শনবিল, এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল। নিঃসন্দেহে বরাক বাসীর কাছে বুক ফুলিয়ে বলার মত এটা একটা স্থান। এই গৌরব মাখা শনবিলের অবস্থা কেমন, কী করেই বা দিনান্তের নুন-পান্থা জোটাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা, এ সবের হাল-হকিকত পর্যবেক্ষন করব বলেই অনুসুচিত জাতি মহাসভার ব্যবস্থাপনায় গ্রীষ্মের এক ভোরে বেরিয়েছিলাম আমরা ক‘জন। সফরসঙ্গী ছিলেন, বন্ধুবর মানবেন্দ্র, উনার এককালের ছাত্র তথা আমাদের বর্তমান সহকর্মী অনুপম, আমার এককালের সহকর্মী তথা বর্তমান ছাত্র নিলম, এবং সাংবাদিক বন্ধু পীযূষের নেতৃত্বে হাফ ডজন সাংবাদিকেরা। এক সাংবাদিক তো ফিরে এসে উনার পত্রিকায় লিখলেন, শিরোনাম, ধান খায় সিংলা... পরাণ জ্বলে শনবিল্ বাসীর !!!!
‘বাড়া ভাতে ছাই’ কথাটা শুনেছেন তো অনেকেই, প্রত্যক্ষ করেন নি তো কক্ষনো! তাই নয় কি? অমনটা অভিজ্ঞতাও আপনাদের হয় নি, তাই না? মনে করুন, চব্য-চেস্য-লেহ্য-পেয় দিয়ে সুস্বাদু খাবার সাজানো সামনে, দারুণ খোশ মেজাজে আপনি শুধু পাতে হাত দেবেনঃ আর ঠিক অমন সময়-ই কোনও এক অদৃশ্য কারণে আপনার সামনা থেকে থালা-খানা উধাও হয়ে গেছে! কেমন ছিঁড়বে... মেজাজটা?
সেরকম একটা পরিস্থিতিতে আপনাকে আজ অবধি যদিও পড়তে হয় নি, কিন্তু বৃহত্তর শনবিল- রাতাবিল- নগেন্দ্রনগর – গোপীকানগর – অর্জুননগর – ভৈরবনগর - বসন্তপুর – শান্তিপুর - শ্রীরামপুর – বাংলাটিলা – শৈলনগর – বাগানটিলা - ফাকুয়া এবং পাশের অন্যান্য সব গ্রামের বাসিন্দাদের সেরকম একটা পরিস্থিতিতে ফি বছর পড়তে হচ্ছে। এক বুক দুঃখ নিয়ে স্থানীয় এক বাসিন্দা বললেন, এ বছর আগাম বন্যা হওয়ায় যা ক্ষতি হল, সেটা পুষিয়ে উঠতে সাত-আট বছর লাগবে। আর এই সাত-আট বছরের মধ্যে যদি আরও দু-এক বার বন্যার পুনরাবৃত্তি হয়, তাহলে? কষুন তো হিসেব টা! এলাকার বরিষ্ঠ বাসিন্দা কামদেব দাস রাকেশ নগরের জনসভায় দুঃখ করে বলছিলেন, টিনের চালায় বাস করতে আমাদেরও তো সাধ হয়... কিন্তু সাধ্যি কৈ? অনেকটা যেন গোঁজা লোকের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতই অধরা থেকে যায়...। ওঁদের স্বপ্নটা ...... চিরকাল ......
রাকেশ নগরের জনসভা এবং স্বল্পাহারের পর শুরু হল নৌকা-যাত্রা। ঘড়িতে বেলা বারোটা। নৌকা যতই এগিয়ে যাচ্ছিল, চারদিকে শুধু জল আর জল। সর্বত্র দ্বা-দ-শ-ঘ-টি-কা। পাকা সোনালী বুরো-ধান...। যাওয়ার কথা ছিল কৃষকের গোলায়; সিংলা নদীর বদান্যতায় পড়ে রয়েছে ‘বিশ বাঁও জলের’ তলায়!
রাকেশ নগর থেকে নগেন্দ্রনগর...... প্রায় দু ঘণ্টার সফর কালে মোটর-বোটের সহযাত্রী বাসিন্দারা তর্জনী উঁচিয়ে দেখালেন, এটা এনার ক্ষেত, তো ওটা উনার। আসলে ক্ষেত তো নয়, এ যেন হ্রদ... চিল্কা... শুধু নোনা জলের ব্যবধান। হাঁসুলী বাকের উপকথায় যে বর্ণনা বিভূতি ভূষণ দিয়েছেন, শনবিল-রাতাবিল-এর কাছেটা যেন নেহাতই তুচ্ছ। তেমনটাই মনে হচ্ছিলো।
মহাসভার তরফে ব্যবস্থাপক তথা অন্যতম সফরসঙ্গী প্রনবানন্দ দাস বলছিলেন, আমাদের এই দুঃখ চিরকালের!এ দুঃখমোচনে কোনও নেতা মন্ত্রী আজ পর্যন্ত সে রকম ভাবে এগিয়ে আসেন নি। ওঁদের পঞ্চবার্ষিকী দেখা মেলে। সেই ইলেকশনে। বক্তৃতার ফুলঝুরি আর গালভরা প্রতিশ্রুতি যে আর বস্তাপচা সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়, এতদিনে হাড়ে হাড়ে ট্যাঁর পেয়ে গেছেন তারা সব্বাই!
লা প্রায় দুটা নাগাদ নৌকা ভিড়ল মোকাম-কালিবাড়ী’র ঘাটে। বেশ পুরনো ধর্মস্থান। দুটি ধর্মাবলম্বী লোকেদের সহাবস্থানে গড়ে ওঠা কি অপূর্ব প্রতীকী পীঠস্থান। রাম-মন্দির বাবরি মসজিদ নিয়ে অনাদিকাল থেকে যারা লড়াই করে আসছেন, এই মোকাম-কালিবাড়ী থেকে অনায়াসে শিক্ষা নিতে পারেন, ওই সমস্ত মেকী ধার্মিকেরা।
দুপুর আড়াই-টা। নৌকা নগেন্দ্রনগরের জনৈক ভদ্রলোকের ব্যক্তিগত ঘাটে। মধ্যাহ্ন ভোজনের ঘণ্টা খানেকের বিরতিতে শনবিলের হরেক রকম মাছ দিয়ে শনবিলে বসেই খাওয়ার অমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম। আনুষঙ্গিক আতিথেয়তা, আন্তরিকতা, অভিজ্ঞতা, এ সবকিছুই বাড়তি পাওনা। প্রচলিত অর্থে সূচিত কিম্বা অধি সূচিত জাতির তুলনায় অনুসুচিত জাতির লোকেদের মন যে গ্রীষ্মের স্ফীত শনবিলের মতই বিশাল, তা আর বলার অপেক্ষা করে না।
পড়ন্ত বিকেল। নৌকা এগিয়ে চলেছে কালীবাড়ি চরের দিকে। বা দিকে শ্মশানঘাট। খানিকটা উঁচু জায়গায় দাড়িয়ে রয়েছে ওই গোটা তল্লাটের একমাত্র মৃতদেহ সৎকারের জায়গাটি। চারদিকে জলে থৈ থৈ। মাঝিভাইকে জিগ্যেস করলাম, এই মরশুমে কেউ মারা গেলে কি উপায়? অবধারিত উত্তর। নৌকা দিয়েই শবদেহ আনা, নৌকা দিয়েই শবকাষ্ঠ জোগাড়, এককথায় সবই নৌকা-নির্ভর। এলাকার একমাত্র হাইস্কুলটাও দেখলাম অথৈ জলে ঠায় দাড়িয়ে আছে। মাষ্টার- ছাত্র-ছাত্রী সবারই নৌকা ছাড়া গত্যন্তর নেই!
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো। উপেক্ষিত শনবিলে সূর্যাস্ত বিষণ্ণতা এবং প্রকৃতির বিরল সুন্দর রূপের এক মিশ্র অনুভুতিতে মন ভরে উঠছিল। সত্যিই তো...... এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ অনসুচিত জাতির লোকেদের মতই গোটা এলাকাটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্লের এক জাজ্বল্য উদাহরণ। গোটা দিনের সফর শেষে কালীবাড়ির চরে অনুষ্ঠিত জনসভায় সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হল, শনবিল- রাতাবিল-কে বাঁচাতে প্রয়োজন একসাথে জোরদার আন্দোলন, প্রয়োজন লাগাতার ধর্মঘট, রাস্তা রোকো সব কিছুই। কিছুই বাদ পড়বে না। ধীর-লয় থেকে আন্দোলন দ্রুত-লয়ে নিয়ে যেতে হবে...... এ সবই হয়তঃ বা হবে... কিন্তু এতো করেও সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের নিদ্রা ভঙ্গ হবে কি......? ? ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন