“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪

শকুনের সাতকাহন....


(C)Image: ছবি

।। পার্থ ঘোষ।।


         ৮০'র দশকের কোন এক নিস্তরঙ্গ দুপুর।আপাত শান্ত বাংলার শিক্ষক, পঞ্চম শ্রেণির ক্লাশ নিচ্ছেন।খোলা জানালা দিয়ে দেখা যায় পথ। পথচলতি মানুষ, গরু,বেওয়ারিশ কুকুর একটু ছায়ার খোঁজে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। শিক্ষকের গম্ভীর গলা ভেসে আসে অনেকদূর। এবার সমীর বল...বলেই....

শিক্ষকঃ বল দেখি, শ - কু - ন.....শকুন
ছাত্রঃ হকুইন্
শিক্ষকঃ বল্ শকুন....
ছাত্রঃ স্যার হকুইন্
শিক্ষকঃ বল্ শকুন
ছাত্রঃ হকুইন্

শিক্ষকমশায় কিছুটা রেগে গিয়ে এবার ভেঙে ভেঙে, টেনে টেনে শান্ত ও ধীর লয়ে বললেন... বল শ......কু......ন।
ছাত্রটি ও ভেঙে ভেঙে,টেনে টেনে বলতে লাগল... হ.....কু........ইন্
এবার শিক্ষকের চোখ ক্রমশ লাল হয়ে উঠতে লাগল। কক্ ফাইটের মোরগের মত উনার ঝুঁটিও খাড়া হতে লাগল। ঈষৎ গলা চড়িয়ে বলতে লাগলেন.....শ....কুন,

ছাত্রটিও ততটাই জোরে, মাত্রা ও তীক্ষ্ণতা বজায় রেখে বলতে লাগল.... হ...কুইন্
অগত্যা শিক্ষকমশায় চেয়ার ছেড়ে হাতে বেত নিলেন। বল- শকুন ? ছাত্রটি তখনও অকাতরে "হকুইন্" ই বলে যাচ্ছে।সাঁই সাঁই শব্দে বেত্রাঘাত শুরু---- তবুও "হকুইন্ "আর "শকুন "হচ্ছেনা।শিক্ষকমশায়ের মেজাজও ততটাই তিরিক্ষে হয়ে যাচ্ছে-------- কি..?.হকুইন্ ??? বল.. শকুন !!

             তখনও হকুইন চলছে একনাগাড়ে। তিনখানা বেত ভেঙে খান খান। শিক্ষকমশায় ক্লান্ত হয়ে কিছুটা যেন হাঁপাচ্ছেন।ছাত্রের অবস্থা অনেকটা, বলির আগে ভেজা ছাগশিশুর মত।মারের জায়গা গুলোতে,নানা ভঙিমায় একেবেঁকে দ্রুত হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।সে তখনো পর্যস্ত মার খাওয়ার যুতসই কারনই খুঁজে পাচ্ছিল না। শেষে শিক্ষকমশায় নাছোড় ছাত্রের কাছে একপ্রকার হার স্বীকার করেই যেন রণে ভঙ্গ দিলেন।
             তখনো স্কুলে মারধোর ছিল স্বীকৃত বিধান। শিশু মনোবিজ্ঞান উন্নতি করলেও,সেই গ্রাম্য স্কুলের চৌকাঠ পর্যন্ত তা এসে পৌঁছায়নি । ভিন দেশ থেকে আগত গোবেচারা মুখের সমীর পাল এমনিতেই গুটিয়ে থাকত। তেলচুকচুকে মাথায় যেন জ্যামিতি বাক্সের স্কেল দিয়ে সিঁথি টানা। শকুনের জন্য ওর সেদিনের মার খাওয়া আর তার কাঁচুমাচু রক্তিম মুখ আমি আজো ভুলতে পারিনা। সেই ছোট্টবেলাতেই বাড়ী ফেরার পথে রাস্তারধারে গোলহয়ে থাকা লম্বা গলার এই পাখিদের পাথর ছুঁড়ে মারার জন্য হাত নিশপিশ করত।সুযোগ পেলেই অব্যর্থ ছুঁড়তামও ঢিল । আজ আর এই সত্যিকারের শকুনকুলের দেখা পাইনা,অনেক বছর। জানিনা পাখিটি আজ লুপ্তপ্রায় না বিলুপ্ত!

           তবে শকুন নামক বিভৎস দর্শন পাখিটার সমস্ত গুণাবলী নিয়ে সেদিনের সমীর আজ বহাল তবিয়তে। পুঁথিগত বিদ্যার সাথে ছাড়াছাড়ি তার অষ্টম শ্রেণিতেই। কালের ও নিজের তাগিদে আমূল বদলেছে সে। ছিঁড়ে ও ছিনিয়ে খাওয়াটা বেশ রপ্ত করে নিয়েছে আজ। দামি গাড়িতে ইংরাজি স্কুলে যায় সন্তান। নিজের গলায় গরুবাঁধার দড়ির সাইজে সোনার মা'কালি মার্কা লকেট সহ মোটা চেইন।হাতে সিন্ধুসভ্যতার পুরুষের মত বালা। স্ত্রীর অলংকারের দাপটে পড়শি বউ-ঝি'দের মুখে টুঁ শব্দটিও নেই। দামি সিগারেট আর মদের দয়ায় ফি বছর চেকাপে চেন্নাই, আমেদাবাদ। ছোট বড় নানা কমিটির মোড়ল। নানা দলের দাদারা আসেন সামান্য নিমন্ত্রনে, বাড়ীর কালিপুজা মাতিয়ে দিতে। বছরে দুবার করে মেরেজ'ডে আর নানা আছিলায় জন্মদিন পালন।
            শুধু এই শকুন গোত্রীয়দের নিয়েই সমাজ নয় জানি,তবে এরাই সমাজের দিশা বদলায় আজ। সোসাল নেটওয়ার্ক তথা সামাজিক জালে আবদ্ধ সচেতন মানুষ হাতে গোনা। সখের গান,কবিতা আর সাহিত্যের আঙিনায় ভিনরূপী শকুনের আজ দৃপ্ত পদচারণা। জনপ্রতিনিধিদের অবর্তমানে, গুণীজন সংবর্ধনায় এরাই প্রধান বক্তা বা বিশেষ অতিথি। তাই কখনো কখনো ভাবি সেই সমীর আজ আমার লজ্জা না অহংকার !!! সব যুগেই এমন কিছু শ্রেণির চরিত্রেরা ছিল,থাকে, হয়তো থাকবেও। ভারতীয় উপমহাদেশের জলবায়ু বিশেষ ভাবে এই জাতীয় প্রাণীদের যোগ্য বাসস্থান, তাই এখানে এদের অবাধ বিচরণ ও বসবাস।
           কেবলমাত্র সমীর নয়,সমীর প্রতিনিধি মাত্র। যেকোন পেশাতেই আজ সমীরদের রমরমা দখল ।ছোট বড় ব্যবসায়ী থেকে অফিসের ছোট ও বড়বাবু,কেরানি, মাস্টার-বাস্তুকার বা ডাক্তার, কোথায় নেই এরা ? প্রাথর্না গৃহ গুলোতেও শকুনেরা বেঁধেছে বাসা আজ,ঈশ্বরের দরবারেও ছিঁড়ে ও ছিনিয়ে নেবার দাপুটে ভক্তির উৎপাত এদের। আমরা সহজেই মেনে নিই সব,সবকিছুই ।এই মেনে নেওয়াটার পোষাকী নাম রাখি "ভদ্রতা"। এমন ভদ্রদের সাথে তুলনাতে তৃতীয় লিঙ্গরাও অপমান বোধ করেন নির্ঘাত। অনেক পুরুষ থেকেও ওদের মর্দানি আমায় অবাক করে।
           বিশ্বাস করুন,আমার কাঁচা আলে কেউ পা দেয়নি নির্দিষ্ট করে কোনদিন । ঐ ভদ্রতার মোড়কে আছি ভালই,তৃতীয় লিঙ্গ সেজে। রসেবশের জীবন আমার। শাকপাতা খাই বলে মাছ মাংসের দাম জানিনা,তফাৎ মাত্র এইটুকুই । আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করবেন এমন উপায়ও যে নেই। সামনে দাঁড়ালে হুবহু আমাকেই দেখবেন,একান্ত নিজস্ব দর্পণে। কোন ব্যক্তি বিশেষের কুৎসা করার অভিলাষী নই আমি,কিংবা কোন রাজনৈতিক রং লাগাবার সামান্য ইচ্ছাটুকুও নেই আমার । বলছিলাম একটি শকুন জাতীয় জীবকুলের কথা,যারা যুগে যুগে বিদ্যমান। আর সেই ছোট্ট বেলা থেকেই আমার জাত শত্রু বলে যাদের দেখলেই ছুঁড়তে ইচ্ছা করে পাথর। অর্থ ও ক্ষমতার বলে এরা সমাজটাকে খোক্ লা করে অহর্নিশ। পতিব্রতা সধবার সর্বনাশ থেকে অসহায় বিধবার অনিচ্ছার সহবাসে এরা নিপুণ কারিগর। এক অদ্ভুত সহজাত বুদ্ধিতে ওরা অনায়াসেই রাজক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ব্যবহারও করে অনায়াসে । এদের আলাদা কোন দল বা জাত হয়না,এরা শকুনগোত্রীয়।
          সমাজের সজীব সত্যচিত্র তুলে না ধরে কবে কোথায় যথার্থ কাব্য আর যথার্থ সাহিত্য হয়েছে,আমি অন্তত জানিনা। চর্যাগীতিকাই হোক আর ময়মনসিংহের পালা, মধুকবির লেখাই হোক আর কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাবনা , সমাজ ও সমকাল এসেছে বারবার। মেকি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে কিছুদিন বাজার গরম করা গেলেও কালের বিচারে তার কীই বা মূল্য ? তবু আমি শুকনা ডালে দেখি প্রেম,রক্তশূন্য নারীর চোখে খুঁজে বেড়াই ভালবাসা। আমি ভাবের ঘরে চুরি করি,সভ্যতার ধ্বজায় লিখি নাম।
            আজ আমার একটা নিজস্ব ঝাঁকুনি চাই প্রবল, রিখটার স্কেলের সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে হোক প্রচন্ড এক ভূকম্পন। শিরা উপশিরায় জ্বলে উঠুক আগ্নেয়গিরি,কিংবা সুনামি হোক কোন ভয়ানক । প্রলয়াঘাতে অন্তরাত্মা জেগে উঠুক আপন তাগিদে। প্রতিবাদের জন্য প্রতিবাদ হয়েছে অনেক। আজ পাড়ায় পাড়ায় জাগুক বিবেক। সত্যিকারের শকুন বিলুপ্ত না হয়ে বাঁচুক কোথাও,অন্য কোনখানে । এ শহর গ্রাম পাড়া মহল্লা হোক শকুন বিহীন। একটা আন্তরিক চেস্টা শুরু হোক নিজেদের শকুন দৃষ্টি আর শকুনি খিদের থেকে পরিত্রাণ দেবার ও পাওয়ার । অন্তত সমকাল ও ভাবিকালের প্রতি সুবিচার হবে কিছুটা।

কোন মন্তব্য নেই: