“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ১৩ মে, ২০১৫

সুরমা গাঙর পানি --ভাটি পর্ব ৫

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার পঞ্চম  অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)


  

           বাবুদের ভাষায় সিলেটকে শ্রীহট্ট বলতে পারে না বৈতল । জোড়া জোড়া অক্ষর দিয়ে বানানো শব্দ যেন কিছুতেই হাটেমাঠে জলের আঁশটে গন্ধে মানানসই হয় না । তবে হ্যাঁ সিলেট বড় সুন্দর । সুরমা নদীর চান্নিঘাটও দেখতে বড় মনোরম । ঘাট থেকে উঠেই সোজাসোজির পথের উপর এক মস্ত ঘড়ি , বলে আলি আমজদর ঘড়ি । সিলেটের সুন্দর চান্নিঘাটর সিঁড়ি আর আলি আমজদর ঘড়ি । দুটোই বৈতলের কাছে নতুন , এত মনোরম নদীর বাঁধানো সিঁড়ি দেখেনি , আর ঘড়িতো দেখেইনি জীবনে । নদীর উপর ধনুকের মতো একটা লোহার পুল এর ওপারে ইস্টিশন । কিনপুল পেরিয়ে এপারে পড়লেই বন্দরবাজার জিন্দাবাজার আর কালীঘাটে শুধু মানুষের ভিড় , দোকানপাটের হল্লা । শহরে নাকি গাড়ি ঘোড়া প্রচুর থাকে , সিলেটে গাড়ি খুব কম , ঘোড়ার গাড়িতে সুন্দর সুন্দর মানুষ যায় , সালু কাপড়ের ঝাঁঝরঘেরা গাড়িতে যায় বড় বাড়ির বৌঝিরা । সাইকেল চড়ে মানুষ , কিনপুলের উপর পিলপিলিয়ে সাইকেল চলে । সাইকেল দেখে লোভী বৈতলের লোভ হয় একটা হাতিয়ে নেওয়ার । সিলেটের ছোট ছোট গলি মহল্লাগুলি ঘুরে বেড়াতে সাইকেল খুব কাজের জিনিস । তবু এমনি হেঁটে হেঁটে সব রাস্তায় ঘুরেছে বৈতল । সিলেটের পাড়াগুলিও তাদের গ্রামের মতো , বইয়াখাউরিতে কোনও পাকা সড়ক নেই, সিলেটের পথগুলি সব ছবির মতো । নদীর পারে চালিবন্দর শেখঘাট থেকে দরগা মহল্লা । শাহজালালের দরগায় গিয়ে বৈতল মায়ের জন্য নতুন করে দোয়া প্রার্থনা করে । আগের বার মৌলভীবাজার থেকে পানি  পড়া নিয়ে বলেছিল শাহী ইন্দারার জল । মসজিদ দেখে তো বৈ তল অবাক , এত বড় দরগা সে দেখেনি জীবনে । কী বিশাল ডেকচি , ডেকচিতে বিরিয়ানি বানায় । বিশাল বিশাল সব গজার মাছকে ছোলা খাওয়ায় , পিরের কাছে মিনতি করে দোয়া কর দাতা , আমার মারে বালা করি দেও । বাসুদেব বাড়ির প্রাঙ্গণে হরিবোলের সংকীর্তনে মেতে ওঠে । জলে ঘেরা ভাটির দেশের বৈতল প্রাণভরে দেখে সিলেটের গলি । মাছুদিঘীরপার তোপখানা কাজির বাজার কাষ্টঘর জামতলা আর অনেক দূরের শুঁটকির বাজার মাছিমপুর । মাছিমপুরের বেপারিদের সঙ্গে দরদাম করে , জেনে যায় পাইকারদের লাভ । এবার বাপের সঙ্গে ভাড় করে নিয়ে আসবে সোজা মাছিমপুর । হেঁটেও আসতে পারে , মাছিমপুর বাজার লাগোয়া সুরমানদীর ঘাটও আছে । নৌকো করেও আসা যায় । বৈতলের মাথায় অন্যচিন্তা , সাইকেল করেও তো আসতে পারে , দুচাকার সাইকেলে অনেক মাল উঠানো যাবে । তিন চাকার এক আচানকি সাইকেলও আছে সিলেট শহরে , সওয়ারি টানে । মেয়ে বিবিদের নিলে ঘোড়ার গাড়ির মতো শাড়ি কাপড়ের ঝাঁঝর বেঁধে দেয় , বলে রিক্সা । রিক্সা অনেক বড় , নিয়ে যাওয়া যাবে না বইয়াখাউরি । কিন্তু সাইকেল একটা চাই তার , বায়স্কোপ একটাও দেখবে । একটা টিংটিঙে লোক টিনের চোঙ মুখে লাগিয়ে তুফান মেল তুফান মেল হেঁকে যাচ্ছে , তার পিছনে আর একটা লোক বাঁশের চাটাইএ সাঁটা এক কাগজ বাঁশে বেঁধে নগর সংকীর্তনের মতো ঘুরছে , কাগজের ছবিটা চেনে , কাননবালার , তুফান মেল সিনেমা । টকি হাউসে দেখানো হচ্ছে । টকি হাউসে এসে কেন যে মনটা দোটানায় পড়ে । বাপের ধাত পেয়েছে বৈতল , একসঙ্গে অনেক কাজ করা পছন্দ করে না বাপ । বলে, দুই নাও চড়ে , উফিনত অইয়া মরে । কোথাও একটা হারামজাদাও জুড়ে দেয় বাপ । এখানে এই সিলেটের বিদেশে বৈতল বায়স্কোপ দেখা বাতিল করে , হলের সামনে হাম্বার সাইকেলটাই দেখে । লুলা বলেছিল সিলেটের পথে ঘাটে পয়সা , কই কোথাও ছড়ানো কিছু পায় নি বৈতল । সাইকেলটাই একমাত্র রয়েছে অনেকক্ষণ মালিকহীন । যেই ভাবনা সেই কাজ । সাইকেলের চাকায় যে তালা লাগানো থাকে জানে না বৈতল । তালা ভাঙলেও চড়ে যে পালাবে সে উপায় নেই , চালাতেও তো জানে না । পুলিশই ধরে সরাসরি । পেটি কেসএ চালান হয় বৈতল । পুলিশ নাম বলতে বলে , বৈতল বলে লুলা দাস , গ্রাম মিরাশী, পরগনা খিত্তা । সব উল্টোপাল্টা বলার বুদ্ধি তার আছে । নাম লেখে না , টিপসই করে । ছেড়ে দেয় জজ , দুদিনের হাজতবাস তো হয়েই গেছে । জজের পেশকার ছাড়ে না , নিয়ে আসে বাড়ি । বিনা পয়সার বেগার শ্রমিক ।

      বৈতল দাড়িয়াপাড়ার পেশকার বাড়ি থেকে সোনার মাকড়ি নিয়ে পালায় সাতদিনের মাথায় । পেশকার কামিনী দাম-এর মেয়ের কানে জ্বলজ্বল করে সোনার গয়না । বইয়াখাউরির তুলসীতলায় সন্ধ্যাবেলা বাতি জ্বালে বৈতলের মা । মাটির প্রদীপে আলোকিত মায়ের মুখখানা বড় সুন্দর দেখে বৈতল । বাবুর বাড়ির মেয়েটির মুখখানিও বড় মিষ্টি , ফর্সা । নাম বুড়ি ।

পাশের বাড়ির শ্যামলা মেয়ের নাম হাসি । কপাল দোষে বৈতল বুড়ির বাড়ি গরুরাখালি করে । ভুলের প্রায়শ্চিত্ত । সারাদিন গরুর পিছনে ঘুরে পুকুরে পড়ে সন্ধ্যেবেলা । আর পলায়নের ফন্দিফিকির আঁটে । পালিয়ে গেলে একটা দুঃখ থাকবে বৈতলের , বুড়িকে আর দেখতে পাবে না সকাল সন্ধ্যা । পুকুর পারে খেজুর আর আমলকি গাছের নিচে জলে ভাসতে ভাসতে পরনের গামছা দিয়ে ছোট ছোট মাছও ধরে দেয় প্রতিদিন । বলে একদিন বড়মাছও ধরে দেবে, ঘাঘট । পেশকার হাসে, বৈতল বুঝে বিদ্রূপের হাসি । এইটুকুনি ছেলের কর্ম নয় । বৈতল জানে একপাল রিটা আছে পুকুরের মাঝখানে । হাসলে পরে আর তুলবে না মাছ । ডুব দিয়ে মনকে শান্ত রাখে বৈতল । ডুব থেকে উঠে শোনে বুড়ি আর হাসির খিলখিল । রোজ আসে এই সময় । বুড়ি বন্ধুটিকে নিয়ে বাড়ি যায় না । শানে বসে হাসে , আর আমলকি কুড়িয়ে খায় । আজলায় জল তুলে মুখে দেয় । একজনের খাওয়া ফল অন্যজন খায় । বৈতল ওদের অকারণ কথা, হাসি শুনে উদাস হয় । লুলার কথা মনে পড়ে । হিংসে হয় , মনে মনে বলে, তারও বন্ধু আছে । কালো মেয়ে হাসি অনেক গল্প জানে । বলে,

--- ছাতক থাকি দেখা যায় এক পাহাড় । পাহাড়ের নাম সেরা । সাহেবে কয় চেরা ।

--- ছি ছি কিতা কছবে ছেরা নি ।

--- না বে, চেরা , চেরাপুঞ্জি । দুনিয়াত সব থাকি বেশি বৃষ্টি অয় । অউ পুঞ্জির এক রাজা আইছিল ছিলট । চান্নিঘাটর সিড়িত বইয়া খুব অ্যাওলা খাইত বেটায় আর ঘাট তানি পানিও খাইত । খাইয়া কয় অলা মিঠা । আবার খায় অ্যাওলা , আবার খায় পানি । পুঞ্জিত তো অ্যাওলাও নাই পানিও নাই । বন্দরবাজার থাকি তিনশ পঁয়ষট্টিটা পিতলর কলসি বানাইয়া মিঠা পানি লই গেল বেটায় পুঞ্জিত । আবার আইব কইছে এক বছর পরে । অলা আড়ুয়া ।

--- অউ নি তর গপ । ইতা হুনছি । অখন গান শুনাইলা একটা ।

    পেশকারের মেয়ের গানের গলাও মিষ্টি । হাসির অনুরোধে গায় কানন বালার গান , আমি বনফুল গো । দুই বন্ধুর জলসায় বৈতল খাপটি মেরে শোনে শুকসারির গান ,

--- বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের রাই আমাদের ।

কালো মেয়ে হাসি একটু ছটফটে । শুকশারি শেষ হতেই ধরে অন্য গান ।

---পুবেতে বন্দনা রে পুবে ভানু করিয়া রে

   পশ্চিমে বন্দনা রে- মক্কা মদিনা রে

    ইশ্‌ কী মশারে বুড়ি তোর পুকইরো ।

--- ভালাউ অইছে তরে কামড়াইছে । অখন ইতা মক্কা মদিনা গাওয়ার সময় নি ।

 মক্কা মদিনা হউক নবদ্বীপ বৃন্দাবন হউক কেউ মাঝপথে গান থামিয়ে দিলে রাগ হয় বৈতলের । পুকুরের জলে লুকিয়ে না থেকে এবার সেও ধরে গান,

 --- হাওরর মাঝে আকালুকি বন্দিরে

       মাছের মাঝে রউ আর চিতল রে

       মই এক অধম রে নাই কুনু গেয়ান রে

       কী শুনাইমু আমি মুখমতি রে

       তে যদি দয়া করি রে আউলা ঝাউলা কথা রে

  দুই সখীকে অবাক হওয়ার সময় না দিয়েই পনের বছরের বৈতল মান্যগন্য বড় মানুষের মতো বলে,

--- তিন হাঞ্জার সময় তোমরা পুকইরো বই রইছ কেনে । মশায় ধরত কেনে, বাঘেও ধরত পারে । ভূতে ধরলে আমি কিন্তু ভাগমু ।

ধলা বুড়ি বৈতল থেকে বড় না হলেও পাকামির ভাব আছে নামের মতো । বলে,

--- তোরেও তো ধরতে পারে ।

বৈতল বলে,

--- আমারে ধরত নায় । আমি মাছুয়া । মাইমল ।

--- মাইমল । তুই বাঙাল নি ।

--- না, আমি পাটনি । পাটনি আর মাইমল একতাউ । গরিবর ইন্দু বাঙাল নাই ।

--- তেউ । মাইমল পাটনি অইলে কিতা ।

--- মাইমলরে ভূতে ধরে, মশায় ধরে না ।

--- ধুর বেটা পগা ।

--- পগা কইলায় নি আমারে । তে হুন এক পরস্তাব । এক বিটলা বুড়ায় কইছলা ।

--- কিতা  কইছলা ।

--- জালুয়া হকলে তো রাইত জাগিয়া মাছ ধরইন । আর উঙ্গাইন । মাছর মুড়ি চাবাইয়া খাওয়ার সময় মনো করোনি মাইমলর কষ্ট । বানে পানিয়ে মশার কামড়ে তারা তুমরার পাতো গজ পেটি আর মুড়ি উঠাই দেয় । তারার কষ্ট কেউ হুনে না । তারা একজনরে একবার পাঠাইলা মা মনসার কাছে । হে কইল গিয়া আইরে , হুনো বেটি , তুমি অইলায় মহেশ্বরর বেটি, তুমার আর কিতা । তুমি আমরারে দেখতায় পারো না । তুমি আমরার আসল মা নায় , তুমারে চন্দ্রধরে বাউ হাতে ফুল দেয় , চেঙ মুড়ি কানি কয় , ঠিক অউ । বিষরিয়ে তো হক্কলতা বুঝইন , কইলা , কিতা অইছে ক । হে কইল, আমরা রাইত জাগিয়া মাছ ধরি আর আমরার খালি ঘুম পায় , মাছ না ধরলে খাইতাম কিতা, খাওয়াইতাম কিতা তুমার বাবু হকলরে । পারলে আমরার ঘুম কমাই দেও । আমরার লগে থাকি থাকি মা বেটিও পেরত অই গেছিল , বগলো কমরো মাটি , কাম নাইতে খালি ঘষে । ঘষি ঘষি সোনার অঙ্গর জিলকানি বার করে । মার আতো আছিল তখন কমরর মাটি এক চিমটা । মাইমলর আতো দিলা , কইলা , যা রে পুত গাইল্লাইছ না, ঘুম কমব । অউ থাকি মশার জন্ম , এক চিমটা কালা মাটি আরি । তার পরে আর কিতা, পাটনির গাত তো মশা বইবউ । কও ?

 বুড়ির বন্ধু হাসি খুব খুশি হয় । বলে,

--- বাক্কাউতো কিচ্চা কয়, পুয়া ইগু কিগুরে ।

--- তুমি আমারে চিন না, আমি তুমারে চিনি ।

--- কচাইন আমি কে ।

--- তুমি আমারে দেখি হাস নি ।

--- না, আমি হাসি না ।

--- অউত্ত তোমার নাম ।

--- ধুর বৈতল । ইগু কিগু কছ্‌না বুড়ি ।

--- গাইল্লায় লায়নি ।

   বৈতল সচেতন হয় । তার নাম রহস্য নিয়ে মজা করা যাবে না । সে এখানে লুলা , লুলা দাস । আর তখনই পেশকার বাড়ির বুড়ি আলদের লেজ মাড়িয়ে দেয় । বন্ধু হাসিনাকে বলে,

--- কেনে দেখছচ নানি । ইগু চুর । অখন আমরার চাকর ।

    তখনই বুড়ির কানের  মাকড়ি দুটোর সোনারঙে আগুন ধরে । কেউটের বিষ নামিয়ে আনে বৈতল জিভে । বলে,

--- চুর কারে কছ । চাকর কারে কছ । চাকর তো তোর বাপ, হাকিমর গোলামি করে, আবার বড় বড় মাত । তোর কিতা বেটি অত ফুটানি ।

    সোনারবরণী মেয়ের দুই কান ছিঁড়ে মাকড়ি নিয়ে ভাগে বৈতল । সিবিল হাসপাতালের পাঁচিল টপকে দৌড় । দে দৌড় । দৌড়ে গিয়ে ঝপাং চাননি ঘাটের সুরমা নদীতে ।

চলবে
< ভাটি পর্ব ৪ পড়ুন                                                  ভাটি পর্ব ৬ পড়ুন >


কোন মন্তব্য নেই: