“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

একটু নিজের কথাই বলি - ৪(ক)

 ।। সাদিক মোহাম্মদ লস্কর ।।

কী কাজ করিতে আইলি এ ভব সংসারের মাঝে….

পেশা মানে কী? অন্যের চাইতে বেশি রোজগার করার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা, না চাল-ডালের ব্যবস্থা করা, না একই কাজ নানা ভাবে করে আজীবন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা? যে যেভাবে নেয় সেই ভাবেই কাজ করে যায় আজীবন। আমরা যে কাজই করি না কেন একে অন্যের সেবা করে একে অন্যের চাহিদা মেটানোটাই উদ্দেশ্য – You’re gonna have to serve somebody। আমিও পেশা বলতে তা’ই বুঝি। পেটের জোগাড় করার জন্যে এত হাপিত্যেস করতে হয় না। আসলে যাদের অন্ন সংকট তাদের রক্ত চুষে পিঠের জোগাড় করতেই জনম কাবাড় হয়ে যায়। ঠিক কোন জায়গা থেকে আমি পড়াশোনা ছাড়া অন্য কাজ শুরু করেছিলাম, তার হদিস পাওয়াই মুশকিল।



আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ২০০১ সালেই যোগ দিলাম মোরাদ আহমেদ লস্করের প্রতিষ্ঠা করা মওলানা আহমেদ আলি মেমোরিয়াল জুনিয়র কলেজে। সে বছর মাত্র ছ’জন শিক্ষার্থী নিয়ে ভাড়াঘরে কলেজ শুরু হয় অনিশ্চয়তার মধ্যে। ৬০০ টাকা বেতন ছিল প্রথমে। ২০০৪ সালে তিনি শুরু করলেন ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ ডিগ্রি কলেজ। ২০০৫ সালে কলেজকে স্থানান্তরিত করা হয় নিজস্ব জমিতে। ওই সময় সরকার ভেঞ্চার বা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। আমার সহকর্মী ইবোতম্বি সিংহ, মমতাজ বেগম চৌধুরি, বিমল সিংহ, ইবেমতম্বি দেবীরা সহজ সরল মানুষ – অতশত বোঝেন না। আমি তাঁদের হয়ে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম জুনিয়র কলেজের অনুমোদন প্রক্রিয়া কতটুকু এগিয়েছে। তিনি বলতেন, সব হয়ে গেছে। ২০০৬ সালে সহকর্মীদের বুঝিয়ে সবাই মিলে চাপ দিলাম। অনেক পরে তিনি কনকারেন্সের এক কাগজ দেখালেন যেদিন আমি উপস্থিত ছিলাম না। তারপর অনেক সংগ্রামের পর ২০১০ সালে প্রমাণ হল যে ওই কাগজ ভুয়ো। তখন আমি আইনের আশ্রয় নিতে চাইলাম, কিন্তু সবাই রাজি ছিল না। বৃহত্তর এলাকার মানুষ এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন এই সংগ্রামে। পালোরবন্দের যদুনন্দন রবিদাস, বাঁশকান্দির মাহমুদ হুসেন বড়ভূঁইয়া, বাদ্রিপারের সইফুল হক, বিকাশ গোয়ালা, বাবাহান সিংহ, ইবংহল সিংহ প্রমুখ যোগ দিলেন। আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে আরেকটা কলেজ খোলা হল। আমি এতে সম্মত ছিলাম না। কারণ এর আগেও বাঁশকান্দিতে কলেজ নিয়ে ঝগড়া হয়ে দুটি কলেজই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিল। কিন্তু আমার তখন আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাই এলাকার নেতৃস্থানীয় মানুষের সিদ্ধান্তকে সম্মান দিয়ে এক প্রস্তাব দিলাম – প্রায় বন্ধ হয়ে পড়া ১৯৯৮ সালে স্থাপিত বাঁশকান্দি জুনিয়র কলেজকে চাঙ্গা করা হোক। সেই মতে এর কর্ণধার মধুচন্দ্র সিংহের সঙ্গে আলোচনা করে কিছু শর্তসাপেক্ষে কলেজটিই চালু করা হল। আশাতীত সাফল্য পাওয়া গেল। কিন্তু ভালো করে খতিয়ে দেখা গেল এই কলেজেরও সরকারি কোনও অনুমোদন নেই। অতএব ২০০৬ সালের আইনমতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন নেওয়া হল। পরবর্তী পর্যায়ের জন্য সব নথিপত্র জমা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেই লাল ফিতের গেরো। মোটা অঙ্কের লেনদেন করতে হয়।

পাইওনিয়ার ২০১৫

        এদিকে ২০১৪ সালে আমার কাছে আরেকটা প্রস্তাব এল। প্রায় বন্ধ হয়ে পড়া আরেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে হবে। ‘মিল্লত একাডেমি’ নামের ইংলিশ স্কুলটিকে বাঁচাতে গেলাম। দেখলাম সেখানেও কোনও সরকারি অনুমোদন নেই। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জড়ো করে অসহায় অভিভাবক ও শিক্ষকদের মুখে হাসি ফুটিয়ে

পাইওনিয়ার ২০১৯
সে বছর পরীক্ষার আয়োজন করা হল মাত্র দু’মাসের মধ্যে। তারপর প্রতিষ্ঠাতাদের ভাবধারা থেকে সরে নাম সহ খোলনলচে পালটে দিলাম। আশাতীত সাফল্য পাওয়া গেল পাইওনিয়ার ইংলিশ স্কুলেও। এ যাত্রায় সহযাত্রী ছিলেন এলাকার ব্যতিক্রমী যুবক মান্না লস্কর ও তাঁর পরিবারের লোকজন। ২০১৫ সালেই সরকারি ঘোষণামতে আবেদন করলাম অনুমোদনের জন্যে। কিন্তু সেই লাল ফিতের গেরো। কয়েক লক্ষ টাকা দাবি করছেন সরকারি কর্মকর্তারা, আমি কিন্তু এক পয়সাও ঘুষ দেওয়া-নেওয়া করি না। ইউডাইসের আবেদন করার সময় একজন কর্মকর্তা দুহাজার টাকা দাবি করেছিলেন ম্যাডামকে দিতে হয় বলে। আমি না দেওয়ায় স্বাভাবিক নিয়মে অনেক পরে অনুমোদন পেল।
অধ্যক্ষের কার্যালয়ে চেখে দেখা ২০১৭
অধ্যক্ষের কার্যালয় ২০২০

এদিকে ২০১৬ সালে বাঁশকান্দি নেনা মিয়া উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালন ও উন্নয়ন কমিটি পুনর্গঠনের সময় আমাকে একটি মহল থেকে সভাপতি মনোনয়নের প্রস্তাব দেওয়া হল। বিধায়ক রাজদীপ গোয়ালা ও স্কুলের অধ্যক্ষ সহ অনেকেই মাকে চাইলেন স্কুলের সার্বিক উন্নয়নের জন্যে। অনেকে বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু বিজেপির জেলা তথা রাজ্যস্তরের নেতারাও এই আপত্তিতে সায় দেননি। কয়েক দশকের অবহেলায় নিমজ্জিত জাহাজের মত এই বিশাল প্রতিষ্ঠানকে প্রথমে ডাঙায় তুললাম প্রবল প্রতিকুল পরিস্থিতিতে অর্থাৎ পরিকাঠামোর উন্নয়ন হল। এখন তাকে ঘষা-মাজা করে কাজের উপযোগী করে তোলা অর্থাৎ শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা বেশ কষ্টকর অভিজ্ঞতা। পড়ুয়াদের পড়ার দরকার নেই, অভিভাবকদের যত্ন নেওয়ার দরকার নেই, শিক্ষকদের পড়ানোর দরকার নেই, পরিদর্শকের পরিদর্শনের দরকার নেই। কারণ একটাই – নকল। নকল যোগানকে আশ্রয় করে পরীক্ষা আর ভর্তির সময় অনেকের অনেক ধরণের রুজিরুটির ব্যাপারও ছিল। আমি সেই মৌচাকে হাত দিলাম আর ভেঙে ফেললাম। পরিস্থিতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। স্বয়ং অধ্যক্ষ বহুবার আমাকে হঠানোর চক্রান্ত করে বিফল হয়েছেন। অন্য কেউ এই মৌচাকে হাত দেওয়ার সাহস করে না। কিন্তু কেউ প্রকাশ্যে আমার বিরোধিতাও করেনি। তবে আমাকে কেউ ভয় পায় না – ভালোবাসে, হয়তো একটু সমীহ করে। কেউ কেউ সহমর্মিতার সুরে হুমকিও দিয়েছেন যে নকল বন্ধ করলে সমাজবিরোধিরা নাকি আমাকে হত্যাও করতে পারে। এরই মধ্যে এসে পড়ল মহাবিপদ – করোনা ও লকডাউন। স্কুল কবে খুলবে ঠিক নেই, মনে হচ্ছে সব কিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।

           সরকারি চাকরি করার উদ্দেশ্য আমার ছিল না। এমনকি শিক্ষকতা করাও আমার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু নিয়তি ধাক্কা দিতে দিতে আমাকে শিক্ষক হিসেবেই কাজ করাচ্ছে। এই একটা কাজ আমি খুব ভালো করে করতেও পারি আর স্বতঃস্ফুর্তভাবে করি। এখন প্রায় অর্ধশত শিক্ষিত মানুষ আমার সহকর্মী হিসেবে কাজ ও রোজগার করছেন। শিক্ষা নিয়ে আরও কাজ করতে চাই। এ প্রসঙ্গে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলছি, কাছাড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া সরকারি স্কুল দু’টিকে যদি অর্ধেক খরচে আমার কাছে সমঝে দেওয়া হয় তো সেগুলোকেও সবচেয়ে ভালো স্কুলে রূপান্তরিত করার আত্মবিশ্বাস আমার আছে।

কোন মন্তব্য নেই: