“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

সুরমা গাঙর পানি --ভাটি পর্ব ৪



(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার চতুর্থ  অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।


ক পুয়ার বাপ অনেকদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে ভুলে যায় সব । মাকে বলে,
--- আইজ হিদল পুড়া আর ভাত । ঠাসিয়া দিছ মরিচ ।
     ঝালের মুখে জিভের চকাশ চকাশ আনন্দে মায়ের চোখও চিকচিক করে । খাওয়ার পর মা বৈতলকে চিবুনো পান দেয় । বৈতল খায় আর হিংসুক চোখে লুলাকে দেখায় । লুলাও রেগে মাকে অনুযোগ করে ।
--- আমারে দিলায় না ।
--- মুখর পান খাইবে নি বেটা ।
--- কেনে, হিগুয়ে খাইতে পারে আমি কিতা দুষ করলাম ।
বৈতলের মা লুলাকেও দেয় । বলে,
--- অতদিন কই গেলে, কই থাকলে , কিতা খাইলেরে বাপধন ।
--- আমরা আউরি ঘুরছি গো মাই । হারা মইলবাজার ঘুরচি আর খাইছি যেতা পাইছি ।
--- আর ইবায় তার বাপে খায়না,সব বালা বালা জিনিস রাখি দেয় পুয়ার লাগি !
মা বলে,
--- এক মাস থাকি শুটকির আড়তদার আইছে বাজারো। শিলংঅ বুলে লাইয়ার শুটকির দাম বাড়ছে । দের না । কয় আরো বাড়উক । ইবার ঘাঘট, ঘনিয়া , পাবিয়াও বালা অইছে । তোর লাগি রাখি দিছে বালা দেখিয়া ।
     বৈতল বাপের সঙ্গে সিদল দেয় । হাওরের বড় বড় পুঁটির শুটকি সাজিয়ে রাখে মাটির কলসিতে। পরতের পর পরত সাজিয়ে দেয় শুকনো মাছ। মাছের পেট থেকে তেল বের করে রেখেছে বাপ । সিদল দেওয়ার সময় আবার তেল মাখায় । হাঁড়ির মুখ চুন শুকনো লতা পাতা দিয়ে বন্ধ করে । রান্নাঘরের নিচে মাটিতে পুঁতে রাখে আঘন মাসের জন্য ।
    অগ্রহায়ণ মাসের নতুন সিদল আর পান্তা ভাতে শরীর বাড়ে দুরন্ত । মা বলে,
--- মাছর তেলও সব দেয় না । তোর লাগি রাখি দেয় । কয়, মাছর লগে টক্কর দিতে অইলে, সাপর লগে টক্কর দিতে অইলে মাইমলি গন্ধ লাগে । তেলাল শরীর লাগে। কয় তেলে জলে বাইচ্চা বাড়ে । পনর বছর অই গেছে , অখনও তুই বাইচ্চা নি ।
     গল্লা বেতের শরীর বাপও মিশে থাকে মাটি আর জলের সঙ্গে । শুধু মাছ আর সাপ নয় , দশাসই মানুষকেও কাবু করে ফেলে তার কালো কুচকুচে লতা শরীরে । বেতাল বুঝলেই বেয়াড়া প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে নেয় জগৎবেড়ে আর ছুঁড়ে ফেলে বড় হাওরের গর্ভে, আইড় বোয়ালের খাদ্য হতে পানিকবরে ।
খুব বেটাগিরি আছে বাপের ।
আবার মাকে যখন মারে তখন হিংস্রতা থাকে না । নিরুপায় মানুষের দুঃখ ঝরে পড়ে ঘামের ফোঁটায় ।
সেদিন কিন্তু একবারও ঘাটার বাইরে যায় না বাপ ।
মাকেও বলে না, বেইমান বেটি ।
রাত হতেই প্রলয় ডাকে হাওরের জলে । ঝড়, তুফান, বন্যা ।
বাপ বৈতলকে ডাকে,
--- হেই বৈতল । পানিখেউড় দেখতে নি চল ।
     প্রলয় রাতের অন্ধকারে বাপ বেটা বেরিয়ে যায় এক দড়ি আর এক মস্ত কলসি মাপের খলুই হাতে ।
     জলখেলা দেখতে চলে বৈতল । জলের সঙ্গে খেলতে চলে । জলের সব আঁশটে প্রাণীর সঙ্গে লড়তে যায় পিতাপুত্র ।
     চারদিক অন্ধকার । সে এক ভীষণ দৃশ্য । জলের সাঁ সাঁ শব্দ শুধু । জলতরঙ্গে সুরমা নদী আর হাওরের সীমারেখা একাকার । বিদ্দুচমকের মধ্যে বৈতল ভাবে চরাচর বুঝি শেষ হয় ।
     বাপ পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় । বৈতল পেছনে আছে কি না খেয়ালও করে না । বৈতল ও বিজলির অপেক্ষায় থাকে, বাপের চলা কল্পনা করে আর আই মনসার থানকে গন্তব্য ঠিক করে রাখে । থানের উপর বিশাল হেলা বটগাছ ঢেকে রেখেছে হাওর । বাপ খলুই এর গলায় দড়ি বেঁধে তার হাতে দেয় । বলে,
 --- ছাড় কইলেউ ছাড়বে ।
      বৈতল দেখে আই মনসার মন্দিরের সামনে এক অলৌকিক দৃশ্য । মাতৃমূর্তির সামনে এক চাটা জ্বলছে টিমটিমিয়ে , মাটির প্রদীপ । এই দুর্যোগের রাতে কে জ্বালিয়ে গেল প্রদীপ । হাঁটুমুড়ে বসে বৈতল এক মনে জপ করে আইমনসার স্তব ,
মনিগন - মনিগন ভূষিতে নমস্তে
ভগবতী বিষহরি দেবী নমস্তে ।
        বটগাছের শিকড়ে হাত দিয়ে নম করে । শিকন্দর গাজিকেও নম করে । সিলেট জেলার সব নদী হাওরের মালিক এই গাজি । খুশ থেকো বাবাজি । বাপের শেখানো বুলি কপচায়,

শাহ সিকন্দর গাজি
মাছ পাইলে আধাআধি
তুমি খাইবে মাছ খান
মোরে দিবে গচা খান ।
    তর তর করে গাছের উপর চড়ে যায় বৈতল । নিঁখুত আর নির্ভয়ে । বৈ তল জানে ভয়ের কিছু নেই কোথাও , বিশ্বসংসারে অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই । হেলে থাকা বট গাছের ডালে আর হাওরের জলে ডাকাডাকি । বৈতলের পিছল শরীর জড়িয়ে ধরেছে বটের ডাল । এক হাতে খলুই, দড়ি অন্য হাতে । বজ্রপাতের কড়কড়াৎ আর আলোর বিচ্ছুরণে অবাক কিশোর দেখে দুই অপার্থিবের দাপাদাপি । হাওরে জলের তাণ্ডব আর তার বাপের লড়াই । পানিকে শাসন করছে খালি হাতে । নিচের জল থেকে ডাকে বৈতলকে ,
  --- লামা বৈতল ।
বৈতল নামিয়ে দেয় খলুই ।
বাঁশের মাছপাত্র মুহূর্তেই ভরে ওঠে রূপোলি শস্যে । খলবলানো জলচরে ভরে যাচ্ছে খলুই । বাপকে বলে বৈতল,
 --- আমি লামতামনি পানিত ।
খালি হাতে মাছ ধরার কসরৎ শিখেছে সে বাপের কাছে । বাপ বলে ,
 --- না ।
 ভোর হয় হয় । ফর্সা হয়ে গেছে আকাশ । বাপ বলে,
 --- খলুই ধরি রাখ । আস্তে আস্তে লাম । 
বাড়ি ফিরে আসে বৈতল । বাপ ফেরে পরে । মাছের টুকরিতে খলুই উপুড় করে খোঁজে আলদের বাচ্চা ।
রাগে নয়, কৌতুকে বাপকে বলে বৈতল,
 --- পাইতাম নায় , ফালাই দিছি ।
ছেলের তেলাল শরীরে শরীর মিলিয়ে বাপ বলে,
  --- সাবাশ !
বৈতল বলে,
 --- তুমি আমারে মারতায় চাইছলায় ।
 --- না রে বেটা , দেখলাম তুই কিতা করছ ।
 --- কিতা আবার করতাম, আলদে নি মারত আমারে ।
 --- তুই পারবে বেটা । সাপর লগে লড়াই করি বাচন লাগে আমরার । তুই পারবে ।
  বৈতল বুঝে বাপ কথা খুঁজে পাচ্ছে না । এই প্রথম বাপের সঙ্গে সংঘাতে যায় বৈতল । বলে,
  --- তে তুমি আমার মার লগে ঝগড়া কর কেনে, মা কুনু সাপ নি ।
 বাপ শোনেনি কথা । চলে যায় জলের বিশ বাওয়ে । বলে,
  --- পানি কিলাখান দেখলে ।
 --- পানি তো পানি উ , কিতা দেখতাম ।
  --- ঠিক। ঝড়ঝাপটা হউক, ঘোলা অউক , নিন অউক , কুড়ুলা অউক , যেতাউ অউক পানি তো পানি অউ । তে পানি আছিল বেটা ছয়ত্রিশ বাংলাত ।
মাইনষে কইন মহাপ্লাবন । মাটি নাই কুনুখানো । খালি ছাতকর টিল্লা  আর খাসিয়াপুঞ্জি । ছাতকর তিন নদী মিলিয়া সাগর । আমরা ডরাইছি চেরাপুঞ্জির পাড়ো নি পানি উঠি যায় ।
 --- ইতা হুদা মাত ।
 --- না বে । জিগা না অউ বেটিরে । সব ঘরবাড়ি ডুবি গেছে , গরু মইষ নাই একটাও । পানি লামার পরে দেখছি ধান চাউল গু অই গেছে , চুন গুলিয়া পাত্থর অই গেছে আবার ।
 --- সব যদি ডুবি যায় তুমি দেখলায় কেমনে ।
 --- আমরা সব গাছো ।
 --- গাছ কই , গাছও তো পানির তলে ।
 --- না , আমরার ইখান তো উচা । গাছর আগা আর কিছু বাড়িনতর চাল নেতাজির টুপির লাখান ভাসি রইছে ।
 --- ছয়ত্রিশ বাংলাত নেতাজি আছলা নি নেতাজি ।
 --- কথার কথা কইলাম আরি । তিনদিন আছলাম গাছো । গাছো আছিল এক সাপ । জোয়ান গাট্টা আমার লাখান ।
 --- কী সাপ ।
 --- আলদ থাকিও মারাত্মক । পাগলার জমিন্দার বাড়িত থাকত । পালোয়ানি করত । লাঠিয়াল আছিল । লাঠিয়ামি করত । আমি চাকর ইগুরে দেখতাম পারতাম না । তে কেমনে বুজমু যে ঝিমমারি পড়ি রইছে গাছো । হাপি কুপিরে আমি ডরাই না । আর হিগুত ডরাইয়া ভিজুতিতু । আমার চউখ দেখিয়াউ কাজিমরা । কইলাম , ছাড়তাম নায় । শাশিরসো টিপিয়া মারি ফালাইছি । অখন জিগাইবে নি কেনে মারলাম । ডাক অউ বান্দির বেটিরে । তুই ওতো অউ বেইমান বেটির পুত । জিগা বজরি দাসরে চিনে নি ।
    একদিনের পানি  পড়া দুদিনেই জল ।
    বৈতলের গৌরাঙ্গী জননীর মুখে আবার আতঙ্কের নীল ।

চলবে
 < ভাটি পর্ব ৩ পড়ুন                                                                      ভাটি পর্ব ৫ পড়ুন >

কোন মন্তব্য নেই: