আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে গত ৮ জুন ২০০৪ সালে ‘শুক্রের সূর্য অতিক্রমণ’ ঘটনার তোলা ছবি ।সূর্যপৃষ্ঠে শুক্র গ্রহকে কালো মটর দানার মত দেখা যাচ্ছে ।
‘লাইভ শো’ দেখতে যারা ভালবাসেন তাঁদের জন্য এক জব্বর খবর । ‘আই পি এলের’ দীর্ঘ নাটকীয় লাইভ ক্রিকেট ম্যাচগুলো দেখে যারা ‘বোর’ হচ্ছিলেন, তাদেরকে এক আলাদা স্বাদ দেবার জন্য আগামী ৬ জুন দু’জন ‘কলাকার’ তৈরি হচ্ছেন । প্রায় তিন ঘণ্টার এই শোয়ে থাকবে এক আলাদা আনন্দ, মজা আর শিহরণ । সকাল সাতটা থেকে শুরু হওয়া এই ‘শো’ দেখার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষেরা উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছেন । সেদিনই ঘটতে চলেছে এমন এক মহাজাগতিক ঘটনা যা আবার দেখতে হলে আমাদের আরও ১০৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে । ‘ট্রেন্সিট অব ভেনাস’ নামক অনুষ্ঠানে সূর্য আর শুক্রের দ্বৈত অভিনয়কে ক্যামেরা-বন্দী করবেন পৃথিবী স্বয়ং । আসলে সেদিনই এক অভিনব সূর্য গ্রহণ ঘটতে চলেছে যার নেপথ্যে রয়েছেন নায়িকা শুক্র গ্রহ বা ‘ভেনাস প্ল্যানেট’ । সূর্যের সঙ্গে শুক্রের ‘টুইস্ট ডান্স’ নিয়ে আসর আপাতত গরম । আর এই লাইভ শো-এর ‘টি আর পি’ও তাই এখন তুঙ্গে ।
সৌরজগতের নানা চমকপ্রদ ঘটনার মধ্যে ‘ট্রেন্সিট অব ভেনাস’ হল এক অতি বিরল ঘটনা । সূর্য আর পৃথিবীর মধ্যে রয়েছে শুক্র আর বুধ গ্রহ । কখনো কখনো এই গ্রহ দু’টি সূর্য আর পৃথিবীর মধ্যে এক সরলরেখার চলে আসে । আর তখন দৃশ্যমান হয় গ্রহণ । সাধারণত: সূর্যগ্রহণ বলতে আমরা পৃথিবী আর চন্দ্র উপগ্রহের ‘রাউন্ড ডান্স’-এর কথাই জানি । পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় চন্দ্র পুরো সূর্যকেই ঢেকে ফেলে । তখন সূর্য ভোজবাজীর মতই কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবীর আকাশ থেকে ‘গায়েব’ হয়ে যায় । গ্রহণ হতে হলে সূর্যের কৌণিক ব্যাসার্ধের সঙ্গে চন্দ্রের কৌণিক ব্যাসার্ধ মিলতেই হবে, আর হতে হবে অমাবস্যা । আর বলয়গ্রাসের সময় চন্দ্রের কৌণিক ব্যাসার্ধ সূর্য থেকে কিঞ্চিৎ ছোট হয় । তাই সূর্যকে একটি রিং এর মত দেখায় । আর এই মজার ঘটনা সম্ভব হওয়ার পেছনে চন্দ্র আর পৃথিবীর স্বল্প দূরত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে । কিন্তু বুধ আর শুক্র গ্রহের দূরত্ব পৃথিবী থেকে বেশী হওয়ার কারণে বুধ বা শুক্র গ্রহ পুরো সূর্যকে ঢাকতে পারেনা । পৃথিবী থেকে এই বিশেষ সূর্য গ্রহণের সময় শুক্র গ্রহকে তখন একটি কালো মটর দানার মত সূর্যের পৃষ্টে দেখা যায় । এই গ্রহ সূর্যের বলয়ের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যেতে সময় লেগে যায় কয়েক ঘণ্টা । মজার ব্যাপার হল জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ‘ট্রেন্সিট’ সময় গণনা করে পৃথিবী আর সূর্যের দূরত্ব নির্ণয় করতে পারেন ।
১৬৩১ সালে জোহানেস কেপলার প্রথম গণনার সাহায্যে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেন যে ৬ ডিসেম্বর ১৬৩১ সালে ‘ট্রেন্সিট অব ভেনাস’ হবে । সেদিন ‘ট্রেন্সিট অব ভেনাস’ ইউরোপে দৃশ্যমান না হওয়ায় তিনি সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকলেন । জেরেমিয়া হরোকস নামে এক ইংরেজ পুরোহিত প্রথম বোঝতে পারেন যে এই ঘটনা দ্বিতীয়বার ‘রিপিট’ হবে খুব কম সময়ের ব্যবধানে । তিনি অঙ্ক কষে দেখেন যে ২৪ নভেম্বর ১৬৩৯ সালে এটি আবার দৃশ্যমান হবে । বিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনিই প্রথম এই ঘটনা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ করেন । আসলে ‘ট্রেন্সিট অব ভেনাস’ জোড়া ঘটনা হিসেবে হয়ে থাকে । এর মানে এই ঘটনা একবার হলে দ্বিতীয়টি খুব কম সময়ের মধ্যে ‘রিপিট’ হয় । যেমন ১৮৯৫ আর ১৯০৫ সালে ‘ট্রেন্সিট অব ভেনাস’ ঘটেছিল । এই ঘটনা গত ৮ জুন ২০০৪ সালে পৃথিবী থেকে শেষ দেখা গিয়েছিল । ৬ জুন ২০১২ এর পর আবার এই ঘটনা দৃশ্যমান হবে ২১১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে । এর মানে পাক্কা ১০৫ বছর পর !
এই ঘটনা দেখতে হলে একটু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে । খালি চোখে সূর্যকে দেখতে গেলেই অন্ধ হবার চান্স থাকে । সাধারণত: ওয়েল্ডিং এর কালো গ্লাস বা এক্স রে প্লেট কে দুই বা তিন পরতে জোড়া দিয়ে ফিল্টার বানাতে হবে যা সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে রক্ষা করবে । জলে প্রতিফলিত সূর্যের প্রতিবিম্বকেও যেন সরাসরি কেউ না দেখেন । দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে প্রজেকশন স্ক্রিনের মাধ্যমে সূর্যের প্রজেক্টেড ইমেজ দেখা যেতে পারে । আর এটাই সব থেকে নিরাপদ ।
সকাল ঠিক সাতটার সময় এই ঘটনা শিলচরে দৃশ্যমান হবে । ততক্ষণে শুক্র গ্রহ সূর্যের প্রায় মধ্যখানে চলে আসবে । সকাল প্রায় ১০:০৫ এ সূর্যের বলয় থেকে শুক্রগ্রহ বের হওয়া শুরু হবে । তারপর সকাল প্রায় ১০:২১ এ শুক্র পুরোপুরি বেরিয়ে পড়বে সূর্যের বলয় ছেড়ে আর শেষ হয়ে যাবে লাইভ শো ।
গরমের কষ্টে নাজেহাল আম আদমিরা অন্তত: সেদিন আশা করবেন না যে বৃষ্টি হোক । আসলে এই ঋতুতে বৃষ্টির সঙ্গে যে আমাদের এক আলাদা রোমান্সের সৃষ্টি হয় । আসুন না গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ স্বল্প ক্ষণের জন্য ভুলে আমরা এক মহাজাগতিক ঘটনার সাক্ষী হই !
* সম্পর্কিত সংযোগঃ Transit of Venus
* সম্পর্কিত সংযোগঃ Transit of Venus
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন