“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৯

জলমাঠের খামারবাড়ি

।। অভীককুমার দে।।

আমরা যখন পৌঁছলাম, মেলাঘরের আকাশে কালো মেঘ জটলা পাকিয়েও জল ধরে রাখতে পারছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে দুএক ফোঁটা ঝরে পড়তেই সম্মিলিত মেঘ কেমন খেঁকিয়ে উঠলো। অবস্থা বেগতিক দেখে বিজনদা, মানে কবি বিজন বোস বাংলাদেশের বন্ধু আল মাদানী আর আমাকে বললেন, 'আর একটুও দেরি করা ঠিক হবে না, চলো'। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অটোরিক্সায় চেপে বসলাম। গাড়ি চলছে রুদ্রসাগরের দিকে।

শেষ বোটটি তখনও ঘাটেই ছিল। তাড়াহুড়ো করে টিকিট নিয়ে আমরা তিন জন চড়ে বসলাম বোটে। বসতে না বসতেই ঘাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। মনে হলো, আমাদের জন্যই বুঝি অপেক্ষা। প্রকৃতিগত সম্পর্ক ও টান আমাদের আসার খবর এই ভ্রমণের সাথে যুক্ত সবকিছুকেই জানিয়ে দিয়েছে বোধহয়। রুদ্রসাগরের বুক চিরে দ্রুত ছুটে চলছি। সামনেই নীরমহল। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। বড় হচ্ছে। কাছে আসছি। কাছে টানছে। কেন জানি, জলসীমানা শেষ হতেই চায় না। বিভূতিভূষণের পাহাড় যেন জলের রূপ ধরে কাছে দূরের খেলা খেলছে। দেখছি, বাঁদিকের জলসীমা হয়ে দলবদ্ধ বৃষ্টি ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। ডানদিকে নীরবতা। আমাদের বোট তখন রুদ্রসাগরের মাঝামাঝি, মেঘেদের ভিড় ঠেলে একটুকরো আলো নীরমহলের মুখে যৌবনের রঙ ঢেলে দিয়েছে।

সশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিল বোট। ঢেউয়ের পর ঢেউ মহলকে অগ্রিম জানিয়ে দিচ্ছিল আমাদের খবর। খবর দিয়েই ফিরে আসছে আবার। এই ঢেউগুলো সুশিক্ষিত প্রহরীর মতোই লুকিয়ে ছিল রুদ্রসাগরের জলে। এক অসাধারণ অভ্যন্তরীণ চলন জানে ঢেউ। বোট যখন প্রায় কাছাকাছি, ঢেউয়ের ভেতর ঢুকে পড়ছিল ফিরতি ঢেউ।

মহলের ঘাটে পা রাখার আগেই বৃষ্টিদল হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বোটের ছাদে। একপ্রকার হুড়াহুড়ি করে একবোট ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ঢুকে পড়লাম অন্দরমহলে। ভেতর সব মানুষ জটলা পাকিয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করলেও, আমরা তিনজন বৃষ্টি ভিজেই ছাদের গম্বুজে পৌঁছে গেলাম। এখান থেকে রুদ্রসাগরকে উন্মুক্ত মাঠের মতোই দেখাচ্ছিল। মেঘেরা ভিনদেশী চাষী, বৃষ্টিবীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে অনবরত। বৃষ্টি শেষে বীজতলার মতোই সেজে উঠেছে জলমাঠ। লাঙলের দাগ যেন জেগে আছে রুদ্রসাগরের বুকে। আমরা তিনজন ভীষণ খোশমেজাজেই তখন। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল বলে আর কেউ উপরে ওঠেনি। জলের মাঝখানে এই মহল চাষীদের খামারবাড়ির মতোই লাগছে। মনেহয়, জলমাঠের ফসল পাকলে এখানেই তুলবে। ছাদের গম্বুজের ভেতর থেকে চারদিক দেখতে দেখতে ছবি তোলার ঋতু লেগেছে সবার। ছবি উঠতে ওঠাতেই বদলে যাচ্ছিল আকাশের ছবি। আমরা যখন নেমে আসছি, তখন আর বৃষ্টি নেই বললেই চলে। ক্লান্ত আকাশের ঘাম শিশিরের মতোই ঝরছে।

একজন চা বিক্রেতা ডেকে বললেন, 'চা খাইবেন ?' বৃষ্টিতে ভিজে একটু ঠান্ডাও লাগছিল। পাশে বসে চা খেতে খেতে গল্প জমে উঠলো। তেমন তাড়াও নেই। কথায় কথায় জানতে পারলাম, তিনি অঞ্জন বর্মন। বয়স আটচল্লিশ। একটিমাত্র ছেলে। দশম শ্রেণীতে পড়ে। প্রায় চার বছর মহলের ভেতর চা বিক্রি করছেন। খুব চেনা মানুষের মতো ডেকে চা খাইয়ে সংসার চালাচ্ছেন। কত বৃষ্টিভেজা মানুষের গায়ে উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা নীরমহল জানে। ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন মহল ছেড়ে বেরিয়েছি, তখন আকাশের কাছে মেঘ আছে, যদিও কালো বুক সাদা হয়ে গেছে। পাখিরা বাসায় ফিরছে। আমরাও বোটে উঠলাম। বোট ছেড়ে দিতেই এক অপরিচিতা কন্ঠে শোনা গেল, 'চিকন গোয়ালিনী, রসের বিনোদিনী... '

কোন মন্তব্য নেই: