- পার্থঙ্কর চৌধুরী
(লেখাটা বেরিয়েছে দৈনিক যুগশঙ্খের ৫ জুন সংখ্যাতে উত্তর সম্পাদকীয় হিসেবে)
(লেখাটা বেরিয়েছে দৈনিক যুগশঙ্খের ৫ জুন সংখ্যাতে উত্তর সম্পাদকীয় হিসেবে)
এ বারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস যে বার্তা ছড়িয়ে দিতে চায়, তা হল, সবুজ অর্থনীতি – তুমি কি এতে সামিল? (Green Economy: Does it include you?) এই সামিল হওয়া এবং না হওয়ার মধ্যে রয়েছে বিস্তর দৃষ্টি-ভঙ্গির ফারাক, আত্ম-প্রেম বনাম আত্ম-ত্যাগ এর লড়াই, ভোগ-সর্বস্ব বনাম ত্যাগ-সর্বস্ব জীবন, এবং এসবের ভিত্তিতে বিভিন্ন ছোট-বড় গণ্ডি তথা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র-পরিচালনার পন্থা-পধ্বতির তারতম্য ইত্যাদি।
পরিবেশ শুধুমাত্র যে প্রচলিত ধ্যান-ধারনা নিয়েই চিন্তা চর্চায় ব্রত থাকবে, ওমন ভাবনা করাটা বাস্তব-বিমুখতা, বিজ্ঞান সমর্থিতও নয় বটে। ব্যক্তিগত জীবন-লব্ধ প্রজ্ঞা, সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান এর উপর নির্ভর করছে পরিবেশ, তার প্রকৃতি, তার ধর্ম, এবং বহমানতা। পরিবেশের স্বাভাবিক গণ্ডি যেমন প্রদুষন, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, জৈব বৈচিত্র্য ইত্যাদি আর পাঁচটা প্রচলিত বহুল চর্চিত দিক ছাড়াও অনেক অনেক সোপান রয়েছে, রয়েছে সহস্র ধারা। সূক্ষ্ম এবং সুস্থ বিচার বিবেচনায় সমস্ত ধারাস্রোতই সবুজাভ এক বিন্দুতে এসে মিলতে বাধ্য।
উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও পরিবেশ অধ্যয়নের অন্যতম আরেকটা মুল্যবান দিক হচ্ছে, মনন বিশ্ব (বা HUMAN ECOLOGY)।অনেকে আবার এটাকে মানবিক বাস্তুতন্ত্র-ও বলেন। এ বিষয়টাই হচ্ছে গোটা মানব প্রজাতি নিয়ে, এবং অতি অবশ্যই বাস্তু-তন্ত্র এবং পরিবেশ রক্ষায় তাদের ভুমিকা নিয়ে। প্রথাগত পরিবেশ-বিষয় নিয়ে পঠনপাঠন না করেও অনেকেই পরিবেশ-প্রেমি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন, গোটা বিশ্ব জুড়ে এমন ভুরি ভুরি উদাহরন রয়েছে। শিল্পচর্চা করে কেউ পরিবেশবাদী হয়েছেন, কেউ আবার সাহিত্য কিম্বা রসায়ন শাস্ত্র, অর্থনীতি বা দর্শনশাস্ত্র পড়ে পড়ে, আবার কেউ কেউ রাজনীতির আঙ্গিনা থেকেও সরাসরি পরিবেশ কর্মী।
সন্ন্যাসি এবং ভিখিরি-র মধ্যে পার্থক্য কোথায়? একটু ভেবে দেখুন! সর্বত্যাগী সন্ন্যাসির যেমন কিছুই নেই, ভিখিরির-ও তো তাই। কিন্তু তফাত এখানেই যে, নাই নাই করেও যৎকিঞ্চিত ছেঁড়া কাঁথা, ভাঙ্গা হাড়ি-বর্তন যাই আছে, ভিখিরি সেটাকেই আগলে রাখতে চায়, একটুও হাতছাড়া করতে রাজি নয়, আর সন্ন্যাসি ঠিক তার উলটো। (ভণ্ড-সাধুদের বাদ দিয়ে বলছি।) সন্ন্যাস-পূর্ব জীবনের সব সুখ-সাচ্ছন্দ্য, ভোগবিলাস ইত্যাদি এক লহমায় ত্যাগ করে ইনি গেরুয়া রঙ-টাকেই আপন করে নিয়েছেন। আমরা কি সেই অর্থে সবুজ রঙটাকে আপন করতে পারি না ? আগামী প্রজন্মের স্বার্থে খানিকটা ত্যাগের কথা কি সেরকম করে একটু ভাবা যায় না!
সম্প্রতি এলেন এটকিসন (Alan Atkisson)-এর সম্পাদিত একখানা রিপোর্ট-এর পাতা উলটাচ্ছিলাম। অর্থনীতিতে সুপণ্ডিত এই লেখক অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ‘লাইফ বিয়ন্ড গ্রোথ-২০১২’ (Life Beyond Growth-2012) রিপোর্টটিতে বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, যে পরিবেশ, (Environment), প্রাকৃতিক ভারসাম্য (Ecological Balance) এবং এর দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়া (Sustainable benefit) যে একেবারেই দুরুহ ব্যাপার নয়। তবে তার জন্য চাই গোটা বিশ্ব জুড়ে, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধান, তাঁদের কর্মকাণ্ডে, তাঁদের চলন, বলন, মননে ঐ সন্ন্যাসির আত্মত্যাগ।
সবুজ অর্থনীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রাস্ট্রসঙ্ঘ বলেছে, যে এটা এমন এক পন্থা যেখানে মানুষের উন্নয়ন হবে, সামাজিক সমতা বজায় থাকবে এবং যা তুলনামুলক ভাবে পরিবেশের বিপদ এবং দুর্দশা লাঘবের সহায়ক হবে। সেই অর্থে সবুজ-মুখি উন্নয়ন আখেরে দীর্ঘমেয়াদী সুফল দিতে সক্ষম। ‘লাইফ বিয়ন্ড গ্রোথ’ বইটির উপসংহারে বলা হয়েছে,
সবুজ অর্থনীতি+ জাতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য = দীর্ঘমেয়াদী সুফলপ্রদ পৃথিবী, অর্থাৎ,
(Green Economy + National Happiness = Sustainable World)।
এবার একটা কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, ‘গ্রীন-ইকোনমি’ কথাটাকে বাস্তব রূপ দিতে হলে অনেক সুবিধাদি ছেঁটে ফেলার হ্যাপা, ভোগ-বিলাস বিসর্জন,এবং আরও অনেক অনেক কিছু ত্যাগ প্রয়োজন। এ যে গোটা পৃথিবীর বাসিন্দাদের নিজেরা ‘না খেয়ে- না পরে’, বা ‘কম খেয়ে-কম-পড়ে’ আগামী প্রজন্মের জন্য বরাদ্দ রাখার অঙ্গীকার। এ মুহূর্তে তাই যে প্রশ্নটা বিশ্ববাসীর কাছে সবচেয়ে বেশি আত্ম-সন্ধানের সেটা হচ্ছে এই, ‘পারবি না কি যোগ দিতে (আত্মত্যাগের) ওই ছন্দে রে...?’
প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বা পুরোপুরি বন্ধ করে আমাদের জাগতিক ভোগবিলাস, সুখ-সাচ্ছন্দ্য কি সম্ভব? আমাদের কৃষিক্ষেত্র, শক্তির উৎস, নগরায়ন, যানবাহন, নদীবাঁধ এবং এ জাতীয় হাজারো রকমের প্রযুক্তি ‘পৃথিবী’ নামক একমাত্র ‘লিভিং প্ল্যানেট’-টার চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। আর এদের সাথে যোগ হয়েছে হরেক রকমের দৈনন্দিন সৃষ্ট এবং শিল্পজ প্রদুষন! এটা কি ভাবা যায় যে ধরুন আজ থেকে দু-তিনশো বছর আগের শিশুদের (এমন কি মহাপন্ডিত ব্যক্তিদেরও) এই ‘গ্লোবেল ওয়ার্মিং’, ‘ক্লাইম্যাট চেঞ্জ’ জাতীয় শব্দগুলো জানা ছিল না। আবার নিয়মিত পরিবেশ পাঠও তখন স্কুল-কলেজে হত না। তাই বলে, সেদিনের পরিবেশটা কি আজকের মত ম্যার-ব্যরে ছিল?
এটা তো সত্য যে জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্য ভোগের নিরিখে গোটা বিশ্বের দেশ গুলোকে এক পর্যায়ে ফেলা যাবে না। এবং তাই স্বাচ্ছন্দ্য ভোগের মাত্রাটা ছেঁটে বিশ্ব ব্যাপী এক মাত্রায় নিয়ে আসাও অসম্ভব। ধনী দেশগুলকে যদি বলা হয়, বাপু! তোমাদের বিলাসিতা কমাও, শিল্পের অগ্রগতির নামে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরন তলানিতে নিয়ে এসো, গরিব দেশ গুলোকে যদি বলা হয়, ভাই, তোমরা অগ্রগতির পথে হাটো, তবে সবুজ-কে ম্লান করে নয়! স্রেফ তাহলেই কি একটা গড়পড়তা পর্যায়ে এসে দাঁড়ানো যাবে? এ যাবত হয়ে যাওয়া পরিবেশ সংক্রান্ত শীর্ষ সম্মেলন-গুলো তো সেরকম একটা ইঙ্গিত দিতে একেবারেই নারাজ।
সবুজ অর্থনীতির সাথে জাতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য মিলিয়ে পৃথিবীর দীর্ঘমেয়াদী সুফললাভ সম্ভব, এই আপ্তবাক্যটার মধ্যে ভবিষ্যতের উত্তরনের পথ বাতলে দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু, সেটাকে বাস্তবে কার্যকরী করতে কে পরিমান কাঠখড় পোড়াতে হবে, সে উদ্যোগটা কে নেবে? আখেরে ধনি-গরিব নির্বিশেষে দেশগুলোকে অমনভাবে রাজি করানোও টা তো প্রায় অসম্ভব, প্রত্যেকেই এক একটা বিশাল স্তম্ভ।
বেড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধবে? – সেটাই এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন! বিশ্বের পরিবেশবিদ-দের কাছে এটাই বড় চেলেঞ্জ!
তাহলে কি বছর বছর পরিবেশ দিবসে ঐ সবুজ রঙটাকে আপন করার অঙ্গীকার নিছকই লোক দেখানো? সবুজ অর্থনীতিতে নিজেকে সামিল করার তাগিদে এই কুম্ভীরাশ্রু? ভণ্ড-সাধুদেরও তা দেখে যে চক্ষু চড়ক হওয়ার উপক্রম!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন