জীবন তো একটা বহতা নদী। এই চলমান নদীতে ডুব দিয়ে যে যার গাগরী ভরে ঘরে ফেরে। আর এই গাগরী উপুড় করেই বলি আমার কিছু দেবার ছিল। অথচ আমার বলতে ওই গাগরী। আর সবই তো আমার নয়। ওই গাগরীটিই আমার মানব হৃদয়। অন্নদাশংকর রায় এভাবেই ব্যাখ্যা করতে করতে বুঝিয়েছিলেন, যে জল দিয়ে গাগরী ভরিয়েছেন, তা তো নিখিল বিশ্বের জীবন যমুনা। কবির হৃদয়ও ভরে থাকে অম্লমধুর নানা অভিজ্ঞতায়। কবিতায় তো ভালোমন্দ মিশেই থাকে, কেউ আদর করে নেয়, কারুর কাছে অনর্থ। অথচ কবির কাছে কবিতা নিজেকে উলঙ্গ করে দেখার যমুনা-দর্পণ। একটি জীবনের ভিতর দিয়েই তো আমরা অনেকগুলো জন্মন্তর পার হয়ে আসি।
গান শুনতে শুনতে অনেক সময় দূরে চলে যাওয়া যায়, কবিতা মনের ভেতর শুনতে শুনতেও। আবার ফিরে আসা যায় ভালোবাসায়। আমরা বেড়া ভাঙি, আমরা অশোকবনে রাঙা নেশায় রাঙি। মাটির নিচের প্লেট সরে গেলেই বাড়িঘর কাঁপে, রাস্তায় ফাটল ধরে, ধস নামে। চারপাশে বাড়ে আবর্জনার স্তূপ। অথচ রিখটার স্কেলে সব ধরা পড়ে না। অনেক কিছুই থেকে যায় অধরা। অথচ আমরা যখন বুঝতে পারি, কিছুই হারাইনি, তখনই আমাদের স্বস্তি। কবিতা এবং কবির গান আমাদের কিছুই হারাতে দেয় না।
শহরে একসময় একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম, ছিল ছোট রান্নাঘর, আমাকেই রাঁধতে হতো সবার জন্যে, ঠিক আমার রান্নাঘরের জানালার বিপরীতে পোদ্দার বাড়িতে আরেকটি ভাড়াটে পরিবার। ওই পরিবারের প্রমত্ত ছেলেকে সামলে, সমস্ত কাজকর্ম, ঝক্কি ঝামেলার অবকাশে, হঠাৎ হঠাৎই, সময়ে অসময়ে একা একা এক ভদ্রমহিলা আপন মনে গেয়ে উঠতেন রবীন্দ্র সংগীত। গলায় সুর ছিল। কখনও কখনও রান্না করতে করতে চুপি চুপি শুনতাম তাঁর গান। তখন আর একা মনে হতো না নিজেকে, মনে হতো পাশে আছে কেউ, একান্ত আত্মীয়।
কবিতা, সংগীত থেকে সরে গেলে আমরা যাব কোথায় ? দালাল স্ট্রিটে ? সেনসেক্সের হাটে ?
গুয়াহাটিতে ত্রিপুরা ভবনে একা ছিলাম বেশ ক'দিন। সঙ্গী ছিল 'অক্ষর' থেকে প্রকাশিত শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর ' কবিতা সংগ্রহ'। চোখ দেখাতে গুয়াহাটি যাওয়ার ঠিক মাসখানেক আগে বইটি কিনেছিলাম 'বইঘর' থেকে বুকের বাঁদিকের সম্ভবত তীব্র আকর্ষণেই। এক সঙ্গে কবিকে পাঠের অন্তর্তাগিদে। শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর সঙ্গে আমার পরিচয় অতন্দ্র-নান্দীমুখের স্বাদ-গন্ধের দিন থেকেই। 'নান্দীমুখে' ছাপা হয়েছে তাঁর বহু কবিতা। 'এই পথে অন্তরা', 'অনন্ত ভাসানে' আমাকে পাঠিয়ছিলেন শক্তিপদ। শক্তিপদ আমাদের গর্বের কবি, প্রিয় কবি। তাঁর কবিতার বহু পঙক্তি একসময় আমাদের টানতো চুম্বকের মতো। মধ্যরাতে তুমুল বৃষ্টির ভেতরও তাঁর কবিতা পড়েছি। শক্তিপদ ছাড়াও আমাকে বিদ্যুতের মতো কাছে টেনে নেয় রণজিৎ দাশের কবিতা। রণজিৎও তা ভালো করে জানে। যেমন এক সময় দমকা হাওয়ার মতো কাছে টানতো 'শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা'। ভালো লাগতো, 'দেবতার সঙ্গে' এবং সন্দীপনের 'সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী'।
কিন্তু গুয়াহাটিতে একা একা শক্তিপদে ডুবে থাকবো ভেবেও ডুবে থাকতে পারিনি। বারবার সজাগ হয়ে গেছি, শক্তিপদ-র কবিতার যে আশরফি আমাকে এতকাল টানতো, তা কি হারিয়ে ফেলেছি অনিচ্ছায়, অযত্নে ? বেশ কিছু কবিতা বারবার পড়েছি ; পুরোনো, আগে পড়া। না, টানছে না আগের মতো। ঊষাদের বাড়িতে (ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য) একান্ত আলোচনায় জিজ্ঞেস করে ফেলি, কেন এমন হচ্ছ আমার ? আলোচনায় উঠে আসে ক্রমে অনেক প্রসঙ্গ। বোঝা যায়, বড়ো কারণ, সময়ের ব্যবধান।
আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিল না আষাঢ়-শেষের বেলা
উদ্যানে ছিলো বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ ভৈরবী।
ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়েও আমরা শক্তির কবিতাতেই সহসা শুনেছি রাতের কড়ানাড়া। এক সময় শক্তি চট্ট্যোপাধ্যায়ের কবিতাও আমরা চেটেপুটে খেয়েছি রাক্ষুসে ক্ষুধায়, বিষামৃত ভেবে। জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি এই কবির কবিতা সেভাবে ক'জন পড়ছেন বিভোর হয়ে মধ্যরাতে আজ একা একা ঘোরের মধ্যে? আবার এই সময়ের কবি বিকাশ সরকার, যুগশঙ্খ পত্রিকার অফিসে বসে আড্ডা দিতে দিতে যখন বলেন, আনন্দ থেকে প্রকাশিত তার 'বিষাদ বালক' কবিতার বইটি টাকা দিয়ে কিনে আনার জন্য প্রকাশনীতে এক বন্ধুকে পাঠিয়ে এক কপিও পাননি। বিক্রি হয়ে গেছে সব। তখন ভালোই লাগে। বিকাশ এসময় প্রচুর লিখছেন। বিকাশেরও স্বীকারোক্তি, যদি সত্যি প্রথম সংস্করণ শেষ হযে থাকে, কবিদের কাছে সুখবর। তপন বন্দ্যোপাধ্যায় এক সময় 'নান্দীমুখ'-এ অনেক কবিতা লিখেছেন, পরে গদ্য লেখক। হাইলাকান্দিতে বেশ কয়েক বছর আগে দেখা, শক্তিপদও ছিলেন। জানতে চেয়েছিলাম, কবিতা লেখা তিনি কেন ছেড়ে দিয়েছেন ? তাঁর স্পষ্ট উত্তর, কবিতা এখন কেউ পড়ে না। কবিতার পাঠক কমে গেছে। আমার পাল্টা প্রশ্ন ছিল, 'গদ্য কি পাঠকরা বেশি পড়ছেন আজকাল ?' -'হ্যাঁ, কবিতার চেয়ে গদ্যের পাঠক বেশি' তপন উবাচ।
আমরা কি হারিয়ে ফেলেছি আমাদের কবিতা-যৌবনের বেহিসাবি দিনগুলো ? কবিতা পাঠের নিবিড় আড্ডা, আসরও কমে গেছে আজকাল। কোথায় সেই 'কবিতা দৈনিক', 'কবিতা ঘন্টিকী' ? 'কবিতা ভবন' থেকে তো আমরা অনেক দূর চলে এসেছি অনেকেই। লাইব্রেরি থেকে কবিতার বই কম তুলছেন পাঠকরা অনেক বছর ধরেই। প্রকাশকদেরও অভিমত, কম বিক্রি হয় কবিতার বই ! গল্প, উপন্যাস কি প্রকাশকের লক্ষ্মী ? আসলে শেকড়েই গোলমাল, বড় গন্ডগোল গ্যাংটকে। বড়ো কঠিন সময়। একদিকে তথাকথিত ভোট রাজনীতির অতি সক্রিয় উৎপাত, অন্যদিকে কর্পোরেট উচ্ছ্বাস, লক্ষ্মীর জন্য সাধনার পড়া। থাকা-খাওয়া-বিত্তবৈভবে বেঁচে থাকার অহর্নিশ নাম সংকীর্তনের কোলাহলে চারপাশটাই কেমন হয়ে উঠেছে ঘোলাটে, কুৎসিত, অপরিচ্ছন্ন, ভাবলেশহীন, অমনযোগী। সবাই যেন সেয়ানা পাগল। স্কুল, কলেজ, য়ুনিভার্সিটিতে সাহিত্য পাঠের আগের সেই সোনালি দিন আর নেই। মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহ হারিয়েই রোজদিন চোখের সামনে ফতুর হয়ে পড়ছে একটা অদ্ভুত সময়। ভাবখানা হল- প্রয়োজনের বই চাই, যা কাজে লাগে পরিপাটি বৈষয়িক জীবনে, এর বেশি কিছু নয়। অথচ অপ্রয়োজনের শ্রেষ্ঠ তালিকাতেই তো উঠে আসে কবিতার নাম। এতো হিসেবি পড়াশোনায়, কাজের পড়ার জন্য বইয়ের ভিড়ে বড়ো একা হয়ে যায় কবিতাই। লক্ষ্মী আর সরস্বতীর বিবাদ সম্ভবত শুরু এখান থেকেই। ভূপেন হাজারিকা, শচীন কর্তা, সলিল চৌধুরীর গান তো এখনও আমাদের কাছে মন কেড়ে নেওয়া মৌলিক।
আবার দারুণ খুশি খুশি লাগে যখন শুনি জনপ্রিয় কবি হীরেন ভট্টাচার্য্যের 'সুগন্ধি পখিলা' কবিতার বইয়ের চোদ্দোটি সংস্করণ নিঃশেষিত। সময়ের চেয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত এগিয়ে রাখার সাহিত্য তো কবিতাই। কবিদেরই তো বেশি করে আলোচনা করা উচিৎ কবিদের নিয়ে। ভালোই তো লাগে পড়তে জয় গোস্বামীর বই 'জয়ের শক্তি', 'নিজের রবীন্দ্রনাথ', 'জয়ের শঙ্খ' এবং 'নিজের জীবনানন্দ'। বুদ্ধ দেব তো 'কবিতা' কাগজে আমাদের সে কথা শিখিয়ে গিয়েছেন অনেকদিন আগেই। একেকটা সময় আসে আবার একেকটা সময় চলে যায় আলো হাওয়া রোদ্দুরে। সব ভাষাতেই থাকে কবিতার শত্রুমিত্র। থাকে আবার ভালোবাসার লোকও। হয়তো অপেক্ষা করতে হবে সুসময়ের জন্য। একথাও তো সমান সত্যি, প্রচুর কবিতা লেখা হচ্ছে বাংলা ভাষায়, যা ছুঁয়ে আছে আন্তর্জাতিক ভূগোল। সব লেখা রোদ পায় না, ছায়ায় হারিয়ে যায়। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে এ সময়ের বাবা-মায়েদের মধ্যে ক'জন বলতে পারবেন, তাদের ছেলেমেয়ে কবি হয়ে উঠুক তারা চান ! ফ্রানৎস কাফকাও তাঁর ডায়েরিতে লিখাছেন অভিমানে, 'কেউ চায় না আমি লেখক হই।' কাফকার সংগ্রাম ছিল তার একনায়ক ঘোর ব্যবসায়ী বাবার সঙ্গে। মাকে বলেছিলেন, 'কেউ আমায় ভালোবাসে না।'
এই সময়ে ভালোবাসা কোথায় কবিদের প্রতি ! অথচ কবিরাই একমাত্র ভালোবাসেন স্বপ্ন দেখতে এবং স্বপ্ন দেখাতে। মাঝেমধ্যে তারাই আবার যেন আটকা পড়ে যান অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে। মনে হতেই পারে এই সময়টা কবিতার বিপ্রতীপ, আবার মনে হতে পারে কবিতারই বহ্নিবকুল। ভালো লেখা হলে পাঠক সাড়া দেবেই। দেশে কল-কারখানা, ইন্টারনেট এবং বাণিজ্যভিত্তিক বিনোদনের ছড়াছড়ি। ফলে, হয়তোবা কবিতার প্রতি পাঠকের রাগানুরাগ স্পষ্টত ক্রমক্ষীয়মান আজ। এখনও কবিতার বেশির ভাগ দীক্ষিত পাঠকই ষাট ও সত্তর দশকের, যাদের চুল উঠে কপাল বড় হয়ে গিয়েছে অনেককাল আগেই। কবিতা তো রূপে ভোলায় না, ভালোবাসায় ভোলায়। 'আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না, ভালোবাসায় ভোলাবো।' যেমন চলনবিল দিয়ে পদ্মায় বোটে শিলাইদহ থেকে পতিসরের পথে যেতে যেতে একটি কবিতা এসেছিল রবীন্দ্রনাথের মনে। বয়স তখন তার সাঁইত্রিশ। কবিতার নাম ‘মানস প্রতিমা’,
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শূন্য গগন-বিহারী।
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা।
একশো চোদ্দো বছর আগের সেই দেখা, পুরোনো হয়ে যায়নি এখনও। ট্রামে, বাসে, ট্রেনে, কাজকর্মে, নিদ্রায় জাগরণে, ঘন ঘোর সংঘর্ষময় জীবনে কবিতা কিন্তু এভাবেই চলতে ফিরতে উঁকি দেয় আমাদের মনের দাওয়ায়। সুভাষ মুখ্যোপাধ্যায় তো মানুষের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতেই কবিতার লাইন খুঁজে পেতেন, ঘরে ফিরে টুঁকে রাখতেন ডায়রিতে। আমাদের পাঠকদের কাছে টেনে নিতে হয়তো এখন অনেক পর্দা সরাতে হবে। সরাতে হয়। কবিতা ছাড়া মুক্তি নেই। আবার মানুষ কবিতার কাছেই নিজেরা ফিরে আসবে, কবিতার আগুনেই সেঁকে নেবে মুক্তির আনন্দ। সংগীত ও চিত্রের জন্য, আয়নায় নিজের মুখ দেখার জন্য, ভালোবাসার জল ঝড়ের জন্য, নির্লোভ সততার জন্য কবিতার বিশ্বই তো মহাবিশ্ব। মানসিক সাযুজ্যের মানচিত্র এখানে অনেকদূর প্রসারিত। কবিতায় নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়ে কবিতার অন্তর্নিহিত শক্তিকেই বড় করে দেয়। আসল কথা হল, ভালো লেখা, ভালো লাগা। ভালো না লাগলে তো সবই ভূষি; অপক্ক, অখাদ্য। বিচারের মানদন্ড তো লোকপ্রিয়তা নয়। কবিতার পাঠক তো প্রকৃত অর্থে কবিরাই। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গেই তো মিল তাঁর চিত্রকলার। কবি এবং পাঠকের মধ্যে একটা কমিউনিকেশন গড়ে তোলা জরুরি। যাকে আগে বলা হতো ‘সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদ’। জীবনের সঙ্গে যোগ হয়ে থাকাই কিন্তু আসল কাজ এই ব্যস্ত জীবনে। শঙ্খ ঘোষের ‘ বোঝা’ কবিতায় পড়ি:
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন