“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

কবি কর্মী অনিল সরকার এর স্মৃতিতে

।। দেবাশিস ভট্টাচার্য।

 
নীরবে চলে গেলেন অনিল সরকার। একবগগা মানুষটি পন করেছিলেন, রাজনীতি যদি করতেই হয়, তবে করবেন শিল্প সাহিত্য নিয়েই। নিজের মতো করে তাই করে গেছেন। উত্তর পুবে, সাহিত্য-সংস্কৃতির সূত্রেই গড়ে উঠেছিল তাঁর নিজস্ব নেটওয়ার্ক। বহু অখ্যাতনামাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, আক্ষরিক অর্থেই অপ্রকাশের আঁধার থেকে তুলে এনে। তাঁর কাজের একটা নিজস্ব মডেল ছিল, নাগরিক পরিশীলনের দিকে দ্ৃষ্টিপাতের আগ্রহ কম ছিল, অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন এতে। কোনো বন্ধু অনুযোগ করে বলেছিলেন, অতি "অর্ডিনারি" গ্রামের যাত্রাদলকে দিল্লি মুম্বাই পাঠান তিনি, আমাদের কাজ দেখেন না। হ্যাঁ, নাগরিক মানুষের পরিশীলন নয়, তিনি মানুষের প্রাণের ছন্দ,গ্রামের টিলা- লুঙ্গার মৌলিক গন্ধকে ছড়াতে চেয়েছেন, এটাকে তাঁর টাস্ক বলে ভাবতেন। এই অবস্থান রাজনৈতিক দেখনদারি ছিল না, কোনো কোনো অনুষ্ঠানে গ্রামের দল অতি সাধারণ মানের অনুষ্ঠান হয়ত পরিবেশন করছে, যারা মঞ্চে পেশাদারিত্ব প্রত্যাশা করেন, তাদের হয়ত ভালো লাগছে না, কিন্তু অনিল সরকারকে দেখেছি উৎসাহের সঙ্গে বসে থাকতে। এর মধ্যেকার আন্তরিকতা স্পর্শ না করে যায় না। 
        
এই মানুষটির ডাকে এক মঞ্চে যতীন গোস্বামী, আর মেলাঘরের গ্রামের অপেশাদার দল কলা প্রদর্শন করে। আমার মনে আছে, সগর্বে একটি এমন অনুষ্ঠানে ত্রিপুরীভাষী একটি ব্যান্ড এর এক শিল্পীকে দেখিয়ে বলেছিলেন, এই ছেলেটি "অমুক" এর শ্যালক, সেই অমুক একটি সন্ত্রাসবাদী দলের বড়ো পাণ্ডা। নিশ্চিতভাবেই এই ছেলেটি তার দলের ছেলেমেয়েগুলকে নিয়ে সন্ত্রাসী হত। আমি তাদের গান ধরিয়ে দিয়েছি। এখন এরা রাতে ঘুমোতে পারে না। সারা বছর প্রোগ্রাম থাকে। আমি এইভাবেই, সন্ত্রাসবাদকে প্রতিরোধ করেছি গান দিয়ে। মন্ত্রককে ব্যবহার করে পঞ্চায়েত-মহকুমা-ব্লক-জেলা-রাজ্য স্তরের নানা প্রতিদ্বন্দ্বিতা আয়োজন করেছি। বলেছি, তোরা তোদের গান কর। যারা বলেছে গান নেই তাদের, বলেছি, আজান আছে তো, অথবা কীর্তন ? এগূলোরই কম্পিটিশন হবে। আজ মুম্বাইর নাটকের দলে যে চুনু মিয়া কাজ করে ভারতের শিল্পবোদ্ধাদের চোখে পড়েছেন,ইনিও অনিল সরকারের আবিস্কার। যে মঞ্চে ত্রিপুরার শ্রেষ্ঠ কন্ঠশিল্পী হিসাবে পুরস্কার নিতে গিয়ে রিক্সাচালক চুনু কেঁদে ওঠে বলেছিলেন,অনিল সরকার তার পিতা, তার নতুন জন্ম দিয়েছেন, ঘটনাচক্রে আমি ওই মঞ্চে ছিলাম একজন বক্তা হিসাবে। ওই মঞ্চেই, একটি ছেলে , সিন্নথেসাইজার বাদক, নবীন শিল্পীর রাজ্য পুরস্কার নিতে এসে আমাকে নমস্কার করে জানিয়েছিল, সে আমাদের ছাত্র, বিশালগড়ের দিকের কোনো গ্রামের ছেলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এম ফিল করছে। দেশের আর কোনো সংস্কৃতিমন্ত্রী এই আন্তরিকতায় কাজ করেছেন কি না জানা নেই।
        
 
        অনিল সরকার চেয়েছিলেন একটা কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে। তাঁর সাগ্রহ আহবানে বরাক উপত্যকার গ্রামের রংমাই নাগা, কিংবা ওঝা নাচের দল নিয়ে একাধিকবার আগরতলা বইমেলায় গেছি। বারবার বলতেন, টাকাকড়ি দিতে পারব না, কিন্তু এই সমন্বয়টা গড়ে না উঠলে পূর্বোত্তরের উপজাতিদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে। উত্তর পুবের শিল্প-সংস্কৃতির একটা অখণ্ড মঞ্চ তাঁর স্বপ্ন ছিল। কমরেড, নিজস্ব যাপনের মধ্যবিত্ত সীমা ছেড়ে আপনার ডাকে পুরোপুরি সংস্কৃতি সংগঠক হওয়ার অবকাশ ছিল না, আমার এই সীমাবদ্ধতা একাকী মুহূর্তে বড়ো পীড়া দেয়। আমি শুনেছি, মন্ত্রীর বাড়িতে সকাল থেকেই হাজির হতেন সামান্য কীর্তনশিল্পী, কিংবা বাউল। এঁরা তার নিকটজন, পরম বন্ধু। প্রান্তিক মানুষের এমন আন্তরিক বন্ধু বামপন্থীদের মধ্যেও বিরল। অনিল সরকারের স্মৃতির প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা।তাঁর কাজের ধরণ, আমার কাছে গবেষণার বিষয়। এই কর্মী মানুষটির সাংস্কৃতিক কাজের যথাযথ, নির্মোহ, প্রণালীবদ্ধ মূল্যায়ন হোক।

কোন মন্তব্য নেই: