(দেবাশিস তরফদারের 'মেঘ ও রৌদ্র' পড়ছিলাম এক বিশেষ দরকারে। তিনি শুধু একক কবি নন। দেখা যাবে পূর্ববঙ্গ গীতিকা হয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অশোক বিজয় রাহা, দেবেন্দ্রকুমার পাল চৌধুরী পেরিয়ে আমাদের কবিতার পরম্পরার একজন সার্থক ধারাবাহক। কেমন হবে আমাদের কবিতার ভাব এবং ভাষা, দেবাশিস তরফদার না পড়লে বোঝাই যায় না। হারাঙ্গাজাও এই নিয়ে দ্বিতীয়বার পড়া। ভাবলাম, কেননা পড়িয়ে ফেলি আপনাদেরও। তিনি আন্তর্জালে লিখতে পারেন না, বাংলা--তাঁর হয়ে তাই নিজেই তুলে দিলাম।বানান তাঁর মতোই রেখে দিয়েছি।)
গৌহাটী
এখান থেকে অনেক দূর
কলকাতার
কথা আমরা ভাবতেই পারি না
চারদিকে
গোল হয়ে পাহাড়
মাঝখানে
একটা বাটির মতো ছোট আমাদের এই শহর—
তোমাদের
মনে হতে পারে----এই কি শহর
পাঁচমিনিট
হাঁটলেই ফুরিয়ে যায়---
আমাদের
মনে হয় না
আমাদের
কল্পনায় হারাঙ্গাজাও বড় হতেই থাকে—
বেলুন
যেমন বড় হয় আমাদের দমে
শহর বড়
হয় মনে।
কলকাতার
পাড়ার নাম গল্পের বইতে থাকে—
শ্যামবাজার
ঢাকুরিয়া ভবানীপুর
অনেক দূর
দূর নাকি পাড়াগুলি
আমার মনে
হয় আমাদেরও অনেক পাড়া
বাড়ি
থেকে ইস্টেশন যেতে
আমি থেমে
থেমে যাই, থমকে থমকে দেখি
পথ কেমন
অনেক দিকে চ’লে গেছে
একটা পথ
মন্দিরের দিকে গেছে
ঐ পথটার
নাম রেখেছি মন্দিরটিলা
আরেকটা
ছোট পথ ব্রিজের দিকে---সে পথটাকে
মনে মনে
জাটিঙ্গা রোড বলি
পথের
প্রতিটি ঘটনাই ইস্টেশন
ইস্টেশন
মানে যেখানে যেখানে থমকে দাঁড়াই
এই
ব্রিজটাও তেমন একটা ইস্টেশন
যার নীচে
কালো পাথর আর রূপালী ফেনা মেশানো একটা নদী
জাটিঙ্গা
নদী---
রাতের
বেলা পাঁউরুটি কিনে ফেরার পথে
এই
জায়গাটাতে থমকে দাঁড়াই
নীচে
চকচক করছে জল
ওপরে
চকচক করছে তারা
ব্রিজ
পেরুলেই বাজার
সে যেন
নতুন একটি পাড়া—ভাবতে ক্ষতি কী?
আমাদের
বাজারে কম কি জিনিস আছে?
একটা
দোকানে ক্রীম বান পাওয়া যায়
গোল গোল
, নরম নরম, মাখন মাখন গন্ধ
একটা
দোকানে সারাদিন গান বাজে
মিষ্টি
খেতে খেতে শুনে যাও গান
আজকাল
অনেক উন্নতি হয়েছে বাজারের
ব্যাডমিন্টনের
র্যাকেট পাওয়া যায়।
বাজারের
পর কালীবাড়ি—তার পরেই ইস্টেশন
দিনে
দু’বার গাড়ি আসে, দশমিনিট জিরায়
শিলচরের
লোক নিয়ে গৌহাটি যায়
গৌহাটির
লোক নিয়ে শিলচরে ফেরে
আর
মালগাড়ির ত কথাই নাই
ঘুমিয়ে
ঘুমিয়ে তাদের শব্দ শুনি সারারাত
ইস্টেশন
আশ্চর্য এক পাড়া
ঘুগনি,
মাংস , আনারস
টিকেটঘর,
ঘন্টাঘর
ভোরবেলা
এস একদিন সেখানে
দেখবে
সারি সারি কাঠের বাকসে
সারি
সারি ঘুমন্ত লোক—গাছের ডালে রাতের পাখীর মত
যেই না
দিল টিং টিং ঘণ্টা
অমনি
জীয়ন কাটিতে সব আলো
পাখীগুলি
জেগে উঠল চীৎকারে
কাঠের
বাকস থেকে বেরিয়ে পড়ল রুটি, কলা , ডিমসেদ্ধ
শুনেছি
গঙ্গার ওপর দিয়ে জাহাজ চলে
আমাদের
জাটিঙ্গা নদীতে শীতকালে হাঁটুও ডোবে না
তাতে কী?
একটু
খোঁজাখুঁজি করলে ঠিক পেয়ে যাবে বুক জল
বড় বড় দুটো
পাথরের মাঝখানে
চেষ্টা
করলে ডুবও দেওয়া যায়, আমি দেখেছি
জল
ছিটানো যায় ঘন্টার পর ঘন্টা
ভীড় ক’রে
ছেলেমেয়েরা চান করতে আসে
তাদের
চান ফুরাতেই চায় না
বিশ্বাস
কর’, আমাদের বেড়াবার জায়গা প্রচুর
শুক্রবারে
বিকেলে এস, নিয়ে যাব শহীদ বাবার মাজারে
কতলোক
মোমবাতি জ্বালাতে আসে
মুরগী
কাটে, পায়েস ভোগ দেয়
কলাপাতায়
গরম গরম পায়েস
রবিবারে
নিয়ে যাবো ইস্টেশনের ওপারে
যেখানে
সিঁড়ি উঠে গেছে পাহাড়ে, আকাশের দিকে
বনের
মধ্যে দিয়ে সিঁড়ি , সিঁড়ি উঠে গেছে বোলমোল বস্তিতে
যেখানে
হ্মারদের গীর্জাঘর
ছোট্ট
ইস্কুলঘরের মত
সেখানে
থাংময়ী খুড়ীর বাড়ী
নিকোনো
উঠান---লেপের তুলো রোদে দিয়েছে
বসার ঘরে
লাস্ট সাপারের ছবি
আর একটা
কাঁথায় সেলাই করে লেখা
‘যীশু
এবাড়ির অদৃশ্য অতিথি
প্রতিটি
খাবার টেবিলে তিনি আছেন
আমাদের
সব কথা আড়ি পেতে শুনছেন’
শুধুই কি
বোলমোল বস্তি
আরো কত
পাহাড়ী বস্তি আছে
যেমন
দলৈচুঙা---সে সব জায়গায় ত এখনও যাওয়াই হয় নি
কখনো
কখনো যাই মন্দিরটিলায়
সে যেন
এক হিমালয়---আমার মনে
কত পাহাড়
বেয়ে , জংলী লতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে
উঠি আমি
নিঝুম
মন্দিরটি –জলের কল আছে
আর আছে
ঠাণ্ডা বারান্দা—শুয়ে থাকি সেখানে
আমাদের
এই শহরে সারাবছরেই কিছু না কিছু লেগেই আছে
দুর্গাপুজায়
ভীড় হয়
তেমনি
বড়দিন ধুম হৈ হৈ
নিউ-ইয়ার
অবধি লাল তারা জ্বলে পাহাড়ে
ফেব্রুয়ারী
মার্চ মাসে এলে দেখবে পাহাড়ে চক্রদিয়ে আগুন
জুম
চাষের আগুন
নামঘরে
কীর্তন, নেপালীদের ভাইফোঁটা
কিছু না
কিছু সবসময়েই আছে
সব আছে
ব্যাংকও
আছে একটা---টাকা রাখার
আছে
দু-দুজন ডাক্তার
আটটা বেড
আছে হাসপাতালে
বাঙলা
ইস্কুল, ইংরাজী ইস্কুল, হিন্দী মাস্টার
আমাদের
হেডমিস্ট্রেস দিদিমণির নাম হে-সিন্থিয়া
তাঁকে
রাস্তায় দেখলে গুড মর্নিং বলি
আমাদের
ইস্কুলঘরের জানালায় কাঁচ নেই
এবার
নাকি তাও লাগিয়ে দেবে
কত মজার
খবর হয় আমাদের
একদিন
একটা অটোর সঙ্গে চিতাবাঘের ছানার ধাক্কা লাগল
মরা
ছানাটা ছিল ফুটফুটে
একদিন
আমাদের ইংরাজী স্যার
মদ খেয়ে
রাস্তায় শুয়ে রইলেন
গৌহাটী
এখান থেকে অনেক দূর
ট্রেন
বদল করতে হয়
শিলচর
থেকে খবরের কাগজ আসে
সেখানে
মাঝে মাঝে কলকাতার খবরো থাকে
কলকাতা
বড় শহর
ছোট্ট
বাটির মত হারাঙ্গাজাও, পাহাড়ের কোলে
তোমরা
ভাব—পাঁচ মিনিটের শহর
আমি জানি
হারাঙ্গাজাওয়ের কথা
পাঁচ
ঘণ্টা বলেও শেষ করতে পারব না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন