“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৪

একটি দুর্লভ বইয়ের খোঁজে


।।পার্থ ঘোষ ।।

ক অদ্ভুত সময়ের জীবিত মানুষ আমি। আজকাল কবিতা,গান,গল্প,উপন্যাস আর মিনি স্কার্টের মত মিনি কবিতার আড়ালে ঢাকি যত লজ্জা, অপদার্থতা। কেউ কেউ জীবনকে উপভোগ করি, স্বাদ মাখা আঙুল চুষে চুষে। বাদ যায়না কিছুই। ভদ্রতার ঘোমটা ফেলে,ঘরে ঢুকেই হালকা বাহারি গ্লাসে ঢালি শিক্ষা,কাটা আপেলে চিবাই কালচার। নীল আলো জ্বালিয়ে দক্ষিনী ডাবিং ছবি কিংবা দেশীয় আর্টফ্লিম।তিন বছর ধরে টানা চলতে থাকা পারিবারিক সিরিয়ালে,ঘরের লক্ষী আজ ঝাগড়ার ক্লাশ করে । ৩৭৮ নাম্বার পর্বে,চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে তার। মূখ্য চরিত্রটি যেন গৃহিনীর আপন বোনঝি। পারিবারিক রাজনীতির খুঁটিনাটি শিক্ষা, থুড়ি !! নিখাত মনোরঞ্জন । নারীদের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ খুবই জরুরি। 
         রান্নাঘরে পোড়া গন্ধ।পাশের ঘরে ভাবি রাষ্ট্রপতি হবার সম্ভাবনা নিয়ে লায়েক ছেলে,  হাতে দামি নোটস আর লেটেস্ট মোবাইল। বাদামি চুলে জেলি মেখে যে ছেলেটি স্টাইলের ঘুম ঘুমাবে সারারাত,স্বপ্নসুন্দরীরা ঘুমে এলেও যেন মুগ্ধ হয়।তাকে নিয়ে অযথা চিন্তার কিছু নেই,নচিকেতার জীবনমুখী গান শোনে।বৃদ্ধাশ্রমে, অবিকল গলা মেলায় সকাল বিকাল। ডাগর মেয়ে ব্যস্ততম শিক্ষকের বাড়ি পড়তে যাবে কাকভোরে, ফ্যসান শো'য়ের পোশাকে। কালচার্ড বাবা গর্বিত বাইক নিয়ে ছুটবে যেন অশ্বমেধের ঘোড়া।
        "হাম দো হামারা দো" স্লোগানের অঘোষিত অপমৃত্যু ঘটেছে প্রায় দেড়দশক আগেই।চিনের  রকমারি উপকরনের সাথে আপন করেছি চিনা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নীতিকেও।গো-খাদ্য প্রিয় নেতার সন্তান বেশি থাকায়, সরকার আইন করতে না পারলেও, মধ্যবিত্ত সমাজভাবনাতে এক সন্তানের প্রকল্প জনপ্রিয়তা পেয়েছে।মামা-মাসির দিন শেষ, কাকা-জেঠা নামক শব্দগুলোর অর্থ বোঝাতে, আরো এক দশক পরে হয়তো অভিধানই লাগবে। পণপ্রথা বিরোধী পোস্টারে কাজ  হয়েছে।বরপক্ষের মিনমিনে আপত্তি থাকলেও কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা হাসিহাসি মুখে গ্যাসচালিত ঠান্ডা গাড়ি উপহার দেয়। ইংরাজি বলা আদুরী কন্যাই এখন
দাবি শিখেছে যে। নারী আপন অধিকার সচেতন হলে দেশ উন্নত হয়।কন্যা ভ্রুণ হত্যা কমেছে কিনা জানা নেই।স্ত্রী -পুরুষের আনুপাতিক হারের স্থিতাবস্থা নিশ্চিত হওয়া উচিৎ।
       হলুদ হাতের মা, ঠায় বসে মজলিশ জমায় প্রভাতী স্কুলের সামনে। আলাপী মুখে হালের সিরিয়াল,সিনেমা,অন্যের বরের অবৈধ প্রণয়,নতুন ফ্রিজের গু্ণগান,রেশনের চালের নিন্দা।নিজের পরিচিত স্বর্ণকারের সততা নিয়ে দস্তুর মত বাজি ধরেন।বান্ধবীর বুটিক ও বিউটি পার্লারের নিখুঁত বর্ণনা। শাড়ির চেয়ে চুড়িদারের উপকারিতার মোক্ষম কারণ বলার সাথেই আসে অনিবার্য ধর্মীয় গুরুর প্রসংগ,আগামী উপাসনার অগ্রীম নিমন্ত্রন।গত বিবাহবার্ষিকীর মেনুর লিস্ট। ননদের বিয়েতে স্বামীর আর্থিক গৌরবময়
অবদানের ফাঁকে শ্বাশুড়ির মতিভ্রষ্টতার অজুহাতে পৃথক হবার গল্প।সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে,সূর্য পূর্বদিকে উঠার মত সত্য কথন।
        ২৫ শে বৈশাখ আর ২৫ ডিসেম্বরে সমান গুরুত্ব দিই।ভাদ্রমাসে তালের পিঠা না খেলেও ডিসেম্বরে কেক আনতে ভুলিনা। বিয়ের তারিখে গন্ডগোল হলেও ভালেন্টাইন্স ডে ভুলিনা। খেঁজুরের রসে নাক সিঁটকালেও
ভদকায় আপত্তি করিনা।কলমির শাঁকে অরুচি হলেও বিদেশী হার্বাল প্রডাক্টসের খোঁজ রাখি।বিজ্ঞান সম্মত
খাওয়া ও ভদ্রলোকসুলভ উৎসব পালনে পারদর্শিতা অর্জন করেছি। পায়ে ছুঁয়ে প্রণাম করার বদলে, কোমর ব্যথার অজুহাত দিয়ে হাঁটু ছুঁই বড়দের।
        ইতিহাসের অধিকাংশ মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া আন্দোলনে মধ্যবিত্তের ভূমিকা অনস্বীকার্য। হয় শিল্প-
সাহিত্যে কিংবা পতাকা হাতে।এই মধ্যবিত্তের গুণগানের ফাঁকে দারিদ্র্যসীমার নীচের কথা আজো চাপা পড়ে যায়।যদিও রিক্সাশ্রমিকের ছেলে ব্রেন্ডড জিন্স প্রেমিকার হাত ধরে সারারাত পূজা দেখে। সমাজের উঁচুনিচু ভেদাভেদ ঘুচলেই মঙ্গল।
       এই ডামাডোলের মাঝেই ভাগ্যক্রমে একদিন জীবনের মানে শিখতে গিয়েছিলাম তেলবিহীন রুক্ষ মাথার এক বৃদ্ধের কাছে। গুরু বলে প্রণাম করেছি তাঁর কাঁদা মাখানো কর্কশ পায়ের পাতায়। জমিতে কাজ করতে করতে যিনি বলেছেন পাপ কী,পূণ্য কী। অভুক্ত মুখে তেঁতো বিড়ির কষ গিলতে গিলতে শিখিয়েছন মানবিকতার সর্বশেষ সংজ্ঞা । ধর্ম অধর্মের অতি সূক্ষ্ম তফাৎ বলেছেন অনায়াসে।যুক্তিবাদের মুখে ঝামা ঘসে দিয়ে,নীতি শিক্ষার কথা বলেছেন। "ফেইসবুক স্টেটাস " শব্দটাকে না জানলেও অনায়াসেই মানব
সভ্যতা,বাঙালি কৃষ্টির স্টেটাসের দিশা বদলের কথা শোনালেন। খড়ি উঠা শীর্ণহাতে মাথায় আশীর্বাদ  করে বললেন,...."ওহে তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালির দল,তোমরা আগে কিছুদিন ' অ আ ক খ 'শেখ। বাল্যশিক্ষা বইয়ের শিক্ষায় শিক্ষিত কর নিজেদের। " বাজার ঘুরে আজ সারাদিন আমি "বাল্যশিক্ষা"বই খুঁজছি। "লিটিল লিটিল টুইংকেল স্টারের" ভিড়ে বইটি পাওয়া যাচ্ছেনা,কেউ পেলে দয়াকরে একটু জানাবেন। বয়সে বড়
হলে নির্ঘাত পায়ের পাতা ছুঁয়েই প্রণাম করব।


কোন মন্তব্য নেই: