।। শিবানী দে।।
বছরের পর বছর
কেটেছে, কেউ জেনেছে তাদের কথা, কেউ বা জানেনি । সেই সময়ে, যখন নিরক্ষরতাই সামূহিক ছবি, অক্ষরপরিচয় মুষ্টিমেয়, শিক্ষিত
অঙ্গুলিমেয়, সেই সময় তারা এত বড় কাণ্ড ঘটিয়েছিল । ভাষা---- যে শব্দটার মানেও বেশির ভাগ লোকে জানত না, কেন তারা বাঙালি--- সেই প্রশ্নটার উত্তর ও জানত না, সেই রকম সময়ে সেই ভাষার জন্য কতকগুলো পাগল ছেলেমেয়ে আত্মোৎসর্গ করেছিল ।
তাদের আত্মত্যাগের ফলে ভাষা আমাদের হয়ে থাকল ।
কিন্তু অত্যাচারীর অত্যাচার থামে কই ? ৬১র পর ৭২ । আবার ৮৬ । বার বার পরীক্ষা
দিতে হয়েছে, পরীক্ষা দিয়েছে আমাদের হয়ে আরো কিছু তরতাজা প্রাণ । পুলিশের গুলিকে ভয়
পায়নি, বুক পেতে দিয়েছে। সেই স্পিরিট আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাবার
কথা। কিন্তু ঢোকেনি ।
ভাষা আমাদের থাকল, বললাম । কিন্তু আমরা রেখেছি কি ?
ইংরাজি তো জীবিকার
জন্য শিখতেই হয়, অন্যান্য ভাষাও শিখতে হয় । কিন্তু কথায় কথায় মাতৃভাষা
ছেড়ে অন্য ভাষায় কথা বলার দরকার আছে কি? কথায় কথায় নিজের সংস্কৃতি ,
ভাষা, ঐতিহ্য ভোলার
অভ্যাস বোধ হয় বাঙালি ছাড়া আর কারও নেই । বাঙালি যত
তাড়াতাড়ি অন্যের সংস্কৃতি, অন্যের ভাষা রপ্ত করে, তত তাড়াতাড়ি আর কেউ পারে না ।
আমার নিজের হালের অভিজ্ঞতার কথাই
বলি । কিছুদিন আগে বরাক উপত্যকায় গিয়েছিলাম । করিমগঞ্জ থেকে শিলচর
যাচ্ছিলাম ট্রেনে । সহযাত্রী এক ভদ্রলোক, ধরুন ক-বাবু, তাঁর সঙ্গী ভদ্রলোক (ধরুন খ-বাবু) -এর সঙ্গে হিন্দিতে গল্প করছিলেন । খ-বাবুকে দেখতে চা-বাগানের শ্রমিক-শ্রেণির বলে মনে হচ্ছিল, এধরণের লোকজনের দেখা বরাক উপত্যকায় হামেশাই মেলে । তারা অনেক বছর ধরে এ অঞ্চলে থাকার ফলে বাংলা বলতে
বুঝতে পারে,
তাদের ছেলেমেয়েরা অনেকেই বাংলা স্কুলে পড়ে । মাঝে মাঝে সেই ভদ্রলোক, মানে খ-বাবু, বাংলায়ও দু-একটা কথা বলছিলেন । ওঁর কথাবার্তায়
কিছুটা ভারিক্কি চাল । হয়তো এলেমদার লোক । ক-বাবু
তাঁর অন্য ধারে
বসা গ-বাবুর সঙ্গে ওদিককার চলতি বাংলাই বলছিলেন, বোঝা যাচ্ছিল
তাঁরা ওদিককার বাঙালি । কিন্তু খ-বাবুর সঙ্গে তিনি কিছুতেই বাংলা
বলবেন না, উনি জানলেও না । যদিও ক-বাবু এবং খ-বাবু দুজনেরই হিন্দি তেমন একটা উঁচুদরের নয়,আমার অভিজ্ঞতায়
সেটা মেঠো, ক-বাবুরটা তাও ভাঙ্গা ভাঙ্গা ।
তারও আগের আরেকটা
অভিজ্ঞতা--- রুমিনাথকান্ডের জেরে সেবার বরাক বন্ধ, আমাকে শিলচরে পুরো ৩৬ ঘণ্টা কাটিয়ে কলকাতার
উড়ান ধরতে হবে । যে হোটেলে উঠেছি,সেখানে রিসেপশনের ভদ্রলোক বাংলায়ই কথা
বলছিলেন, কিন্তু বেয়ারাদের কোন কিছু জিগ্যেস করলে, বা ওদের দিক থেকে
কিছু বলবার হলে ওরা হিন্দিতে কথা বলছিল । সেই ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দি,
বাংলা উচ্চারণে ।
ঠিক জানিনা, ওদের ধারণা হয়তো ছিল যে শিলচরে হোটেলে কোন মহিলা একা থাকলে সে বাঙালি হতে পারেনা
। বন্ধের পরদিন সকালে প্রাতরাশ সারতে সামনেই একটা রেস্তোরাতে গেলাম
। সেখানে আরো আচম্বিত ! রিসেপশন থেকে বেয়ারা সবাই অসমীয়াতে কথা বলতে লাগল , যদিও আমি স্পষ্ট বাংলায়ই অর্ডার দিয়েছিলাম । ওরা কিন্তু নিজেদের মধ্যে বাংলাই বলছিল । ধরে নেওয়া যেতে পারে ওরা আমাকে অবাঙালি ভেবেছিল, কিন্তু বাংলা কথার
জবাব বাংলায় দেবেনা, এটা তো মানা যায় না ।
স্কুল-পাঠ্য বইতে
বানানে ভুল, বাক্যে ভুল, বহুলপ্রচলিত সংবাদপত্রেও ভুল, শুদ্ধ করে ভাষাটা শেখার বা শেখাবার প্রয়োজন কেউ বোধ করে না,
হয়তো বা জানেও না । ভাবনাটা যেন--- বাংলা শিখে কোন চতুর্বর্গ উদ্ধার হবে ? তার চাইতে হিন্দি ভুল হোক শুদ্ধ হোক দু-চারটি বুলি ঝাড়ো, কথায় কথায় দু-চারটে ইংরাজি শব্দ ফোড়ন দিয়ে
দাও, স্মার্ট বলে লোকে
পাত্তা দেবে । ভুল হোক শুদ্ধ হোক, অসমিয়া বলতেই হবে, শাসকের অনুগ্রহ নাহলে তো জীবন চলবে না । বাংলার
কোন দরকার নেই । অসমিয়ার সঙ্গে অসমিয়া বল, হিন্দিভাষীর সঙ্গে হিন্দি, বাংলার অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কোন গুরুত্ব নেই । তবে সেটাই কি ঠিক ? আমার তো মনে হয়, যে জিনিষটা নেই সেটা হল আত্মসম্মান । আত্মসম্মান থাকলেই সে নিজ ভাষার, সংস্কৃতির, আত্মজনের, দেশের সম্মান রাখতে এগোয়, যে আত্মসম্মান রাখতে আমাদের শহিদেরা প্রাণ দিয়েছিল ।
নিকট আত্মীয়রা
দেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে আছে বলে, স্বামীর এবং কিছুটা নিজের কর্মসূত্রে, এমনি বেড়ানোর জন্য ও, আমি দেশের অনেক জায়গায় ঘুরেছি, থেকেছি । স্বভূমিতে
মাতৃভাষা ছাড়া অন্যভাষায় আগ বাড়িয়ে কথা বলার এই প্রবণতা বাঙালি
ছাড়া আর কারো মধ্যে দেখতে পাই না। পশ্চিমবঙ্গেও এই প্রবণতা রয়েছে । আমার ব্রহ্মপুত্র
উপত্যকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে ওখানে অসমিয়ারা অনেকেই বাংলা জানে, বুঝতে ও বলতে পারে
। বাংলায় কিছু জিগ্যেস করলে, বাসে, ট্রেনে, হোটেলে অনেক সময়ই বাংলায় উত্তর পাওয়া যায়
। কিন্তু প্রথমত অসমিয়াতেই কথা বলে । অন্য কোথাও আগ বাড়িয়ে কেউ বাঙ্গালির সঙ্গে বাংলা, বিহারির সঙ্গে হিন্দি, মালয়ালির সঙ্গে মালয়ালি বলতে যায় না। প্রথম যে যার মাতৃভাষায়ই কথা বলে। কিন্তু বাঙ্গালির মনে কেন পরের বুলির প্রতি এত মোহ বুঝতে পারিনা । এরা ভালভাবে না জানে নিজের ভাষা, না জানে অন্য ভাষা ।
শহিদেরা হয়তো আকাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন