“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

ভুমিপুত্র হও

স্বপন সেনগুপ্ত






















দৃশ্যত শান্ত আমি, নেই অভিমান
ভিতর অঙ্গারে লাল, অহর্নিশ
আকাঙ্খার কিছু চোরাটান--
যেন কাঁটাগাছে লেগে থাকা ক'ফোঁটা
শীতের শিশির।
ক্ষোভ কিঞ্চিৎ আছে, ভুমিপুত্র আমি,
এখানেই বিদ্যাভ্যাস,
প্রেম ও প্রণয়ে অধীর।

ভি এম-এ জন্ম নিয়েছে আমার সন্তান,
তাকেও বলেছি, ভুমিপুত্র হও--
চেনো মাটি, শস্যদানা, ধান।
কোন ভ্রুক্ষেপ নেই; অজ্ঞান- দুপুর নিয়ে
ওর ঘোরাফেরা,
চুল ফেলে যখন তখন সে
হয়ে যায় ন্যাড়া।

চারদিকে মানুষের ঈর্ষা, ক্রোধ কাতরতা পড়ি--
কোনও ভাষা বুঝি, কোনও ভাষা
জ্যোৎস্নাহীন থেমে থাকা ঘড়ি।
যমজ পাহাড় ভেঙে শুধু এই চলা--
কখনও খাদে নামে
কখনও সপ্তমর ওঠে গলা।

বাঁশ পাতা, লালমাটি এখনও অমিয়
গোদক আমারও প্রিয়,
প্রিয় শুকনো মাছ--
কবি ছুঁলে আঁশ লাগে, লোকে বলে
কবি ছুঁলে সাড়ে সর্বনাশ।

                          (c) Picture:ছবি

উদ্ভিজ রেণু

                                     / স্বপন সেনগুপ্ত
















দাঁড়াতে দাঁড়াতে এখন শিখে গেছি উদ্ভিদ সংগীত
সূর্যকে ভাগ করে খাওয়া।

আমার কোনও জুম্মাবার নেই, সব বারই জুম্মাবার।
কুচুটে মেঘ দেখলে মাথা নত করি
আলো ফুটলেই আরশিনগরের গল্প।
এখন ঝুরি নামছে থরথর।
অপলক, থির হয়ে এসেছে চোখ
চামরের লেজ নাড়াতে নাড়াতে আর
বৃষ্টি নামাতে পরি না।
টের পাই, মাটির গভীরে ফুট কাটে
শেকড়ের ছন্দ ও সঙ্গীত।

ঘারে ককুদ নিয়ে খর্রোদে কারা হাঁটছে,
কারা উলোখাগড়া, গন্ধবনিক, কারা চর্যাপদ
থেকে ধার করে এনেছে দাহ্য-ছায়া,
গুহ্য রেণু। দাঁড়াতে দাঁড়াতে এখন শিখে গেছি
উদ্ভিদ স্বভাব, বীজ রেখে যাওয়া।
অনেক বীজ মাটিতে পা-রাখলে অরণ্য--
অনেক বীজ মাথা কুটে কঠিন পাষাণে।

মায়ের তলপেটের দাগমাটির শরীরে
কতো সংকেত চিহ্ন--
একেকটা সোকসংগীত থেকেই জেগে ওঠে উদ্ভিজ রেণু।

                                           (c) Picture: ছবি

বিরল রন্ধনে

                                                         / স্বপন সেনগুপ্ত



















বাঁশ থেকে বাঁশি হয়। বাঁশিতে মানব সুর লাগে--
বাঁশি বেনু হয়ে বাজে।
ফুল থেকে রেণু হয়, রেণু থাকে ফুলের পরাগে।
চোখ তার খোঁজে ঘর
ঘর সে-তো পুষ্পগুহা--
গর্ভকেশর।

কিছু রেণু ঘর চেনে
কিছু রেণু ছিন্নমূল--
বড় করে মৃতের জঠর।

এই ছিল চিত্রভাষা--
মাতৃধারা বিনয়ী সরল। মানুষের সরলতা সিসা-বিষে
পুড়েছে প্রবল।

চারদিকে পোড়ামুখ
বিষে নীল চরিত্র হননে।
এবার ফেরার পালা। এবার ফেরার সুরে
মানুষের ইস্তাহারে--
বাজে বাঁশি রাত্রি জুড়ে গর্ভদেশে অসম্ভব ঘুমে।

খেয়েছি ধাতুর বীজ--
ধাতুচূর্ণ বিরল রন্ধনে।

                                                          (c) Picture: ছবি

এ আমার ভিখিরি হাত নয়

                                                                                       / স্বপন সেনগুপ্ত

















আমার ভিখিরি হাত নয় যা দেবে করুণায়
তাই হাত পেতে নেবো,
পোষা বেড়াল ছানার মতো ছুঁয়ে আদর করতেই
ঘর্ঘর শব্দ হবে কিংবা
উৎসবের আলো দেখলেই বাঁশি কিনতে যাবো।

চোখের নিচে এখন সমুদ্র উতরোল
বয়েসে বয়েসে বুঝি মানুষ বদলায়
খোলস খোলার আগেই সমস্ত শরীর গলে
ফোঁটা ফোঁটা রক্তে আবার ভেসে ওঠে মুখ
পুরোনো কবিতার খাতা সব ছিঁড়ে ফিঁড়ে যায়
দু'পকেট খালি করে বাড়ি ফিরে আসি।

যারা দাঁড়াতে শেখে হাত রেখে ঠুনকো জঠরে
হাতের মুঠো থেকে চলমান সমুদ্র হারায়,
লুম্বিনী পার্ক থেকে ফিরে আসে অসুস্থ আকাশ।

                               (C) Picture:ছবি

স্বগতোক্তি

                                                                                       স্বপন সেনগুপ্ত

তোমার নাভির কাছাকাছি আমার প্রতিটি ঢিল
গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়তো
তুমি হাসতে হাসতে
হাসতে হাসতে একেক সময়
অদৃশ্য হয়ে যেতে।

এই কিস্তিবন্দি নিরুত্তাপ খেলা
ক্লাইভের শহরে কেউ ভালোবাসলো না,
ভাগচাষির মতো আমার নালজমি
দেনার দায়ে বিকিয়ে গেল
ঘর গেল
গোয়ালের শান্তি লুঠে নিল।

তোমার দু:খ হয়েছিল
আমারও দু:খ হয়েছিল
জানি, কুরুশকাঠি দিয়ে অনেকদিন
তুমি এই দু:খকে ধরে রাখতে চেয়েছিলে।
ছবিতে আমিও দেখেছি--
হারবার সিলের বাচ্চার দুধ খাওয়া।

বড়ো অদ্ভুত মনে হয় করতল--
জ্যোৎস্নাহীন, শ্রাবণের দু:খহীন
এ যেন ডাকঘরের সীলমোহরের ক্ষত,
যতো তাকে জলে রাখি ধুয়ে মুছে যাক
ততো যেন জ্বলে ওঠে--
আত্মপ্রকাশের এতো বিড়ম্বনা ?

নিপুণ খলিফা ছাড়া এতো জল
এতো আলো হাওয়ায় ক্ষয়ে যাওয়া
রূপবান মানবিক প্রাণীর শরীর
ঢেকে দিতে আর কারা পারে ?

হাঁটছি, হাঁটছি, অনন্ত সময়ব্যাপী হেঁটে
চলেছি; অজস্র পায়ের ছাপ রেখেও দেখেছি
এ মাটির বড়ো নাকটান--
দাগ মুছে ফেলে
চিহ্ন মুছে ফেলে
মুছে ফেলে শরীরের রক্ত ও ঘাম।

বহুদিন তোমার সঙ্গে দেখা নেই
তুমি কেমন আছ কিছুই জানি না।
জানি না, কোন তানপুরায় তোমার
আর্দ্র আঙুল কাঁপছে,
কোন বৃক্ষবীজের ছায়া দেখবে বলে
গুঁড়ি মেরে বসে আছো !

তোমার নাভির কাছাকাছি আমার প্রতিটি ঢিল
গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়তো
তুমি হাসতে হাসতে
হাসতে হাসতে একেক সময়
অদৃশ্য হয়ে যেতে।

                                          (C) Picture : ছবি

মঙ্গলবার, ২৬ জুন, ২০১২

কবিতার রাত কবিতার দিন

                                                                                       লিখেছেন: স্বপন সেনগুপ্ত            

                              জীবন তো একটা বহতা নদী। এই চলমান নদীতে ডুব দিয়ে যে যার গাগরী ভরে ঘরে ফেরে। আর এই গাগরী উপুড় করেই বলি আমার কিছু দেবার ছিল। অথচ আমার বলতে ওই গাগরী। আর সবই তো আমার নয়। ওই গাগরীটিই আমার মানব হৃদয়। অন্নদাশংকর রায় এভাবেই ব্যাখ্যা করতে করতে বুঝিয়েছিলেন, যে জল দিয়ে গাগরী ভরিয়েছেন, তা তো নিখিল বিশ্বের জীবন যমুনা। কবির হৃদয়ও ভরে থাকে অম্লমধুর নানা অভিজ্ঞতায়। কবিতায় তো ভালোমন্দ মিশেই থাকে, কেউ আদর করে নেয়, কারুর কাছে অনর্থ। অথচ কবির কাছে কবিতা নিজেকে উলঙ্গ করে দেখার যমুনা-দর্পণ। একটি জীবনের ভিতর দিয়েই তো আমরা অনেকগুলো জন্মন্তর পার হয়ে আসি। 

           গান শুনতে শুনতে অনেক সময় দূরে চলে যাওয়া যায়, কবিতা মনের ভেতর শুনতে শুনতেও। আবার ফিরে আসা যায় ভালোবাসায়। আমরা বেড়া ভাঙি, আমরা অশোকবনে রাঙা নেশায় রাঙি। মাটির নিচের প্লেট সরে গেলেই বাড়িঘর কাঁপে, রাস্তায় ফাটল ধরে, ধস নামে। চারপাশে বাড়ে আবর্জনার স্তূপ। অথচ রিখটার স্কেলে সব ধরা পড়ে না। অনেক কিছুই থেকে যায় অধরা। অথচ আমরা যখন বুঝতে পারি, কিছুই হারাইনি, তখনই আমাদের স্বস্তি। কবিতা এবং কবির গান আমাদের কিছুই হারাতে দেয় না। 

                        শহরে একসময় একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম, ছিল ছোট রান্নাঘর, আমাকেই রাঁধতে হতো সবার জন্যে, ঠিক আমার রান্নাঘরের জানালার বিপরীতে পোদ্দার বাড়িতে আরেকটি ভাড়াটে পরিবার। ওই পরিবারের প্রমত্ত ছেলেকে সামলে, সমস্ত কাজকর্ম, ঝক্কি ঝামেলার অবকাশে, হঠাৎ হঠাৎই, সময়ে অসময়ে একা একা এক ভদ্রমহিলা আপন মনে গেয়ে উঠতেন রবীন্দ্র সংগীত। গলায় সুর ছিল। কখনও কখনও রান্না করতে করতে চুপি চুপি শুনতাম তাঁর গান। তখন আর একা মনে হতো না নিজেকে, মনে হতো পাশে আছে কেউ, একান্ত আত্মীয়। 

            কবিতা, সংগীত থেকে সরে গেলে আমরা যাব কোথায় ? দালাল স্ট্রিটে ? সেনসেক্সের হাটে ? 

      গুয়াহাটিতে ত্রিপুরা ভবনে একা ছিলাম বেশ ক'দিন। সঙ্গী ছিল 'অক্ষর' থেকে প্রকাশিত শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর ' কবিতা সংগ্রহ'। চোখ দেখাতে গুয়াহাটি যাওয়ার ঠিক মাসখানেক আগে বইটি কিনেছিলাম 'বইঘর' থেকে বুকের বাঁদিকের সম্ভবত তীব্র আকর্ষণেই। এক সঙ্গে কবিকে পাঠের অন্তর্তাগিদে। শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর সঙ্গে আমার পরিচয় অতন্দ্র-নান্দীমুখের স্বাদ-গন্ধের দিন থেকেই। 'নান্দীমুখে' ছাপা হয়েছে তাঁর বহু কবিতা। 'এই পথে অন্তরা', 'অনন্ত ভাসানে' আমাকে পাঠিয়ছিলেন শক্তিপদ। শক্তিপদ আমাদের গর্বের কবি, প্রিয় কবি। তাঁর কবিতার বহু পঙক্তি একসময় আমাদের টানতো চুম্বকের মতো। মধ্যরাতে তুমুল বৃষ্টির ভেতরও তাঁর কবিতা পড়েছি। শক্তিপদ ছাড়াও আমাকে বিদ্যুতের মতো কাছে টেনে নেয় রণজিৎ দাশের কবিতা। রণজিৎও তা ভালো করে জানে। যেমন এক সময় দমকা হাওয়ার মতো কাছে টানতো 'শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা'। ভালো লাগতো, 'দেবতার সঙ্গে' এবং সন্দীপনের 'সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী'। 

             কিন্তু গুয়াহাটিতে একা একা শক্তিপদে ডুবে থাকবো ভেবেও ডুবে থাকতে পারিনি। বারবার সজাগ হয়ে গেছি, শক্তিপদ-র কবিতার যে আশরফি আমাকে এতকাল টানতো, তা কি হারিয়ে ফেলেছি অনিচ্ছায়, অযত্নে ? বেশ কিছু কবিতা বারবার পড়েছি ; পুরোনো, আগে পড়া। না, টানছে না আগের মতো। ঊষাদের বাড়িতে (ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য) একান্ত আলোচনায় জিজ্ঞেস করে ফেলি, কেন এমন হচ্ছ আমার ? আলোচনায় উঠে আসে ক্রমে অনেক প্রসঙ্গ। বোঝা যায়, বড়ো কারণ, সময়ের ব্যবধান। 

আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি 

এমন ছিল না আষাঢ়-শেষের বেলা 

উদ্যানে ছিলো বরষা-পীড়িত ফুল 

আনন্দ ভৈরবী। 

        ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়েও আমরা শক্তির কবিতাতেই সহসা শুনেছি রাতের কড়ানাড়া। এক সময় শক্তি চট্ট্যোপাধ্যায়ের কবিতাও আমরা চেটেপুটে খেয়েছি রাক্ষুসে ক্ষুধায়, বিষামৃত ভেবে। জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি এই কবির কবিতা সেভাবে ক'জন পড়ছেন বিভোর হয়ে মধ্যরাতে আজ একা একা ঘোরের মধ্যে? আবার এই সময়ের কবি বিকাশ সরকার, যুগশঙ্খ পত্রিকার অফিসে বসে আড্ডা দিতে দিতে যখন বলেন, আনন্দ থেকে প্রকাশিত তার 'বিষাদ বালক' কবিতার বইটি টাকা দিয়ে কিনে আনার জন্য প্রকাশনীতে এক বন্ধুকে পাঠিয়ে এক কপিও পাননি। বিক্রি হয়ে গেছে সব। তখন ভালোই লাগে। বিকাশ এসময় প্রচুর লিখছেন। বিকাশেরও স্বীকারোক্তি, যদি সত্যি প্রথম সংস্করণ শেষ হযে থাকে, কবিদের কাছে সুখবর। তপন বন্দ্যোপাধ্যায় এক সময় 'নান্দীমুখ'-এ অনেক কবিতা লিখেছেন, পরে গদ্য লেখক। হাইলাকান্দিতে বেশ কয়েক বছর আগে দেখা, শক্তিপদও ছিলেন। জানতে চেয়েছিলাম, কবিতা লেখা তিনি কেন ছেড়ে দিয়েছেন ? তাঁর স্পষ্ট উত্তর, কবিতা এখন কেউ পড়ে না। কবিতার পাঠক কমে গেছে। আমার পাল্টা প্রশ্ন ছিল, 'গদ্য কি পাঠকরা বেশি পড়ছেন আজকাল ?' -'হ্যাঁ, কবিতার চেয়ে গদ্যের পাঠক বেশি' তপন উবাচ। 

                  আমরা কি হারিয়ে ফেলেছি আমাদের কবিতা-যৌবনের বেহিসাবি দিনগুলো ? কবিতা পাঠের নিবিড় আড্ডা, আসরও কমে গেছে আজকাল। কোথায় সেই 'কবিতা দৈনিক', 'কবিতা ঘন্টিকী' ? 'কবিতা ভবন' থেকে তো আমরা অনেক দূর চলে এসেছি অনেকেই। লাইব্রেরি থেকে কবিতার বই কম তুলছেন পাঠকরা অনেক বছর ধরেই। প্রকাশকদেরও অভিমত, কম বিক্রি হয় কবিতার বই ! গল্প, উপন্যাস কি প্রকাশকের লক্ষ্মী ? আসলে শেকড়েই গোলমাল, বড় গন্ডগোল গ্যাংটকে। বড়ো কঠিন সময়। একদিকে তথাকথিত ভোট রাজনীতির অতি সক্রিয় উৎপাত, অন্যদিকে কর্পোরেট উচ্ছ্বাস, লক্ষ্মীর জন্য সাধনার পড়া। থাকা-খাওয়া-বিত্তবৈভবে বেঁচে থাকার অহর্নিশ নাম সংকীর্তনের কোলাহলে চারপাশটাই কেমন হয়ে উঠেছে ঘোলাটে, কুৎসিত, অপরিচ্ছন্ন, ভাবলেশহীন, অমনযোগী। সবাই যেন সেয়ানা পাগল। স্কুল, কলেজ, য়ুনিভার্সিটিতে সাহিত্য পাঠের আগের সেই সোনালি দিন আর নেই। মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহ হারিয়েই রোজদিন চোখের সামনে ফতুর হয়ে পড়ছে একটা অদ্ভুত সময়। ভাবখানা হল- প্রয়োজনের বই চাই, যা কাজে লাগে পরিপাটি বৈষয়িক জীবনে, এর বেশি কিছু নয়। অথচ অপ্রয়োজনের শ্রেষ্ঠ তালিকাতেই তো উঠে আসে কবিতার নাম। এতো হিসেবি পড়াশোনায়, কাজের পড়ার জন্য বইয়ের ভিড়ে বড়ো একা হয়ে যায় কবিতাই। লক্ষ্মী আর সরস্বতীর বিবাদ সম্ভবত শুরু এখান থেকেই। ভূপেন হাজারিকা, শচীন কর্তা, সলিল চৌধুরীর গান তো এখনও আমাদের কাছে মন কেড়ে নেওয়া মৌলিক। 

                      আবার দারুণ খুশি খুশি লাগে যখন শুনি জনপ্রিয় কবি হীরেন ভট্টাচার্য্যের 'সুগন্ধি পখিলা' কবিতার বইয়ের চোদ্দোটি সংস্করণ নিঃশেষিত। সময়ের চেয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত এগিয়ে রাখার সাহিত্য তো কবিতাই। কবিদেরই তো বেশি করে আলোচনা করা উচিৎ কবিদের নিয়ে। ভালোই তো লাগে পড়তে জয় গোস্বামীর বই 'জয়ের শক্তি', 'নিজের রবীন্দ্রনাথ', 'জয়ের শঙ্খ' এবং 'নিজের জীবনানন্দ'। বুদ্ধ দেব তো 'কবিতা' কাগজে আমাদের সে কথা শিখিয়ে গিয়েছেন অনেকদিন আগেই। একেকটা সময় আসে আবার একেকটা সময় চলে যায় আলো হাওয়া রোদ্দুরে। সব ভাষাতেই থাকে কবিতার শত্রুমিত্র। থাকে আবার ভালোবাসার লোকও। হয়তো অপেক্ষা করতে হবে সুসময়ের জন্য। একথাও তো সমান সত্যি, প্রচুর কবিতা লেখা হচ্ছে বাংলা ভাষায়, যা ছুঁয়ে আছে আন্তর্জাতিক ভূগোল। সব লেখা রোদ পায় না, ছায়ায় হারিয়ে যায়। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে এ সময়ের বাবা-মায়েদের মধ্যে ক'জন বলতে পারবেন, তাদের ছেলেমেয়ে কবি হয়ে উঠুক তারা চান ! ফ্রানৎস কাফকাও তাঁর ডায়েরিতে লিখাছেন অভিমানে, 'কেউ চায় না আমি লেখক হই।' কাফকার সংগ্রাম ছিল তার একনায়ক ঘোর ব্যবসায়ী বাবার সঙ্গে। মাকে বলেছিলেন, 'কেউ আমায় ভালোবাসে না।' 

          এই সময়ে ভালোবাসা কোথায় কবিদের প্রতি ! অথচ কবিরাই একমাত্র ভালোবাসেন স্বপ্ন দেখতে এবং স্বপ্ন দেখাতে। মাঝেমধ্যে তারাই আবার যেন আটকা পড়ে যান অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে। মনে হতেই পারে এই সময়টা কবিতার বিপ্রতীপ, আবার মনে হতে পারে কবিতারই বহ্নিবকুল। ভালো লেখা হলে পাঠক সাড়া দেবেই। দেশে কল-কারখানা, ইন্টারনেট এবং বাণিজ্যভিত্তিক বিনোদনের ছড়াছড়ি। ফলে, হয়তোবা কবিতার প্রতি পাঠকের রাগানুরাগ স্পষ্টত ক্রমক্ষীয়মান আজ। এখনও কবিতার বেশির ভাগ দীক্ষিত পাঠকই ষাট ও সত্তর দশকের, যাদের চুল উঠে কপাল বড় হয়ে গিয়েছে অনেককাল আগেই। কবিতা তো রূপে ভোলায় না, ভালোবাসায় ভোলায়। 'আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না, ভালোবাসায় ভোলাবো।' যেমন চলনবিল দিয়ে পদ্মায় বোটে শিলাইদহ থেকে পতিসরের পথে যেতে যেতে একটি কবিতা এসেছিল রবীন্দ্রনাথের মনে। বয়স তখন তার সাঁইত্রিশ। কবিতার নাম ‘মানস প্রতিমা’, 

তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা, 

মম শূন্য গগন-বিহারী। 

আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা। 

                  একশো চোদ্দো বছর আগের সেই দেখা, পুরোনো হয়ে যায়নি এখনও। ট্রামে, বাসে, ট্রেনে, কাজকর্মে, নিদ্রায় জাগরণে, ঘন ঘোর সংঘর্ষময় জীবনে কবিতা কিন্তু এভাবেই চলতে ফিরতে উঁকি দেয় আমাদের মনের দাওয়ায়। সুভাষ মুখ্যোপাধ্যায় তো মানুষের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতেই কবিতার লাইন খুঁজে পেতেন, ঘরে ফিরে টুঁকে রাখতেন ডায়রিতে। আমাদের পাঠকদের কাছে টেনে নিতে হয়তো এখন অনেক পর্দা সরাতে হবে। সরাতে হয়। কবিতা ছাড়া মুক্তি নেই। আবার মানুষ কবিতার কাছেই নিজেরা ফিরে আসবে, কবিতার আগুনেই সেঁকে নেবে মুক্তির আনন্দ। সংগীত ও চিত্রের জন্য, আয়নায় নিজের মুখ দেখার জন্য, ভালোবাসার জল ঝড়ের জন্য, নির্লোভ সততার জন্য কবিতার বিশ্বই তো মহাবিশ্ব। মানসিক সাযুজ্যের মানচিত্র এখানে অনেকদূর প্রসারিত। কবিতায় নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়ে কবিতার অন্তর্নিহিত শক্তিকেই বড় করে দেয়। আসল কথা হল, ভালো লেখা, ভালো লাগা। ভালো না লাগলে তো সবই ভূষি; অপক্ক, অখাদ্য। বিচারের মানদন্ড তো লোকপ্রিয়তা নয়। কবিতার পাঠক তো প্রকৃত অর্থে কবিরাই। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গেই তো মিল তাঁর চিত্রকলার। কবি এবং পাঠকের মধ্যে একটা কমিউনিকেশন গড়ে তোলা জরুরি। যাকে আগে বলা হতো ‘সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদ’। জীবনের সঙ্গে যোগ হয়ে থাকাই কিন্তু আসল কাজ এই ব্যস্ত জীবনে। শঙ্খ ঘোষের ‘ বোঝা’ কবিতায় পড়ি:

 

হঠাৎ কখনো যদি বোকা হয়ে যায় কেউ, সে তো নিজে আর 

বুঝতে পারে না সেটা। যদি বুঝতই তা হলে তো বুঝদারই 

বলা যেত তাকে। তাই যদি, তবে 

তুমিও যে বোকা নও কীভাবে তা বুঝলে বলো তো ?

 

 

রবিবার, ২৪ জুন, ২০১২

সাংস্কৃতিক বন্ধন রচনায় নগাঁও বাঙালি সম্মিলনী

              (নগাঁও বাঙালি সম্মিলনী, আয়োজিত 'ষষ্ঠবিংশতিতম উত্তর পূর্বাঞ্চল রাজ্যভিত্তিক বার্ষিক সাংস্কৃতিক উৎসব, ২০১২' তে বিচারক হয়ে এসছিলেন প্রখ্যাত লেখক শৈলেন সাহা । পড়াশুনা কলকাতায় সেরে  দিল্লিতে প্রায় ৩৭ বছর ধরে বাস করছেন । সাহিত্য সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়েই এখনকার জীবন । উত্তর পূর্বাঞ্চলের সঙ্গেও বেশ যোগাযোগ  রয়েছে । নাটক এবং আবৃত্তির বিচারক হিসেবে এবং সাহিত্য সম্মেলনের আহ্বানে ভারত ও বাংলাদেশে যাতায়াত আছে । দেশে বিদেশে বহু পত্র পত্রিকার সাথে সম্পর্কিত । লেখার বিষয় বস্তু বিচিত্র -- কবিতা , গল্প , আলেখ্য , নাটক, প্রবন্ধ , আলোচনা , সাময়িক প্রসঙ্গ ইত্যাদি -- যখন যা ভালো লাগে ।  বহু মঞ্চ সফল  অনুষ্ঠান তাঁর রচনা ,পরিচালনা ও পরিবেশনায় দর্শক উপভোগ করেছেন ।  নগাঁও সফরের অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন গুয়াহাটির সংবাদ লহরি কাগজে ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১২তে । সেটিই সংগ্রহ করে আপনাদের জন্যে তুলে দিলাম। শ্রী সাহাকে লেখাটা দেবার জন্যে ধন্যবাদ। )
                জানুয়ারী মাসটা এলেই নতুন বছরের আমন্ত্রনে প্রকৃতিতে যে অসাধারণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তার প্রভাব আমাদের মনে ও পারিপার্শ্বিকতায় ধরা পড়ে । আকাশের রোদে তখন মিষ্টি হিমেল আমেজ । প্রত্যেক ঘরে ঘরে পরমান্ন আর পিঠের আয়োজন । আমাদের মনের মধ্যে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব জেগে ওঠে । বিহু, পোঙ্গল, পৌষ-পার্বণ আমাদের জীবনে নিয়ে আসে আনন্দের বন্যা । আমরা ছোট বড় সকলে মেতে উঠি বিভিন্ন রকম আনন্দ উৎসবে ।  মাঝে কিছুটা অদল বদল হলেও এখন আবার জানুয়ারী মাসে ফিরে এসেছে ছুটির মাসের আমেজ । পুরণো বছরের শেষে পুরণো ক্লাসের পড়া শেষ করে পরীক্ষা দিয়ে নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বইয়ের নতুন পাতার গন্ধ শিশুদের মনেও নিয়ে আসে নতুন উদ্দীপনা । বাতাসে উড়ে বেড়ায় ছুটির গন্ধ । সবাই আমরা গেয়ে উঠি – “পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে , আয়রে চলে, আয় আয় আয় । ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে , মরি হায় হায় হায় ” । 

                    সত্যিই তো, এমন আনন্দ সকলের সাথে ভাগ করে নিতে নানা ধরণের আনুষ্ঠানিক আয়োজন আমাদের পুলকিত করে । সেই মেজাজটিকে আরও সফল করে তুলতে প্রতি বছর আসামের “নগাঁও বাঙালি সম্মিলনী” দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে নিয়মিত আয়োজন করে চলেছেন তাঁদের বার্ষিক সাংস্কৃতিক উৎসব এই জানুয়ারীতে । সেখানে চার থেকে চুরানব্বই সকলেই জমায়েৎ হন আনন্দের অংশীদার হতে । আমারও সৌভাগ্য হয়েছে তাঁদের আমন্ত্রণে সুদূর দিল্লি থেকে ছুটে গিয়ে সেই আনন্দে সামিল হবার । ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এই রকম  অনেক আয়োজনে  আমি দেখেছি নানা ধরণের ত্রুটি বিচ্যুতি , যা বড় ধরণের আয়োজনে অনেক সময়েই এড়ানো যায় না , বরং বলা ভাল সেটা যেন চাঁদের কলঙ্ক সৌষ্ঠব । কিন্তু অবাক হয়ে দেখেছি এঁদের সামগ্রীক কর্মকুশলতা । আয়োজকদের ওপর মহল থেকে নিচের মহল পর্যন্ত সবাইকে যেন একটি মালার ফুল বলে মনে হয়েছে । সবাইকে নিয়েই একটি মালা গেঁথেছেন তাঁরা । কোথায় শুরু কোথায় শেষ , কে বলে দেবে !  কার আগে কে,  কাকে বাদ দিয়ে কাকে দেখবো । সমস্ত কর্মযজ্ঞে সবাই যেন রাজ পুরোহিত । প্রত্যেকে নিজের দায়িত্বটুকুই শুধু নয় , অন্য কারও সামান্য খামতিটুকুও ঢেকে দিচ্ছেন নিজস্ব আন্তরিকতায় । আমন্ত্রিতদের তত্ত্বাবধান  থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের সামান্য টুকিটাকি পর্যন্ত নজরে রেখেছেন সকলেই । দায়িত্ব পালনের ভাগাভাগি পুর্বনির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও চোখ খোলা রেখেছেন প্রত্যেকে । আমার নিজের অভিজ্ঞতায় এ এক বিরল দৃষ্টান্ত । এমনটা সম্ভব হয়েছে বলেই বোধ হয় এই  “নগাঁও বাঙালি সম্মিলনী” ১৮৯৪ সাল (বাং – ১৩০১) থেকে শুরু করে আজও আসামের এই প্রান্তিক অঞ্চলে ১১৮ বছর ধরে সসম্মানে  নিজেদের গর্ব অক্ষুন্ন রেখেছেন । প্রতিবেশি অঞ্চলের সকল ভাষাভাষি মানুষেরাই কিন্তু এই উৎসবে সামিল হন সমান আগ্রহে । রাজনৈতিক সকল সমস্যাকে দূরে সড়িয়ে রেখে এখানকার মানুষ মিলিত হন এই উত্তর পূর্বাঞ্চল রাজ্যভিত্তিক সাংস্কৃতিক উৎসবে ।  আমার মনে হয় বাংলা সংস্কৃতির এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য ।  
              এ বছর ২০১২ সালের ৬ই জানুয়ারী থেকে ১০ই জানুয়ারী পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সেই উৎসব । এই আয়োজনে ছিল নানা ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন রকম প্রতিযোগিতা, যা সকল বয়সের মানুষদেরই আকর্ষণ করে ।  এ বছর বিশেষভাবে পালিত হল স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম সার্ধশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান । সেই উপলক্ষে বার্ষিক সাহিত্য পত্র “অনুরণন”-এর চতুর্থ বার্ষিকী সংকলনটি প্রকাশিত হল স্বামীজিকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে । যিনি যেভাবে চিনেছেন স্বামীজিকে তাই দিয়ে নানাবিধ নিবন্ধ রচনা করে সযত্নে সাজানো হয়েছে সংগ্রহে রাখার মত এই বিশেষ সংখ্যাটি । অনুষ্ঠান শুরুর প্রথম দিনের সন্ধ্যায় এই পত্রিকাটির শুভ উন্মোচন করেন বিশিষ্ট অসমিয়া কবি ডাঃ প্রয়াগ শইকিয়া মহোদয় । এদিন সকালে সম্মিলনীর সভাপতি শ্রী কিশোরকান্তি বসু মহাশয় উৎসব প্রাঙ্গনে পতাকা উত্তোলন করে পাঁচদিনব্যাপী এই মহোৎসব ও মিলন মেলার উদ্বোধন করেন এবং  রাজ্যসভার মাননীয় সাংসদ শ্রীমতি নাজনীন মহোদয়া মঞ্চে রাখা পিলসুজের ওপর প্রদীপ প্রজ্ঞ্বলন করে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেন । সকালের অনুষ্ঠান শুরু হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মকর্তাদের এবং ভারতীয় স্টেট ব্যাংক, নগাঁও শাখার মুখ্য প্রবন্ধক শ্রী দিলীপ সরকার ও আঞ্চলিক প্রবন্ধক শ্রী জি কে সরকার মহোদয়কে সংবর্ধনা জানানোর মধ্য দিয়ে । এই উৎসবের সবচেয়ে বড় সাফল্য হল, এখানে সকল মানুষ সব রকম রাজনৈতিক মতবাদ এবং জাতি-ধর্ম-ভাষা নিরপেক্ষে কেবল মাত্র সাংস্কৃতিক আকর্ষনে এই মিলন মেলায় সামিল হন ।  
                        যে সমস্ত প্রতিযগিতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন এখানে রাখা হয়েছিল সেগুলি হল – রবীন্দ্র সঙ্গীত, রবীন্দ্র নৃত্য, নজরুল গীতি, নজরুল নৃত্য, সমবেত সৃষ্টিশীল নৃত্য, বাংলা কবিতার আবৃত্তি, সমবেত সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কন, আলপনা, কুইজ, তবলা লহরা, বহুরূপী, শব্দজাল,  স-র-গ-ম সুরের আকাশে । এ বছরের বিশেষ আয়োজন ছিল – লোকগীতি ও স্বগীয় ভূপেন হাজারিকার বাংলা গানের প্রতিযোগিতার । এ ছাড়াও  স্বল্প দৈর্ঘের নাট্য প্রতিযোগিতা প্রতি বছরের মত এবারেও যথেষ্ট উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল । এই সাংস্কৃতিক মঞ্চে এ বছরের আলোচনার বিষয় ছিল “ স্বামী বিবেকানন্দ ” । তা ছাড়াও বিভিন্ন সঙ্গীত ও  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভরা ছিল এই পাঁচদিনের মহা মিলন উৎসব ।                                   
                                                        

              এই উৎসবকে খুব সার্থক ভাবেই “উত্তর পূর্বাঞ্চল রাজ্যভিত্তিক সাংস্কৃতিক উৎসব” বলে অভিহিত করা যায় , কেননা এর টানে সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে মিলিত হন এই আনন্দমেলায় । এঁরা আসেন ত্রিপুরার বিলোনিয়া, খোয়াই ও ধর্মনগর থেকে, ডিমাপুর সহ নাগাল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, মেঘালয়ের শিলং এবং অসমের শিলচর, করিমগঞ্জ, লামডিং, ডিব্রুগড়, তিনসুকিয়া, জোরহাট, মরিয়নী, পয়লাপুল, গোলাঘাট, সরুপাথার, বড়পাথার, ডিফু, বঙ্গাইগাঁও, রাঙাপাড়া, বরপেটা রোড ,  ধুবরী, যমুনামুখ, ঢেকিয়াজুলী, লঙ্কা, রূপহী, তেজপুর, গুয়াহাটি, হোজাই, মরিগাঁও, নগাঁও ইত্যাদি জায়গা থেকে । শুধু অংশগ্রহণকারীরাই নয় , বিচারকরাও আসেন  বিভিন্ন জায়গা থেকে । নানা প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে এঁরা স্থানীয় কৃতিদের সঙ্গে বহিরাগতদেরও আহ্বান জানান বিচারের স্বচ্ছতার প্রয়োজনে ।  এ বছরের বিভিন্ন বিভাগের বিচারকমন্ডলীতে ছিলেন -  রবীন্দ্র সঙ্গীতে - চন্দ্রিকা চৌধুরী ও রিন্টু রবার্ট ডিকস্টা (গুয়াহাটি) এবং স্বপ্না সরকার (ঢেকিয়াজুলী) ; নজরুল গীতি ও স্বগীয় ভূপেন হাজারিকার বাংলা গানের বিভাগটিতে  – মির্জা নিয়ামুদ্দীন (ডিব্রুগড়), মন্দিরা সাহা (রাঙাপাড়া) ও চন্দ্রিকা চৌধুরী (গুয়াহাটি) ;  নৃত্য বিভাগগুলিতে – দেবযানী ঘোষ (কোচবিহার), নুরী রায়চৌধুরী (ডিমাপুর) ও নাসিমা অঞ্জুম (রাঙাপাড়া) ;  বাংলা কবিতার  আবৃত্তিতে -  তুষারকান্তি সাহা ও গৌতম ভট্টাচার্য (গুয়াহাটি) এবং শৈলেন সাহা (নতুন দিল্লি) ; সমবেত সঙ্গীত বিভাগে – শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার (বর্ধমান), চন্দ্রিকা চৌধুরী ও মৈত্রেয়ী দাস ভৌমিক(গুয়াহাটি) ; লোকগীতি বিভাগে -  শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার (বর্ধমান), মৈত্রেয়ী দাস ভৌমিক(গুয়াহাটি) ও স্বপ্না নিয়োগী (গৌরীপুর) ; চিত্রাঙ্কনে – কিরণশঙ্কর রায় (গুয়াহাটি), অমিতাভ দাশগুপ্ত ও সুজিত দাস (নগাঁও) ; আলপনা ও শিশুদের জন্য বহুরূপী প্রতিযোগিতায় - অমিতাভ দাশগুপ্ত , সুজিত দাস , শুভাশিস দাস ও ভারতী নাহা (নগাঁও) ; তবলা লহরায় – সেবাব্রত সিন্‌হা (গুয়াহাটি), অনিমেষ চৌধুরী (ডিমাপুর) ও গোকুল সাহা (রাঙাপাড়া) ; শব্দজাল বিভাগে – শুভেন্দু দাশগুপ্ত ও রিংকু দাস (নগাঁও) ; কুইজ পরিচালনা করেন – স্থানীয় জনপ্রিয় কুইজ মাস্টার দীপক দাস (দীপন) এবং তাঁকে সহযোগিতা করেন দেবজ্যোতি সরকার, প্রীতম দত্ত ও সন্দীপন সেন ; ভবানন্দ ব্যানার্জীর স্মৃতিতে উৎসর্গিকৃত “স-র-গ-ম সুরের আকাশে ” গানের প্রতিযোগিতায় - শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার (বর্ধমান), মৈত্রেয়ী দাস ভৌমিক(গুয়াহাটি) ও পংকজ নাথ (শিলচর); নাট্যাভিনেতা পাঁচুগোপাল সেনগুপ্তের স্মৃতিতে উৎসর্গিকৃত স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটক প্রতিযোগিতায় – মূকাভিনেতা রণেন চক্রবর্তী (কলকাতা), গৌতম ভট্টাচার্য (গুয়াহাটি) এবং শৈলেন সাহা (নতুন দিল্লি) ।
                       বিচারকদের এই দীর্ঘ তালিকার পাশাপাশি পুরস্কার প্রাপকদের তালিকাও খুব স্বাভাবিক ভাবেই দীর্ঘতর হবে , তবুও আমি এই কৃতিদের  নিজেদের নাম ছাপার অক্ষরে দেখার তৃপ্তিতে আগামিতে এঁরা আরো উৎসাহ নিয়ে  শিল্প সাধনা করবেন যাতে এই অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষ পেতে পারে আরও আরও ভূপেন হাজারিকা কিংবা প্রমথেশ বড়ুয়ার মত শিল্পী । তাই আজকের এই উৎসাহটুকু আমাদের দিতেই হবে । সুতরাং যাঁরা বিভিন্ন বিভাগে আজ পুরস্কৃত হয়েছেন তাঁদের নামগুলি আমি এখানে তুলে ধরছি । রবীন্দ্র সঙ্গীতে – “ক” বিভাগে ১ম – শুভসুন্দর দে (নগাঁও) ও বৈশালী দে (সরুপাথার), ২য় – শব্‌নম্‌ মেঘালী (নগাঁও) ও ৩য় – চৈতালী দে (ঢেকিয়াজুলী) । “খ” বিভাগে – ১ম ,২য় ও ৩য় যথাক্রমে ময়ুরাক্ষী পাল , দেবব্রত ঘোষ (নগাঁও) ও আশিস বণিক (ডিমাপুর) ।  নজরুল গীতির “শিশু” বিভাগে - ১ম ,২য় ও ৩য় যথাক্রমে পারমিতা রায় (নগাঁও), অর্ণব দাশ (সরুপাথার) ও কুনালজিৎ দত্ত (নগাঁও) ; “ক” বিভাগে  ১ম – সমর্পিতা দে (ডিমাপুর) ও শুভসুন্দর দে (নগাঁও) , ২য় – শ্রেয়া সেন (সরুপাথার), ৩য় – আবরার আলম (নগাঁও) ; “খ” বিভাগে ১ম , ২য় ও ৩য় যথাক্রমে – আশিস বণিক (ডিমাপুর), দেবব্রত ঘোষ ও কুমার দত্ত  (নগাঁও) ; রবীন্দ্র নৃত্য বিভাগে - ১ম ,২য় ও ৩য় যথাক্রমে – ভাস্বতী দাস (জোরহাট), শোভাংগী সরকার (নগাঁও) ও  স্বীকৃতি সাহা (বরপেটা রোড)  এবং দুটি সান্ত্বনা পুরস্কার পায় ত্রিনয়নী দেবনাথ ও বিদ্যাশ্রী পাল চৌধুরী (নগাঁও) ; নজরুল নৃত্য বিভাগে  - ১ম ও ২য়- ভাবনা বাঢ়ৈ ও রুণু ভট্টাচার্য (নগাঁও) এবং ৩য় – ঋষভ পোদ্দার (ডিমাপুর); সমবেত সৃষ্টিশীল নৃত্যে – ১ম – নৃত্যাঙ্গনা ( মরিয়ণী), ২য় -নৃত্যাঞ্জলী অকাদেমি ( লামডিং) এবং ৩য় – নূপুর কত্থক নৃত্য অকাদেমি (নগাঁও) ; বাংলা কবিতার আবৃত্তির শিশু বিভাগে – ১ম,২য় ও ৩য় স্থানে  নিশিকা পাল, ত্রিনয়ণী দেবনাথ, ও রেহান নবী (নগাঁও) ; ক-বিভাগে ১ম,২য় ও ৩য় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে নবনীতা সরকার, রিম্পল সাহা ও সপ্তপর্ণা দাস (নগাঁও) ; খ ( বড়দের) – বিভাগে ১ম – রাজেশ শর্মা ( বঙ্গাইগাঁও) এবং ২য় ও ৩য় স্থানে রয়েছেন – মণিপাল গাঙ্গুলী ও পান্না পাল দাস (নগাঁও) ; সমবেত সঙ্গীতে ১ম স্থানে - ঐকতান (নগাঁও) , ২য় স্থানে দুটি দল – কলা ক্ষেত্র (নগাঁও) ও শব্দ মিউজিক্যাল ব্যান্ড (জোরহাট) এবং ৩য় স্থানে – ছোটদের আনন্দধারা (নগাঁও) ; চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় শিশু বিভাগে – ১ম, ২য় ও ৩য় স্থানে – রোজি দত্ত, গৌরব চক্রবর্তী ও অংশুমান বিশ্বাস (নগাঁও) ; ক – বিভাগে যথাক্রমে মৃদুস্মিতা শর্মা, নীলাঞ্জনা দাস ও সুস্মিতা রায় (নগাঁও) ; খ-বিভাগে – ১ম, ২য় ও ৩য় স্থানে প্রবাল নাথ , স্নিগ্ধা দাস ও তানিয়া দেবনাথ ; আলপনা প্রতিযোগিতায় – ১ম, ২য় ও ৩য় হন – কংকনা দেব, সন্ধ্যা পাল ও পান্না পাল দাস (নগাঁও) ; কুইজ প্রতিযোগিতায় জুটিবদ্ধ ভাবে ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান পেয়েছেন যথাক্রমে – ট্রিবিউঞ্জ্যোতি শর্মা ও প্রীতম সেন , অমিয় কুমার বরুয়া ও নয়নজ্যোতি বরা এবং  তপন বৈদ্য ও দেবাশিস ভূঞাঁ ; তবলা লহরাতে শিশু বিভাগে ১ম,২য় ও ৩য় স্থানে যথাক্রমে প্রণবেশ দে ও বৈশালী দাস ( হোজাই) এবং সোহাগমণি শইকীয়া (নগাঁও) ;  ক-বিভাগে ১ম, ২য় ও ৩য় হয়েছে দেবাশিস নাথ (নগাঁও), দেবাশিস চক্রবর্তী (যমুনামুখ) ও শুভায়ন কুন্ডু (রূপহী)  ।
                          

                   শিশুদের বহুরূপী সাজবার প্রতিযোগিতায় ১ম – সুস্মিতা রায় , ২য় – অঙ্কিতা পাল ও মেঘা পাল এবং ৩য় হয়েছে – শ্রেয়া শর্মা (সবাই নগাঁও থেকেই) ; শব্দজাল  প্রতিযোগিতায় নগাঁও-এর বয়োজ্যেষ্ঠরাই পুরস্কৃত হন – ১ম – ঊষারাণী সরকার , ২য় – নিমাই চন্দ্র বিশ্বাস এবং  ৩য় হন প্রবীর রায় ; লোকসঙ্গীত বিভাগে ১ম , ২য় ও ৩য় স্থান অধিকার করেছেন যথাক্রমে আশিস বণিক (ডিমাপুর)  , পারমিতা রায় (নগাঁও) এবং রিঙ্কি সাহা (ডিমাপুর) ; স্বগীয় ভূপেন হাজারিকার বাংলা গানের প্রতিযোগিতায় ১ম ,২য় ও ৩য় স্থান পেয়েছেন  আশিস বণিক (ডিমাপুর) , শব্‌নম্‌ মেঘালী ও দেবব্রত ঘোষ (নগাঁও) ; স-র-গ-ম সুরের আকাশে গানের প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ গায়ক বা গায়িকা বিচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১ম , ২য় ও ৩য় স্থানে পুরস্কৃত হয়েছেন যথাক্রমে মিঠুন চন্দ (লংকা), ময়ূরাক্ষী পাল (নগাঁও) এবং রাজেন দেবনাথ ( ডিমাপুর) । এ ছাড়া বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে ডাকযোগে বিবেকানন্দ বিষয়ক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার ক-বিভাগে ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান পেয়েছে কুণাল পাল , নবনীতা পাল ও বিশাল সরকার (নগাঁও)  এবং খ-বিভাগে ১ম, ২য় ও ৩য় স্থানাধিকারীরা হলেন যথাক্রমে স্বপ্না দে, পূজা পাল, মণি পাল গাঙ্গুলী (নগাঁও) । এই প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত বিচারের দায়িত্ব ছিল প্রখ্যাত সাহিত্যিক মানিক দাস-এর ওপর ।  
               এরপর উল্লেখ করছি বাংলা স্বল্প দৈর্ঘের নাটক প্রতিযোগিতার ফলাফলের কথা । অন্যান্য বছরের মত এবারেও যথেষ্ট ভাল সাড়া পাওয়া গিয়েছিল উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা নাট্যগোষ্ঠীগুলির কাছ থেকে । এবারের প্রতিযোগিতায় একটি বিশেষ ভাল লক্ষণ চোখে পড়েছে , যা হল - মৌলিক নাটক । এবারে সর্বমোট নাটক ছিল চোদ্দটি, তার মধ্যে মৌলিক নাটকের সংখ্যা ছিল আটটি । গত বছর আমরা নাট্যবিচারকেরা আয়োজকমন্ডলীর কাছে একটি প্রস্তাব রেখেছিলাম যে উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা নাটকের উন্নতিকল্পে মৌলিক নাটককে উৎসাহ দিতে এর জন্য পুরস্কার রাখা উচিত, যা গত বছর ছিল না । কমিটি আমাদের প্রস্তাব অনুসারে এবারে মৌলিক নাটকের জন্য আলাদা পুরস্কার ঘোষণা করেন এবং তাতে যথেষ্টই ভাল সাড়া পাওয়া গেছে । এই প্রতিযোগিতাকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলতে আমরা আশা রাখি আগামিতে যদি এটিকে সর্ব্বভারতীয় করা যায় , প্রয়োজনে এই নাট্যপ্রতিযোগিতাকে আলাদা একটি বিশেষ উৎসব হিসেবেও ভাবা যেতে পারে । আয়োজক কমিটি নানাদিক বিবেচনা করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন । এ বছর ৬ই জানুয়ারী সন্ধ্যায় সম্মিলনীর সভাপতি শ্রী কিশোরকান্তি বসু মহাশয় স্বর্গীয় পাঁচুগোপাল সেনগুপ্ত স্মৃতি ছোট নাটক প্রতিযোগিতার উদ্‌বোধন করেন । এটি ৬ই থেকে ৮ই জানুয়ারী প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় । শীতের তীব্রতাকে উপেক্ষা করে দর্শকের এই নাট্যপ্রীতি যথেষ্ট উৎসাহব্যাঞ্জক ।  
              এবারে যে নাট্যদলগুলি বিভিন্ন নাটক নিয়ে প্রতিযোগিতার আসরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে একবার পরিচয় করে নেওয়া যাক । প্রথম দিনে ছিলেন -  ১) ফিনিক্স সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী , হয়বরগাঁও , নগাঁও  ( মৌলিক নাটক – “নিউজ – ভিউজ ”)             ২) সি-রক ক্লাব , মরিয়নী ( নাটক – “আত্মশুদ্ধি” )৩) রবীন্দ্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী , নগাঁও (মৌলিক নাটক – “ঠিকানা”) ৪) নবদিগন্ত নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থা , করিমগঞ্জ ( নাটক – “বেনোজলের গড়খাই”)৫) নটরাজ নাট্য সংস্থা , লামডিং  (মৌলিক নাটক – “আড়ি আড়ি আড়ি”) দ্বিতীয় দিনে ছিলেন – ১) নবারুণ , শিলচর  (মৌলিক নাটক – “মান-হুঁশ”)               ২) ইন্ডিয়া ক্লাব এন্ড থিয়েট্রিক্যাল ইনস্টিট্যুশন , ডিব্রুগড়  ( নাটক – “ভালো মানুষের গল্প”)               ৩) রঙ্গরাগ , গুয়াহাটি  (মৌলিক নাটক – “রাবণ বধের পালা”)      ৪) রেস থিয়েটার , কাছাড় (মৌলিক নাটক – “পান্থ সঙ্গীত” )৫) তেজপুর বাঙালি অবৈতনিক নাট্যসমাজ , তেজপুর (মৌলিক নাটক – “সদ্‌গতি” , মুন্সী প্রেমচাঁদের গল্পের                     নিজস্ব নাট্যরূপ )
             তৃতীয় দিনে ছিলেন – ১) শুভম্‌ নাট্যচক্র , খোয়াই , ত্রিপুরা  ( নাটক – “অন্তর্গত আগুন”)            ২) ফিডো , গুয়াহাটি  (মৌলিক নাটক –  “জন্ম – মৃত্যু – জন্ম”)             ৩) ত্রিবেণী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা , বিলোনীয়া , ত্রিপুরা  ( নাটক – “বিপন্ন বিশ্ব”)               ৪) রূপরঙ্গম থিয়েটার সেন্টার , গুয়াহাটি  ( নাটক – “নিঃশব্দ বহ্নি”) এবারে চূড়ান্ত ফলাফল যেমনটি ঘোষিত হয়েছে , তা হল –

১) শ্রেষ্ঠ দল -  ত্রিবেণী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা , বিলোনীয়া , ত্রিপুরা  ( নাটক – “বিপন্ন বিশ্ব”)

২) দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ দল - রূপরঙ্গম থিয়েটার সেন্টার , গুয়াহাটি  ( নাটক – “নিঃশব্দ বহ্নি”)৩) তৃতীয় শ্রেষ্ঠ দল - ইন্ডিয়া ক্লাব এন্ড থিয়েট্রিক্যাল ইনস্টিট্যুশন , ডিব্রুগড়  ( নাটক – “ভালো মানুষের গল্প”) ৪) শ্রেষ্ঠ পরিচালক – পিনাক দত্ত ( নাটক – “বিপন্ন বিশ্ব”) ৫) দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ পরিচালক – ইন্দ্রনীল দে  ( নাটক – “পান্থ সঙ্গীত” )                                            ৬) শ্রেষ্ঠ অভিনেতা – শিবব্রত রায় (চরিত্র – কার্লোস ;  নাটক – “অন্তর্গত আগুন”)৭) দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ অভিনেতা – দীপঙ্কর দেব (চরিত্র – সুকুমার মিত্র ; নাটক – “বেনোজলের গড়খাই”)
৮) শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী – উৎপলা বোস ( চরিত্র – মতিয়া ; নাটক – “নিঃশব্দ বহ্নি”)৯) দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী –  পলি লাহিড়ী মুখার্জী  ( চরিত্র – কুড়িয়া ; নাটক – “সদ্‌গতি”)১০) শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেতা –  বিশ্বজিৎ কর ( চরিত্র – সূর্যদেও সিং ; নাটক – “নিঃশব্দ বহ্নি”)১১) শ্রেষ্ঠা সহ-অভিনেত্রী –  আন্না ঘোষ ( চরিত্র – ব্রাহ্মনী ;  নাটক – “সদ্‌গতি”)১২) শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী – অরিত্রা গাঙ্গুলী ( চরিত্র – মামন ; নাটক – “ঠিকানা”)১৩) শ্রেষ্ঠ শৃঙ্খলাপরায়ণ  দল - সি-রক ক্লাব , মরিয়নী১৪) বিচারকের বিশেষ পুরস্কার – বিজিতেশ সিন্‌হা ( চরিত্র – বিকলাংগ ভাই ; নাটক – “ঠিকানা”)১৫) শ্রেষ্ঠ আবহসঙ্গীত -  ত্রিবেণী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা , বিলোনীয়া , ত্রিপুরা  ( নাটক – “বিপন্ন বিশ্ব”)১৬) শ্রেষ্ঠ পান্ডুলিপি - রঙ্গরাগ , গুয়াহাটি  (মৌলিক নাটক – “রাবণ বধের পালা” , নাট্যকার – প্রকাশ মেধি )
                এতগুলি প্রতিযোগিতাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে , এত প্রতিযোগী ও বিচারকদের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় সামলে এবং সেই সাথে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পাঁচদিন ধরে সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যাওয়া যে কতখানি কঠিন ব্যাপার তা এখানে না এলে বোঝা যাবে না । জানুয়ারীর শীতের কুয়াসা ভাঙা হালকা রোদ গায়ে মেখে সক্কালবেলা থেকেই নানান রকম রঙিন পোষাকে বিপুল উৎসাহী ছোট বড় নানান মাপের ছেলেমেয়েদের দেখে সাংস্কৃতিক উৎসব নয়, মনে হয় যেন নানা রঙের এক ফুলের মেলা । এই দৃশ্য দেখতে দেখতে আমার নিজের ছেলেবেলার কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ে যাচ্ছিল । বিভিন্ন জায়গা থেকে এই শিশুরা যে কতটা আগ্রহ নিয়ে বাবা-মায়ের হাত  ধরে এই অনুষ্ঠানে আসে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না । অবশ্যই এর জন্য বাবা-মায়েরা যথেষ্ট  প্রশংসার  দাবিদার । তাঁরা জানেন প্রতিযোগিতা মানেই শুধু পুরস্কার পাওয়া নয় , যদিও না পেলে ছোটদের মন অবশ্যই খারাপ হবে এটাই স্বাভাবিক ।  তবুও বছরের প্রথমে আনন্দমেলার এই আকর্ষণটাই যেন এক আলাদা অনুভব এবং সারা বছরের এক আনন্দ সঞ্চয় বলে মনে হয় । তাই দূর দূর থেকে অনেকেই আগের দিন নগাঁও-এ এসে পৌঁছে যান এবং সকাল থেকেই মিলনোৎসবে সামিল হন । এখানে প্রত্যেকের জন্যই খাবার বন্দোবস্ত রেখেছেন আয়োজকমন্ডলী । একটি অস্থায়ী রসুইঘর সহ খাবার-ঘর এই পাঁচ দিনের জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি খোলা থাকে । এখানে শুধু ভালো খাবার পাওয়াটাই বড় কথা নয় , এখানকার বৈশিষ্ট হল এই খাবার তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট সুলভে একটি টোকন সংগ্রহের মাধ্যমে যে-কেউ পেতে পারেন । লক্ষ্যণীয় বিষয় হল প্রতিযোগী থেকে শুরু করে তাদের অভিভাবকরা , এমন কি আয়োজক সংগঠকরা নিজেরাও এই নিয়মেই খাবার খেয়ে থাকেন । বিশেষ অতিথি বা আমন্ত্রিতরা অবশ্য এই আওতায় পড়েন না । প্রত্যেকটি কর্মিবন্ধুরই নজর থাকে অতিথি আপ্যায়নে যেন কোন ত্রুটি না ঘটে । এই রসুইঘরের সমস্ত কাজ এবং মূল দায়িত্ব সযত্নে সদা হাসিমুখে পালন করেন যে মানুষটি তার সর্বপরিচিত নাম অপু ।  তার পারিবারিক নাম যে শান্তনু সরকার তা বোধহয় স্থানীয় বন্ধুরাও জানেন না - তার এই কেটারীং শিল্প তাকে এতটাই পরিচিত করেছে । কাজের আন্তরিকতায় মানুষটা যেন এই সংগঠনেরই একজন হয়ে উঠেছে । 


       এই সাংস্কৃতিক মহোৎসবের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠান সামাল দেন বিভিন্ন বিভাগীয় আহ্বায়ক ও তাঁর সহযোগী সদস্যরা , যার নেতৃত্বে রয়েছেন সাধারণ সম্পাদক শ্রী শংকর দাস । নগাঁও বাঙালি সম্মিলনীর সভাপতি শ্রী কিশোরকান্তি বসু ও উপ-সভাপতি শ্রী পুলকময় রায় , তাঁরাও এই উৎসবের সাফল্যের জন্য সদাজাগ্রত থাকেন ।  স্থানীয়  মিউনিসিপ্যালিটির প্রধান হিসেবে শ্রী বসুকে নানা কাজে শত-ব্যস্ত থাকতে হলেও সারা বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানের সুযোগ্য উন্নতি ও আধুনিকীকরণের নানা পরিকল্পনা নিয়ে তিনি যথেষ্ট চিন্তিত ।  কোন সফল মানুষের পিছনে কোন সুযোগ্য মহিলা থাকেন বলে যে প্রবাদটি  আমরা জানি , এখানে এসে তাই আমার মনে হয়েছে কোন প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে তার সুযোগ্য পরিচালকদের হাতে । তেমনি এখানকার প্রতিটি সদস্যের আন্তরিকতায় আমরা প্রতিফলিত দেখতে পাই এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থাকা মানুষগুলোর স্বচ্ছ,শুভ্র, আন্তরিক পরিচালন ক্ষমতা, যা আমার ব্যক্তিগত অনুভবে সর্ব্বভারতীয় স্তরের যেকোন সংগঠন কিংবা দলীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এটি নিঃসন্দেহে একটি বিশেষ অনুকরণীয় গুণ বলা যায় । 
                অনুষ্ঠান-প্রাংগনে ঢোকার মুখে প্রথম দিনেই চোখে পড়েছিল অভিনব প্রবেশ তোরণ । পরে জেনেছি এর শিল্পসৌকর্যের কথা ।  শান্তিনিকেতনের রামকিংকর বেজের অন্যতম তামিল শিষ্যের কিছু ম্যুরালের প্রভাব এতে লক্ষণীয় । প্রতি বছর শিল্পভাবাশ্রিত তোরণ নির্মানে যে স্থানীয় তরুন শিল্পীর কৃতিত্ব উল্লেখের দাবি রাখে তাঁর নাম অমিতাভ দাশগুপ্ত । এবারে এঁর সাথে বাবু রায় ও স্বপন পালের সহযোগিতায় অনুষ্ঠান-প্রাংগনে দুটি বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা গেল । নন্দলাল বসুর আলপনা , রবীন্দ্রনাথের ছবি ও কবিতার অংশ দিয়ে তাঁরা সাজিয়েছেন আঙ্গিনার চারদিক এবং সেই সাথে বেশ বড় বোর্ডে ২০১১ সালের উল্লেখণীয় বিশ্ব-সংবাদের ছবি নিয়ে সাজানো হয়েছে কোলাজ “ফিরে দেখা – ২০১১” । এবারের আরেকটি সংযোজন - বাংলা সাহিত্যের নানারকম পুস্তক সংগ্রহ নিয়ে উৎসবাঙ্গনে গুয়াহাটির ব্যাতিক্রম-এর আয়োজনে বিক্রয় বিপণি সাজিয়েছেন ভিকি পাবলিশার্স, যার ফলে ক্রেতারা তাঁদের পছন্দমত বই হাতের কাছে পেয়ে অনায়াসে সংগ্রহ করতে পারছেন ।  আগামিতে এখানে মিনি বইমেলার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকেই ।                                                                                
                      এই আনন্দানুষ্ঠানের মধ্যেই ৭ই জানুয়ারী একটি দুঃসংবাদ এসে পৌঁছোয় যে সম্মিলনীর প্রাক্তন সভাপতি হিমাংশু চ্যাটার্জী প্রয়াত হয়েছেন । তাঁর স্বর্গীয় আত্মার সম্মানে উৎসব প্রাংগনের উত্তোলিত পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং সান্ধ্য অনুষ্ঠানের শুরুতে উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে উঠে এক মিনিটকাল নীরবতা পালন করেন ।  প্রতি বছরের বিশেষ আকর্ষনীয় ও জনপ্রিয় গানের “স-র-গ-ম সুরের আকাশে” প্রতিযোগিতাটি এবারে শ্রদ্ধেয় ভবানন্দ ব্যানার্জীর স্মরণে উৎসর্গীকৃত হয় এবং উদ্বোধন করেন তাঁরই অনুজ প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ শ্রী নন্দ ব্যানার্জী মহাশয় । এ বছরের সদ্য-প্রয়াত ভূপেন হাজারিকার সম্মানে ও শ্রদ্ধেয় সঙ্গীতজ্ঞ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্মশতবর্ষ স্মরণে অনুষ্ঠানের শুরুতে দুই শিল্পী নন্দ ব্যানার্জী ও শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার দ্বৈতকন্ঠে গেয়ে শোনান জনপ্রিয় “হারাধন-রংমন” কথা । এরপর রঙিন মঞ্চে শুরু হয় বর্ণময় সঙ্গীতের সুরেলা বিচ্ছুরণ   এবং সেই সাথে এগিয়ে চলে বাছাই ও চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগিতা ও বিচার ।  
           এ বছর স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে শুধু বার্ষিক পত্রিকা “অনুরণন” প্রকাশই নয় , বিশেষ আলোচনা সভারও আয়োজন করা হয়েছিল ১০ই জানুয়ারী দুপুরের অধিবেশনে । প্রধান বক্তা ছিলেন চেরাপুঞ্জী রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদক স্বামী সুমনসানন্দজী মহারাজ এবং  পান্ডু মহাবিদ্যালয়ের ইংরাজী বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ডঃ পরাগ দাশগুপ্ত । অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের সচিব ও বিশিষ্ট সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার । অনুষ্ঠানের শুরুতে  বক্তাদের সাথে একই মঞ্চে আরও যাঁদের সম্বর্ধনা জানানো হয় তাঁরা হলেন স্বামী প্রেমময়ানন্দজী মহারাজ, স্বামী বিশ্বগানন্দজী মহারাজ, অসম সরকারের জলসিঞ্চন বিভাগের মন্ত্রী ডাঃ অর্ধেন্দু দে  এবং নগাঁও সদর সমষ্টির বিধায়ক ডাঃ দুর্লভ চমুয়া ।  স্বামীজির জীবনের বিভিন্ন দিক ও তাঁর জীবন দর্শন নিয়ে বক্তারা তাঁদের বক্তব্য রাখেন । ভক্তি-বিনম্র এই অধিবেশনটিতে শহরের মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে বহু গুণী-মানী মানুষেরা উপস্থিত ছিলেন ।
                   এরপর শেষের দিনের সান্ধ্য অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল পুরস্কার বিতরণী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । অনুষ্ঠানের সূচনা হয় তনয় রায় ও রিয়া চক্রবর্তী (ঢেকিয়াজুলী) পরিবেশিত নৃত্যানুষ্ঠান গনেশ বন্দনা দিয়ে । সম্মিলনীর সভাপতি শ্রী কিশোরকান্তি  বসু মহাশয় এমন একটি বৃহৎ বাৎসরিক অনুষ্ঠানকে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন ও সাফল্যমন্ডিত করার ব্যাপারে সকল রকম সহযোগিতা করার জন্য সমস্ত  নাগরিক ও দর্শকমন্ডলীকে ধন্যবাদ জানান । ধন্যবাদ জানান তাঁর সকল সহকর্মী বন্ধুদেরও যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা ভোলবার নয় । আগামিতে এই অনুষ্ঠানকে আরো সুন্দর ও নবকলেবরে উপস্থাপিত করার আশা প্রকাশ করেন তিনি ।    
               নগাঁও বাঙালী সম্মিলনীর পক্ষ থেকে প্রতি বছর বিদ্যালয়ের উচ্চতর পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে স্থানীয় শ্রেষ্ঠ ছাত্র ছাত্রীদের কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁদের উৎসাহ দানের জন্য আর্থিক পুরস্কারের মাধ্যমে সম্বর্ধনা জানানো হয় । ২০১১ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য নগাঁও বাঙালী উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র শ্রীমান কৃষ্ণ দাস পায় সত্যব্রত মজুমদার স্মৃতি পুরস্কার এবং হয়বরগাঁও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী কুমারী সুস্মিতা চৌধুরী পায় শুভদীপ দে স্মৃতি পুরস্কার । এই সাথে ২০১১ সালের নবম শ্রেণির পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য মৃণাল রায় স্মৃতি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় নগাঁও বাঙালী উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র শ্রীমান বিশাল সরকার ও নগাঁও বাঙালী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী কুমারী রেনেষা রায়কে । এ ছাড়াও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত কুমারী নন্দিতা কর্মকার সমস্ত প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করে যে মনোবলের সঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে সেই কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ঐকতান আর্থিক পুরস্কার দিয়ে তাকেও সম্মানিত করা হয় । সম্মিলনীর সভাপতি শ্রী কিশোরকান্তি  বসু এমন নজির বিহীন প্রেরণাকে উৎসাহ জানিয়ে উপস্থিত সকলের পক্ষ থেকে নন্দিতার আরোগ্য ও উন্নতি কামনা করেন । এরপর সম্মিলনীর পক্ষ থেকে শহরের পাঁচজন বিশিষ্ট নাগরিককে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মান জানানো হয় । এঁরা হলেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ্‌ শ্রী হরিপদ দে , বিশিষ্ট সাহিত্যিক শ্রী অনিল দাশ পুরকায়স্থ, খেলোয়ার ও ক্রীড়া সংগঠক শ্রী অধীর চন্দ্র রায়, বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী শ্রীমতি দীপশ্রী ভট্টাচার্য এবং বিশিষ্ট চিকিৎসাবিদ্‌ ডাঃ রণবীর কুন্ডু ।  
                সেদিনের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের শুরুতে সকল শিশু প্রতিযোগীর হাতে উৎসাহব্যাঞ্জক ছোট্ট ছোট্ট উপহার তুলে দেওয়া হয় । এরপর সকল সফল প্রতিযোগীরা একে একে এসে বিভিন্ন গুণীজনের হাত থেকে নিজের নিজের পুরস্কার গ্রহণ করেন । যাঁরা কোন কারণে এই সময় উপস্থিত হতে পারেন নি কিংবা অন্য কেউ সে দায়িত্ব নেবার মত উপস্থিত না থাকলে পরে সেই পুরস্কার সম্মিলনীর অফিস থেকে সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয় ।
             শেষ দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আকর্ষণ ছিল কলকাতার ভদ্রকালী আর্ট এন্ড কালচারের ছয়শত রজনী অতিক্রান্ত জনপ্রিয় ছোট নাটক “মাঝি”, নাট্য প্রতিযোগিতার বিচারক কলকাতার মূকাভিনেতা রণেন চক্রবর্তীর মূকাভিনয় এবং তারপর “স-র-গ-ম সুরের আকাশে” সঙ্গীত প্রতিযোগিতার বিচারকদ্বয়, প্রথমে শিলচরের প্রখ্যাত গায়ক পংকজ নাথ ও পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত উত্তরপূর্বাঞ্চলের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের কন্ঠে বিভিন্ন স্বাদের মন ভরানো গান । সেদিনের সেই গানের রেশ নিয়েই গভীর রাতে সমাপ্ত হয় ২০১২ সালের উত্তর পূর্বাঞ্চল রাজ্যভিত্তিক ষষ্ঠবিংশতিতম বার্ষিক সাংস্কৃতিক উৎসব । “ আসছে বছর আবার হবে ” এমন শ্লোগান সোচ্চারে ধ্বনিত না হলেও সকলেরই মনে বাজছিল সেই সুর । এ উৎসব যেন আরেক দুর্গাপূজা । 

                                   _________________________________________________________   --- শৈলেন সাহা । দিল্লি ।

ভালবাসার তুকতাক

                           (ত্রিপুরা কবি  সমরজিৎ সিনহা পূর্বোত্তরে সম্মানিত এবং এর বাইরেও বাংলা কবিতা গল্প বিশ্বে সুপরিচিত নাম। কিছু দিন হলো নেটেও এসে হাজির। কিন্তু প্রায়োগিক কারণেই এখনো রোমান হরফেই লিখতে হয়, তাঁকে। একে বাংলা হরফে লিখে পড়ালেন বাংলাদেশের কবি মেঘ অদিতি। তাঁর থেকে নিয়েই  এখানে তুলে দিলাম)



















জ ভোরবেলা কী বিষম দুঃখ এসে
আমাকে ভালবাসার মন্ত্র বলে দিল , আমি জানি না ভালবাসার
তুকতাক হিম -যুগ আগে এরকম ছিল কী না
অনেক বছর আগে কোনো এক সুনীল গাঙ্গুলী
কবিতার পিঠে ছুরি মেরে বলেছিল ,
ভালবাসা ছিল ভালোবাসবার আগে '
আমি জানি না , চিঠির ভাষা কী রকম হলে সেই কিশোরীর
ভালবাসা পার্কের ছায়ায় এক যুগ শব্দহীন বেঁচে থাকে ।
আমি জানি না কেন যে
শরীরের উপমা মন্দির হয় ।
আমি জানি না , ভালবাসার কী রকম তুকতাকে মধ্যরাতে
চুরি হয় কুমারী মেয়ের
সূর্যমুখী প্রেম !
আজ কী বিষম দুঃখ এসে
আমাকে শিখিয়ে দিল , 'বিলি বিলি খান্দা গুলু
বাম চাক দবাং দুলু
হুড়মুড় তা ধিন না উসুখুসু সাকিনা খিনা '
আমি জানি না , ভালবাসার তুকতাক
হিম -যুগ আগে এরকম ছিল কী না !


                                                           (C) ছবি; Picture

শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

একটি মাথুর পদ




তুই বল না কেনে সই,                আমার শ্যাম গেছে কই,
                         বাঁশির ঘায়ে
                                  সে যে আমার
নেয় না লো আর প্রাণ।
আমি ঝাড় ভাসাবো জলে-             রেগে বলেছিলাম বলে
                       বাঁশি কি তার
                                করেছে লো
                                      এতো অভিমান!

হলো সূর্য ডুবে সাঁঝ                  তারে না পেলে পর আজ
আমি               মানব না লো
রাত বিরেত
ফিরব নালো ঘরে;
ধরে বুঝি
নিয়েই গেল
কংস রাজার চরে!

ছুটে বৃন্দাবনে আর                    গেছি যমুনা নদীর পার
শ্রীদাম সুদাম
কেন যে আজ
কেউ ছিল না গোঠে
ঘাটে কলস জলে কেউ                   বসে গুনছিল না ঢেউ

পারাপারের
নাও ছিল না
মাঝি গেছে ওঠে

চেয়ে কদম তলায় দেখ             সারা কুঞ্জবনে মেঘ
যেন                  চাঁদ এসেছে
রাধার মতো
হারিয়ে ফেলে আলো
ফিরল না যে
এখনো
পাখি আমার কালো?!


(কালো সখির মুখ ঢেকেছে           এই হয়েছে  ভালো।)

                                (c)Picture:ছবি

স্তুতি

মূল অসমীয়া : মনোহৰ দত্ত





ময় আহে
গুছি যায়
ৰৈ যায় স্মৃতি
জোনাকত, ৰ’দত
কবিতা লিখি
থৈ যাম শব্দৰ
স্তুতি...

২২/০৬/২০১২






~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বাংলা অনুবাদ :নন্দিতা ভট্টাচার্য

স্তুতি

সময় আসে 
চলে যায়
থেকে যায় স্মৃতি 
পুর্নিমায় , রোদে 
কবিতা লিখে 
রেখে যাব শব্দের 
স্তুতি ...                                                                                              

                                                                                                            (C) Pictureঃ ছবি