“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

একটি রাজনৈতিক প্রেমের মৃত্যু



আমার একটি রাজনৈতিক মৃত্যু আশা করেছিলে তুমি। ভাগ্যিস শেক্সপিয়র সাহেব ছিলেন সেদিন।
'ওথেলো' না লিখলে সেদিন আমার মৃত্যু ছিল নিশ্চিত।শুনেছিলাম এক বছর টেমস নদীর জল বরফ হয়ে গিয়েছিল অসম্ভব ঠাণ্ডায়। তোমার বয়েস ছিল তখন ষোল।টেমস নদীর বুকে সেদিন আমোদ প্রমোদে মত্ত ছিল তোমার দেশের রাজা। সমস্ত আইনের শাসনের বাইরে ছিলেন টেমস পারের রাজত্ব।সময়টা ষোড়শ শতকের কাছাকাছি কোন সময় হবে। টেমসের তীরে এমনি এক বিকেলে শিকার হয়েছিলে তুমি।

১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা জেমস স্টুয়ার্ট স্কটল্যান্ড ভ্রমণের সময় ডাইনিদের শাস্তি ও মৃত্যুকে অনুমোদন দিয়েছিলেন।আজ ২০১২ খ্রিস্টাব্দ। এই দেশে আমার প্রদেশের রাজা, গণপিটুনির নামে রাজনৈতিক হত্যাকে অনুমোদন দেন এখনও।ধর্ষিতাকে দুশ্চরিত্রা বা ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে মারার জন্য ফতোয়া দেন। কারন অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি এই দীর্ঘ সময়কালের মধ্যেও আমার পাহাড়ের। এখনও রাজারা আইনের শাসনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন।

আজ কদিন তোমার মন উচাটন। আমি জানতাম। আমার মৃত্যুকে তুমি আগাম দেখতে পেয়েছিলে। তোমায় সেদিন শেষ বারের মতো দেখে এসেছিলাম। উপহার দিয়েছিলাম এই লংতরাই পাহাড়ের বুনো ফুল আর নতুন কলার মোচা। ষোড়শ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে গাই ফক্স আর তার সঙ্গীদের হত্যা করা হয়েছিল বল্গা হরিণে টানা গাড়িতে করে এনে, আজকের পার্লামেন্টের সামনে। গাই ফক্সের দলে সেদিন আমি ছিলাম না, অথবা ছিলাম! তুমিই জানতে শুধু প্রিয়তমা।  পরের বছরই অত্যধিক তুষারপাতে বরফ হয়ে গিয়েছিল তোমার প্রিয় নদীর জল আর তুমি। ফাঁসি কাঠে দাঁড়িয়ে সেদিন বলেছিলাম একবিংশ শতকে, পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক সভ্যতায় আবার ফিরে আসবো তোমার জন্য। কথা দিয়েছিলে তুমিও।

এক পাহাড়ি সভ্যতার স্বপ্ন দেখতাম আমরা। যেখানে পড়বে পৃথিবীর প্রথম সূর্যরশ্মি। এই জন্মে তাই বেছে নিয়েছিলাম প্রিয় পাহাড়ের এই পাদদেশকে। এই সভ্যতা, পৃথিবীর এই সময় আজ আবার আমায় আরও নির্মমভাবে হত্যা করলো। সেদিন তোমায় শেষ কথা জানানোর সুযোগ দিয়েছিল তোমার রাজা। আজ সেই সুযোগও নেই। পৃথিবী নৃশংস হতে হতেই সভ্য হয়েছে। রাষ্ট্র আরও কঠোর হয়েছে। ধর্ম হারিয়েছে তার যাবতীয় স্বত্বা। রাজা হয়েছেন আরও স্বৈরাচারী।

এসো আলোয় ফিরে যাই। বাইবেল মূদ্রণ হয়েছে আজ চারশত বৎসর। কিন্তু খৃষ্ট প্রেমের বাণী আজও প্রেম দিতে পারেনি এই পৃথিবীকে। পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমধর্মের বাণী আজও ব্যর্থ। যুগে যুগে রাজনৈতিক কারনেই ব্যাবহার করা হয়েছে ধর্মকে। এই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তিকে এখনও মানুষের উপযোগী করে তুলতে পারেনি কোন ধর্ম।
যতদিন তোমাদের কাছে আলো আছে, আলোর পথে যাতায়াত করো, যেন অন্ধকার এসে না পড়ে কোনদিন তোমার উপর। এসো বিশ্বাস করি সেই ঈশ্বর প্রদত্ত আলোর ঠিকানাকে। আমরা আলোর সন্তান।
জানো এই সপ্তমীর বিকেলে, আমার লংতরাইয়ের জীর্ণ কুটিরে, আমার শ্রাদ্ধ বাসরে পড়ন্ত বিকেলের আলো পড়েছে প্রিয়তমা।
এমনিতেই এই সময়টা বুকের ভেতরে কেমন খাঁ খাঁ করে। তুমি দুঃখ পেয়োনা। আমি আবার আলোর সন্তান হয়েই জন্ম নেব। ভালবাসায়, প্রেমে ভড়িয়ে দেব এই সৃষ্টিকে। তুমি শুধু পাশে থেকো।ভয় পেয়োনা! তোমার প্রিয় নদীর রুপ যুগে যুগে পাল্টে যাচ্ছে। অত্যাচারে অত্যাচারে ফুঁসছে তোমার গোমতী, তিস্তা, পদ্মা, গঙ্গা। আর কোন তুষারপাত হবেনা এই সভ্যতায় আমি নিশ্চিত জানি। আগামী ষোল বছর তাই তুমি এক নিরুত্তাপ শরীর হয়ে থাকবে রাজার খাস মহলে। নীল বেণারসী পরিহিত রাজমহিষী হয়ে।
এরপর তোমার মৃত্যু নিশ্চিত জানি। এরপর আলোর রেখা ধরে আমরা আবার নেবো পুনর্জন্ম। পাল্টে দেব একদিন তোমার ওই প্রিয় পাহাড়, নদী আর বীভৎস রাজার অন্দরমহল। এখন তুমি আপাতত নীরব ঝর্ণা হয়েই থাকো।
আমরা আবার ভ্রমণে বেরোব আগামীর জাহাজ ভার্জিনিয়ায় চড়ে সমুদ্র মন্থনে। সৃষ্টি করবো এক নতুন দ্বীপ। আমেরিকা নয় সেই দেশের নাম। নামহীন এক পাহাড়ি দেশ। যেখানে পড়বে পৃথিবীর প্রথম ভালোবাসার সূর্যালোক। জাপানও নয়। যত্ন করে রেখো আমার রক্তকরবী। আক্ষেপ শুধু, এই বাসন্তী দশমীতেও তোমার সিঁদুর খেলা হলো না। একটি রাজনৈতিক প্রেম একা মৃত্যুর সঙ্গে খেলে গেল এক অদ্ভুত খেলা।

(গত তিন চার দিনে ত্রিপুরার পাহাড়ে দুটি যুবতী রাতভর গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এরপর তাঁদের ভাগ্যে জুটেছে খারাপ মেয়ে হওয়ার খেতাব। দুই দলের রাজনৈতিক সংঘর্ষের মধ্যে পরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে দুই সদ্য যুবা। ষোড়শ খ্রিস্টাব্দ আর এই ২০১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোন পরিবর্তন কি আদৌ হয়েছে?)

1 টি মন্তব্য:

সুশান্ত কর বলেছেন...

দারুণ লিখেছো। এই মানবিক অনুভূতিগুলো যদ্দিন বেঁচে আছে, তদ্দিন আশা আছে! দুই একটা বানান ঠিক করে দিলাম!