- - - - - - - - বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
সম্প্রতি শেষ শ্রাবনের
বরাক ভ্রমণে আমার প্রাপ্তির ভাঁড়ার পূর্ণ হয়েছে কানায় কানায়। তারই অঙ্গ হিসেবে আজ বিস্তারিত
ভাবে তুলে ধরছি সেদিনের অন্যতম এক প্রাপ্তির বিবরণ।
বছর পনেরো আগের
কথা। তখন অধুনা লুপ্ত ‘সময় প্রবাহ’ পত্রিকার পাতায় প্রায়শঃই এটা ওটা লিখতাম। লেখালেখির
সূত্রে আরোও যেসব কবি লেখকের লিখার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলাম তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন
শ্রী মনোমোহন মিশ্র। তিনি কোথায় থাকতেন
বা তাঁর বয়স কত সেসব কিছুই জানতাম না। কিন্তু
তাঁর সাবলীল সব রচনা পড়ে তখনই আমি মুগ্ধ হতাম। বলতে গেলে ‘তাঁরে আমি চোখে দেখিনি, তাঁর অনেক গল্প শুনেছি’-
ধরণের ব্যাপার আরকি। সেই থেকে
মনের মানসে তিনি ছিলেন লুকিয়ে। হঠাৎ করে
প্রায় মাস তিনেক আগে শিলচর অম্বিকাপট্টিতে থাকা আমার অকৃত্রিম বন্ধু পীযুষ ফোনে নিয়মিত
কথাবার্তার মধ্যে বললো – ‘বন্ধু, তুই তো লেখালেখি
করিস, তা আমারই ফ্ল্যাটে আমার মুখোমুখি ঘরেও একজন লেখক আছেন।’
জিজ্ঞেস করলাম- কী নাম ?
বললো- মনোমোহন মিশ্র।
আমি তো আনন্দে প্রায়
লাফিয়ে উঠেছি। নমস্য লেখকের পুনরাবিষ্কারে আমি প্রচণ্ড উত্তেজিত। মুখে শুধু “ইউরেকা !!” বলাটাই যা বাকি ছিল।
বললাম- আরে, বলছিস কী ? আমি শিলচর আসলে
অবশ্যই তাঁর সাথে দেখা করব। বন্ধু তো
দারুণ খুশি কারণ এই অছিলায় একপ্রস্থ আড্ডাও হয়ে যাবে ওর ঘরে।
সেই থেকে প্রতীক্ষা - যার অন্ত হলো এবারের বরাক যাত্রায় এক ঝলমলে সকালে। প্রথম দর্শনেই একেবারে মুগ্ধ আমি। আমার কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি সপ্রতিভ, সতেজ, কর্মচঞ্চল এবং কম বয়সের এই
অগ্রজসম মানুষটির সাথে মুহূর্তেই জমে গেল আড্ডা। পদবীর সাথে একেবারে মানানসই তাঁর সবকিছুতেই বৈচিত্র। লেখালেখির তো সম্ভার আছেই, পাশাপাশি চিত্রকলা ও ফটোগ্রাফিরও শৌখিন। চিত্রকল্পে
সমগ্র ‘গীতাঞ্জলী’। ঘরের দেয়ালে
টাঙানো। আমার থেকে প্রায় চৌদ্দ বছরের বড় হলেও যে কেউ দেখলে আমারই
সমবয়সী বলে ভাবতে বাধ্য। বয়সকে হার মানানোর
এও এক রহস্য। ধীরে ধীরে গল্প উঠলো জমে। এক ভূমি, এক ভাষা। তাই বাঁধনহীন দু’জনেই। এরই ফাঁকে উঠে গিয়ে
ফিরে এলেন তিনখানা বই হাতে করে। সবগুলো
নিজের লিখা। উপহারে আমাকে বাধিত করলেন চিরতরে।
তিনটির মধ্যে
যে বইটি আমার সবচাইতে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করল সেই বইটি আজ পড়ে শেষ করলাম। কবিতার
বই ‘উড়ান’। প্রকাশিত হয়েছে জুলাই ২০১১ তে। অর্থাৎ প্রকাশের আট বছর পর হাতে এলো
আমার। সেখানে বসে একনজর চোখ বুলিয়েই জানতে চেয়েছিলাম যে বইটির কোনও পর্যালোচনা
বেরিয়েছে কি না। জানালেন ইতিমধ্যেই তা হয়েছে। তাই আর এ বিষয়ে সচেষ্ট হলাম না।
কিন্তু অসাধারণ এই কাব্যগ্রন্থটির পাঠ প্রতিক্রিয়া সবার সাথে ভাগ করে নেওয়ার লোভ
সংবরণ করতে না পেরেই আজ এই রচনার অবতারণা।
প্রচ্ছদ থেকে
শুরু করে শেষ পৃষ্ঠা অবধি ‘উড়ান’ এক অনবদ্য সংকলন। সচরাচর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ
থেকে একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকে সজ্জিত বৈচিত্রময় এক কাব্য সংকলন। প্রচ্ছদ ও অক্ষর
বিন্যাস – নিখিল শব্দকর। প্রচ্ছদ ওল্টাতেই লেখকের অতি সংক্ষিপ্ত পরিচয়। সেখানেও
চমক। শ্রী মিশ্র প্রথম জীবনে তবলা বাদক ছিলেন জেনে নিজের সাথে সামঞ্জস্যটা যেন
বেড়ে গেল আরোও কয়েক ধাপ। ‘উড়ান’ এর সম্পাদনা জয়দীপ বিশ্বাস, গ্রন্থনা কবি নিজে।
প্রকাশক পুণ্যপ্রিয় চৌধুরী। কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন ‘বরাক উপত্যকা তথা বাংলার
বিশিষ্ট কবি শক্তিপ্রদ ব্রহ্মচারীর স্মৃতির উদ্দেশে’। মুখবন্ধ লিখেছেন বিশিষ্ট
সাহিত্যিক তপোধীর ভট্টাচার্য।
সম্পূর্ণ
গ্রন্থটিকে কবি সুস্পষ্ট তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রথম ভাগটিতে আছে ব্যতিক্রমী
ধারায় লিখিত ঊনিশটি কবিতা। অলঙ্কার হিসেবে প্রতিটি কবিতার প্রতিটি লাইনের শুরু,
মধ্যভাগ অথবা শেষের অক্ষরগুলোকে উপর নিচে সাজিয়ে এক একটি অর্থবহ শব্দবন্ধ বা
বাক্যের সংযোজন ঘটিয়ে এক অসাধারণ মুন্সিয়ানার পরিচয় রেখেছেন কবি। কবিতার এই
ধারাটিকে ইংরেজিতে Acrostic বললেও বাংলায় এর যথাযথ প্রতিশব্দ
নেই। কবি তাই খুব যথার্থ ভাবেই এই পর্বের কবিতাগুলোকে বলেছেন মিশ্র ভাবের কবিতা। বোধ করি এও তাঁর পদবীর সাথে মানানসই। প্রতিটি কবিতা পাঠে বিস্ময় জাগে মনে, কী অসাধারণ অধ্যবসায়ে লিখিত হয়েছে একের পর এক কবিতা। এর মধ্যে ‘আজকের দ্রৌপদী’ শিরোনামে যে কবিতাটি লিখেছেন তাঁর মোট লাইন সংখ্যা ৬৯। উপর নিচে লিপিবদ্ধ আছে – “যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায়চ দুষ্কৃতাম ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে”। এত দীর্ঘ একটি কবিতা অক্ষর বিন্যাস বজায় রেখে গেঁথে ফেলা
হয়তো তাঁরই পক্ষে সম্ভব। ছন্দের এই অলঙ্কার
বজায় রাখতে গিয়ে মুদ্রকেরও মুন্সিয়ানার প্রয়োজন আছে বৈকি। আর এখানে
যথার্থ ভাবেই এই কাজটি করেছে শিলচর সানগ্রাফিক্স।
পরের পর্ব তাঁর
নিজের লিখা বারোটি কবিতার সম্ভার। প্রতিটি
কবিতা পাঠককে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত করে ফেলে অনায়াসে। প্রথম কবিতা – ‘শক্তিদা, তুমি বলেছ বলেই’ প্রয়াত
কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। সব ক’টি কবিতা নিদারুণ অর্থবহ। একেকটি
কবিতার কিছু কিছু লাইন পড়ে চমকে উঠতে হয়। যেমন –
ভাগ্য কবিতা লেখে
তুমি আমি উপলক্ষ মাত্র।
কিংবা
আকাশ থেকে টপকে পড়ে
কবিতার প্রথম ছত্র (কবিতা – আকাশকে ডাকব)।
অথবা –
একদিন নির্বল বাহু তুলে আকাশের দিকে
বিধাতাকে বলব – শক্তি দাও।
বিধাতা বিরূপ হলে
তুমি পাশে এসে দাঁড়িও
তোমার হাতখানি বাড়িয়ো –
তোমার মিনিট খানেক সময় আমাদের দিও। (কবিতা –মিনিট খানেক সময়)।
কিংবা –
বিজয়ের উৎসব সাজাতে গেলে
পরাজিত সৈনিকের শবগুলো চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়,
-----------
------------
আনন্দের উন্মাদ বাসনায়
ছায়া নামে বিষাদের। (কবিতা বিজয়ের ভার)।
তৃতীয় তথা
শেষভাগে রয়েছে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী তথা বিশিষ্ট কবি অটল বিহারী বাজপেয়ীর লিখা
২০টি কবিতার বঙ্গানুবাদ। কবিতার ভাব যথাযথ বজায় রেখে, ভাব বিন্যাস বজায় রেখে
অনুবাদ করা প্রকৃত অর্থেই এক দুরূহ কাজ। কিন্তু এখানেও শ্রী মিশ্র পরিচয় দিয়েছেন
অসাধারণ নৈপুণ্যের। অনুবাদের যথার্থতা পরখ করেই তবে মিলেছে অনুবাদের অনুমতি। নিপুণ
অনুবাদকের অনুবাদে এতটুকুও বিঘ্নিত হয়নি কবিতার পঠনধারা। এখানেই তাঁর প্রয়াসের
সার্থকতা।
গ্রন্থের শেষ
প্রচ্ছদে ন্যাশনেল বুক ট্রাস্টের পূর্বতন অধিকর্তা নির্মলকান্তি ভট্টাচার্যের এক
সংক্ষিপ্ত অথচ অনিন্দ্য আলোচনা কবি ও কাব্যগ্রন্থের যথার্থ সার্থকতা ফুটিয়ে
তুলেছে। সম্পূর্ণ গ্রন্থটিতে সিন্ধুতে বিন্দুরই মতো দু’একটি ছাপার ভুল এবং হয়তো বা
শব্দের গভীরতা বজায় রাখার তাগিদে দু’একটি হিন্দি শব্দের প্রয়োগের বাইরে কোথাও
ন্যূনতম ছন্দপতনের কোনও সুযোগ নেই বললেই চলে।
সব মিলিয়ে একটি
চমৎকার কাব্যগ্রন্থের পাঠে বহুদিন পর এক নিরেট সুখানুভূতির আস্বাদন হলো আমার।
একেবারে ষোলোআনা সফল আমার সেদিনের সাহিত্য আড্ডা।
উত্তরোত্তর
সাফল্য ও সুস্বাস্থ্যময় দীর্ঘজীবন কামনা করি এই মিশ্র মননের সুকবি, সুসাহিত্যিক
শ্রী মনোমোহন মিশ্রের।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন