“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৯

আসামের জনবিন্যাস পরিবর্তন (Demographic change) এবং দুই সন্তান পলিসি।

 ।। দেবাশিস ভট্টাচার্য ।।
(C)ছবি
নেকেই বলেন আসামের জনসংখ্যা বিন্যাসের পরিবর্তনের কারণ হচ্ছে মুসলমানদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। তাই অনেকেই ভাবেন দুই সন্তান পলিসি দিয়ে এই পরিবর্তন রোধ করা সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হলো মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ কি এবং শুধু মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যই কি জনসংখ্যা বিন্যাসের পরিবর্তন হচ্ছে?

আসামে এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই অঞ্চলের হিন্দু এবং মুসলমানদের চাইতেও অনেক বেশি। ১৯৭১ থেকে ২০১১ অবধি আসামে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৯৭%, এর বিপরীতে খ্রিষ্টানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২০৬%। একই সময়ে (১৯৭১-২০১১) আসাম ছাড়া উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১১৭%, ২৭৫%, ৩৭৫% এবং ২১৪%। তাই আসাম ছাড়া উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যের পুরো জনসংখ্যায় হিন্দুদের আনুপাতিক হার ৬৬.৩৯% (১৯৭১) থেকে কমে ৫৩.৯৭% (২০১১)  এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ১৯৭১ সন থেকে ২০১১ সন অবধি হিন্দু জনসংখ্যা ১২.৪২% হ্রাস পায়। অন্যদিকে পুরো জনসংখ্যায় মুসলমানদের আনুপাতিক হার ৪.১৮% থেকে বেড়ে ৫.৫৭% হয়, অর্থাৎ ১.৩৯% বৃদ্ধি পায়। সবচাইতে বেশী বৃদ্ধি হয় খ্রিষ্টানদের, ২৮.৩৪% থেকে বেড়ে হয় ৪৭.৭৭%। অর্থাৎ পুরো জনসংখ্যায় খ্রিষ্টানদের আনুপাতিক হার ১৯.৪৭% বৃদ্ধি পায়। অথচ আসামে ১৯৭১ সন থেকে ২০১১ সন অবধি মুসলমানদের আনুপাতিক হার ৯.৬৬% বৃদ্ধি হতেই বাংলাদেশী প্রব্রজনকে কারণ হিসেবে দেখানো হয়। উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে খ্রিষ্টানদের অস্বাভাবিক আনুপাতিক বৃদ্ধির (১৯.৪৭%) জন্য অবৈধ প্রব্রজনকে কারণ হিসেবে দেখানো হয় কি? আসামে এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে শুধু হিন্দুদের আনুপাতিক হার কমছে কেন, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয় না। অন্যদিকে একই সময়ে ভারতবর্ষের অন্য অনেক প্রদেশেও মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আসামের থেকেও অনেক বেশি, যেমন হিমাচল (১৯৮%), মহারাষ্ট্র (২০৬%), রাজস্থান (২৫০%), হরিয়ানা (৩৩৯%), পাঞ্জাব (৩৬৮%) ইত্যাদি। একই ভাবে ১৯৭১ থেকে ২০১১ সন অবধি খাসি (১৯৯%), মিজো (২০৬%), মিরি (২৪৯%) এইসব ট্রাইবেল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার  আসামের মুসলমানদের চাইতেও বেশি।  কথাটা অনেকেই জানেন না। চিন্তা শুধু মুসলমানদের নিয়ে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্যই এর মূল কারণ।

মহিলাদের উর্বরতার হার বা টিএফআর (Total Fertility Rate) জনসংখ্যা পরিবর্তনের এক  গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসাবে বিবেচিত হয়। টিএফআর হলো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মহিলাদের সন্তান জন্ম দেওয়ার বয়েসে (১৫-৪৯) গড় হিসেবে কতজন সন্তান জন্ম দেন তার সংখ্যা। ২০১১ সনের সেন্সাস রিপোর্টে আমরা দেখতে পাই যে সামগ্রিকভাবে আসামে মুসলমান মহিলাদের টিএফআর (৩.১) হিন্দুদের (১.৭) তুলনায় ৮২% বেশি। নিম্ন আসাম এবং বরাক উপত্যকার কয়েকটি জেলায় (বিশেষত সীমান্ত অঞ্চলে) মুসলমানদের টিএফআর হিন্দু অধ্যুষিত উজনি আসামের  জেলাগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এই কারণেই মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি।

মুসলমানদের বেশি টিএফআরের  অনেকগুলি আর্থ-সামাজিক কারণ রয়েছে, যেমন গড় মাথাপিছু আয় per capital income), মহিলা সাক্ষরতা (female literacy), মহিলা কাজের অংশগ্রহণের হার (female work participation rate), পরিবার
পরিকল্পনা (Contraceptive prevalence), কিশোরী অবস্থায় গর্ভধারণ (Teenage Pregnancy) ইত্যাদি।

অসম মানব বিকাশের প্রতিবেদন ( Assam Human Development Report, 2014) অনুযায়ী  মুসলমানদের মাথাপিছু আয় ( Rs. 18,228)আসামের  হিন্দুদের তুলনায় অনেক কম ( Rs. 28,092)মুসলমানদের মধ্যে কিশোরী মেয়েদের বিয়ের হার (23.3%) হিন্দুদের তুলনায় দ্বিগুণ
 (11.1%)

জনসংখ্যা বিশারদরা একটি বিষয়ে একমত যে শিক্ষা একজন নারীর উর্বরতার আচরণকে (fertility behavior) সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। কারণ শিক্ষাই নারীকে আরও ভাল সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে, অর্থকরী কাজে অংশগ্রহণের হারকে উন্নত করে, পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সহায়তা করে। পরিবার এবং সমাজে শিক্ষিত নারীকে সম্পদ (Asset) হিসাবে বিবেচনা করা হয়, দায়বদ্ধতা (Liability) হিসাবে নয়। তাই অশিক্ষিত মহিলাদের অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়, হিন্দু, মুসলমান ব্যতিরেকে। স্কুল এবং উচ্চ শিক্ষায় বেশি সময় ব্যয় করার জন্য বিয়ে তুলনায় দেরীতে হয় যা মহিলাদের জন্য বাল্যবিবাহের (Adolescent marriage) হার হ্রাস করে। কিশোরী বয়েসে যে মহিলারা বিয়ে করেন তাদের সন্তানের সংখ্যা স্বাভাবিক ভাবেই বেশি হয়।  নেশনেল হেল্থ এন্ড ফ্যামিলি সার্ভে (2015-16) অনুযায়ী, কিশোরী বিবাহ (বয়স ১৫-১৯) সবচাইতে বেশি নিম্ন আসামের মুসলমান অধ্যুষিত ধুবড়ি (২৯.২%), গোয়ালপাড়া (২২.১%), দরং (২০.৬%), নগাঁও এবং বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দি (১৭.৬%)   জেলাগুলিতে। এই জেলাগুলোতে মহিলা শিক্ষার হারও অনেক কম (৫৩.৩% থেকে ৬৮%)। তুলনামূলক ভাবে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা, যেমন ডিব্রুগড়, যোরহাট, শিবসাগর, গোলাঘাট এবং কাছাড়ে মহিলা শিক্ষার হার অনেক বেশি (৭১% থেকে ৭৬.৪৫%)। তাই হিন্দু অধ্যুষিত এই জেলাগুলোতে কিশোরী বিবাহ অনেক কম (৮.৫% থেকে ১১.৮%)।
আবার ২০১১ সনের সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী আসামে মুসলমান মহিলাদের শিক্ষার হার (৫৬.৮%) হিন্দু (৭১.৩%) এবং খ্রিষ্টানদের (৬০.৫%) চাইতে অনেক কম। ভাটি আসাম এবং বরাক উপত্যকার কিছু জেলায় এই ব্যবধান অনেক বেশি। যেমন ধুবড়ি জেলায় মুসলমান মহিলাদের শিক্ষার হার ৪৮.১% আর হিন্দু মহিলাদের ৭১.৯%। আরেকটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো উজনি আসামের কিছু অসমীয়া হিন্দু অধ্যুষিত জেলায় মুসলমান মহিলাদের শিক্ষার হার হিন্দু মহিলাদের চাইতে বেশি যেমন যোরহাট ( হিন্দু - ৭৬.৪%, মুসলমান- ৮১.৩%), ডিব্রুগড় (হিন্দু - ৬৮.১%, মুসলমান- ৭৯.২%) , শিবসাগর (হিন্দু- ৭৪.১%, মুসলমান- ৮৪.৩%), এবং তিনসুকিয়া (হিন্দু- ৬১.৮%, মুসলমান - ৭১.৭%)। এই কারণেই এই জেলাগুলোতে মুসলমান মহিলাদের গড় সন্তান উৎপাদনের হার (TFR) হিন্দু মহিলাদের চাইতে কম - যোরহাট ( হিন্দু - ১.৬, মুসলমান- ১.৫), ডিব্রুগড় (হিন্দু - ১.৭, মুসলমান- ১.৬) , শিবসাগর (হিন্দু- ১.৮, মুসলমান- ১.৫), এবং তিনসুকিয়া (হিন্দু- ১.৮, মুসলমান - ১.৭)। এই পরিসংখ্যান থেকে একটা বিষয় প্রমাণ হয় যে বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণ মহিলাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি, ধর্ম নয়।  ভারতবর্ষের প্রায় ১২৫ টি জেলায় মুসলমান মহিলাদের টিএফআর হিন্দু মহিলাদের থেকে কম। কাজেই মুসলমান মানেই অধিক সন্তান, এই কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়।


আরেকটি কারণে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হিন্দুর চাইতে বেশি, সেটা হলো শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মধ্যে আনুপাতিক জনবিন্যাস। শহরে যারা বসবাস করেন, তারা মূলত চাকুরীজীবী। এর জন্য শিক্ষার প্রয়োজন, শিক্ষার ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত। তাই শহরাঞ্চলে শিক্ষার হার বেশি। ছেলেমেয়েদের জন্য খরচাও বেশি। এইসমস্ত কারণে শহরাঞ্চলের মানুষরা কম সন্তান চান। আবার গ্রামাঞ্চলের মানুষরা মূলত কৃষি নির্ভর। এর জন্য কায়িক পরিশ্রমের প্রয়োজন এবং লোকবলের প্রয়োজন। তাই গ্রামাঞ্চলে যারা বসবাস করেন তাদের বেশি সন্তানের প্রয়োজন। এই কারণেই গ্রামাঞ্চলের মানুষদের শহরের তুলনায় বেশি সন্তান হয়। জীবন ধারণের জন্য এখানে জনবলের প্রয়োজন। সেন্সাসের পরিসংখ্যান একই কথা বলে। ২০১১ সনের সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী আসামের ৯২% মুসলমান গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। সেই তুলনায় ৮২% হিন্দুরা গ্রামাঞ্চলে থাকেন। মুসলিম অধ্যুষিত জেলায় এই ব্যবধান অনেক বেশি যেমন ধুবড়ি (হিন্দু- ৭০%, মুসলমান- ৯৫%),বড়পেটা (হিন্দু- ৭৫%, মুসলমান- ৯৮%), হাইলাকান্দি (হিন্দু- ৮৬%, মুসলমান- ৯৭%) এবং নগাঁও (হিন্দু- ৭৮%, মুসলমান- ৯৪%)। কিন্তু হিন্দু অধ্যুষিত উজনি আসামের কিছু জেলায় এর বিপরীত চিত্র দেখা যায় যেমন যোরহাট (হিন্দু- ৮১%, মুসলমান- ৬১%), ডিব্রুগড় (হিন্দু- ৮৩%, মুসলমান- ৫৩%), শিবসাগর (হিন্দু- ৯১%, মুসলমান- ৮০%),তিনসুকিয়া (হিন্দু- ৮০%, মুসলমান- ৪৬%) এবং গোলাঘাট (হিন্দু- ৯১%, মুসলমান- ৪৫%)। তাই উজনি আসামের এসমস্ত জেলায় মুসলমান মহিলাদের মাথাপিছু সন্তান (TFR) হিন্দুদের তুলনায় কম।

একটা কথা পরিষ্কার যে শিক্ষা এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ছাড়া আসামের দরিদ্র পীড়িত জেলাগুলোতে, বিশেষ করে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানো সম্ভব নয়। এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র দুই সন্তান পলিসি দিয়ে এর সমাধান হবে কি?


কোন মন্তব্য নেই: