সে তো আজকে নয়
প্রিয়তম প্রাণেশ্বরী ইত্যাদি প্রীতির ছায়ামাখা সম্বোধনে
লেখা হয়েছে তখন প্রেমপত্র । এবং শেষে ব য় রফলা, ব্রজমোহন কিংবা ব্রজেশ্বরের
আদ্যক্ষর । প্রমথর প য় রফলা । হেমাঙ্গিনীর হে । তন্ময় এত পুরনো নয়, তাই লেখে
তোমারটি । সেটিও বাতিল হয় মল্লিকার প্রশ্নের জবাব জুতসই না হওয়ায় । মল্লিকা লেখে,
কার টি । দুরকম অর্থের দোদুল্যমান প্রতিবাক্যে তন্ময় জানায়, তোমারটি, আবার কার ।
সেই চিঠি থেকেই নিজেকে বদলে নেয়, লেখে, ইতি তোমার তন্ময় । সম্বোধনে রদবদল হয়, লেখে
প্রিয় মল্লিকা কখনও মল্লি । প্রথমে লিখিত কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা । মল্লিকাকে
অনুরাগে বিশেষিত করা রবীন্দ্রনাথ সহায় । সেসব কথা, কথার দলিল । আর্য ফ্যাক্টরির
তোরঙ্গ থেকে বাছাই করা পুরোনো নতুন ক’খানা প্রত্যয়িত দস্তাবেজ গুছিয়ে রাখে গোদরেজ
সিন্দুকের রাঙামাটিতে । সেই সময়ের প্রিয় সড়কে ভ্রমণ যে তার নিত্যদিনের । পথের
দুপাশে নতুন করে বনবীথি সাজায় তন্ময় । যা ছিল তা দিয়ে, যা নেই তাও থাকে
নবনির্মাণের কর্মশালায় ।
সুখ সময়ের
মনোকথা পড়ে তন্ময় । কার্বন কপি থেকে উদ্ধার করে সংস্কারের সম্বোধন, প্রিয় মল্লি ।
মানে কয়েকবছরের পুরোনো হয়েছে সম্পর্ক ।
‘তোমার শেষ
চিঠিতে বেশ কাব্য করে লিখেছিলে মেঘের বাহনে চড়ে চলে আসবে আমার কাছে । তুমি তো দেখি
কালিদাসের বিরহের গাড়ি উল্টোদিকে চালিয়ে দিলে । এরকম হয় না, এখন পূর্বমেঘ চলছে,
ম্যাপটা ঠিক হোক তারপর তো চড়ে বসবে । না হলে যে কোথা থেকে কোথা যাবে । আর গেলেই
হল, কোথায় যাবে আমাকে ছেড়ে । আমি যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না এক মুহূর্ত । কোশিশ
ছবির সঞ্জীব কুমার জয়া ভাদুড়ি আমরা । কথা বলতে পারি না দূরে আছি বলে, ইশারা পাঠাই
। সংকেত লিখি ।
আমি কোথায় থাকি
জানো । দেশের নাম মণিপুর, জনপদ থানলন । একটা চার্চের গায়ে ডাকঘর আমার । ইম্ফল থেকে
চুড়াচাঁদপুর চার ঘণ্টার বাসপথ । ওখানে থাকতে হবে একরাত । মাঝখানে বিষুণপুর ।
মণিপুর নিয়ে দুরকম মণিপুরির দাবি, একপক্ষে বলে তাদের রাজধানী বিষ্ণুপুর । ডানদিকের
পথে না গিয়ে সোজা এগোলেই মইরাং । নাম শুনেছ হয়তো, আইএনএ সেনাবাহিনী নাগাপাহাড় দিয়ে
মইরাঙে ঢুকছে । ওখানে আছে নেতাজির পূর্ণাবয়ব মূর্তি, আইএনএ স্মারক, ইত্তেহাদ,
ইতমাদ, কুরবানি । আছে জাদুঘর । আরও একটা কিছু আছে এখানে, লোকতাক হ্রদ সত্যি তাক
লাগিয়ে দেয় । হ্রদের জলে মানুষের গ্রাম, মাছের সংসার আর পরিযায়ী পাখি । একদিন
ভোরের বেলা তোমার সঙ্গে বেড়াতে যাব স্বর্গপুরীর হ্রদের পারে । উল্টোপথ হয় যদিও,
বয়স কম তো, একটু ঘোরাঘুরি হয় । আবার পথ সোজা করতে পিছিয়েও যেতে হয় । চুড়াচাঁদপুরে
বিরতির পর গমন আবার । পথের বর্ণনা তো কালিদাস দিয়েছেন । দিনের শেষে উত্তরিবে এসে
গির্জাবাড়ির ডাকঘরে, পাহাড় চূড়ায় । এখানকার স্থানীয় মানুষরা সিম্তে একটি পাহাড়ি
জনগোষ্ঠী । আরও কত আছে, পাইতে, মার, মিজো, নাগা । ইশাই ধর্মাবলম্বী সবাই । ইশুকে
ওরা ডাকে লালপা । আমাকেও ডাকে ঈশ্বর পুত্রের ডাকনামে । তুমি যেমন বলতে যৌবনের
রবীন্দ্রনাথ । রোগা পটকা লোকটাকে রবীন্দ্রনাথ বলায় মিট্মিটে সুখ পেয়েছি । আমার
দাড়ি আরও দীর্ঘ হয়েছে । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা খুব মনে পড়ে, এখানে মেঘ সরমার
মত চরে । সরমা মানে কুকুর । গাভীটাভি নেই এদেশে । এখানে মাংস বলতে কুকুর আর শুয়োর
। সারাবছর মেঘ আমার মতো বিরহী হয়ে পথ হাঁটে । ঝমঝমাঝম মিলন হয়, আমার হয় না ।
খাবারে কোনো বৈচিত্র নেই, পাহাড়ে কুকুর শুয়োর ছাড়া ডাল ভাত গেঁড়ি আর ইম্ফল
চুড়াচাঁদপুর থেকে নিয়ে আসা রাই সর্ষের হলদে হয়ে যাওয়া পাতার সবজি, বলে লাইপাতা ।
সহকর্মী দুজন মণিপুরি, ওসব খাওয়া আমিও খাই । ওখানকার আদিবাসীরা আমাদের বলে
ইন্ডিয়ান । আর, সিম্তে মেয়ে একটি আছে মারিয়া । ওর কিচেনে রাত হলে গ্রামের ছেলেরা
জড়ো হয়, গিটার বাজিয়ে গান গায় । ওর দোকানে অনেক রকম পানীয় । আমাকে চা খাওয়ায়
মারিয়া, আমার সঙ্গে নাচে । গান গাইতে বলে, গাই ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ , সুরেও
লাগে, সবাই কোরাসে গায় বাংলা না জেনেও । মারিয়া তোমার মতো অনেকটা, এত প্রেমিক তবু
নিঃসঙ্গ সে । আমাকে মনের কথা বলে, বলে এক ভারতীয় তার মনের মানুষ । কে সে বলেনি ।
রহস্য করে কী বলতে চেয়েছে বুঝিনি । তোমার যৌবনের রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে ফেলেনি তো
। তার লালপা । মারিয়াকে ভাল না বেসে থাকা
যায় না । তোমার কথা বলিনি ওকে । যদি প্রবাসের রাতগুলি আমার ব্ল্যাকআউট করে দেয়,
সেই ভয়ে ।’
তন্ময় চিঠি
লেখে কার্বন কপি করে । এক হপ্তা ধরে চিঠি লেখা । সর্বক্ষণ সঙ্গে থাকে মল্লিকা ।
কথা বলা শুধু, কাগজে কলমে । ডাকঘরে তো অন্য কাজ নেই । রবিবারে গির্জাঘরে উৎসব হয়,
গ্রামের টাটকা সবজি নিয়ে আসে ভক্তজন, ইশুকে উৎসর্গ করে । এত এত সবজি দিয়ে কী হবে,
পাদ্রি ব্রাদার অনেকটাই বিক্রি করে দেয় । তন্ময়ও কেনে । সারাদিন তো শুধু রান্না
করা, মেঘ দেখা আর চিঠি লেখা, এই তো কর্ম । রানার যেদিন আসে সেদিনই কাজ । সপ্তাহে
একদিন আসে কাঁধে বৃষ্টিরোধক চটের থলি নিয়ে । কোনদিন খইদঙ কোনদিন রঘুমণি । ফেরার
ডাকে তন্ময় ঢুকিয়ে দেয় তার ব্যাক্তিগত চিঠি । মাকে দাদাকে দু-একজন বন্ধুকে লেখা
চিঠি দেয় ডাকব্যাগে । শুধু মল্লির চিঠিতে শেষ থাকে না, ডাকটিকিটও না । বিয়ারিং
হওয়ার ভয় নেই, হাইলাকান্দি প্রধান ডাকঘরের চাকুরের কাছ থেকে তো আর শুল্ক নেবে না
বিভাগ । মল্লিকার কাছে চিঠি লেখাও একটা লাগাতার বিষয় । তাই শেষ থাকে না । সাময়িক
বিরতির একটা নাম দিয়ে, খামে ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দেয় । কখনও কখনও তোমার তন্ময় লিখতেও
ভুলে যায় । খইদঙ কিংবা রঘুমণির ঘণ্টি বেজে উঠলেই মন আনন্দে নেচে ওঠে । গুণচটের
থলিতে যে আছে সাতরাজার ধন মানিক, মল্লিকার চিঠি । ফেরার সময়ও ঘণ্টি বাজিয়ে যায় ।
বল্লমের ফলার কাছাকাছি কাঁধে থাকে ডাক পেটিকা । আর একটি ছোট পেটিকা থাকে কোমর
কশিতে, ডাকহরকরার ব্যাক্তিগত সম্পত্তি । দশাসই চেহারার খইদঙ যখন নেমে যায় জঙ্গলে
মনে হয় দৌড়বীর নামছে হাজার মিটার দৌড়ে । নিমেষে হারিয়েও যায় জঙ্গলের সুন্দর ।
সুকান্ত কবিতার পত্রদূত অবিকল । শম্ভু
ভট্টাচার্যর নাচ দেখিনি তন্ময় । দেখিনি মুকুন্দ ভট্টাচার্যর রানারও । তবে শুনেছে
এখনও, এই সত্তর বয়সেও যুবাপুরুষ নেমে পড়েন মঞ্চে রানার নাচতে । মল্লিকা সন্দেহ করে
তন্ময়কে, জানতে চায় কী করে জানে এত সমাচার । সে তো কলকাতার ছেলে । শিলচর যায়নি
জীবনে, মুকুন্দদাকেও দেখেনি । তন্ময় জানায়,
‘শিলচরের শিখা
দত্ত কাজ করে ইম্ফল জিপিওতে । ওদের একপাড়ায় বাড়ি, মুকুন্দদাদের । এপার ওপার
রাস্তার উল্টোদিকে হেমলতা প্রেসের গলিতে বাড়ি । বলেছে সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিবেশ
বাড়িতে । কেউ গানে কেউ নাচে পারদর্শী । ভাই অনন্ত ভট্টাচার্য লোকগানের ভাণ্ডারী,
কয়েক হাজার গানের সংগ্রাহক । শিখার মতো মেয়ে হয় না বুঝলে, মণিপুরি গান গায়, নাচে,
নাটক করে । স্বামী মণিপুরের বিখ্যাত নাট্যব্যাক্তিত্ব । সারা ভারতব্যাপী নামডাক ।
একদিন গেলাম কোয়াকাইথেলে ওদের নতুন বাড়িতে । শিখা আমার সঙ্গে সিলেটি ভাষায় কথা
শুরু করে । আমি কিছুই বুঝতে পারিনি । কথাটা তোমায় বলি ‘হিদল খাইবা নি, ইরম্বা’
শিখার ধারণা আমি সিলেটি । আামার পদবি নাকি সিলেটি ছাড়া হয় না । আমি জানি ।
জন্মসূত্রে আমি সিলেটি বটে কিন্তু ভাষা জানি না । জন্ম কলকাতার ঝামাপুকুর লেনে,
দেব সাহিত্য কুটীর-এর গলি, শুকতারা শিশুসাথীর বাড়ি । শিখা একটু থেমে যায় অপ্রতিভ ।
বলে এরকম শুঁটকি মাছের সিলেটি নাম হিদল, হিদলের সঙ্গে শুকনো লংকা কাঁচা সবজি কিছু
কন্দ মিলিয়ে ভাপে তৈরি মণিপুরি ব্যঞ্জন ইরম্বা । ‘খাইবা নি’ র অর্থ খাবেন তো ।
খেয়েছি শিখার প্রলোভনে । পচাই মাছের গন্ধে আমার অনিচ্ছাকে পাল্টে দিয়েছিল মেয়েটি ।
খেয়ে সাবান দিয়ে মুখ ধুয়েছি দুদিন । এরপর থেকে শিখার বাড়িতে পরিচিত বাঙালি খাদ্যই
পরিবেশিত হয়েছে । শিখার স্বামী ঐনাম তোম্বা থাকে দিল্লিতে, ন্যাশনাল স্কুল অফ
ড্রামার শিক্ষক । প্রতিবেশী আমিও যাই নিত্যদিন, বিদেশি বিভূঁইয়ে একা রমণীর একমাত্র
বাঙালি ভরসা, বন্ধু । শিখা একদিন... পরে লিখব । রানার এসেছে ।’
এরকম
ডটচিহ্নের মজা করে তন্ময় । ঈর্ষা জাগানিয়া শূন্যস্থান পূর্ণ করতে দেয় মল্লিকাকে ।
পুরোনো চিঠি পড়তে পড়তে তন্ময় হাসে । আসলে মল্লির সাদা মনে কাদা নেই, তন্ময় যা বলে
তা-ই বিশ্বাস করে । কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় বিশ্বাস করেছিল সূর্য পৃথিবীর চারদিকে
প্রদক্ষিণ করে । প্রমাণও দিয়েছিল তন্ময় । কলকাতার প্রতিটি ল্যাম্পপোষ্টে, ফুটপাঠের
স্কার্টিঙে লেখা ছিল এখনও যেমন আছে । নইলে রানারের কথা বিশ্বাস করে । ইম্ফলে রানার
কোথায়, রাণারের দেশ থানলন থেকে কবে সরে এসেছে । তবে এও সত্য এরকম এক একটি
চিঠিবোমার পর মল্লি অনেকদিন চুপ করে থাকে । চিঠি লেখে না । মল্লিকার চিঠি না পেলে
তন্ময়ও ডাকে দেয় না তার দৈনিক বর্ণদূত । একবার তো একসঙ্গে তেষট্টি পাতার পার্শেল
পাঠিয়েছে হাইলাকান্দি প্রধান ডাকঘরে । নয় হপ্তা কোনও চিঠি লেখেনি মল্লি অভিমানে ।
তন্ময়কেই মান ভাঙাতে হয়েছে লাইটনিং ডাকে, লক্ষ্মীবাজার বাড়িতে তো টেলিফোন নেই, পাশের
বাড়ির নম্বর জোগাড় করে ডাক পাঠাতে হয়েছে । বড়সড় ফাঁকির স্তোকবাক্যে ভুলিয়েছে ।
মল্লিকাকে খুশি করতে বলেছে চাকরি ছেড়ে এবার হাইলাকান্দি চলে আসছে পাকাপাকি, কিছু
একটা জুটিয়ে নেবে । তন্ময় এরকম মিথ্যে বলে, মল্লিকা ভাবে সত্যি । সত্য জেনে আবার
অভিমান হয়, তন্ময় আবার বজ্রডাকে মিষ্টি করে বলে, এবার বিয়ের কথা পাড়বে হাইলাকান্দি
গিয়ে । তবে চাকরি ছাড়ার কথাটা একেবারে মিথ্যে বলেনি তন্ময় । একটা মতলব আছে, নইলে
কেন দুম করে ইস্তফা দিয়ে দেয় অর্থনীতির এম এ ।
ইম্ফল থেকে
ডিমাপুর যাওয়া খুব সহজ । সকালের বাস বিকেলে পোঁছে দেয় । তবে তন্ময় তো আর সহজ পথের
পথিক নয় । সে সড়কপথে যাবে শিলচর, শিলচর থেকে ট্রেনে ছত্রিশটা পাহাড়ি সুড়ঙ্গ পার
হয়ে যাবে লামডিং, লামডিং থেকে দুঘণ্টা তিনঘণ্টা বড়বাজার চারঘণ্টায় পৌঁছবে ডিমাপুর
। হাতে সময় দশদিন । কার্ড এনভেলাপ ইনল্যান্ড লেটার বিক্রির চাকরি ছেড়ে ল্যান্ড
লেবার ক্যাপিটাল আর অ্যাডাম স্মিথের কাণ্ডকারখানা নিয়ে কথা বলার চাকরি ডিমাপুর
কলেজে । তবে তন্ময় যে একেবারে বেহিসাবি
তাও নয়, শিলচর যাওয়ার দুটো দিক সে খোলা রেখেছে । এক, হাইলাকান্দি লক্ষ্মীবাজারের
লক্ষ্মীদেবীর সন্দর্শন, দুই, এই দশদিনে শিলচর হাইলাকান্দি করিমগঞ্জে কোথাও যদি
একটা মাস্টারির চাকরি জুটে যায় । মল্লিকা বলেছে হাইলাকান্দির এস এস কলেজে একটা
পোস্ট খালি আছে । তন্ময় বলেছে আবার গ্রাম । মল্লিকা বলেছে গ্রাম নয় শহর । সিনেমাহল
আছে । টাউন হল আছে হাইলাকান্দিতে । আর আসাম হলেও ওখানকার মানুষ সবাই বাঙালি,
সরকারি ভাষাও বাংলা । তন্ময় ভাবে মন্দ কী, মল্লিকাহীন জীবনের অনভ্যস্ততা কাটবে ।
মারিয়া শিখার সঙ্গে বেয়াড়া সম্পর্কও এড়িয়ে যাওয়া যাবে । আর কোথাও কিছু না জুটলে
হুগলি নদীর পারে ঝামাপুকুর লেন তো রইলই ।
স্থলপথে শিলচর ভ্রমণে এসেই সব ওলটপালট হয়ে যায়
। এমন সুন্দর স্বদেশ যে থাকতে পারে জানতই না তন্ময় । মল্লিকাও বলেনি তার নদীমালার
কথা । জিরি চিরি মধুরা ধলেশ্বরী সোনাই রুকমিনি এবং দূরের জাতিঙ্গা, দামছড়া । বড়াইল
পাহাড় থেকে বের হওয়া বরাক সুন্দরীর আঁকাবাঁকা রূপ । কিছুদূর করিমগঞ্জেও গিয়েই আখের
রসের মতো মিঠে পানির নদী কুশিয়ারা । ওদেশে আখের অন্য নাম কুশিয়ারা । ওপার
বাংলাদেশে গিয়েই নৃত্যপরা নদীর নাম সুরমা । সুরমা থেকে ব্রহ্মপুত্র গঙ্গা হয়ে
বঙ্গোপসাগর । তার মানে হুগলি নদীতেও ধলেশ্বরীর জলস্পর্শ আছে । এতসব জানার পর তন্ময়
লেখে,
“আমি এখন শিলচরে
কুসুমানন্দ হোটেলে । এত কাছে তবু এত দূরে । তোমার সঙ্গে আর দেখা হল না । দুদিকের
পথই বন্ধ, এদিকে মাটিজুরির পুল ভেঙে গেছে ওদিকে ধলেশ্বরের পথ জলমগ্ন । আমি কলকাতাই
ফিরে যাব মনস্থ করেছি । প্লেনের টিকিট কেটে নিয়েছি । আমি অপেক্ষা করব তোমার, যতদিন
না তুমি আমার হয়ে কলকাতায় আসবে আমি প্রতিদিন গঙ্গার ঘাটে যাব, দেখে আসব তোমাকে ।
তোমার ধলেশ্বরী শুনেছি এসে মিশেছে গঙ্গায় । নদীর মতো হয়ে তুমি কত কথা বলে যাবে
আমাকে । তবে এবারের চাকরিছাড়া বেড়ানোটা খুব উপভোগ করেছি । এত পাহাড় ডিঙিয়ে তবে
পোঁছতে হয়েছে তোমার কাছে । এত এত নদীগিরির শেষে । তোমার সঙ্গে দেখা হল না কিন্তু
উপলক্ষ তো তুমি । শিলচরের এক কবি লিখেছিলেন – ‘তুমি আছ বলে মেঘে জল...’ তবে এত
জলের কল্পনা কবি করেননি । এ কেমন অভিবাদন বলো, শিলচরে পা দেওয়ার পরেই ঝমঝমাঝম্ ।
কিন্তু এর আগের সব কিছুই তো দারুণ ছিল । পূর্বস্থলী ভ্রমণের সুখ ছিল । সেই চেনাপথ,
চুড়াচাঁদপুর হয়ে । থানলন একরাত, রাতের গানবাজনায়ও কিছুটা লারেলাপ্পা । মারিয়া পাশে
বসতে বলে, যেমন বসেছে গির্জাঘরের দিনগুলিতে । বসেছি পুরোনো দিনের উষ্ণতায়, উনুনের
উত্তাপ আর অনেকদিন পরের মারিয়া আরও সুন্দর হয়েছে । মারিয়া বলেছে কলকাতা যাবে,
পাহাড়ি মেয়েকে শহরে কেমন সুন্দর দেখবে কে জানে । মারিয়া আমাকে একটা ফুল আঁকা রুমাল
উপহার দেয় বিদায়ের সময় । এবার যাত্রা পারবুং, থানলনের মতোই এক জনজাতি অধ্যুষিত
লোকালয় । ওখান থেকে টিপাইমুখ, জিরিবাম । নদী পেরিয়ে জিরিঘাট ফুলেরতল নামের একটা ছবির
মতো গ্রাম, টিলাভুমি আর সমতলের সুষম বণ্টন, আনারসের বাজার বিখ্যাত । মধুর মতো
মিষ্টি বনের টিয়াফল । সোজাপথে শিলচর, মাঝখানে এক পিরের বাড়ি । জ্যান্তপির দেখিনি
জীবনে । বাঁশকান্দির পিরের কেরামতি ভাঙা হাড়গোড় জুড়ে দেওয়ায় । আমি বললাম আমাদের
জুড়ে দাও । পিরবাবা বললে, অভঙ্গ জোড়া যায় না । হাসলেন, শাদির বিধান দিলেন ।”
তন্ময় হাসে ।
এটাও একটা নকল চিঠি । মানে ভুল চিঠি । মানে মিথ্যে কথা । মাটিজুরির পুল ভেঙে গেলেও
মানুষ নৌকায় পারাপার করে, ধলেশ্বরের পথ জলমগ্ন হলেও মোহনপুর দিয়ে হাইলাকান্দি
যাওয়ার ভিন্ন পথ আছে । এসব তাতিয়ে দেওয়ার, মল্লিকার মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার কথা ।
লিখেছে কার্বন দিয়ে, দুটোই রয়ে গেছে পেছন চালায় লুকোনো চালকুমড়োর মতো । কিন্তু এর
পরেও তো লেখা হয়েছে একতাড়া । এমন তো নয় যে মল্লিকার সঙ্গে যখন দেখা হবেই তখন আর
কেন লেখালিখি । নাকি নতুন বাংলা দেখার সুখে ভুলেই গেল প্রিয়তমাকে । তৃতীয় বাংলা
বলে হোটেল ম্যানেজার মিথিলেশ । বলে বাংলার তৃতীয় ভুবন । বরাক নদী আর তার উপত্যকা
নিয়ে খুব গর্ব অধিবাসীদের । তাই তো ওরা বাড়িতে থাকে না । কোথায় গেছে জানিয়েও যায়
না । শিলচর এসেই পরদিন গেছে তন্ময় হাইলাকান্দি । প্রধান ডাকঘরে খোঁজ নিয়ে জেনেছে মল্লিকা
ছুটিতে । বাড়িতেও তালাবন্ধ । আবার গেছে দুদিন পর, পড়শি বাড়ির কেউ একজন এসে বলল
রোজকান্দি যেতে পারে । চাবাগানে ওর মামার বাড়ি । রোজকান্দি থেকে ফেরার পর
চিঠিবন্ধের রাগ কমতে থাকে একটু একটু করে । চিঠি তো নয়, দেখা হওয়ার মাইনিউটস লিখে
পাঠায় ।
‘ তোমার হাইলাকান্দি
পৌঁছানোর দুরকম পথ আছে, একটা ডানদিকে একটা সোজা । ডানদিকের পথটা একটু দুর্গম,
ফিরেছি সেই অগম্য পথেই । মাটিজুরি পর্যন্ত খানাখন্দ, নদী পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তা
মাইলের পর মাইল, পাহাড়ের পর পাহাড়ের শ্রেণি । ডাকাতের ভয়ে গাড়ি ঘোড়াও কম সন্ধে হতে
না হতে । পাহাড় শেষ হতেই গঞ্জের বাজার ধোয়ারবন্দ, মিজোরাম খুব কাছাকাছি,
উগ্রপন্থীও আছে আশেপাশে । তবে সব ভয় ভাঙিয়ে দেয় তোমাদের চা বাগানের অপরূপ সৌন্দর্য
। চায়ের কচি পাতার গন্ধে বিবশ হয়ে যায় মন । মন যে শুধু তোমাকে ডাকে, উৎকণ্ঠায় ভর
করে পোঁছই রোজকান্দি চা বাগান । তোমার মামার বাড়ি, চা বাগানের, বিশাল এক সংরক্ষিত
বনভূমি, জলাভূমি । দার্জিলিং গেছি, চা বাগান দেখা হয়নি দুচোখ ভরে । বাগান দেখা হয়,
তোমার মামার বাড়ির আতিথেয়তা ভুলব না । তোমার মামির রান্না থোড় মচার ঘণ্টর স্বাদ
এখনও ভুলতে পারিনি । হরিণের মাংস খেতে সুস্বাদু শুনেছি খেয়ে বুঝেছি শোনা কথায়
স্বাদ মাপা যায় না । দারুণ । মাছ মাংসের লোভে শাক সবজির লোভে মনে হয়েছিল থেকে যাই
বাকি কয়েকটা দিন । কুসুমানন্দয় আর ফিরব না । তোমার মামার বাড়িতে কোন পরিচয়ে থাকি
বলো তো । তোমার মামা তোমাকে ভালবাসেন খুব । আমাকেও অপছন্দ হয়নি । তোমার বাবাকে তো
বলেই দিলেন বিয়ে হবে বাগানের বাড়িতে । এত আয়োজন লোকজন লক্ষ্মীবাজারে পাওয়া যাবে না
। বাংলা সিনেমার প্রেমের দৃশ্যে যেমন সাইড টক হয়, আমিও বাবা মামার কথার মাঝেই
তোমার কানে শুনিয়ে দিই ডায়লগ,
--- দেখলে তো পিরবাবার কথা মিলে গেল ।
তুমি অবাক অভিনয়ে বলেছিলে,
--- কী কথা ।
--- শাদির কথা ।
--- বিয়ে । ও তো কথার কথা । বাল্কের হাতে নাড়ু ধরিয়ে শান্ত
করা ।
--- আমিও বালক ।
তুমি চোখের ইশারায় কোনও স্মৃতি উস্কে দিয়েছিল প্রগলভতায়,
--- বালক ব্যাঘ্র । সে না হয় হল, কিন্তু এই পিরবাবাটি কে ।
তুমি যে বললে গুরুদেব ।
--- সে আছেন একজন শালগঙ্গায় । তিনিও বললেন বিয়ের কথা ।
--- গেছ তুমি আশ্রমে ?
--- গেছি । তিনি খুব ভালোমানুষ । প্রচুর ধনসম্পত্তি ।
পুরিয়া করে কদমগাছের মাটি বিক্রি করেন । মানুষের অগাধ ভক্তি ।
তুমি সন্দেহ
করেছিলে আমার কথায় ।বলেছিলে,
--- গুরুদেব কিন্তু বাক্সিদ্ধ ।
আমিও যুদ্ধে গেছি । বলেছি,
--- তাই তো মনে হচ্ছে । বললেন বরাক ভূমিতে সুলক্ষণা পাত্রী
পাওয়া যাবে না ।
--- কেন ?
--- শব্দদোষ আছে । বাক্যদোষও আছে ।
--- তাহলে আর কী, চলে যাও খাচ্ছি যাচ্ছির দেশে ।
সত্যি বলছি তোমার
চোখে সেদিন আমার সর্বনাশ দেখেছি । রাগলে পরে তোমাকে সুন্দর দেখার সৌভাগ্য হয়েছে
সেদিন ।’
শব্দদোষ আর
বাক্যদোষের কথা বললে সিলেটিরা রাগে । সিলেটের বাঙালিদের বাংলার উচ্চারণ একটু ভিন্ন
। অনেক বর্ণে অকারণ জোর দেয় । শব্দ প্রকরণও একটু খটোমটো । তন্ময় চলে আসে শিলচর
পরদিন, মল্লিকা থেকে যায় মামারবাড়ি । কোনও কথাই হয় না । সবসময় বড়রা ছোটরা ঘিরে রইল
যে । মল্লিকাও কোনও উৎসাহ দেখায়নি একটু সময় বের করার । তাহলে কী দাঁড়াল। মল্লিকার
মনের পরিবর্তন । আর ভালো লাগছে না সহপাঠী বন্ধুকে, নাকি নতুন বন্ধু হয়েছে কোনও ডাক
বিভাগের কর্মী । লক্ষ্মীবাজারে পাশের বাড়ির অতি উৎসাহী যুবকটি কী, যার নাম দেবাশিস
কানুনগো, যে দিয়েছে বাগানের সূত্র । স্থানীয় ভিক্টোরিয়া স্কুলের মাঝবয়সি ড্রইং
মাস্টার । তাও বা কী করে হয়, সেই কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে
ফাজলামি করার মতো সংলাপও তো বলে গেল প্রেমের প্রথামতো । ডায়লগের শেষে রাগ
অভিমানটাও একই আছে । কুঞ্জদ্বারে তার সদাজাগ্রত বনমল্লিকা তো তাহলে একই আছে । তবু
কেন উচাটন যায় না । শহরের কেন্দ্রে হোটেলটাও মন্দ না, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন খাওয়া
ভাল থাকা সস্তা । মায়া হোটেল গ্র্যান্ড হোটেল থেকে ভাল । আরও কয়েকটা দিন থাকাই যায়
। কিন্তু তন্ময়কে টানে রোজকান্দি চা বাগান । তাই চিঠি লেখা বন্ধ কয়েকদিন । কয়েকদিন
পরের চিঠিটায় থাকে নতুন মোড় ।
‘ হোটেল
ম্যানেজার একটা ভ্রমণ ইটিনিনারি তৈরি করে দেয় আমাকে । প্রথম দিন খাসপুর, কাছাড়ি
রাজার রাজধানী, এখন ধ্বংসাবশেষ । দেখলে তো বাঁশকান্দির পিরবাবা আর শালগঙ্গার
বাবাজির কথা কেমন মিলে গেল । দুজনেই বলেছিলেন যেতে । অভীষ্ট সিদ্ধ হবে । কিসের
অভীষ্ট কে জানে । নতুন জায়গা দেখার আনন্দ আমার সবসময় । গিয়ে তো ভালই হল । এক বিশাল
রাজত্বের কথা জানা গেল । একদিকে মধুরা আর একদিকে নাক্টিছড়া নদী দিয়ে সুরক্ষিত
রাজধানী এখন দুই চা বাগানে বিভক্ত । শিবেরবন্দ ও খাসপুরে মদেশিয়া চা শ্রমিক ছাড়াও
কাছাড়ি বর্মনদের বাস । যদিও খাসপুর ও থালিগ্রামের বাইরে সেই রাজবংশীয় জনগোষ্ঠী
একেবারে কোণঠাসা । কবেই রাজ্য ভেঙে দুভাগ হয়েছে । হিড়িম্বারা উত্তর কাছাড় ও মিকির
পাহাড়ে আর বর্মনরা খাসপুর সহ কাছাড়ে । খাসপুরে শুধু চুন সুরকি আর খসা পাথরের ভাঙা
রাজ-অট্টালিকা এখন জঙ্গলাকীর্ণ । রক্ষণাবেক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই । একা বোকার
মতো দেখি আর ভাবি কী বিখ্যাত ছিল রাজধানী । সংলগ্ন গ্রাম থালিগ্রামে গিয়ে জলতেষ্টা
পায় । নিতান্ত কৌতূহলের তেষ্টা । রাজরাজড়াদের নিয়ে বিশদ জানতে গ্রামবাসীর মতো
সানন্দ সহায় কেউ হয় না । শহরে থাকতে গ্রাম সম্পর্কে কোনও ধারণাই তো গড়ে ওঠেনি আমার
। প্রথম ধাক্কায় থানলনের জনমানবহীন পাহাড় গ্রামে দেখলাম শুধু আকাশবাড়ির মেঘ আর ডাল
বরাবর গৃহপালিত কুকুর । মারিয়ার কিচেনে নিশিবাসর । আসল গ্রামের চেহারাটাই চিনতে
পারতাম না থালিগ্রাম না এলে । বাঁশের বেড়া দেওয়া বাড়ির সীমানায় যে গেট, তাকে ওরা
বলে ঘাটা । এ কেমন নাম, নদীর ঘাট নাকি । ঘাটা খুলে যে কেউ ঢুকে যেতে পারে, কোনও
বাধা নেই । মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক, আর পাঁচজন বাঙালির মতোই দেখতে, কথাবার্তাও স্থানীয়
বাংলায় । তবু কোথাও একটা ব্যতিক্রম আছে, সে কি চোখের পাতায়, একটু ছোট, চিন, বর্মি
কিংবা নেপালিদের একটা আদল । কিন্তু ব্যক্তিত্বের কম নেই কোথাও, আবার একটা মিষ্টি
স্বভাবের আভাসও আছে । আমাকে দেখেই চিনতে পারেন, বলেন কলকাতা থেকে আসছেন । আমি
হ্যাঁ এবং না–এর আমতা আমতায় মণিপুর থেকে শিলচর পর্যন্ত স্থলপথের ভ্রমণবৃত্তান্ত
শুনিয়ে দিই । মাটির দাওয়ায় বসতে দেন একটি আসনে, জানি না সতরঞ্চি বলে কী না আসনটিকে
। ছোট একজনের বসার মাপে তোমার মামার বাড়িতে দেখেছি, বলেছিলে সুজনি । সুজনি থেকে
আলাদা রংবেরঙের সুতোয় বোনা, একেবারে অপ্রতিম, অন্যরকমের সুন্দর এই আসনখানি ।
সুন্দর এখানেই বসতে ডাকছে । এরমধ্যেই ভিতরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আর এক সুন্দর, হাতে
জলপাত্র অন্য হাতে থালা, থালায় কয়েকটি নাড়ু, সম্ভবত নারকেলের । আমি দেখছি যুবতীর
পরিধেয়, সবুজ হলুদে মেশানো, শাড়ি নয় কিন্তু শাড়ির মতোই, ফানেকও নয়, অসমিয়া মণিপুরি
সংমিশ্রণ । মেয়েটি গৌরী, দীর্ঘাঙ্গী । দুভাগ কিংবা তিনভাগের কাপড়ে এক অপরূপা ।
গৃহস্বামী মধুমঙ্গল বর্মন বলেন, আমার মেয়ে কাঞ্চনী । আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়
অন্য প্রশংসা, এত মোলায়েম, এত কোমল । এদিকে কাঞ্চনী ওদিকে আসন । তোমাদের দেশের
সুজনিতে হাত দিয়ে অনুভব করি সুন্দরকে । বিব্রত হয়ে বলি সুখাসন কথা । ঘরের বোনা ছোট
মাদুরখানার নাম পাতঞ্চি । অবিবাহিত মেয়েরা বোনে । গুটিপোকার সুতো দিয়ে বোনা ।
প্রশংসিত পুত্রীর সঙ্গে পিতারও ভাল লেগে যায় বিদেশি পথিককে । শুধু জল নাড়ু নয়,
দ্বিপ্রাহরিক ডালভাতের নিমন্ত্রণও রক্ষা করতে হয় সেদিন আমাকে ।’
মধ্যমা আর
তর্জনী তর্জনী আর মধ্যমা করে করে তন্ময় মধ্যমাকেই জিতিয়ে দেয় । মধ্যমায় যে
থালিগ্রাম । থালিগ্রাম থেকে ফিরে এসে তন্ময় হোটেলবন্দি হয়েই থাকে । মল্লিকাকে কথা
দিয়েও হাইলাকান্দি যাওয়া হয়নি । বেচারি ছুটি শেষ করে ফিরে যাবে বলছে হাইলাকান্দি ।
এদিকে যে শিলচর ছেলেদের সরকারি স্কুলের বাংলাভাষার শিক্ষক মধুমঙ্গল বর্মনের
অপেক্ষায় থাকতে হয় । শুধু মধুমঙ্গল নয় কাঞ্চনীর জন্যও অপেক্ষা করে তন্ময় । মধুমঙ্গল
না এলে ভাবে সে-ই যাবে আবার থালিগ্রাম, শেষবারের মতো দেখে আসবে ডাকের সাজের
প্রতিমা । আবার অভিমানও হয়, অস্থায়ী ঠিকানা তো দিয়ে এসেছে, একদিন দেখা দিতে পারত
পিতা কন্যা । যেদিন দুপুরে তন্ময়ের মধ্যমা নেচে ওঠে আনন্দে সেদিন রাতেই লেখে
মল্লিকাকে ।
“ জানো, আমার
মনের জোরকে জিতিয়ে দিয়ে আজ কুসুমানন্দ হোটেলে এলেন মধুমঙ্গল বর্মন । সুদৃশ্য মোড়কে
এক উপহার নিয়ে । বললেন, পাতঞ্চি । বললেন আপনার ভাল লেগেছিল, আমার মেয়ে নিজের হাতে
বুনেছে । আমরা এই মহার্ঘ বস্তুটি সমাজের বাইরে দিই না । আপনি ব্যতিক্রম তাই একটি
শর্তে এই উপহার । আমি বলি, উপহারে শর্ত থাকে না । মধুমঙ্গল বলেন, জানি, না মানলে
কিছু করার নেই, এ শুধু সামাজিকতা । অবিবাহিত মেয়েরা তাদের প্রিয় পুরুষকে দেয়,
প্রথা বলতে পারেন । মানুষটির আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে বলি, তবে তাই হবে । মেনে নিই
শর্ত, আপনার কন্যা কাঞ্চনী আমাকে প্রিয় ভেবেছে এইতো বড় উপহার, পাতঞ্চিটাও সঙ্গে
থাকল । এবার বলুন শর্ত । মধুমঙ্গল এবারও বিনীত, বলেন, শর্ত কিছুই নয়, শুধু নিজের
কাছে রাখবেন । তিনি আবার বলেন সংযোজনে, প্রিয়র কাছে থাকা মানে তো নিজের কাছেই থাকা
। আমি বলি, আচ্ছা । প্রিয় ছাড়া কাউকে দেব না, নিজের কাছেই রাখব । টা আপনারা এই
সুদৃশ্যে সুজনি ছাড়া অন্য জিনিস করেন না । তিনি বলেন, হ্যাঁ আমাদের বাড়ির মেয়েদের
সব কাপড়ই তো নিজস্ব তাঁতে বোনা, গামছা পাতঞ্চি আমরা পুরুষরাও বুনি । তন্ময় বলে,
না, বলছিলাম, আসামে তো এন্ডি মুগা পাটের কাপড়, আরও অনেক কিছু তৈরি হয়, জাপি, বাঁশ
বেতের জিনিস, প্রয়োজনীয় ঘর সাজানোরও । মধুমঙ্গল
বলেন, ওসব করে বাঙালি নমশূদ্ররা, বোনে পাটের কাপড় অনেক রকম । আমরা শুধু পরম্পরা
বজায় রাখছি । সবাই তো এখন শহরমুখি । অবাক কাণ্ড বলো তো, এত সুন্দর সিলেটি বাংলায়
কথা বলেন তবু বলছেন বাঙালি নমশূদ্র কথা । আপনিও তো বাঙালি, আমার সপাট প্রশ্নের
জবাব দেন মধুমঙ্গল বিনীতভাবে । আমরা বাংলাভাষায় কথা বলি কিন্তু আমরা ডিমাছা ।
বাউলা রাজার বংশধর । কাছাড়ের বর্মনরা খুব সুখী, সাদাসিধে মানুষ । সে কী আর বলতে,
বইয়ে পড়েছি নীলদর্পণের দীনবন্ধু মিত্র একবার এসেছিলেন থালিগ্রাম কার্যব্যপদেশে,
নিয়ে গেছিলেন একজোড়া কাপড়ের জুতো বন্ধুর জন্য । বলেছিলেন ভালমানুষের দেশ থেকে আনা
। জুতো জোড়া উপহার দিয়ে বলেছিলেন ‘কেমন দিলাম’ । বন্ধুর জবাবও ছিল জুতোসই,
বলেছিলেন ‘তোমার মুখের মতো’ । রসরাজ বঙ্কিমের কথা বড় মুখ করে বলে বেড়িয়েছেন
দীনবন্ধু ।”
তন্ময়ের মনে এখন
অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব । কী হয় কী হয় । মল্লিকার মন বোঝা যে ভার । বিয়ের কথা বললে
এড়িয়ে যায় । বলে চাকরি নেই । বলে, এরকম বোকা মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো যায় না ।
মল্লিকা কেমন যেন এক বদ্ধ ঘরের বন্দিনী হয়েই রইল তার জীবনে । তাই তন্ময় যেখানেই
যায় ভিন্ন রমণী নিয়ে উপাখ্যান লেখে চিঠিতে । মল্লিকাকে ঈর্ষান্বিত করে । কিন্তু
মল্লিকা যে এক অনড় অস্তিত্ব তার জীবনে সে কোথাও বারবার বুঝিয়ে দেয় তার বিশ্বাস
দিয়ে । মারিয়ার কথা, শিখার কথা মাঠে মারা যাওয়ায় হতাশ তন্ময় পিরবাবার কথা সাজায়,
সাজায় সাধুবাবার শব্দদোষ কথা । শেষ পর্যন্ত কাঞ্চনীকেও সাজিয়েছে । খাসপুর এবং
তৎপরবর্তী ঘটনার বিবরণ দেওয়া পত্রলেখা নিয়ে তন্ময় এবার কুসুমানন্দ ছাড়ে । ডিমাপুর
কলেজে জয়েন করার আগে একটা হেস্ত নেস্ত হোক । এবার যাওয়া হাইলাকান্দি । অভিজ্ঞান পৌঁছে
দিতে প্রিয়গমন । মধুমঙ্গল যে বলেছেন প্রিয়র কাছে থাকা নিজের কাছে থাকা । বাংলার
শিক্ষক মনের কথা সাজিয়ে দিয়েছেন । রোজকান্দি বাগানের কাছাকাছি বড়জালেঙ্গা পৌঁছেই মনে পরে তার
শর্তাধীন উপহারটার কথা । মনের আসনের যে কত নাম, পাতঞ্চি নামটা বড় মনের মতো রঙে রং
করা । স্বপ্নে দেখা আসনখানি মল্লিকাকে দিয়ে সে নির্ভার হবে এবার । শিখা মারিয়া
কাঞ্চনীর প্রিয়নামও সমর্পণ করবে মল্লিকায় । ব্যাস আর কাকে ভয় । সন্ধ্যা আঁধারে তাই
বাগবাহারের অরণ্যপথেও সে নিঃশঙ্ক, যেখানে ডাকাতের হা রে রে রে ভয় । বিকল চিত্তকে
মুচকি হাসি দিয়ে ঠিক করে নেয় তন্ময়, সন্ধ্যা সমাগমের আগেই সে পোঁছে যায়
প্রিয়াভবনের প্রধান ঘাটায় । তার পরই তো লক্ষ্মীর ঘর, লক্ষ্মীবাজার, শহর হাইলাকান্দি
।
সে আজকে নয়
তন্ময় মল্লিকার
এখন কথাও লেখা আছে চিঠিতে । খোলা তোরঙ্গের মণিমুক্তো সাজিয়ে নিলেই তো আখ্যানের
বিস্তার আবার । তাই, আপাতত সবুর, বিরতি ।
(সকালবেলা)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন