যে পরিবেশটাতে আমরা বসবাস করছি, সেটা আমাদের উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া
সম্পদ নয়, বরং ভেবে
নেওয়া উচিত যে আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে আমরা ধার নিয়েছি। এই আপ্তবাক্যটি দিয়েই আলোচনা শুরু করা
যাক। ভারতবর্ষ তো মুনি-ঋষিদের দেশ।পাচ হাজারেরও বেশি বছর পুরনো বেদ-বেদান্তের নির্যাসই এদেশের চালিকা শক্তি। পরিবেশ সংরক্ষন নিয়ে বেদান্তদর্শনে
পঞ্চ-মহাযাজনার উল্লেখ রয়েছে। এগুলো হল ব্রহ্ম-যাজনা, দেব- যাজনা, পিত্র- যাজনা, অতিথি-
যাজনা এবং বলিবৈশ্য়দেব-যাজনা। এদের মধ্যে পাঁচ-নম্বর-টি, অর্থাৎ ‘বলিবৈশ্য়দেব-যাজনা’ এ
ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক। যেখানে বলা হয়েছে, যে পরিবেশ ও প্রকৃতির রক্ষণাবেক্ষন
যদি ঠিকঠাক না করা হয়, তাহলে বাস্তুতন্ত্র
তথা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা মুস্কিল ! ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও এগুলোর
রক্ষনাবক্ষনের উপর সেই সময়কার দিনেই যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
দেশটা স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭ সালে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭২ এই দীর্ঘ পঁচিশ বছর
পরিবেশ, বায়ুমণ্ডল, জলাভুমি, স্থল ভাগ ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য বাস্তবিক
অর্থে কোনও আইনই প্রনয়িত হয় নি। ফলে যা হওয়ার, তাই হয়েছে। সাংখ্য-দর্শনে ‘পুরুষ’ ও ‘প্রকৃতি’ এই দুটো ধারনার উল্লেখ রয়েছে, তারই সুত্র ধরে লিখতে হয়, ঐ সময়টুকুতে যথেচ্ছ ভাবে প্রকৃতির উপর
পুরুষের উপর্যুপরি অত্যাচার হয়েছে। আবার, এস ওয়াজেদ আলীর কথা ধার করে আজকের দিনে বলতে হয়… ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে’…!
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে পত্র-পত্রিকায় ‘গান্ধিবাগ-সাপনালা-শহিদ স্মৃতি
উদ্যান’ নিয়ে বেশ কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছে, এবং হচ্ছেও। শহর শিলচরের বুকে এককালে একটা প্রাকৃতিক জলাশয় ছিল। বছর দশেক হল, সেটা ভরাট হয়েছে। চারতলা মল, শপিং কমপ্লেক্স, ফাস্ট
ফুড সেন্টার ইত্যাদি হয়েছে সবই। এ সবই হয়েছে কিন্তু
প্রকৃতির মতামত না নিয়ে, প্রকৃতির
বিরুদ্ধে। স্বভাবতই প্রকৃতি
তার নিজ ভঙ্গিমায় প্রতিবাদ জানানো শুরু কুরে দিয়েছে। তিন বা চার ফুট পুরু রড-কঙ্ক্রিটের ঢালাই ভেদ করে জল চলে আসে, মলের নিচতলায়,
গাড়ী রাখার স্থানে। এটা শুধু একা নিবন্ধ লেখকের অভিজ্ঞতা নয়, আপনাদের অনেকেরই নিশ্চয় একই অভিজ্ঞতা রয়েছে ! মলের
নিচতলায় গাড়ি রেখে মলে ঢোকার আগে পায়ের জুতো-জোড়া পুরোপুরি ভিজে যায়। আরও কিছুদিন পর হয়ত, এক-দেড় ফুট জল সেখানে থাকাটাও অবান্তর কিছু নয়। শহর–মাতৃকা
ভয়ে ভয়ে রয়েছেন, হয়ত বা মনে মনে প্রমাদ গুনছেন... এক রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব
দোসর...!
দোসর এই কারনেই যে এক পা এগিয়ে ‘গান্ধিবাগ-সাপনালা-শহিদ স্মৃতি উদ্যান’
নামক কফিনে প্রথম পেরেকটা গ্যাঁড়ে দেওয়া হয়েছে এই কদিন আগে, ৫ই সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ
এবছরের শিক্ষক দিবসে! ডঃ দীপঙ্কর দেবনাথ নামক পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক প্রাক্তন
ছাত্র বছর দুয়েক আগে একটা আর-টি-আই করে রাজ্যের শিক্ষা বিভাগে জানতে চেয়েছিলেন যে অসমের কতটা স্কুল-কলেজে পরিবেশ-বিদ্যা বাধ্যতামুলক ভাবে পড়ানো হয়। উত্তর এল ‘৩৬০টা’। পরবর্তী
আরেক আর-টি-আই করে তিনি একই দপ্তরে জানতে চাইলেন, ঐ স্কুল-কলেজগুলোর মধ্যে কতটাতে পরিবেশ শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। এবার উত্তর এল, ‘শূন্য-টা’। তার মানে এই দাঁড়াল যে, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের সরাসরি
নীতি-নির্দেশিকা থাকা সত্বেও পরিবেশ শিক্ষার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা
কুম্ভকর্ণের কালনিদ্রায়! এহেন পরিস্থিতিতে ‘ সবুজ-ধরিত্রি-মাতা’ কি সুবিচার আশা
করতে পারেন?
অতীতের সিঁড়ি বেয়ে পেছনের দিন গুলোর কথা অবলম্বনে লিখতে হয়, গান্ধীবাগ নামটি হওয়ার আগে, সাপনালা নামটি এসেছে। প্রয়াত ঐতিহাসিক ডঃ দেবব্রত দত্তের লিখায় এর উল্লেখ রয়েছে।
সেখানে উল্লেখ রয়েছে, প্রয়াত কামিনী কুমার চন্দের উদ্যোগে ‘স্টেশন কমিটি’ থেকে শিলচর
মিউনিসিপালিটি উন্নীত হয়েছিল, আজ থেকে ১২৭ বছর আগে, অর্থাৎ ১৮৯৩ সালে। প্রয়াত
চন্দ, ১৮৯৪ সাল থেকে দীর্ঘদিন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শিলচর মিউনিসিপালিটির ভাইস-
চেয়ারম্যান পদে ছিলেন যদিও, কিন্তু আক্ষরিক অর্থে চেয়ারম্যানের সব কাজই উনাকে
সামাল দিতে হতো।
সার্কিট হাউস- টাউন ক্লাব- ডি,এস,এ-পুলিশ প্যারেড গ্রাউন্ড ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে গোটা এলাকাটিই
ব্রিটিশ সাহেবদের অধীনে ছিল, এবং ভারতীয়দের
ঐ এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। আজকে যেখানে ‘গান্ধিবাগ-সাপনালা-শহিদ স্মৃতি উদ্যান’ রয়েছে, ঐ সম্পূর্ণ এলাকাটি তখন
ছিল একটি জলাভুমি । সেটা ১৯১৩ সাল, প্রয়াত কামিনি কুমার চন্দের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই জমি টুকু ব্রিটিশ দের কাছ
থেকে নতুন ভাবে হওয়া মিউনিসিপালিটির জন্য অধিগ্রহন করেন। প্রাথমিক ভাবে ঐ স্থানের বেশী অংশটুকুতে বক্রাকার সাপ-নালা খনন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে গান্ধীজীর নিধনের পর উনার চিতাভস্ম এনে
এখানে রাখা হয়েছিল। তাই পরবর্তী নাম
হয়েছে গান্ধীবাগ। চিতাভস্মের বাকি
অংশ মধুরামুখে বরাক নদীতে বিসর্জন করা হয়েছিল, তাই মধুরাঘাটের নাম, গান্ধীঘাট। ঐতিহাসিকদের মতে, পবিত্র এ স্থানগুলো বরাক উপত্যকার ‘হেরিটেজ সাইট’
হিসেবে ঘোষণা করার দাবি রাখে।
সাপ নালার ধারে পাশের অপেক্ষাকৃত উঁচু এবং সমতল জায়গায় তৎকালীন বন বিভাগের আধিকারিক (Conservator
of Forests) জনৈক দত্ত মহাশয় এবং কামিনী কুমার চন্দ এই দুইজনের যৌথ
উদ্যোগে কোলকাতার শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে বিভিন্ন প্রকারের
মুল্যবান গাছ এবং ঔষধি বৃক্ষের চারা এনে এই স্থানে রোপণ করা হয়েছিল। এ সবই আজ অতীত। পরবর্তীতে দশকের
পর দশক ধরে ক্রমবর্ধমান অবহেলার শিকার হয়েছে এই স্থান। ইংরেজিতে একটা কথা চালু আছে, Give the dog a bad name, and then kill it. সাপ নালা-গান্ধীবাগের
ক্ষেত্রে সম্ভবত এটাই ঘটতে চলেছে !
শহর শিলচরের মাস্টার প্ল্যান যেটা রয়েছে, সেখানে
সম্প্রসারিত শহর একদিকে কাশীপুর, আর অন্যদিকে
শ্রীকোনা, আর ওদিকে সোনাবাড়ীঘাট এবং এন আই টি ছাড়িয়ে প্রায় শিলকুড়ি পর্যন্ত রাখা
আছে। খবরে প্রকাশ, বরাক উপত্যকায় একটা ছোট খাট চিড়িয়াখানা এবং পশু পুনর্বাসন
কেন্দ্র হবে। সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে জানা গেল, এদের
কোনোটাই শহরের ঐতিহ্য নষ্ট করে করা হবে না, বরং, শহুরে কোলাহলের বাইরেই
থাকবে। কক্ষনও পত্র-পত্রিকার এটা চোখে পড়ে নি, যে গৌহাটির ‘দিঘলি-পুকুরি’-কে
সংস্কারের নামে বিনির্মাণ করা হবে। তেজপুরের অগ্নি-গড়-এর ক্ষেত্রেও তা হবে না। ঐতিহ্য
সংরক্ষনের জন্য আপোষহীন মানসিকতা রয়েছে বলেই সেসব জায়গায় তা কক্ষনো হবে না। ‘একোল্যান্ড’
নামের জলকেলি তো গৌহাটিতেও রয়েছে, তবে তা রানী
যাওয়ার পথে, গাড়ভাঙ্গা নামক স্থানে, শহর থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দূরে।
শহর এলাকার উন্নয়নের জন্য ভারত সরকারের টাউন এন্ড কান্ট্রি প্লানিং বিভাগের আরবান
প্লানিং গাইডলাইন, ২০১৪ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্দেশ মেনে প্রতিটি শহরে মাথাপিছু ৯ বর্গমিটার সবুজ খোলা জায়গা রাখার বিধান রয়েছে এবং এটাও বলা
হয়েছে যে শহরের প্রতিটি নাগরিকই যেন মিনিট পনেরো হাঁটলেই সেরকম একটা জায়গায় গিয়ে
পৌছাতে পারেন। শহর অঞ্চলে যান বাহন এবং সুউচ্চ দালান-বাড়ী থেকে যে তাপ নির্গত হয়ে
উষ্ণমণ্ডলের (Heat Island) সৃষ্টি হয়, সেটাকে শুষে নেওয়ার
জন্যই এই প্রেসক্রিপ্সন। আন্তর্জাতিক ষ্ট্যাণ্ডার্ড মতে প্রতি ১০০০ জনসংখ্যায়
১.৬২ হেক্টর খোলা জায়গা থাকা আবশ্যক। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে এটা যথেষ্ট
সন্তোষজনক (অর্থাৎ ১.৯% থেকে ৪৬%)। এ দেশেরও বিভিন্ন শহরে (যেমন বেনারস, চণ্ডীগড়,
জয়পুর, ভূপাল, এলাহাবাদ, এবং নয়ডা) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত শহরে মাথাপিছু ৯ বর্গমিটারের অনেক বেশী সবুজ
খোলা জায়গা রয়েছে। আমাদের প্রিয় শহর শিলচর, এই পরিসংখ্যানের ধারে কাছে আসার
প্রশ্নই উঠে না ! এ দিকটায় যে বা যারা নজর দেবেন, তাঁরা কে বা কারা ?
আরবান প্লানিং গাইডলাইনের নির্দেশিকায় একদিকে যেমন যথেষ্ট পরিমানে ‘আরবান গ্রিন স্পেস’ রাখার
প্রণিধান রয়েছে, ঠিক তেমনি আরবান অর্থাৎ শহরের সবুজ এলাকা এবং পথের ধারে কি কি
প্রজাতির গাছ লাগানো উচিত তার সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, নিম, আমলকি,
মহুয়া, সিসাম বা শিশু-গাছ, আম, শিরীষ ইত্যাদি বর্ষা-বৃক্ষ
(Rain tree) লাগাতে হবে, এবং ইউকেলিপ্টাস তথা অন্যান্য কাটা জাতীয়
গাছ লাগানো বারন করা হয়েছে। দুটো গাছের
মধ্যে ন্যুনতম দুরত্ব ১০ থেকে ১২ মিটার রাখা উচিত বলে উল্লেখ রয়েছে, এবং তা
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলা হয়েছে, যাতে করে গাছগুলো বড় হলে পর দুটো গাছের
চন্দ্রাতপের (Canopy) মধ্যে ফাঁকা জায়গা থাকে, নতুবা এক
গাছের জন্যও অন্য গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা। প্রস্তাবিত ‘গান্ধিবাগ-সাপনালা-শহিদ স্মৃতি উদ্যান’ স্থানের বিনির্মাণের জন্যও যেহেতু
এক হাজার গাছ (লতা কিম্বা গুল্ম জাতীয় নয়) লাগানোর কথা পত্র পত্রিকায় বলা হয়েছে,
সে প্রসঙ্গে কোনও কিছ বললে বলতে হয় যে তার জন্য ৬২ বিঘা জমি দরকার। ন্যুনতম ১০ মিটার ফাঁক রেখে
গাছ লাগালে, এবং ঐ এলাকায় যদি অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র গাছই লাগানো হয়, তাহলে
১৭ বা ১৮ বিঘা জমিতে সাকুল্যে ২৭৮ বা ২৯১টা গাছ লাগানো যেতে পারে। আরবান প্লানিং
এর নিয়ম মেনে এর চাইতে বেশী গাছ লাগানো কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। স্বভাবতই প্রশ্ন থেকে
যায়, সবুজায়নের জন্যও এক হাজার লাগানোর গল্পটা তাহলে মিলছে কোথায় ? এটা কি তাহলে গল্পের সেই চতুষ্পদী জন্তু... যেটা গাছে চড়বে...?
সবাইকে নিয়ে সবার উন্নতি হোক, এই মন্ত্রটাই তো আজকের দিনে
চালিকাশক্তি। এই আপ্তবাক্যটি যদি শিরোধার্য করা যায়, তাহলে মনে হয় ভালো থাকার মন্ত্রটা আমাদের
শহরবাসীর হাতেই থাকবে। এটাকেই পাথেয়
করে ‘গান্ধিবাগ-সাপনালা-শহিদ স্মৃতি উদ্যান’ –এর
প্রকল্পটার বিষয়ে শহরের নাগরিকদের নিয়ে একটা গনসমাবেশ করা যেতেই পারত। নাগরিকরা
যেহেতু পূরসভার করদাতা, অতএব, এ বিষয়টিতে তাদের নিজ নিজ সুচিন্তিত মতামত পেশ করার
অবকাশ তখন থাকতো। সুস্থ গনতন্ত্রে এটাই তো কাম্য। শহরের অভিবাবকরা সময় মত সে পথ
মাড়ান নি কেন, বিষয়টা ধন্ধে থেকেই গেল...!
(বিভিন্ন তথ্যসুত্র তথা বিশিষ্ট সুধিজনের বিভিন্ন তথ্য
আলেখ্যটিতে ব্যবহৃত হয়েছে, সবার প্রতি রইলো কৃতজ্ঞতা ।)