দিগন্ত শর্মা |
(দিগন্ত শর্মা,
সাদিন কাগজের সাংবাদিক এবং অনুসন্ধানী লেখক। এর আগে তিনি ‘ নেলি
১৯৮৩’ নামে
একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন লিখেছিলেন তিনি। বর্তমান অনুবাদক সেটি বাংলাতে অনুবাদ করেছিলাম। দু’টিই আগে পরে
বই হিসেবে বেরোয়। সেই বইতে মূলত ধরা হয়েছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু তথা মুসলমানদের উপরে নেমে আসা আক্রমণের ছবি। এবারে বাঙালি হিন্দুর উপরে কেমন অত্যাচার
নেমে এসেছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে তিনি ঘুরেছেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পূব থেকে পশ্চিমে। আর লিখছেন এই নিবন্ধ।
ধারাবাহিক ভাবে এটি এই ব্লগ ছাড়াও প্রকাশিত হবে, আরো দুই একটি ব্লগে এবং ছাপার
অক্ষরে বেরুবে শিলচর থেকে প্রকাশিত চন্দন সেনগুপ্ত সম্পাদিত মাসিক ‘অরুণোদয়ে’। লেখকের
সঙ্গে কথা বলতে চাইলে যোগাযোগ করুন, এই নম্বরে: ৯৮৫৪৬-৩১৯২৮। )
( মিছিলা নমশূদ্র) |
মূল অসমিয়াঃ দিগন্ত শর্মা
বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর
প্রস্তাবনা
১৯৭৯এর প্রথম
ভাগে অসমের মঙ্গলদৈ লোকসভা সমষ্টির সাংসদ হীরালাল পাটোয়ারির আকস্মিক মৃত্যু হয়। সে
বছরের শেষের দিকে আসনে উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন আয়োগ। একই সঙ্গে ঐ
বছরের এপ্রিল মাস থেকে ভোটার তালিকাতে নাম ভুক্তির কাজ আরম্ভ করে। মে’ মাস
অব্দি এই ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ অব্যাহত ছিল। কিন্তু মে’মাসের
প্রথম সপ্তাহে ভোটার তালিকাতে প্রচুর অবৈধ বিদেশীর নাম ঢোকে গেছে বলে এক অভিযোগ
উত্থাপিত হয় । বলা হয়, কংগ্রেস (আই) দল
নিজের ভোট ব্যাঙ্ক শক্তিশালী করতে কৌশলে সন্দেহজনক
নাগরিকের নাম ভোটার তালিকাতে ঢুকিয়েছে। এই
অভিযোগ উত্থাপন করে পুরো আসাম কাঁপিয়ে তোলে ‘সারা
আসাম ছাত্র সংস্থা’। এর আগে অসমে বিদেশী অনুপ্রবেশ থেকে
শুরু করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে সারা আসাম ছাত্র সংস্থা, সংক্ষেপে
‘আসু’ বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচী রূপায়ণ করে আসছিল। অন্যদিকে সংসদে তখন ভারতীয়
জনতা পার্টির নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ী ১৯৭৯র আগেই অসম সহ সমগ্র পূর্বোত্তরে
বাংলাদেশীদের অবাধ অনুপ্রবেশ হচ্ছে বলে বক্তব্য রেখেছিলেন। সেই বক্তব্য অসমের
একাংশ সচেতন ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্র সংগঠনের
নেতৃত্বকে আন্দোলনমুখী করে তোলে। এর আগে ‘আসু’ মুখ্যমন্ত্রী গোলাপ বরবরাকে কয়েক
দফা দাবি সম্বলিত স্মারকপত্র প্রদান করেছিল। এমনকি তারা প্রধানমন্ত্রীকেও সত্তর
দশকের মধ্য ভাগ থেকেই নানা দাবিতে স্মারকপত্র দিয়ে আসছিল। কিন্তু কেন্দ্রের সরকার
সেই সব সমস্যা সমাধানের জন্যে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেয় নি। ১৯৭৭এ জরুরি অবস্থার পরে
কেন্দ্রের সরকার বদল হলো। অসমেও সরকার বদল
হলো। একই সময়ে অত্যন্ত শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন সারা আসাম ছাত্র সংস্থারও নেতৃত্ব
বদল হলো। ‘আসু’র নেতৃত্বে এলেন
প্রফুল্ল কুমার মহন্ত এবং ভৃগু কুমার ফুকন।
মঙ্গলদৈ লোকসভা আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্থাপিত বিদেশী নাগরিকের
প্রশ্নটিকে ‘আসু’ নেতৃত্ব বড় করে
তোলে ধরলেন। মঙ্গলদৈ লোকসভা চক্রে ভোটার তালিকাতে বিদেশী নাগরিকের নাম অন্তর্ভুক্ত
হয়েছে বলে নির্বাচনী আয়োগের কার্যালয়ে হাজার হাজার অভিযোগ পত্র প্রেরণ করে।
নির্বাচনী আয়োগ সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষাও করেন। গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে নির্বাচন
আয়োগও এই সব অভিযোগ-পত্রের ৬৪.২৮% সত্য
বলে ঘোষণাও করে। অর্থাৎ আয়োগ স্বীকার করে নেয় যে প্রায় ৪৫,০০০
ভোটার এই চক্রে সন্দেহজনক নাগরিক।
মিছিলা নমশূদ্র |
এই ঘটনা পুরো
আসামকে উত্তেজিত করে তোলে। মঙ্গলদৈর ঘটনাকে আধার করে ‘আসু’
দাবি তোলে সারা রাজ্যের ১৩টি লোকসভা আসনের ভোটার তালিকাই
প্রকাশ করতে হবে এবং বিদেশী নাগরিকের নাম সেগুলোর থেকে বাদ দিতে হবে। মঙ্গলদৈর ঘটনা রাজ্যের ভূমিপুত্র এবং
মধ্যবিত্তদের একাংশকে উত্তেজিত এবং আবেগিক করে তোলে। তাদের বিদেশী বহিষ্কারের
দাবিকে আসামের আরো কিছু জাতীয় সংগঠনও সমর্থন জানায়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ থেকে অসমে
প্রব্রজন অব্যাহত আছে বলে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। ১৯৭৯তে ‘আসু’র নেতৃত্বে বিভিন্ন দল-সংগঠনের এক
সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সর্বদলীয় সভাতে সারা আসাম গণ-সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হয়।
‘আসু’র নেতারাই এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। অসম সাহিত্য সভাও এই সংগঠনে সামিল হয়।আসুর সভাপতি
প্রফুল্ল কুমার মহন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এক স্মারক পত্র প্রেরণ করেন, যেখানে
অসমে অস্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিসংখ্যা তুলে ধরা হয়। এর পরেই আরম্ভ হয়
আন্দোলনের কর্মসূচী---প্রতিবাদী মিছিল, বন্ধ, গণ-সত্যাগ্রহ ইত্যাদি ইত্যাদি...।
দিগন্ত শর্মার আগেকার বইএর বাংলানুবাদের প্রচ্ছদ |
দিল্লিতে সরকার
বদল হয়। ইন্দিরা গান্ধি আবার রাজপাট দখল করেন। দিসপুরে বারবার সরকার গঠন এবং পতনের
ঘটনা ঘটে। ‘আসু’র বিদেশী কেন্দ্রিক আন্দোলন সারা রাজ্যকে উত্তাল করে তোলে। সংগঠিত
হয় নানা হিংসাত্মক ঘটনা। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারী নেতৃত্বের
কয়েক দফা বৈঠক হয়ে যায়। কিন্তু এই সব আলোচনা-বৈঠক সমস্যার কোনো সমাধান
করতে পারল না। আন্দোলনকারী নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি হলো
না। ফল-স্বরূপে অসম থেকে এই বিদেশী বিতাড়ন বা বহিষ্কার এক জ্বলন্ত সমস্যা রূপে
মাথা তোলে। আসু, গণ-সংগ্রাম পরিষদ তথা আন্দোলনকারী নেতা, কর্মী, সমর্থকেরা বিদেশীর
বিরুদ্ধে নিজেরাই ব্যবস্থা নিতে গোপনে শলা-পরামর্শ করতে শুরু করে। ‘বিদেশীরা আছে
কই?’ ‘বিদেশী কারা?’ ‘ বিদেশী প্রধান অঞ্চল কোনগুলো...?’ এসব কথার ব্যাপক গুঞ্জন
ওঠে। একাংশ লোক ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বাঙালি হিন্দু এবং মুসলমান বসতি-প্রধান
এলাকাগুলোই বিদেশীর বাসস্থান বলে চিহ্নিত
করে। সেই প্রব্রজনকারী বা আভ্যন্তরীনভাবে
স্থানান্তরিত (internally
displaced) মানুষ যে এলাকাগুলো দখল করে বসতি স্থাপন
করেছিলেন সেই এলাকাগুলো দখলমুক্ত করবার জন্যে একাংশ নেতা-কর্মীদের গোপন
আহ্বান ছড়িয়ে দেয়া হয়। আন্দোলনের সমর্থক হাজার হাজার মানুষ এই সব
‘বিদেশী’দের তাড়িতে দেবার জন্যে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন, কোথাও বা তা
হিংসাত্মক আকারও নেয়। একই সঙ্গে ‘আসু’, গণ-সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্ব প্রশাসনযন্ত্রকেও
অচল করে দেবার জন্যে বহু গোপন বেআইনি কর্মসূচী শুরু করে। এরই মধ্যে ইন্দিরা গান্ধি
নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারি মাসে অসম বিধান সভার সাধারণ
নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৭৯র থেকে বেশ কবার অসম রাষ্ট্রপতি
শাসনাধীনও ছিল। সেখানে কেন্দ্রের কংগ্রেস (ই) সরকার নির্বাচন করবার সিদ্ধান্ত নিলে
তাকে প্রত্যাহ্বান জানিয়ে উচ্চতম ন্যায়ালয়ে আবেদন করা হয়। ন্যায়ালয় সেই আবেদন ১
ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রত্যাখ্যান করে। ইন্দিরা গান্ধি সঙ্গে সঙ্গে যে সব কর্মচারী
নির্বাচনের কাজে অংশ নেবেন তাদের জন্যে
গ্রুপ ইন্সিওরেন্সের সুবিধে দেবার কথা ঘোষণা করেন। আর ঐ ১ ফেব্রুয়ারির থেকেই অসম
পরিণত হয় এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। জাতীয় সংগঠনগুলোর বিরোধিতাকে অবজ্ঞা করে ইন্দিরা
গান্ধি নির্বাচনী প্রচারও করেন। অসমের ভূমিপুত্রের (খিলঞ্জিয়া) একাংশ এই
নির্বাচনকে অবৈধ আখ্যা দেন। আন্দোলনকারীরা নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানান।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অধিকাংশ মানুষ এই আহ্বানকে সমর্থন জানান। পুলিশ ফাঁড়ি ঘেরাও,
রাস্তা-ঘাট বন্ধ, সেতু জ্বালিয়ে দেয়া ইত্যাদি আরম্ভ হয়। পুলিশের গুলিতে বেশ কিছু
ছাত্রনেতার মৃত্যুও হয়। রাজ্যের পরিস্থিতি হয়ে পড়ে অগ্নিগর্ভ। ওদিকে বাঙালি
অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ
নামাবার গোপন পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। অসমিয়ার অস্তিত্ব রাখতে অসমকে বিদেশী
মুক্ত করতেই হবে। তারজন্যে
বিদেশী তাড়াতে হবে। ‘আহ আহ ওলাই আহ! খেদ ঐ খেদ , বিদেশীক খেদ!’ স্লোগানে মুখরিত হয়
আকাশ। কিন্তু কোথাকার বিদেশী তাড়াবে? কিছু
নেতারা বিভিন্ন জেলার চরঅঞ্চল, বনাঞ্চল, গ্রেজিং এলাকা, পতিত ভূমি, সরকারি খাস
জমিতে বসবাস করা বাঙালি হিন্দু –মুসলমানকে বিদেশি বলে শনাক্ত করে সেই এলাকাগুলোতে পরিকল্পিত ভাবে আক্রমণ নামাতে
শুরু করেন। মঙ্গলদৈ
চাউলখোয়া চরঅঞ্চল, নগাঁও (এখনকার মরিগাঁও) জেলার নেলি অঞ্চল, মৈরাবাড়ি, কামপুর,
চামগুড়ি, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর, চমরিয়া, নলবাড়ির মোকালমোয়া, দরং জেলার
খৈরাবাড়ি-কলাই গাঁও ইত্যাদি জায়গাতে আন্দোলনকারীরা নৃশংস আক্রমণ নামায়। সেরকম এখনকার ধেমাজি জেলার (তখনকার লখিমপুর জেলা) বিষ্ণুপুর, শান্তিপুর ইত্যাদির বাসিন্দা হিন্দু বাঙালিদের উপরে
ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ থেকে ধারাবাহিকভাবে ভয়াবহ
আক্রমণ নেমে আসে। অসমিয়া এবং
জনজাতীয় হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে অত্যন্ত নির্মম এবং জঘন্য আক্রমণ নামায়
শিলাপাথারের কাছে ‘আর্নে’ বলে এক বিশাল চরঅঞ্চলে। সেই নিরীহ বাঙালিরা বিদেশী
বহিষ্কার আন্দোলনে সৃষ্ট সংঘাতময় পরিবেশের
কেমন বলি হয়েছিলেন, সেই সংঘাতের আগেকার এবং পরবর্তী প্রব্রজন (Migration) বা স্থানান্তরণ (Displacement) পরিস্থিতি, সংঘাত পরবর্তী ন্যায় ব্যবস্থার এই সব
মানুষের জীবনে কী রকম প্রভাব ফেলেছে, পরবর্তী কালে শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে এই সব
নির্যাতিত মানুষের ভূমিকা কী ছিল... অগ্নিগর্ভ ১৯৮৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে সারা
আসামেই বাঙ্গালিরা কী রকম নির্যাতিত হয়েছিলেন---ক্ষেত্র-ভিত্তিক অধ্যয়ন করে এই
লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।
(এক)
সবুজ
আর্নে চরের রক্তাক্ত অধ্যায়
ছেঁড়া পা ছুঁয়ে মিছিলা নমশূদ্র নীরবে কাঁদছিলেন |
‘সেদিন সকালে
উঠে বাড়িতে এটা ওটা করছিলাম। ছেলেমেয়েরা উঠোনে ছিল। ওদের বাবা একবার ঘরে যান,
আরেকবার আসেন। গ্রামের বুঝদার মানুষেরা দিন দুই আগেই ধেমাজির দিকে অনেক বড়
গণ্ডগোলের কথা শুনেছিলেন। সেদিনও আমাদের
গ্রামের উত্তর দিকে অনেক হৈ হট্টগোল কানে আসছিল। কোথায় কী হচ্ছে---কিছুই ধরতে
পারছিলাম না। কিন্তু হঠাৎই সকালে সকালে আমাদের গ্রামেও চিৎকার চেঁচামেচি,
হুলস্থূল, কান্নাকাটি, মার ধর আরম্ভ হয়ে গেলো। হাজার হাজার লোকে ঘিরে ফেলল আমাদের
গ্রাম। ওদের হাতে দা, বর্শা, বল্লম, বন্ধুক, তির-ধনুক, লাঠি আর জ্বালানো মশাল...।
গ্রামের লোকেরা পালাতে শুরু করলে যাকে যেখানে পেলো কোপাতে শুরু করল। আক্রমণকারীদের
কেউ বা লাঠি দিয়ে মারল, কেই তির ধনুকে, কেউ বা বন্দুক দিয়ে গুলি করল। আমি বাড়ির
উঠোন থেকে ছেলেমেয়ে দুটোর হাতে ধরে প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিলাম। আমার স্বামী আর বড়
মেয়ে রীণাও দৌড় দিল। কিন্তু সেরকম দৌড়োচ্ছি যখন তখনি অস্ত্র হাতে লোকগুলো আমাদের
ঘিরে ফেলল। ওদের কেউ একজন আমাকে লম্বা একটা ডেগার দিয়ে ঘা বসালো। ঘাটা আমার পায়ে
লেগে পা একটা দুই টুকরো হয়ে গেলো। হাঁটুর নিচের টুকরোটি ছিটকে দূরে পড়ে গেলো আর
আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।” কথাগুলো বলে মিছিলা নমশূদ্র নামের পঁয়ষট্টি বছরের মহিলা
থামলেন কিছুক্ষণ। শাড়ির আঁচলে দুই গাল বেয়ে নামা চোখের জল মুছলেন। খানিকক্ষণ তিনি
মাথা নত করে রইলেন। একটি পিড়িতে বসে কথা বলছিলেন তিনি। এইবারে তিনি দুই হাতে শাড়ি
কুঁচকে বাঁ পা দেখালেন ---‘এই দেখুন...’
মিছিলা নমশূদ্র
যখন আমাদের কথাগুলো বলছিলেন কচি কাঁচা ছেলে মেয়ে, যুবক যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা পাশে
দাঁড়িয়ে বসে সব কথাই শুনছিলেন। কিছুক্ষণ সবাই নির্বাক হয়ে পড়লেন। নীরবতা ভেঙ্গে
আমরাই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার পরে কী হলো?’
‘তারপরে আমি সেখানেই পড়ে রইলাম। পরে গ্রামের অন্য
মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে এলেন স্বামী। জ্ঞান যখন ফিরে এলো, আমার
অবশিষ্ট পাটুকু কাপড়ে বাঁধা ছিল। অসহ্য ব্যথায় আমি ছটফট করছিলাম। এরই মধ্যে আমি
স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম ছেলেমেয়ের কথা। তখনই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন।
বললেন, আমাদের বারো বছরের ছেলে বিজয় আর ছয় বছরের মেয়ে শ্রীমতীকে ঘাতকেরা কেটে মেরে
ফেলেছে। আমি যেখানে পড়ে ছিলাম, সেখানেই বুঝি বিজয় আর শ্রীমতীরও মৃতদেহ পড়ে
ছিল। স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, বড় মেয়ে
রীণা কই? তিনি বললেন, রীণার (১৬) হাতে দায়ের ঘা পড়েছে, পিঠে একটা তির বিঁধেছে। ওকে
মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে হয়তো ওরা মৃত বলে ভেবেছিল, ছেড়ে চলে গেছে। আমার পা কাটার
যন্ত্রণা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল এই সন্তান হারাবার দুঃখ, এরপরে স্বামী আমাকে ভৈরবপুর আশ্রয় শিবিরে নিয়ে এলেন...।’
‘ঠিক
মনে নেই। কিন্তু এটা মনে আছে---আমার এই পা আর সন্তানকে কেড়ে নিয়ে গেছে অসমিয়াদের
যে আক্রমণ সেটি ঘটেছিল ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারি মাসে। মানে ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহে।
সেদিনটির পরে আর আমি স্বামী ছাড়া নড়াচড়া করতেই অক্ষম হয়ে গেলাম। এদিকে আমাদের বাড়িঘরও আক্রমণকারীরা জ্বালিয়ে
ফেলেছিল। আশ্রয় শিবির থেকে প্রথমে লখিমপুর হাসপাতালে, পরে ডিব্রুগড় হাসপাতালে থেকে
মাস ছয়েক চিকিৎসা করালাম। এর পরে গ্রামে
যদিও বা ঘুরে এলাম বছর না ঘুরতেই হঠাৎই একদিন আমার স্বামী নরেশ নমশূদ্রের মৃত্যু হলো। বাড়িতে পড়ে রইলাম সেই
দাঙ্গাতে পঙ্গু আমি আর আমার কন্যা। আমার পা নেই, আর কন্যা রীণার আহত হাত। উঃ কী যে
যন্ত্রণা...!’
ছেঁড়া
পা ছুঁয়ে মিছিলা নমশূদ্র নীরবে কাঁদছিলেন। তাঁর বয়স এখন ষাট পার করেছে। ৩২ বছর আগে
বিদেশী বিতাড়নের নামে অসমিয়া জাতির
অস্তিত্ব রক্ষার নাম নিয়ে হাতে কর্মে একাংশ বাঙালির উপরে যে হিংস্র আক্রমণ সংঘটিত
হয়েছিল, তারই সাক্ষী হিসাবে আজও ধেমাজি জেলার শিলাপাথার থানার অন্তর্গত আর্নে রামনগর গ্রামে আছেন মিছিলা নমশূদ্র। স্বামীর মৃত্যুর পরে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে
পড়েছিলেন মিছিলা। কিন্তু আন্দোলনকারী দায়ের ঘায়ে আহত কন্যা রীণাকে স্থানীয় এক তরুণ
বিয়ে করে, মিছিলার দৈনন্দিন জীবনের চালিকা শক্তি এখন সেই মেয়ে জামাইই। দুখানি ক্র্যাচ দু’দিকে ধরে কোনোক্রমে চলাফেরা
করেন মিছিলা। প্রতিমুহূর্তে তাঁর ছেঁড়া পা তাঁকে মনে করিয়ে দেয় অসমিয়া জাতির
সংগঠিত সেই নৃশংসতা আর বর্বরতার কথা। শুধু যে এই মিছিলা নামের মহিলাটির বেলা, তাই
নয়। বৃহত্তর আর্নে চর অঞ্চলে মিছিলা নমশূদ্রের সেই ছিন্ন পাখানি এখন অসমিয়া
উগ্রজাতীয়তাবাদের নির্মম ঘৃণনীয় তথা নারকীয় অধ্যায়ের জ্বলন্ত সাক্ষ্য। মিছিলা যখন ক্র্যাচ
দু’খানাতে ভর করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ান, তখনই যেন গ্রামবাসীর
(সে সময়ের ভুক্তভোগী) চোখে ভেসে উঠে নৃশংস সেই সব আক্রমণের ছবি।
পক্ষের শূন্য কপাল |
আর্নে রামনগর
গ্রামে মিছিলা যখন আবেগ বিহ্বল হয়ে অসমিয়া ভাষী স্থানীয় জনজাতি মানুষের সেই
আক্রমণের কথা বর্ণনা করছিলেন তখন কাছেই বসে ছিলেন আরেক মহিলা। মিছিলার কথা শেষ হবে
হচ্ছে করতেই সেই মহিলা বলে উঠলেন, ‘ সেই আক্রমণের দিনটিতে আমার বিয়ের মাত্র সাতদিন
হয়েছিল। আগের রবিবারে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। পরের রবিবারে আমরা আক্রান্ত হলাম। আমাকে
আর্নে রামনগরে বিয়ে দিয়েছিলেন। দুদিন আগেই গেছি স্বামীর ঘরে। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে
একদিন কাটাতে না কাটাতেই সেই আক্রমণ নেমে এলো...’
মহিলাটি কথা
থামালেন। খানিক সবাই নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপরে বড় কষ্টে আটকানো গলাতে মহিলাটি
বলে গেলেন, ‘ সেদিন আমার সামনেই স্বামীকে হত্যা করল ওরা। আমাকেও আক্রমণকারীরা
মারতে আসছিল। স্বামী আমাকে দৌড়ে পালাতে বলে নিজে ওদের বাধা দিতে দৌড়ে গেলেন। দুই
পা দৌড়ে গেছি কি পেছনে ফিরে দেখি, আমার স্বামীকে কোপাচ্ছে ওরা। উনি গড়িয়ে পড়ে
গেছেন, সেই শরীরে লাঠি দিয়ে ঘা দিচ্ছে।
তারপরে কিছু লোকে আমাদের বাড়িতে আগুন দিল।
আমি দৌড়ালাম। ইতিমধ্যে গ্রামের মানুষজনও দৌড়োচ্ছে প্রাণ বাঁচাতে। আমি দৌড়ে
দৌড়ে প্রাণ বাঁচালাম। কিন্তু আমার সিঁথির সিঁদুর হারালাম। বিয়ের মাত্র সাতদিন
পরেই। আমাদের সামনেই মহিলাটি হুহু করে কেঁদে ফেললেন। আমরা দেখে গেলাম শুধু---তাঁর
দুই গাল বেয়ে নামছে চোখের জল। দেখে গেলাম, তাঁর শূন্য কপাল। গেল তিনটা দশক তিনি
পার করেছেন এই দুঃখের বোঝা বয়ে বয়ে। বিয়ের
সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ষোল। নাম তাঁর পক্ষ নমশূদ্র। আর্নে রামনগরের উপেন্দ্র
নমশূদ্রের বাইশ বছরের ছেলে মাণিক নমশূদ্রের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পক্ষের। মিছিলার
ছিন্ন পা, পক্ষের শূন্য কপাল---অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদী , অসমের অস্তিত্ব রক্ষার
নামে সংগঠিত ঘাতক বাহিনী এই সমাজকে দেয়া ‘নির্মম উপহার’ ।
(ক্রমশ:)
~~~~~~~ ০০০~~~~~~~~~
লেখাটি আর যেখানে পড়া যাবেঃ
১) http://sushantakar40.blogspot.in/2015/05/blog-post.html
২) http://swabhimanngo.blogspot.in/2015/05/blog-post_28.html
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন