(আমার প্রিয় কথাশিল্পী রণবীর পুরকায়স্থ। তাই তাঁর গল্প উপন্যাস একাধারে টাইপ করে যাচ্ছি। আজ তাঁর সম্প্রতি লেখা এক ছোট গল্প। টাইপ করবার পরে, সম্পদনাতে, সংশোধনীতে সাহায্য করেছেন, আরো এক সুলেখিকা, আমার শিক্ষিকা মেঘমালা দে মহন্ত .---সুব্রতা মজুমদার )
মধ্যম সাহাকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই । সে মিশে যেতে পারে জলের মতো ঝোলে ঝালে অম্বলে, ঝাঁকের কই হয়ে কানে হাঁটতে পারে সে।যে কোন আসরেই সে জমজমাট থাকে তার বাজারি রসবোধ নিয়ে আর দুর্মুখ খ্যাতির জোরে । তাই সৌরাষ্ট্র-শিলচর মহাসড়ক থেকে পাহাড়লাইনের ব্রডগেজ বিতর্কে , বাস-ট্রাক মালিক সংগঠনের সভায় , মন্ত্রীসান্ত্রী আমলা থেকে আমজনতার মিছিলে সে কমনম্যান হয়ে ঢুকতে পারে । তবে লঙ্কার মহাসম্মেলনে সে সাধারন লেতিপেতি নয় ,পরিবহন মন্ত্রীর বিশেষ মন্ত্রণাদাতা হিসেবে আমন্ত্রিত এবং মিনিস্টার মাওসেন এর সঙ্গে সাইড কথায় ব্যস্ত এখন । বলা ভাল মন্ত্রীই শুরু করেছেন বার্তা,
“কেমন দেখলে মিডিলম্যন?লঙ্কার
মানুষ আমাদের দেখে নি তো?
“আরে না স্যার, ওরা তো আর রাজা নয় যে আপনার গতবিধি নিয়ন্ত্রণ করবে
?ওরা মহারাজ রাবন নয় যে বলবে , ঘরপোড়া বেটা কোথা যায় এত রাতে ?”
“ঘরপোড়া বেটা ?কাকে বললে মধ্যম?”
“আপনাকে নয় স্যার কীর্তিবাসী রামায়ণের কথা , রাবন রাজার উক্তি ।“
“কার উদ্দ্যেশে?”
“লঙ্কা ভাগের গল্প শুনবেন স্যর ?”
“জানি। কালনেমির লঙ্কা ভাগ ।”
“না স্যার, রামায়ণ গানের অনুষ্ঠান।“
“রামলীলা না ঢপযাত্রা ?”
“কিছু একটা হবে । আসর জমজমাট । আসরের কেন্দ্রে মূল গায়ক গাইতে গাইতে
ভুলে গেছে মোক্ষম নামটি,ঐ ঘরপোড়া ব্যাটার নাম। অসহায় গায়ক ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো
গেয়ে যাচ্ছে একটি লাইন বারবার, “লঙ্কায় যে
গিয়েছিলো...”।আর দোহারকির দিকে আর্ত ইশারায় জানতে চাইছে, “লঙ্কায় যে গেছিলো তার নাম কী?”
নির্বিকার দোহারকি করতালির বোলে গায় “ছয় আনা দশ আনা আমি জানি কী?” মানে অসম বন্টন
। এইকথা ? নিরুপায় মূল গায়ক তৎক্ষনাৎ খোল বাজিয়ে জানিয়ে দেয় ,মুছে দেয় বিভেদের
বেড়াজাল গানের সুরে “আজ হতে তোমার আমার
সমান সমান”।ভ্যানতাড়া শেষ হয় ,দোহারকির মিষ্টি সুরে শোনা যায় পাসওয়ার্ড,”লঙ্কায় যে
গিয়েছিলো বীর হনুমান”, ধন্য ধন্য পড়ে যায় আসর জুড়ে ।
২
ছয় আনা দশ আনার বিভেদ মেটাতে প্রায়ই বসে এরকম গোলটেবিল।
কখনও গোয়ার ডোনা পাওলায়, কখনও অরুণাবন্দের একশিলা মন্দিরে,
কখনও হাসিমারায় ধেমাজি মাজুলিতে। তবে এবারের আলোচ্যসূচিতে টাকা আনার
হিসেব নেই । মিত্রপক্ষ সঙ্কটের মুখোমুখি হওয়ায় লঙ্কাযাত্রার সিদ্ধান্ত । এবারের
বাগান বাড়ির মন্ত্রণায় নেই কোনো সমান সমান এর স্লোগান কিংবা নতুন কোন পাওনাগন্ডার
অভিসন্ধি ।
স্থিতাবস্থা বজায় রেখে এবারের মূল কথা হলো তালমিল, কো-অর্ডিনেশন। দলের
কেউ যেন কোনো চাপের কাছে মাথা না নুয়ায় । কোন অবস্থায় কোনো তাড়াহুড়ো না করে ,
মহাসড়ক কিংবা ব্রডগেজের কাজ যেমন চলছে তেমন চলবে লাহে লাহে।মানে, মন্থরতার মন্ত্র
বজায় রাখতে হবে । কৌশল হিসেবে একপা পিছোনোর ভান করে দু’পা এগিয়ে যাওয়া। তবে
শত্রুপক্ষকে মানে পাবলিককে , জনগণকে কিছুতেই দুর্বল ভাবা চলবেনা ।বোকা বানিয়ে
এগিয়ে যেতে হবে । সাধারণ মানুষের চাটুতে সেঁকে নিতে হবে নিজস্ব চাপাটি । আহা, রুটি
যখন ফুলে ওঠে মনে হয় ভারত দেশটা হাতের মুঠোয় চলে এলো , গুজরাটের স্যানন্দ আনন্দ
থেকে গাড়ি গাড়ি দুধ-মাখন-লস্যি-ন্যানো একটানে চলে আসে মহাসড়ক বেয়ে ।ব্রডগেজ হলে তো
কথাই নেই ,দুনিয়া মুট্টী মে। ফুলে ওঠা রুটির সুন্দর দেখে কামভাবও জাগতে পারে
জনমানসে । পাবলিকের সরলমনে পুরুষ্টু স্তনের উষ্ণতা সঞ্চারিত হতে পারে ।মনে হতে
পারে ফুলুক আর একটু, ফুলুক রুটি । ফুলতে দেওয়া উচিত, দেখুক হাভাতের দল,আর জ্বলুক, বুঝুক গরম শরীরে হাত দিলে
কী কান্ডটাই না ঘটে । একবার লাঠি
চালিয়ে দিলে ছ’মাসের জন্য ঠান্ডা।
উত্তরপূর্বাঞ্চলের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনা মূলত জাত্যাভিমানের
উপর নির্ভরশীল। কে কতটা অসমিয়া কতটা বাঙালি , কার্বি দিমাসা হাজং রাভা বডো মনিপুরি
নাগা তাই নিয়ে সাড়ে তিন ফুটের আস্ফালন, আন্দোলন । সর্বভারতীয় ধর্মক্ষেত্রের লড়াইটা
জমে যায় সময় বুঝে মুসলমান বিদ্বেষ ঘিরে । জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় রেলপথ
জলপথ সড়কপথ কিংবা বিমানপথের যোগাযোগ নিয়ে ভাবনা চিন্তার সময় কোথায় । পানীয় জল
ঘরবাড়ি স্বাস্থ্য খাদ্য লেখাপড়াও তাই এদেশে গৌণ। তবে পৌরসমাজ যে একেবারেই এসব
ব্যাপারে উদাসীন এ বলা যাবে না , মধ্যবিত্ত নেতারা মাঝে মধ্যেই আন্দোলন সংগঠিত করে
। শখের ইনকিলাব হোয়, ভেঙ্গেও যায় নেতাদের স্বার্থসিদ্ধি হলেই ।ইদানীং সম্মিলিত
কৃষ্টি মঞ্চ নাম দিয়ে নাটকের দল, কবি কথকের দল ,ছোট কাগজের দলও জোট বেঁধেছে শিলচর
হাইলাকান্দি লালা বদরপুর করিমগঞ্জ লামডিং হোজাই লঙ্কায় । বলছে লড়াই লড়াই লড়াই চাই
, লড়াই করে জিততে চাই ।
কিসের লড়াই ,পরিবেশ রক্ষা আগে না মানুষের
সড়ক। বড়াইলে অভয়ারণ্যের উপর দিয়ে সড়ক গেলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য থাকবে না । জঙ্গলের
উপর দিয়ে মহাসড়ক আর রেলের সুড়ঙ্গ পথ করতে গেলে শ্রমিক কর্মচারির পর্যাপ্ত সুরক্ষা
দিতে হবে সরকারকে ।সত্যিই তো নায্য কথা। সমস্যার নিরসনে রাজনৈতিক নেতারা ডেপুটেশন
দিয়েছে দিসপুরে ,রেলমন্ত্রকে ।পাবলিককে বুঝিয়েছে যে যার মতো। বছরের পর বছর, যুগ
পার হয়ে যাওয়ার পর জনতা এখন বলছে সব ঢপ । মিলিভগত ।বলছে সাঁড়াশি আক্রমণে প্রতিরোধ
হবে এবার , আদায় হবে বিজি আর এমএস ।
৩
বিচক্ষণ সাংবাদিক মধ্যম সাহা আর প্রাজ্ঞ মন্ত্রী মাওসেন-সংবাদ থেকেই
এবার উঠে আসবে গোল টেবিলের নিস্কর্ষ । বাকিটা পিকনিক ।
‘দৈনিক জয়পতাকা’র নির্ভীক সাংবাদিক মধ্যম সাহা কবিতা লিখত এককালে। নাটক
করত, ছোট কাগজের সম্পাদক ছিল, মহাসড়ক আর রেলের ঠিকাদারদের সঙ্গে সম্পর্ক তখন থেকেই
। বিজ্ঞাপন নিয়েছে প্রচুর । সেও তো হয়ে গেল এক দশক । মধ্যমের আর একটা গুণও আছে ,
সে কথা বলতে পারে , লিখতে পারে সাজিয়ে গুছিয়ে ঝালমশলা দিয়ে । তবে যতই হাড়জ্বালানি
হোক তার লেখার কলম ,মধ্যম কিন্তু একটা বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত তৈরি করতে পেরেছে বরাক
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় । বিশেষ করে নেতা মন্ত্রী আমলা ঠিকাদারদের গুপ্ত সমিতির
সংগঠক হিসেবে ।
মধ্যমের কলমকে ভয় করে সবাই । লেখে যেমন হয়, লেখার ভয় দেখিয়েও হয় তার ।
মধ্যমের খ্যাতিমান হওয়ার গল্পটিও বেশ মজার । গবেষণা অন্তর্তদন্ত আর কিছু কেচ্ছা
কাহিনী মিলিয়ে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের সিলেটি প্রধানদের বিষয়ে একটি ধারাবাহিক
উত্তর সম্পাদকীয় , মানে রেক্টর উপাচার্য বিভাগীয় প্রধান ডিন এদের যোগ্যতার নির্মোহ
পর্যালোচনা তথা কেচ্ছাকাহিনীর সত্য মিথ্যা লিখে । ধন্য ধন্য পড়ে যায় শিক্ষা জগতে ,
বিশেষ করে বরাক উপত্যকার সাধারণ পাঠক মনে । তবে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তার
অতি উৎসাহের কারণ ভিন্ন বলে রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলের সিদ্ধান্ত ।
সাংবাদিকতার পেশায় কুৎসা প্রসঙ্গ তো জলভাত । একটু সতর্ক থাকলেই পেড়ে ফেলা
যায় ভারি ভারি ব্যাক্তিত্বকে, ধূলোয় গড়াগড়ি খাওয়ানো যায় প্রতিষ্টা। মধ্যম সাহার লেখার গুণেই বেশ কিছু ঊত্থাণ পতন হয়
শিক্ষা জগতে ।
শিলচর রেলওয়ে স্টেশনের নাম ভাষা শহিদ স্টেশন রাখার ব্যাপারেও মোক্ষম
চালটি তারই । সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী মাওসেনকে কাজে লাগিয়ে রাজ্য সরকারের স্বীকৃতি
আদায় করিয়েছে, লোকমুখে এমনই প্রচার । বলেছে
, রাজ্য
সরকার খুলে দিক গাঁট, উলটো গেরো দিয়ে বন্ধ করে দেবে রেল ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের চাবি
। তবে স্টেশনের নাম নিয়ে জনসাধারণের দাবি যে গনআন্দোলনের রূপ নেবে সেটা ভাবেনি
মধ্যম। তার সাজানো গল্পটি ফ্লপ করে মাঠে মারা যায় ।
তারপর তো মৌচাকে ঘা । মহাসড়ক আর ব্রডগেজ নিয়ে দফায় দফায় ধর্না ধর্মঘট
আর বন্ধে উত্তাল পাহাড় থেকে উপত্যকা ।এসব নিয়ে দুর্বার মধ্যম সাহার উত্তর
সম্পাদকীয় । দুর্নীতি আর কালহরণ নিয়ে জোর কলমে লিখতে থাকে মধ্যম । জনমত গঠিত হয় ,
এবং একশিলায় দীক্ষা নেয় মধ্যম। একশিলা থেকে মাওসেন বাসট্রাক মালিক এবং ছোটবড়
ঠিকাদার ও আমলা আধিকারিক রাজনৈতিক নেতাদের একত্রিত করার দায়িত্বপূর্ণ কাজে জুড়ে
যায় মন্দিরের বাবাজি আর মাওসেন মন্ত্রীর আদেশে ।
৪
অরুণাবন্দের জাগ্রত মন্দির একশিলা ।এক পাথরের রাধাকৃষ্ণ মন্দির নিয়ে
উপত্যকার মানুষের অগাধ বিশ্বাস। মন্দিরমালিক বলাই গোস্বামীকে ভক্তজনেরা চেনে
বাবাজি নামে ।এলাকার মানুষের দুঃখী জীবনে একমাত্র ভরসাস্থল একপুরিয়া মৃত্তিকায় ।সর্বরোগহর
এই মৃত্তিকা পাওয়া যায় বিনামূল্যে। প্রাক স্বাধীনতা থেকে সদ্য স্বাধীন দেশে
অরুণাবন্দ বিখ্যাত হয়ে আছে চা-শ্রমিক আন্দোলনের জন্য , কী বাঘা বাঘা নেতারা সব
সেকালের।খাদির ধুতি পাঞ্জাবি আর টায়ারের চটি পরা জননেতাদের সামর্থ ছিলনা সেন্ট্রাল
রোডের ফ্লেক্স থেকে বাহারি চটি কেনার ।একশিলার বাবাজিরও অনাড়ম্বর জীবন, খাদির
প্রচলন নেই মন্দিরে তাই তিনি সেনগুপ্ত ধুতি পরেন ,আর তেল চকচকে শরীরে থাকে পিথ্রি
কোম্পানির ফুলহাতা উত্তমকুমার গেঞ্জিও।দেখলেই ভক্তি হয়। যারাই আসে পুরিয়ামাটির
সঙ্গে মাগনায় প্রসাদ পায় মন্দিরের ।একশিলার চারদিকে চারটি কদম গাছ, গাছের নিচের
মাটি দিয়ে হয় পুরিয়া । প্রতিবছর ঘাগরা নদির পলিমাটি দিয়ে ভরাট করে রাখা হয় গাছের
গুঁড়ি ।আবার এই মাটির পুরিয়া দিয়ে হয় সার্টিফিকেটও, দীক্ষান্ত শংসাপত্র ।পুরিয়ারও
আছে অনার্স ডিস্টিংশন। রঙের অভিজ্ঞানে ধরা পড়ে মেধা । ১০০ ভাগ বিশ্বাসযোগ্যতার
সবুজ পুরিয়াধারী মধ্যমের এখন অবাধগতি মন্ত্রী থেকে সান্ত্রী মহলে ।
৫
মধ্যম এখন সাতচিতের কড়ি । লঙ্কার এই গোলকধামে সে সর্বজনগ্রাহ্য
ঘড়াঞ্চি ।
সোনার লঙ্কাপুরির জৌলুস এ লঙ্কায় না থাকলেও রূপসিং এর বাড়িতে বৈভব
প্রচুর।রামায়ণের লঙ্কার কালনেমি সৌমীলি কুবের রাবণ মেঘনাদ বিভীষণ নেই কোথাও,বিজয়
সিংহও নেই, ছিলনা কোনকালে ।সাগর নেই ধারেকাছে, ব্রহ্মপুত্র কলং ও অনেক দূরে । তবে
আসাম দেশের লংকার খুব সুনাম, কামরাঙ্গা লংকা, ধানিলংকা, সিটিফল লংকা।এক রকমের লংকায় ঘিয়ের
গন্ধ ম ম করে , কালো কালো মার্বেলের মতো।মোটকথা আসামের লংকায় খুব ঝাল।এত লংকা
খেয়েও অধিবাসীদের মধ্যে তেমন ঝাল প্রতাপ নেই।অনেকটা বাঙ্গালিদের মতো শান্তিপ্রিয়
শান্ত ছেলে, সেই কোন কালে শশাঙ্ক রাজা ছিল , আহোমদের ছিল লাচিত বরফুকন। যুদ্ধটুদ্ধ
তেমন করেনি কেউ । যদিও প্রতাপী জাতি দিয়ে ঘেরা আসাম দেশের সীমানা, নাগা মনিপুরী
খাসি লুসাই গারো অরুণাচলি ।
অসমিয়ারা কিন্তু বন্ধুত্ব সূত্রে বাঙ্গালির সবচেয়ে কাছাকাছি, আবার একে
অন্যের ঘোষিত শত্রুও । একটা ভালোবাসা এবং ঘৃণার সম্পর্কে টিকে আছে বন্ধুরা ।কার্বি
ডিমাছারাও ভাল, বড়োরা একটু রাগী। আসলে উত্তরপূর্বে কেউ খুব একটা রাগি টাগি নয়,
রাজনীতি আর ভূগোলের জটিল অঙ্ক রাগিয়ে দিয়েছে শান্তিময় মানুষকে ।জাতিবিদ্বেষের
চর্চা কিন্তু এই গোলটেবিলের বিচার্য নয়, বরং কিছু চালাক মানুষ মিলে মিশে থাকার
দীক্ষা নিয়েই লঙ্কাধামে মিলিত হয়েছে । তাই লঙ্কার কৌশলী ভৌগলিক অবস্থানটাই নিশ্চিত
হচ্ছে প্রতিরক্ষার জন্য ।
নগর লঙ্কার প্রধান বিশেষত্ব হল তার তিমোহানী কেন্দ্র । সংকেত স্থান
আজমখানের ঘড়ির দোকানে মুখ করে দাঁড়ালে বাঁহাতে ভাটির দেশ ,নামনি অসম।ডানহাতে উজান,
উজানি অসম, এক আশ্চর্য বিভাজিকা । সামনে অনেকটা দূরে উত্তরবাহিনী ব্রহ্মপুত্র,
বুড়া লুইত , পাতকৈ পাহাড়। আর নিচের দিকে দক্ষিণে বড়াইল পাহাড়। বড়াইলের পাথরে
জঙ্গলে আটকে আছে ব্রডগেজ আর মহাসড়ক। বর্তমান মিটার গেজের পাহড় লাইন যেখানে শেষ
সেখানেই বরাক নদির অববাহিকা ,বদরপুর শিলচর করিমগঞ্জ হাইলাকান্দি ।উজানি পথে
একচিলতে নাগা পাহাড়কেও ছুঁয়ে নেওয়া যায়। তারপরতো কাজিরাঙ্গা যোরহাট শিবসাগর
ডিব্রুগড় তিনসুকিয়া মার্ঘেরিটা লিডু অরুণাচল প্রদেশ ।আর ভাটি পথে ডবকা হোজাই নঁগাও
গুয়াহাটি কোকড়াঝাড় ।রামায়ণের কালের এই
শহরে এসে মিলিত হওয়া তিনটি পথই খুব গুরুত্বপূর্ণ ।ব্যক্তিগত উদ্যোগের এই সভার
প্রস্তুতি , প্রতিরক্ষার বিস্তর তৎপরতা । যেন মহাভারতের সময়ের মন্ত্রণাসভা । একটা
মাত্র সাদা অ্যাম্বেসেডরে মন্ত্রী মাওসেন
, বিভিন্ন মডেলের অন্যগুলোও যেন মাথা নুইয়ে , লুকিয়ে লুকিয়ে ঢুকছে এক দূর্গের ভিতর
।পাঞ্জাবি বস্তির শেষ সীমানায় জঙ্গলের ভিতর রূপ সিংহের প্রমোদভবন তথা বাগানবাড়ির
দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কাফিলা ।রেলের কন্ট্রেক্টর রূপ সিং পাঞ্জাবি হলেও,সর্দারদের মতো
পাগড়ি পরলেও , গুরু নানকের শিষ্য হলেও , সর্দার ভাষা জানেনা একছত্তর ।পুরোদস্তুর
অসমিয়া সে ।
আসামের সঙ্গে শিখ ধর্মের একটা আত্মিক যোগ আছে । পনেরো শতাব্দীতে গুরু
নানক এসেছিলেন, তারপর গুরু তেগবাহাদুরও সশিষ্য ছিলেন কিছুদিন নগাঁও জেলায়। কয়েকঘর
শিষ্য আর ফিরে যায়নি, গুরুর আদেশেই হয়ত থেকে যায় লঙ্কায়।জঙ্গলের ভিতরে রূপ সিং এর
দূর্গবাড়িটা নিচতলা থেকে ক্রমশ ছোট হতে হতে গেছে তিনতলা পর্যন্ত , এক
ব্যালকনিওয়ালা পিরামিডের মতো ।
দোতালার তিনদিকে অথিতির ঘর আর মাঝখানে প্রমোদভবন কিংবা সভাগৃহ । মূল
মন্ত্রণাস্থল । বিকেল থেকেই অতিরিক্ত সতর্কতা জঙ্গলবাড়ির চারদিকে ,সশস্ত্র পুলিশ
দিয়ে ঘেরা ।
রেলপথ আর সড়কপথ রুখতে বাঘা বাঘা সব মহারথীর দল ঢুকছে এদিক ওদিক দিয়ে ।
ভালুকমারির দিক দিয়ে ঢুকছে শইকিয়া স্যার, মহাসড়ক প্রকল্পের প্রধান অভিযন্তা,
হাওয়াইপুর থেকে সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী, সঙ্গে পরিবেশ সচিব নির্মল ডেকা।বড়াইল
অভয়ারণ্যের ভিতর সড়ক হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে । নির্মল স্যার ফাইল আটকে
রাখলে কার ক্ষমতা নড়ায় । তাই বগলদাবা।আমপুখুরি
থেকে বিজয় নাহাটা , সরবজিৎ খুরানা ,আলাউদ্দিন খান , শ্যামল বনিক, বিজয় সানোয়াল , চঞ্চল
রাভা এরা সব বড় ঠিকাদার ছাড়াও আছে জনা কয়েক খুচরো ফড়ে আর বিশ্বস্ত চাকুরে । মাথা
গুনতি পনেরোজন, খুচরোরা থাকছে নিচের তলায়, বড় মাঝারিরা মাঝখানে ।
মধ্যম সাহা নিচের তলার একটা ঘরে তালা লাগিয়ে রেখেছে আবার দোতালায় রূপ
সিং এর ঘরও শেয়ার করেছে ।কারণ রূপ সিং এর ঘরের একদিকে মিনিস্টার ও শইকিয়া স্যার ,
অন্যদিক ফাঁকা, লামডিং থেকে আসবে জগজিৎ সিং রাঠোর ।ঘনঘন এদের সঙ্গে বন্ধঘরে
মন্ত্রণা হয় মধ্যমকে নিয়ে ।
লামডিং এর বনপথে আটকে পড়া রাঠোরকে নিয়ে উৎকন্ঠিত মাওসেন মন্ত্রী । এক
উগ্রপন্থীদল অপহরণ করেছে, মধ্যম জানে সব, মন্ত্রীকে জানায়নি । এসব ছোট দল, টাকা
পেলেই ছেড়ে দেবে । তাই মন্ত্রীকে বলা হয়েছে হাতীর উপদ্রব ।মাওসেন মন্ত্রী কিন্তু
আঁচ করে নেয় পুরো ঘটনা ।মধ্যমকে বলে,
“যাবে নাকি মিডিলম্যান একবার ? রূপকে নিয়ে যাও ।“
“আপনার বিশ্বাস হলো না তো ?”
“মন্ত্রীত্ব করছি কুড়ি বছর , তোমার হাতির গল্প হজম করার বয়স পেরিয়ে
গেছি ।”
“এত ভাববেন না । সব ম্যানেজ হয়ে গেছে, রূপ মাল পাঠিয়ে দিয়েছে। ”
“কত চাইল?’’
“সে ওদের ব্যাপার, রূপ সিং রেলের ঠিকাদার।’’
“রেলের ব্যাপারই অন্য, কী বলো ? প্রচুর ফান্ড ।”
“আপনারও কম নয় স্যার।টাকা সেন্টারের, আপনার হাতে পড়ে সোনা হয়ে যাচ্ছে
।”
“না রে মিডল, পাবলিক খেপে যাচ্ছে, আজকাল ডেইলি পার্টি হচ্ছে,কমিটি
হচ্ছে।সংগ্রাম সমিতি প্রতিরোধ কমিটি।কতদিন আর নির্মলকে দিয়ে ঠেকিয়ে রাখব?তোমার
বরাকেই যত উৎপাত ।”
“আপনার দেশেও কম নয় স্যার । কার্বিদের ডিমাসাদের তো বুঝানো যায়না।কোন
পাহাড় কোন ঝর্ণা থেকে থেকে উদয় হয় সাতচল্লিশ নিয়ে ।”
“এবার তাহলে কাজে গতি আনতে হবে । স্পিড ।”
“স্পীড আনলে বাঁচবেন? পাবলিকের মার হজম করা যায় ,কিন্তু যাদের সঙ্গে
এনেছেন?গদি নিয়ে টানাটানি ।”
“বাজেট বরাদ্দ তো বাড়িয়ে যাচ্ছি।”
“সে ঠিক আছে , এবার চালাকি করুন ।”
“তাও তো করে চলেছি ।”
“কম্প্রোমাইজ করুন। বলে দিন ছ’মাসে কমপ্লিট করে দেবেন।”
“হবে?”
“ছ’মাস অনেক সময় স্যার।”
“তবে তাই হবে । প্ল্যানটা তো বললে না ?’’
“বলব স্যার ।”
“জানি। কমনম্যান আর মিডিলম্যান এর মাথায় বুদ্ধি গিজ গিজ করে ।”
৭
রান্নার ব্যবস্থা উপর তলায় ।চারজন পাচকদল এসেছে একশিলা থেকে।এরকম
উন্নয়নমুখী গুপ্ত সভায় বাবাজির থাকে প্রধান ভূমিকা ।বাবাজিই মেলান তিনিই ছাড়ান ।
বলেন হাত ধরে থাকো ,একশিলা রক্ষা করবে । মৃত্তিকাপ্রাপ্ত শিষ্যদের মিলিয়ে দেন তিনি
। বাবাজি বলেন এত ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছে উন্নয়ণের পরিকাঠামো,
সবাইকে এক না করলে তো ঠুকাঠুকি হবে ।কাজ বন্ধ হবে, উন্নয়ণ থেমে যাবে । সুরক্ষার
ব্যাপারটিও বাবাজি বুঝিয়ে দিয়েছে রূপ সিংকে । তাই জঙ্গলসভায় ঢোকার মুখেই ক্যামেরা
মোবাইল ল্যাপটপ জমা রাখতে হয়েছে নিজের নিজের লকারে । বাবাজি বলেন , মন খুলে কথা
কইতে হবে ।
তবে স্বাগতম পানাহারের দায়িত্ব রূপ সিং একশিলা পাচকদের হাতে ছাড়েনা
।তার ব্যক্তিগত পাচক ধনীরাম হাজংকে অনেকেই চেনে । ধনীরামের বিশেষ আইটেম ছাড়া যে
জঙ্গলের সন্ধ্যা রঙ্গীন হয়ে নামতেই চায়না । নতুন নতুন সব চাটের বিচিত্র পদ।
বনমুরগি হরিণ আর একটা রহস্যময় কিন্তু
দারুন সুস্বাদু আহার্যে জমজমাট হয়ে ওঠে সন্ধ্যার বনবাড়ি।দেশি বিদেশি নরম শক্ত
মিলিয়ে বিচিত্র পানীয় পেটে পড়তেই দু’ভাগ হয়ে যায় সভাসদ্রা । রাঠোর ফিরে এসেই
ঘোষনা করে একশিলার মাহাত্ম্য, বাবাজি বলাই গোস্বামীর একনিষ্ট প্রতিপন্ন করতে একটা
উপদল গঠন করে রেলের ঠিকাদারদের নিয়ে , নাম দের বিজি পার্টি। মাওসেন ঘোষনা করে এম
এস পার্টির ।
বিজি পার্টির বিজয় সানোয়াল হরিণের মাংস দিয়ে স্কচ খেতে খেতে বিজয়
নাহাটাকে বলে,
“বিজয়দা, তোমার থিওরি কিন্তু দারুন।মদ খাবে কিন্তু মাংস খাবে না ।”
“আমি মদও খাই না সোনা । বিয়ার মদ নয় ।”
এম এস পার্টি মানে মহাসড়ক কিংবা মাও সেন ক্যাম্পের বিজয় নাহাটার সঙ্গে
সবাই মজা করে ।বিজয়ও যুক্তি বুদ্ধির ধার ধারে না , উল্টোপাল্টা কথা বলে জমিয়ে রাখে
আসর ।শইকিয়া স্যার মহাসড়কের কাজের অগ্রগতি জানতে চাইলে বলে ,
“উগ্রপন্থী স্যার। শাবল চালালেই, গাঁইতি চালালেই স্যার লেবার প্রবলেম
। দুটো বাংলাদেশি লেবার উঠিয়ে নিয়ে গেল।”
“বাংলাদেশি গেছে তো তোমার কী? কাজ আটকাবে কেন ?”
“আমার সব লেবার বাংলাদেশি স্যার ।”
“লেবার রেজিস্ট্রেশন আছে ?”
“আছে স্যার সব ইন্ডিয়ান ওরা স্ট্রাইক করে।”
ধর্মঘটের কথা শুনে শইকিয়া সন্তষ্ট । কিন্তু বিজি পার্টির সরবজিৎ ছাড়ে
না , ওর বিয়ার তত্তে ফিরে আসে । বলে,
“শালে বিয়ার দারু নেহি, শুওরের মাংস মাংস নয় ।”
“ আরে দোস্ত, ওটা আমি বলিনি, সোয়াবিন খাইয়ে আমার এক দোস্তের বাপ
বলেছিলো শুওরের মাংস।”
“ তোওবা তওবা ।”
সবুজ রঙের ধনীরাম-চাট চাখতে চাখতে আলাউদ্দিন রাগে,
“শালা মালাউন। সব খায় । মদও খায় মাংসও খায় । বনজঙ্গল বিক্রি করেও খায়
।নির্মল স্যার তো জানে না তুই ফরেষ্টের জন্তু মেরে সাফ করে দিচ্ছিস ।”
আপন মনে মাল খেতে খেতে নির্মল ডেকা উপস্থিতি জানান দেয়,
“এই, কে রে ভাই পরিবেশ নষ্ট করছে ?”
“শইকিয়া স্যার, স্যার ।”
মধ্যম সাহা শইকিয়ার পাত্রে মদ ঢালতে ঢালতে ঢালতে হাসে । শইকিয়াও জবাব দেয় মুখের উপর ,
“বেশ করেছি, এই নির্মল ডেকার জন্য পাবলিকের কম ভোগান্তি ? পরিবেশ নষ্ট
হবে বলে কী সড়ক হবে না? সড়ক বানাতে গেলে জীবজন্ত মারতেই হবে, বিজয় মারে মাংস
খাওয়ায় ,পয়সা নেয়না । ব্যস্, কেস ফিনিস্ড ।”
“দেখলি তো আলু ? পয়সা নিই না , ফ্রিতে দিই স্যরকে । পশু, বনমুরগি,
বনরুই, খরগোস, মেরে কেটেকুটে ডাব্বায় ভরে পাঠাই । আমি খাইনা ।”
মাওসেন শইকিয়া আর রাঠোর মৃদু হাসি দিয়ে সামাল দেয় নাহাটাকে । তবে পেটে
মাল পড়লে শইকিয়াটি হয়ে ওঠে একটি বিচ্ছু । নাহাটাকে কপট সমর্থন করে বলে,
“না না নাহাটা খায় না । তবে ঐ গ্রীন আইটেমটা দারুন । এই ধনীরাম বিজয়কে
দিয়েছিস ?খেয়েছ গুরু ?”
“হ্যাঁ স্যার, ঐ সবুজটা তো ?বড়িয়া স্যার,মাশরুম ওটা ।গাছের
ছাল।নিরামিষ ।”
“গাছের ছাল? মাশরুম তো ছত্রাক, গাছের মতো।গাছ নয় মাংস তো নয়ই , বিজয়দা
যখন খায় ।”
শ্যামল বনিক একটা নতুন তত্ব দেয় ছত্রাক বিষয়ে । মানে দুষ্ট বুদ্ধি একটা
আছে ।শ্যামল সবুজ
চাটের পাত্র আবার বাড়িয়ে দেয় নাহাটার দিকে ।সে নেয় এক পিস, মুখে দেয়, এর মধ্যেই
হাসি মুখে শেফ ধনীরামের প্রবেশ। ওকে দেখে নাহাটা আরো খুশি,একচুমুক বিয়ারের নেশাও
চোখে মুখে । বলে,
“ধনীরামজি ,বড়িয়া বানায়া ।”
“কোনটা সাহাব ?”
“আরে ইয়ে যো হরাওয়ালা আইটেম। ক্যা চিজ সে
বানায়া?”
“আচ্ছা লাগা সাব?”
“বহুত আচ্ছা।”
“ও তো ভেকুলি স্যার ।”
“ভেকুলি ইতনা আচ্ছা হোতা হ্যায় ?”
মূল বিষয় থেকে হাসি ঠাট্টায় সময় চলে যাচ্ছে
দেখে মধ্যম সাহা আসরে নামে। ভেকুলির গল্প থামিয়ে নাহাটাকে বলে,
“এবার একটু কাজের কথা হোক বিজয়দা ?”
“কাজের কথাইতো হচ্চে হে মধ্যমদা ।”
“মানে?”
“হরা হরা গ্রিণ গ্রিণ , সবুজ ।”
“ভেকুলি ?”
“আরে না দাদা, সেভ গ্রিণ, পরিয়াবরণ । আমাদের
নির্মল স্যার থাকলে কোন চিন্তা নেই ।”
“বিজেপি যে জোরদার আন্দোলন শুরু করেছে ,আইন
অমান্য।”
মাওসেন মন্ত্রী এবার বিরক্তি প্রকাশ করে ।বলে,
“এখানে পার্টি পলিটিক্স আনবে না মধ্যম । পাবলিক
কী বলছে শোনাও ।”
“বলছে ডিরেক্ট একশনে যাবে ।”
“যাক না , ডিরেক্টলি মায়ের ভোগে পাঠাব । লিডার
কে ?”
“সত্যেন্দ্র বেপারি । শিলচর মালিনী বিলের
রিফুজি ।”
“পাঠিয়ে দাও একশিলায়।বাবাজি সাইজ করে দেবে।
প্রেস রিলিজ রেডি করে নাও ।”
“এত তাড়াতাড়ি ?”
“ছ’মাস নয় ,এক বছর করে দাও । এক বছরে শেষ করব
মহাসড়ক। নইলে পদত্যাগ করব ।”
“আর ব্রডগেজ ?”
“রেলের মন্ত্রী আছে । সাহেব আছে রাঠোর ।”
রাঠোরেরও এক রা ,
“আপনার কথাই শেষ কথা । এক বছর ।”
৮
জঙ্গলমহলে সন্ধ্যা নামে । ঝিঁঝিঁর ডাক এক সুরে
। গোল টেবিল ঘিরেও গুঞ্জন,বাক্ বিতন্ডা বিভিন্ন সংলাপ,
“এ কেমন কথা, মন্ত্রী বললেই হয়ে গেল ?”
“রেলের ডিভিশনের কথার কী দাম, রেলমন্ত্রী বলুক ।”
“কাজ কে করবে ? মন্ত্রী ?”
“লেবার প্রবলেম সামাল দিতে দিতে আমরা জেরবার ।”
“এতোগুলো ট্রাক চালাচ্ছি ,এত কমিশন। মালগাড়িতেই
যদি আসবে ডিরেক্ট তাহলে কিসের এত পিরিত ?”
“এতগুলো নাইট সুপার। সব বসে যাবে ।”
“অনেক টাকা ইনভেষ্ট করে ফেলেছি মন্ত্রীর কথায়
।”
মন্ত্রী আজ বাঘের পিঠে সাওয়ার। রাগে । বলে,
“শালা।”
মধ্যম সাহা মন্ত্রী মাওসেনকে আটকে দেয় । বলে,
“হ্যাঁ, মন্ত্রী বলেছিলেন ব্রহ্মপুত্র সেতু
থেকে ঝাঁপ মারতে ?”
“দালালি না করে উপায় বল সাহা ।”
“উপায় তো মন্ত্রীর কথায় ।”
“এক বছর ! এ কী সম্ভব ?”
“প্রেস রিলিজ দেবেন।”
“তবে তো হয়েই গেল। এরপর আর কী, বগল বাজাব?”
“না সবাই মিলে তেনেঙ্গেনায় যাব , নতুন রাজ্য
নতুন রাজধানী ।”
এবার সবাই একে একে শান্ত হয় ।উপায় খুঁজে পায় ।
বুঝতে পারে মন্ত্রীর চাল। সানোয়াল বলে ,
“তেলেঙ্গেনা কেন? আমাদের কী কম আছে নতুন রাজ্য
?”
কোচ ডার্বি ডিমাসা বড়ো বরাক, শুধু ল্যান্ডই
ল্যান্ড। আবার আন্দোলন। ব্রডগেজ মহাসড়ক আবার ভোগে । আমরা আছি সঙ্গে ।”
মধ্যম সাহাও এবার হাসি মুখে সায় দেয় । বলে,
“স্যার, পদত্যাগ করলেই চিফ মিনিস্টার হাফলং-এ।
বরাকে কে হবে ?”
“বরাকে হবে না।”
শ্যামল বনিক বিশেষজ্ঞের মত দেয় । মধ্যম প্রশ্ন
করে,
“কেন হবে না ?”
“সাপোর্ট পাবে না । দল উপদল অনেক, কোন্দল
বিস্তর ।”
“গুড।বনিকের মাথা খুব পরিষ্কার । আলাউদ্দীন কী
বলে ?”
“বরাক আলাদা না হলেও উপায় আছে , হিন্দু মুসলমান
লাগিয়ে দেয়া যাবে ।”
“তাহলে কী দাঁড়ালো ?সব মায়ের ভোগে। যেমন আছে
তেমন থাকবে রেলগাড়ি আর মহাসড়ক ।”
বিজয় নাহাটা আর আলাউদ্দীন খান পান করে কম, নেশা
হয় বেশি। রাত দশটার মধ্যে দু’জনে চলে যায় নিচে ।মধ্যম সাহার মাথায় পরদিনের
প্ল্যানিং, বিজয় নাহাটাকে ভেকুলির অর্থ জানানোর পর কী হবে প্রতিক্রিয়া ।ভেকুলির
অর্থ ব্যাঙ, আর ব্যাঙের মাংস খেয়েছে জানলে নির্ঘাত বারে বারে তিন লিটার বমি করবে
আর প্রায়শ্চিত্তের জন্য ছুটবে পাওয়াপুরি ।
৯
সমাবেশটাই আসল কথা, আলোচ্য বলে কিছুই নেই
মহাসভায়। শুধু মনোবল বাড়ানো, দীর্ঘায়ত করা কর্মকান্ড। তাই মনের সুখে কড়া পাহারায়
ঘুমোতে পারে মন্ত্রী আমলা ঠিকাদারের দল।
সকালে উঠে কেউ কেউ ভুলে যায় রাত হুল্লোড়ের কথা, কেউবা সাহেবি প্রথা মেনে দু’এক পেগ
ঢেলে নেয় হ্যাংওভার কা্টানোর জন্য।
তবে মধ্যম সাহার অগাধ মনোবল আঘাত পায় ভেকুলি
নিয়ে বিজয় নাহাটার নির্লিপ্ততায়। ব্রেকফাষ্ট টেবিলে সবার সামনে বিজয় নির্বিকার
ভাবে জানায় ভেকুলি শব্দের অর্থ। বলে ধনীরাম এর আগেও খাইয়েছে ।ব্যাঙের মাংস মাংসের
ক্যাটাগরিতে পড়ে না , হরা মানেই ভেজিটেবিল, শাকসব্জি ।
রূপ সিং এর লঙ্কাবাড়ির অরণ্যসম্পদ দেখে অভিভূত
মন্ত্রী মাওসেন। হৃস্ট মিনিস্টার প্রফুল্লমনে রূপ সিংকে নির্দেশ দেয় রক্ষীদের
খাবারের ব্যবস্থা করতে । রূপ সিং জানায়,
“ওরা খাবে না স্যার, নির্দেশ নেই।”
“ওদের কথায় চলবে নাকি ?বলবে মন্ত্রীর অর্ডার ।”
“বলেছি স্যার, ওদের অফিসারটা একটু টেঁটিয়া
।আদর্শবাদী ।”
“পুলিশ আবার আদর্শবাদী হয় নাকি?”
“ওরা সশস্ত্র পুলিশ স্যার ।”
“আমাদের দায়িত্বে আছে এখন। খাবারের গুণাগুণ
দেখাও ওদের কাজ। কত কিছুই হয় আজকাল ।”
“বিষক্রিয়া ?”
“হতেই পারে ’’
এখানে এসব হবেনা স্যার ।সব পাচক আসে একশিলা
থেকে । বাইরের লোক ঢুকতে দেওয়া হয়না ।”
“চশপমা পরা একটা ছেল, ব্রেকফাষ্ট পরিবেশন করছিল। আগে দেখিনি। আউটসাইডার।”
“একশিলা থেকে পাঠীয়েছেন বাবাজি মহারাজ ।”
“সে তো অন্ধ। কী দেখভাল করবে ?”
“অন্ধ ততটা নয়। সে বোবা , কথা শুনতে পারে,
বুঝতে পারে ।”
“ছেলেটি চটপটে, বাবাজির ভাবনা চিন্তা আছে ।এবার
চানটা সেরে নিই তোমার জলের ঘাটে । সেফ তো ?”
“মাছ ধরবেন স্যার ?নৌকো করে চলে যান ,একটা চর
আছে পুকুরের মাঝখানে । গাছ গাছালি ঢাকা ।”
“মাছ আছে ?”
“আছে স্যার আপনার জন্য স্পেশাল।”
“বাবাজি জানে না তো?”
“কী যে বলেন স্যার? টপ সিক্রেট ।”
কত বিঘে জমি আর জল কে জানে। রূপ সিং এর
জমিদারির বিশালত্ব যে দেখেছে সেই অবাক হয়েছে । শুধু গাছ আর গাছ ,ধানখেত, আমবাগান,
সুপুরিবন আর নারকোল গাছের সারি । কত রকমের বন্যপ্রানী । আম কাঁঠাল জাম জামরুলের বন
। বিভিন্ন প্রজাতির শাকপাতা মশলার গাছ, জিরে ধনিয়া কালোজিরে তিল তিসি তেজপাতা ।
রূপ সিং অসমিয়া সর্দার হলে কী হবে , সে গরুর দুধ থেকে মোষের দুধ পছন্দ করে বেশি
।তাই তার গোশালায় গরু ছাড়াও মোষ ছাগল পাঠাও আছে । হাঁস মুরগি পালনেরও ব্যবস্থা আছে
। সে তার বাগানকে বলে পঞ্চবটি ।গাছবাগানের শেষে পাঁচিল, পাঁচিলের পর আবার বিষ্ময়
ভরা জলাশয় , পুকুর, ঝিল বলাই ভাল। ঝিলের মাঝখানে চরবাগান,শনবাঁশের ঘর একটা ,
বিশ্রামাগার। যেখানে মাওসেন মন্ত্রী মাছধরায় ব্যস্ত ।
১০
মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতেই লঙ্কাকান্ড ঘটে যায়
জঙ্গলমহলের তিন তলায় ।পাকশালার কোন ত্রুটি নয় ,অত্যাধুনিক গ্যাসের যন্ত্রপাতি
মড্যুলার সব আছে ঢাকাঢুকি । আলো হাওয়ার জন্য কাঁচের জানালা দুটো , একজস্ট আর চিমনি
দিয়ে বেরিয়ে যায় তেল মশলার ধোঁয়া । রান্নার শেষে একটুক্ষণের জন্য খুলে দেয়া হয়
জানালা , আর সেই ফাঁকে সাত সাতটা হনুমান রান্নাঘরে বাঁধিয়ে দেয় হুলোস্থুল ,
লুটপাটের খাবার খেয়ে পালাতে পারে না ,ধরাশায়ী হয়ে পড়ে থাকে কিচেনে। এতগুলো
হনুমানের মৃতদেহ দেখে চারজন কাজের মানুষ কাঁপছে ঠকঠকিয়ে । এমন ধারা ওরা দেখেনি
কোনদিন । বানর হনুমানতো অনেক কান্ডই করে, রান্না ঘরে ঢুকে , বাগান তছনছ করে ।
রান্নাবান্নাও লুট করে খেয়ে চলে যায় গদাই লস্করের দল। কিন্তু কড়া নিরাপত্তার
ঘেরাটোপে রান্না করা খাবার খেয়ে এত হনুমানের মরে যাওয়াটাও অভিনব ।
খবর পেয়েই পুলিশ ফোর্স ছাদ থেকে চারজন রান্নার
লোককে নামিয়ে আনে বন্দুকের নলে । রূপ সিং সব দেখেশুনে হতভম্ব । মহাসড়কের
শইকিয়া আর রেলের রাঠোরও তথৈবচ। আতঙ্কিত সবাই । ভয়ে কথা নেই মুখে । মন্ত্রী
মাওসেনকে ডাকিয়ে আনে রূপ সিং । সেই একমাত্র সাহসী। বলে,
“এদের ছাড়বে না । লোকেল থানায় খবর দাও । বলবে
আমি ডেকেছি ।”
থানার ইন্সপেক্টর কয়েকজন পুলিশ নিয়ে আসতেই নতুন
করে শুরু হয় তৎপরতা । আবার সবাই দল বেঁধে যায় অকুস্থলে । সঙ্গে চার আসামীও। লোকেল
পুলিশ এক এক করে ওদের উপর চড়াও হয়, গুতোটুতোও দেয় ।পুলিশ কালো চশমা পরা বোবা
ছেলেটির দিকে তাকায় ।মধ্যম সাহা ওকে ডেকে নেয়, সাহস দেয়। পুলিশ মধ্যমকেই প্রশ্ন
করে,
“কিছু বলল?”
“বলল আমপুখুরি বাড়ি ।”
“মানে লঙ্কার হনুমান। ওই তাহলে পালের গোদা !কী
করে বলল?”
“ইশারায়।”
“আপনি জানেন?”
“জানি । ও আমাদের মন্দিরের ভক্ত । বাবাজির খাস
মানুষ।”
“নাম বলল?”
মধ্যম সাহা একটা চিরকূট এগিয়ে দেয় অফিসারকে ।
ইন্সপেক্টর পড়ে তো অবাক্। বলে,
“শুটকি নাগা। দেখেতো মনে হয়না । বাঙ্গালি
বাঙ্গালি লাগে। আমপুকুরিতে এক পিসও নেই। লঙ্কায় নেই নাগা ।”
“ওয়েট ওয়েট অফিসার । অকারণ তৎপরতার দরকার নেই ।
বেচারা কথা বলতে পারে না । ছোটবেলা থেকেই হোজাইয়ের লামডিং নাগার বাড়িতে কাজ করেছে
। বোবার কী নাম, কীইবা টাইটেল ?”
“আপনি কি করে জানেন এত খবর ?”
“আবার তড়বড় ? অন্যদিক খুঁজুন, খুঁজে বের করুন
কালপ্রিট । কে বিষ দিয়েছে, কী উদ্দেশ্য ? মন্ত্রীর সুরক্ষা নেই আপনার এলাকায় ।”
মন্ত্রীর অনুমোদনের নীরবতা দেখে ঘাবড়ে যায়
অফিসার। অনুচ্চ স্বরে মাওসেনকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
“বুঝলেন স্যার, আমাদের ডার্কে রেখে ফোর্স
ডেপ্লয় করা হয়েছে । ওরাইতো দেখছে।”
মধ্যম সাহা অফিসারকে বলে,
“আলো অন্ধকারের হিসেব পরে হবে । এখন যা করণীয়
তাই করুন ।”
পুলিশ চারজন পাচকদলেই তদন্ত সীমাবদ্ধ রাখে।
বয়স্ক লোকটির নাম মোহনবাঁশি ।সঙ্গের পৃথুলা মহিলাটি মাছ মাংস সবজি কুটে বাটনা বাটে
, মোহনবাঁশির বৌ। নাম কিছু একটা বলে । সঙ্গে দুই সাকরেদ ।এক বিহারি নাম রামু। অন্যজন সীতারাম বেহেরা ,উড়িয়া ।
পুলিশের রামুকেই নরমসরম মনে হয়। পাছায় দেয় রুলের এক গুঁতো। বলে,
“বল শালা, খাবারে কি মিশিয়েছিস ?”
“গরিব আদমি বাবু ।”
“তুই হিন্দু না মুসলমান?”
“রাম রাম রাম ।”
“লুঙ্গি পরেছিস কেন ?কে বলেছে বিষ মেশাতে ?আলফা
না মিকির গার্ড ?ইয়াত স্যার মুজাহিদিনও আছে । নির্বিচারে রেল লাইন হোয়া , মহাসড়কও
নিবিচারে। হাইড আউট নস্ট হই যাব ।”
যাকে উদ্দেশ্য করে বলা শেষ দিকের সংলাপ , সেই
মন্ত্রী থামিয়ে দেয় থানাদারকে । বলে,
“আপনি কি বাঙ্গালি না অসমিয়া ?”
“স্যার, বাঙ্গালি ।”
“বুঝেছি , আর পলিটিক্যাল ভাষণ দিতে হবে না ।
এবার যান ।’’
রূপ সিং বাধা দেয়, বলে,
“যাবেন কোথায়। লাশগুলোর কী হবে?”
“আমি কী করব স্যার, বাড়ির ভিতর মরেছে ।”
এবার ভয় পাওয়া সব অস্থায়ী আবাসিক একযোগে বলে,
“খাবারও নেবেন। সব ফরেন্সিক হবে । হনুমানের
পোষ্টমোর্টেম হবে । জানতে হবে চক্রান্ত ।”
আবার সাইডটকে যায় মাওসেন আর মধ্যম সাহা
রিপোর্টার । এদিকে বিজনেসম্যান শ্যামল বনিকের তর সয় না । বলে,
“স্যার, আপনি সিএম কে টেলিফোন করুন। সিবিআই
করাতে হবে।”
মন্ত্রী ধমক দিয়ে শ্যামলকে থামিয়ে দেয় ।পুলিশকে বলে,
“কিছু করতে হবে না । কিছু হয়নি এখানে ।
রিপোর্টার সাহার সঙ্গে চলে যান, সব বলে দেবে ।”
১১
মধ্যম সাহার বুদ্ধি নিয়ে পুলিশ চলে যেতেই আলো
চলে যায় দুম করে ।প্রায়ন্ধকার ঘর থেকে একটা গমগমে কন্ঠস্বর ভেসে আসে গোলটেবিল ঘরের
সিঁড়ির মুখে । একটু আলোর ছটা ঘিরে থাকে স্বরের উৎসে । দুপদাপ শব্দে বন্দুকের দল
ঘিরে রাখে আলোর মুখ।
স্বল্পালোকিত মুখাবয়বে অনেক পরিচিত মুখের আদল।
কখনও যেন বৃদ্ধ মোহনবাঁশি , কখনও রামু , রামচন্দ্র বেহারা, কালো চশমা নেই চোখে তবু
অনেকটা শুঁটকি নাগার মতো , পাশের নারীমূর্তিটিও অবিকল অস্পষ্ট নামের মোহনবাঁশির
গৃহিনী। আলোমুখের কণ্ঠস্বর এবার স্পস্ট হয়,
“বড় জোর বেছে গেছেন সার । মন্ত্রী হলেও শিক্ষক
তো ছিলেন এককালে, বুদ্ধিমান মানুষ।আপনার মিডিলম্যানও বুদ্ধি ধরে। শেষ মুহুর্তে
শুভবুদ্ধির উদয় হয়ছে, পাঁচকান হতে দেয়নি। গুড, তবে সাহাবাবু কতদিন আর মিডিলম্যানের
হয়ে দালালি করবেন?সাংবাদিকতার পবিত্র পেশাকে সম্মান দিন ।”
“আমি মধ্যম। মধ্যম সাহা ।দৈনিক জয়পতাকায় লিখি
।”
বিব্রত মধ্যম সাহা আলোমানুষের সঙ্গে কথা কয় ।
“কুলদীপ নায়ার , বীর সাংভির মতো কিংবদন্তি
সাংবাদিকের উত্তরসূরী আপনি। শুনবেন?বীরের
কথা একটু শুনবেন? বীর বলেছেন, রাজনীতির পর সাংবাদিকতাই সবচে’ শক্তিশালী পেশা।
কিন্তু দায়হীন শক্তির আঁধার আর ক্ষমতা আছে বলেই সাংবাদিকতা নিছকই এক ব্যবসা হতে পারেনা । শুধু
অর্থোপার্জনের জন্য থাকবেন না এ পেশায়। আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না ।”
“বীর স্যারকে দেখেছি দিল্লিতে।”
“গান্ধিজিও বলেছেন সাংবাদিকতার সেবাধর্মের
কথা।”
“গান্ধিজিতো অহিংসার পূজারি?”
“তো কী হয়েছে, সংবাদপত্রের হিংসা নিয়ে বলেছেন।
তিনি সংবাদপত্রকে এক বিশাল শক্তি হিসেবে মানেন। সুশৃঙ্খল আচারসংহিতার কথা বলেছেন, নইলে উচ্ছৃংখল খরস্রোতের মতো
অবস্থা হবে । গ্রামের পর গ্রাম ডুবিয়ে দেবে , শষ্য নষ্ট করবে । যেমন নিয়িন্ত্রণহীন
কলম সেবার বদলে ধ্বংস করে । বলেছেন ‘আমাদের সংবিধানের রূপকাররাও সংবাদমাধ্যমের
প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েছেন, মেনে নিয়েছেন একটি মুক্ত ও স্পন্দিত সংবাদমাধ্যমের
প্রাধান্য ‘।
“আপনারা সংবিধান মানেন?
“আর আপনি, মিস্টার স্তম্ভ। প্রথম পিলার ,
সংসদীয় গণতন্ত্রের মন্ত্রী ও বিধায়ক। সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে এসব কী করছেন
মাওসেন?”
আলো এবার মন্ত্রীর কাছাকাছি হয় । বলে,
“বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্যকরী গণতন্ত্রকে শেষ
করতে উঠেপড়ে লেগেছেন যে ?মানুষকে এক করার পরিবর্তে বিভাজিত করছেন ব্যক্তিগত
স্বার্থসিদ্ধির জন্য। জাতীয় মূল্যবোধ নিয়ে হাসিঠাট্টা করছেন। মানুষের আশা
আকাঙ্ক্ষার মূলে লাঠি আর টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছেন । গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুলি
চালাচ্ছেন।”
“আমরা ওসব বিশ্বাস করিনা । অহিংসায় বিশ্বাস করি
।”
“চোপ্। ২০০৮ সালের বাইশ জুলাই অহিংসার দেশে
লোকসভার ভিতর কী হয়েছিল মনে আছে? ঘুষের টাকা নিয়ে কী ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছিল?”
“বিরোধীদের চক্রান্ত ।”
“আর এই রূপ সিং এর ডেরায় কী হচ্ছে ?কার
চক্রান্ত ?একশিলা বাবার?”
“বাবাজি সাধু মানুষ।”
মাওসেন এর প্রতিরোধ উডিয়ে দেয় আলো,
“নেটওয়ার্ক সাধু। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেন সবাই।
নিজেকে শুদ্ধ করুন। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ছাড়া গণতন্ত্র বাঁচেনা । আমলাদেরও বলেছি জল ঘোলা করবেন না আগুন নিয়ে খেলবেন না । এক বছর বেঁচে থাকার
পারমিট কম নয়। বারোমাসে সব ঠিকঠাক করে ফেলুন। ব্রডগেজ আর মহাসড়ক। হবে তো ?”
সবাই সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ জানায় ।
“আর যদি না হয়?”
মোহনবাঁশির বৌয়ের আদলের নারী কন্ঠ জবাব দেয়,
“এক্সিকিউশন ।”
মূল আলো আবার বলে,
“রায় লিখে রাখার জন্য বিচার বিভাগের এক পিস
আনতে পারলে না? সোহাগা ছাড়া সোনা জুড়বেন কি দিয়ে?”
“আপলোগ হ্যায় না জি ।”
নাহাটার নিরামিশ নেশার ঘোর কাটেনি, তাই সাহস
করে বলে,
“অসাধু ব্যবসায়ীর দল , কেউ বাঁচবেন না ।”
“আপনালোক কোন্ হ্য়, মাওবাদি নেকি?”
নাহাটার দৃষ্টান্তে মুখ ফুটে মহাসড়ক শইকিয়ার।
আলোর জবাবও হয় তীক্ষ্ণ,
“আমরা সাধারণ মানুষ, আম আদমি বলে ঠাট্টা করেন
আপনারা । একটি একতাবদ্ধ এবং জাগ্রত জাতির নাগরিক মুখ আমরা। তীক্ষ্ণধার তরোয়াল আমরা
। ‘খর করবাল’ এর কথা শুনেছেন কোথাও? আমরা সেই দল । তেমনই তীক্ষ্ণ । না শুনে থাকলে
জেনে নেবেন আপনাদের মিডিলম্যানের কাছে , মধ্যম জানে ।”
“না, আমি জানি না । মনে পড়ছে না ।”
মধ্যম মিনমিন করে । আলো আবার সচল হয়।
“সি সি টিভির ফুটেজে আমাদের বিশ্বাস নেই , তাই
নষ্ট করে দিয়েছি। নিজস্ব ক্যামেরায় সাউন্ড সিস্টেমে লোড করে নিয়ে যাচ্ছি। ধন্যবাদ
অনলাইন বাবাকে , মোবাইলগুলো নিয়ে নেবেন লকার থেকে। বুঝতেই পারছেন , চালাকি চলবে না , ফোর্স যারা পাহারা দিচ্ছে সব এরাই
,আমরা নকল পুলিশ। আমাদের কোনো দয়ামায়া নেই। এবার একটু অন্যরকম হল। কী আর করা যাবে
, হনুমান আপনাদের বাঁচিয়ে দিল ভারতীয় রেল আর সৌরাষ্ট্র-শিলচর স্থলপথের স্বার্থে ।”
“এর মধ্যে যদি পৃথক রাজ্যের আন্দোলন হয়, দাঙ্গা
হয় ?”
“৩৬৪ দিনের মধ্যে কত কিছুই হতে পারে, শেষ
বিচারের দিনটা আপনাদেরই বেছে নিতে হবে । হত্যা না জীবন। আর কিন্তু শহিদ হওয়ার
সুযোগ দেব না লঙ্কার বীরপুঙ্গবদের।”
“মানে?”
“মধ্যমের গল্পটা ভুলে গেলেন সবাই ?লঙ্কায় যে
গিয়েছিল তার নাম কি?”
ওরা চলে যেতেই মধ্যম সাহার বিভ্রম কাটে, মনে
পড়ে তরোয়ালের কথা, খর করবাল। আপন মনে হাসতে থাকে আর ডান হাত মুঠো করে উঠিয়ে গায়,
“বন্দেমাতরম।”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন