“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০

একটু নিজের কথাই বলি -- ৪ (খ)

 ।। সাদিক মোহাম্মদ লস্কর ।।

বিধায়ক রাজদীপ গোয়ালার সঙ্গে,২০১৮ 

মন্ত্রী এসএম দেবের সঙ্গে, দিল্লি, ২০০৪

    রাজনীতির প্রতি আমার আকর্ষণ ও অনীহা দুটিই আছে। ক্ষমতায় যারা বসে তাঁদের উপর ছড়ি ঘোরানো আমার ভালো লাগে। সেই সুযোগ তো আর সব সময় পাওয়া যায় না, তাই ভোটের সময় একটু ঝাড়-ফুঁক করি। ছোটবেলায় সে সুযোগ পেতামও। নির্বাচনের সময় এলাকার কিশোরদের নিয়ে একটা অফিস করে বসলাম কারো, সেখানে বসে রাজনীতির গল্প শোনা এক বড় মজার ব্যাপার ছিল আমার কাছে। তারও আগে কমরেড নুরুল হুদার সভায় গিয়ে বসতাম স্কুলের মাঠে। লাল সেলাম, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, নিপাত যাক এসব স্লোগান শিখেছিলাম ওখানে। কে একজন কিশোর একবার একটা গান গেয়েছিলেন ‘পাকের ঘরে আগুন লাগছে থাল ভরি ভাত খাইতেনি…’ । আবছা মনে পড়ে শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার ছিলেন বোধ হয়। আমার ছোট মামার সাইকেলের পিছনে লেখা থাকত ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ছোট নানাজি কমিউনিস্ট ছিলেন। এদিকে লক্ষীপুরে ১৯৮৩ সাল থেকে আমৃত্যু বিধায়ক ছিলেন দীনেশ প্রসাদ গোয়ালা। বাম রাজনীতি ধীরে ধীরে বিলীন হতে শুরু করল। তবে কংগ্রেস তেমন ঘাঁটি গাড়তে পারত না বাঁশকান্দিতে। একবার নেনা মিয়া স্কুলে সন্তোষ মোহন দেবকে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয়নি, এমভি স্কুলের সেই সভায় বড় মাপের এই নেতার কাছে বসার সুযোগ পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। আর একবার গনি খান চৌধুরিও নেনা মিয়া স্কুলে সভা করতে সমস্যায় পড়েছিলেন, তখনও তাঁর পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। আর আসাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আকসার ডাকে শিলচর শহরে গিয়ে জেলে যাওয়াও ছিল আমার ছাত্র রাজনীতি। আমি তখন প্রাথমিক স্তরের ছাত্র। আকসার নামে সি-র সঙ্গে কে ও এইচ লাগল পর্যায়ক্রমে। মনে পড়ে আমাদের জন্যে গাড়ি ও খাওয়ার বন্দোবস্ত করতেন সাংসদ রাণা দেব। আকসার নেতার সঙ্গে আমাদের তেমন পরিচয় ছিল না। একবার সদরঘাট পৌঁছতেই এক দাদা গোছের ছেলে এসে বলল, ‘তোমরা বড্ড দেরি করে আসলে দেখছি। সব্বাইকে ধরে নিয়ে গেছে। ভালোই হল। একটা কাজ তোদের করতে হবে। ওই (সুপার বাস) গাড়িগুলো জ্বালিয়ে দে। কিচ্ছু হবেনা। ভাবিস না।’ আমাদের দলে কয়েকজন বড় ছেলেও ছিল। তারা সুপার বাস পোড়ানোর প্রস্তাবটা গিলে বসল। বেঁকে বসলাম আমি। বললাম, ‘আমি ওসব বাজে কাজে নেই, আমাদের কেউ যাবেও না। আর যদি তোমরা যাও তো আমি এখনই হেঁটে বাড়ি ফিরে যাব।’ অগত্যা সবাই ক্ষান্ত হল। আমরা স্লোগান দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। দেবদুতের কাছে পৌঁছতেই পুলিশের গাড়ি এসে আমাদের ধরে নিয়ে গেল। আর ওই দাদা ততক্ষণে হাওয়া হয়ে গেল। একবার কিছুদিনের জন্য আসুতেও যোগ দিয়েছিলাম। বর্তমান উপাধ্যক্ষ আমিনুল হক লস্কর সহ অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয় এরকম এক পুলিশ হেফাজতে। গণনাট্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করে পরিচিত হই নৃত্যগুরু মুকুন্দ ভট্টাচার্য ও অন্যান্য বামপন্থীদের সঙ্গে। কলেজে পড়ার সময় ছাত্র সংসদে নির্দল প্রতিযোগিতা করে হেরেছিলাম। এখনও কোনও দলীয় রাজনীতিতে নেই, তবে নির্বাচন এলে পরিস্থিতি বিবেচনা করে একটু আধটু ঘোরাফেরা করি। তাই রাজনীতি আমার পেশা নয়। আর রাজনীতি কী করে পেশা হয় সেটা বুঝতেও পারি না। কারণ যারা রাজনীতি করে তাঁরা তোলাবাজি বা ঠিকাদারিও করে, সে অন্য পেশা।



সমাজকর্ম আমার আরেক কর্মক্ষেত্র, ঠিক পেশা নয়। ছোটবেলায় গ্রামে ক্লাব গঠন করে খেলা-ধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সমাজসেবা করেছি। অনেক সংস্থা গঠন করেছি এবং বহু সংস্থায় সাময়িক কাজ করেছি। ২০০৩ সালে আমাকে বরাক হিউম্যান রাইটস প্রটেকশন কমিটিতে যোগ দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করলেন নেহারুল আহমেদ মজুমদার। অনেক ইতস্তত করে শেষমেশ ২০০৪ সালে সদস্য হলাম বিএইচআরপিসি-র। প্রথমটা খুব একটা যোগাযোগ রাখিনি। তারপরে মনে হল সামাজকর্মকে পেশা করলে মন্দ হয় না। কিন্তু গুড়ে বালি পড়ল। কিছু আজগুবি লোকও এই সংস্থায় কাজ করছেন দেখলাম, যাদের উদ্দেশ্য ভালো ছিল না। তারপর দেখলাম কিছু লোক এসে কিসের টাকা ফেরত চাইতে শুরু করল, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পরে জানলাম, তখনকার সেক্রেটারি নাকি সংস্থায় চাকরি দেওয়ার কথা বলে কিছু টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। একদিন শুনলাম ওই সেক্রেটারি নাকি পুলিশের হেফাজত থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। সেই থেকে নেহারুল সেক্রেটারি হলেন। কিন্তু আমাদের মাথায় তখন ঋণের বোঝা। টাকাকড়ির ব্যাপারে হবিবুর রহমান চৌধুরি (নববার্তা প্রসঙ্গের মালিক) বা অন্য কেউ কোনও দায় দায়িত্ব নিতেন না। অতএব নেহারুল দায়িত্ব নিলেন, বাকিটা আমার। এবার সংস্থাকে বাঁচাতে লেগে গেলাম। তাই নানা প্রজেক্টের আশায় দৌড়ঝাঁপ শুরু করলাম। কানের জল বের করতে আরো জল ঢালতে শুরু করলাম। একসময় ঋণ নিয়েও বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করলাম। কিন্তু সব জলে গেল। কারণ এ ধরণের সরকার বিরোধী সংস্থা কোনও সরকারি অনুদান পায় না। আর বিদেশি টাকা পাওয়ার মত অবস্থায় আমরা ছিলামও না। আমি তখন কপর্দকশূন্য হয়ে গেলাম। এরই মধ্যে যোগ দিলেন অলিউল্লাহ লস্কর, নানাভাবে সহযোগিতা করলেন বিচারপতি মাহমুদ হুসেন বড়ভুঁইইয়া। আন্তর্জালের ব্যবহার করে বিশ্বের নানা সংস্থার সঙ্গে পরিচয় হল। কিন্তু টাকার বন্দোবস্ত হয় না। নিজের রোজগার আর মার তহবিল থেকে ঋণ শোধ করলাম। এবার সভাপতি হলেন অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক মনীন্দ্র শঙ্কর গুপ্ত। কোনমতে সদস্যদের চাঁদা দিয়ে কাজ চালিয়ে গেলাম। তবে সংস্থা এক নতুন ধারায় কাজ করতে শুরু করল। পরিচয় হল বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে। নানা সংস্থার আয়োজিত প্রশিক্ষণে যোগ দিলাম। সংস্থায় সদস্যদের যোগ-বিয়োগ চলতেই থাকল। বর্তমানে সভাপতি প্রসেনজিত বিশ্বাস ও সচিব প্রধান তানিয়া লস্কর। এখন কিছু সংস্থার সঙ্গে পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে কিছু কাজ করার উপযুক্ত টাকাও আসছে। কিন্তু আমার আর নেহারুলের সেই হারানো টাকা ভুল পথে খরচ হওয়ায় সেই অধ্যায়টা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমিও অন্যান্য পেশায় জড়িত, তাই পেশাদারি সমাজকর্মে সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। বাকি সব গুছিয়ে নিতে পারলে হয়তো আবার পেশাদার মানবাধিকার কর্মীরূপে ফিরে আসতে পারি।

1 টি মন্তব্য:

Jamil Laskar বলেছেন...

এমন অনেক জিনিস জানতে পেরেছিলাম যা আমি আগে জানি না।আপনার প্রচন্ড সম্ভাবনা রয়েছে।একদিন ফুল টি ব্লোম হবে |