক্কা মদিনাও ঘুরি আও । তে কার্তিক তো তোর মতো আড়ুয়া , হে বারই গেল, এক বছর দুই বছর তিন বছর পরে সব ঘুরিয়া উরিয়া আইল । আইয়া দেখে গণেশে তার মার চাইর দিকে চক্কর কাটের । ছোট ভাইরে কইল, তুই গেলে না । গণেশে কইল আমার মাউ আমার সব তীর্থ । তে আমরাও সিলেট ঘুরিয়া ভাবছি সব ঘুরি লাইছিসিলটর অউ সব ঘুরা অইছে নি । তর তো অখনও লক্ষণছিরিও দেখা অইল না ।
--- অইত ইবার গিয়া যাইমু ।
  এত ঘোরাঘুরি করেও বৈতলের মনটা কাঁটা খচখচ করে । মার সামনে কী করে মুখ দেখাবে । মায়ের দুঃখ দুর করতে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে , কিছুই তো পারেনি করতে , এক দরগা মহল্লায় গিয়ে দোয়া চেয়েছে শুধু । আর এক মেয়েকে দুঃখ দিয়েছে । তার আর বাপের সঙ্গে তাহলে অমিল রইল কোথায় । বৈতল ভেবে পায় না এমন শান্তশ্রী মায়ের সন্তান সে কী করে এত নিষ্ঠুর হতে পারে । পণাতীর্থের জল বারবার মাথায় ঢালে বৈতল । কিছুতেই শান্ত হয় না মন । লুলাকে মারে , খুব মারে । লুলা সঙ্গে না থাকলে যে বৈতল শয়তান হয়ে যাবে । লুলা বলে,
 --- চল যাই আবার মইলবাজার । এক আউলিয়া বাবার মাজার  জিয়ারত করি আই । তর মনো শান্তি অইব । বাবার নাম শাহ মুস্তাফা কিন্তু মাইনষে কয় শের সওয়ার চাবুকুমার বাঘর পিঠো চড়িয়া সাপরে চাবুক বানাইয়া খেদাইছন বাঘ আর সাপ দুগুরেউ । তর ও মনর বিজ্‌লা খেদাইবা আউলিয়া বাবায় ।
   বৈতলের কিছুতেই আপত্তি নেই । লুলাকে হিন্দু পরিচয়ে অনেক আখড়ায় মন্দিরে নিয়ে গেছে । লুলা আপত্তি করে নি। বলেছে ,
--- মাইনষর গাত লেখা থাকে না ইন্দু বাঙাল । ইতা মাইনষে বানায় ।
  মসজিদে মাজারেও গেছে দুই বন্ধু । লুলা সাবধান করে দিয়েছে , শিখিয়েছে নিয়মকানুন । বলেছে,
--- দেখিছ , নমাজর সময় পাওর পাতার গাইটর উপরে রাখিছ তফন ।
    সিঁদ কাঁটার হাতে খড়িও হয়েছে দুলালীর বিধু গুপ্তর বাড়ি । হাকালুকির হাওরের এক বিলে পাতা জগৎবেড়ে টান দিয়েও দশ টাকার মাছ চুরি করেছে । পেট চালাতে হবে না , পেটের তান বড় টান । পেট ভরলেই মন হরি হরি বলে, বলে বিষহরি মা জননী । লুলার পেটেও গানের বিদ্যা আছে , তবে বেসুরোষে কবিগানের ঢঙে লুলাকে শোনায় সুরত জামাল ও আধুয়া সুন্দরীর গীতিকা ।
--- ‘দুই দোস্ত গলাগলি জুড়িল ক্রন্দন
অন্তরে জ্বলিল যেন জ্বলন্ত আগুন ।
দুলালে ডাকিয়া আলাল কহিতে লাগিল
সুখেতে বসিয়া ভাই দেওয়ানগিরি কর
আবার যাইব আমি হইয়া ফকির ।’
পাথারকান্দির কাছে আদমটিলার বাগানে ঢুকে বৈতল লুলাকে বলে,
---‘ এবার যাইব আমি হইয়া ফকির ’। আমি পাই লাইছি বন্ধু ।
--- কিতা পাইচছ ।
--- অউ হুন । আমি পাই লাইছি আমার গুরু ।
   পথের ধারে এক পিরের মোকাম । ঘরের ভিতর টিমটিমে এক চেরাগ । আলো আছে কী নেই বোঝা যায় না দেবালয়ের আভাস বোঝা যায় । শোনা যায় এক ভক্তের করুণ সুর , গানের জাদুতে চরাচর মুগ্ধ । স্বল্পবাস এক ফকিরের দিব্যদেহ থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো । যতক্ষণ গান ততক্ষণ জ্যোতি । কাকে শোনায় ফকির গান । কেউ তো নেই আশে পাশে । চা বাগানের উত্তুঙ্গ টিলায় কোথায় আদমের বংশধর । ফকিরের বিলাপে বৈতল বিবশ হয় , 
---‘ ও হোছেন কাইন্দা বলে, মা জননী বলি তোরে
     এট্‌টু পানি দিলা না মোরে...’
সুরের কেরামতি গলায় না থাকলেও লুলা সুর চেনে, গান চেনে । বলে,
---ইতা তো বাঙালর গান বেটা ! মুসলমানি গান । ফকির সাবে জারি গান গাইরা ।
--- গাউকা না গলাখান হুন । আহারে । আমার মার গলার মালসি গান হুনচছ নি । বুক ফাটি যায় । কথা উথা কিচ্ছু নায় , গলা বেটা গলা । তান গলা আমার মার লাখান । আমি তান খাদিম অইয়া থাকি যাইমু ।
    গলা দিয়ে চিঁড়ে ভেজে না । কানা ফকির চেলা করে না । কিন্তু থাকতে দেয় মোকামে । বৈতল শুধু ফকিরের গান শুনতে চায় । ফকির গায়, বৈতলের মন ভরে না । বলে,
--- হউদিন রাইতর মতো গাউকা ।
--- আল্লার মর্জি না অইলে কুনু চউক দিয়া পানি বারয় নিরে বেটা ।
--- আপনার তো গলা দিয়া পানি বার অইছে । হিদিন রাইত মনো অইছে আপনেউ বিশ্ববিধাতা , আপনে কান্দইন আপনে কান্দাইন ।
--- কান্দতে কেনে বেটা । অখন তো হাসতে খেলতে ।
--- আমার একটু কান্দন লাগব ।
--- কেনে , কুনু গুনা করচছ নি ।
--- করছি । 
--- জানি! ছুকরির গাত হাত উঠাইচছ । নানি ।
--- তুমি জানলায় কেমনে । অউ হালার হালায় কইছে ।
--- ফকিরর ইতা জানন লাগে ।
--- বেঙ জান তুমি । ফকির উকির কিচ্ছু নায় তুমি । তুমার গান বালা । আমিও গান গাই । মনসা আইর গান বালা লাগে । পাটনির পুত তো । ই লুলা ইগু বেইমান । তুমারে কই দিছে । তেও তুমারে কইলাম আর পুড়িন্তর গাত আত তুলতাম না । কান ছিরতাম নায় ।
--- তুইন বুলে সাপ ধরছ , সাপর উঝা নি ।
--- আমি নায়, হেহে বেজর পুয়া । সাপ ধরিয়া আমার থলিয়াত রাখছে । কেনে কইলায় আক্‌তা ।
--- আমিও ধরতাম । দাত ভাঙ্গিয়া রাখি দিতাম , মা’নে ডরাইত ।
   মা মনসার পুথিও গাইতাম । অখন ফকির অইয়া ছাড়ি দিছি ।
--- আমারে শিখাই দেও না পুথির গান ।
--- তোবা । আর পারতাম নায় । আল্লা ছাড়া আর কেউ নাই ই দীন দুনিয়াত অখন । এক কতা কইতাম পারি তোরে, তুইন সুজা জা গিয়া কুশিয়ারার হিপারো । ইটা পরগণা । গয়গড় গাউ । হনো পাইলিবে । 

চলবে
< ভাটি পর্ব ৫ পড়ুন                                                   ভাটি পর্ব ৭ পড়ুন

কোন মন্তব্য নেই: