(সৌজন্য 'রবিবারের বৈঠক, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৪) |
মূল শহর ছাড়িয়ে বাস রাস্তা ধরে ঘণ্টা
দেড়েক গেলে এক বিশাল দীঘি। এককালে বেশ পরিস্কার জল ছিল দীঘিতে...আর প্রচুর
মাছ।সারা দিন দীঘির জোলো বাতাস ঠাণ্ডা করে
রাখত আশে পাশের মাটিকে। সে মাটিতেই কুসুমদের মত কিছু পরিবার বাসা বেঁধেছিল ।সে
পরিবার গুলোর হয়ত বা তেমন কোন বংশ কৌলীন্য ছিল না... ছিল না শিক্ষা সংস্কৃতির সুযোগ। নিজেদের অধিকার প্রাপ্য ইত্যাদি বিষয়েও
তাদের উদাসীনতা ছিল...আসলে অধিকার সাব্যস্ত করার পথ, মত ও কলাকৌশল তাদের আয়ত্বের
বাইরে ছিল। তাদের সাধারণ জীবন কেটে যাচ্ছিল সাধারণ মাপের সুখ দুঃখ নিয়ে। জন্ম
মৃত্যু বিবাহ ছাড়া আর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা বা উৎসবের সুযোগ তাদের জীবনে ছিল
না...কিন্তু স্বপ্ন ছিল কিছু কিছু...বেঁচে থাকার স্বপ্ন...হাইওয়ের পাশে থরে থরে
দাঁড়িয়ে থাকা বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড গুলো সেই স্বপ্নে মায়াবী রঙ লাগিয়ে যেত প্রায়
সময়ে।
কাজলকালো চোখে এমনই কিছু স্বপ্নমায়া
জড়িয়ে একদিন শিবনাথের বৌ হয়ে তার ঘরে এসেছিল কুসুম। কালো অথচ দোহারা চেহারার
শিবনাথকে বেশ মনে ধরেছিল তার...।দুজনের ভাব জমতেও বেশি দেরি হয়নি।শিবনাথ টুকটাক
বেতের কাজ জানতো.. বাড়ীতে বসেই এটাসেটা
বানাতো আর সপ্তাহে সপ্তাহে শহরে ফেরি করে আসতো সেসব। আবার কোন কোন দিন সারা
দুপুর বিকেল দীঘিতে মাছ মারত।কিছু মাছ দিয়ে রাত্তিরে ঝাল রাঁধত কুসুম... বেশির
ভাগটাই পরের দিন হাটে বেচে দিত শিবনাথ।আর হাটের থেকে ফেরার পথে কুসুমের জন্য নিয়ে
আসতো কাঁচের চুড়ি...যে চুড়ির কিছু কিছু সে নিজেই আবার ভাঙত রাতের বিছানায়...কুসুমকে
সোহাগ করতে করতে।
নতুন বিয়ের নেশা ও আড় ভাঙ্গার পর
কুসুম একদিন ধরে পড়েছিল শিবনাথকে...সঙ্গিনী স্বপ্না ও কৃষ্ণার মত সেও শহরে যাবে...বাবুদের বাড়ীর ঘরকন্নার কাজ করবে।
শিবনাথ কোন মতেই রাজী হয়নি। কুসুম অনেক বুঝিয়েছিল...মান করেছিল, চোখের জলও
ফেলেছিল। কিন্তু শিবনাথের সেই এক গোঁ। ঘরের বউকে পরের কাজ করতে দেবে না। কুসুম
তবুও আশায় আশায় ছিল...কিন্তু সেই যে একদিন কাকডাকা ভোরে ঘরের পেছনে গাছে ঝুলতে থাকা স্বপ্নার প্রাণহীন
দেহটা উদ্ধার করা হল এবং কৃষ্ণার কাছ থেকে সে জানতে পারল যে কাজের বাড়ীর
দাদাবাবুটির বদান্যতায় স্বপ্নার “পেট” হয়ে গিয়েছিল বলেই...,
সেদিনই শিউরে উঠেছিল কুসুম, আর মনে মনে ভগবানকে শতকোটি প্রণাম
জানিয়েছিল...শিবনাথকেও।
সেদিন
দুপুরে ভাত খাওয়ার পর নিজের কাজ নিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসেছিল শিবনাথ। কুসুম ঘরের ভেতর
বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছিল। কদিন ধরেই শরীরে কেমন যেন অসোয়াস্তি ভাব।খাবার খেলেই
গা-পেট সব গুলিয়ে আসে।গত দুমাস ধরে ‘মাসের কাপড়’ ও লাগেনি তার। তবে কি...?
শিবনাথকে দুদিন ধরেই বলবে বলবে করছে কুসুম, কিন্তু সেই যে গত পরশু শহরে গিয়েছিল
শিবনাথ, তারপর থেকে সমস্ত দিন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে, মেজাজও ঠিক নেই। কিছু বলতে
গেলেই মুখ করছে। থাক রাতের বিছানায় বলবে এখন...কুসুম একটু চোখ বুজে জিরোতে চেষ্টা
করে। হঠাৎ তুমুল শোরগোল এ বিছানা ছেড়ে উঠে বসে সে।দ্রুত পায়ে বাইরে আসে...হে ভগবান
এ কি...একটা লোহার চাকা লাগানো বিশাল দৈত্য একধার থেকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে থাকে
তাদের এতদিনকার বসবাসের ঘর-দুয়ার, গৃহস্থালি । কিছু বুঝে উঠতে পারে না কুসুম...ঘোর
লাগা চোখে দেখতে থাকে শিবনাথ প্রাণপণ চেষ্টায় তাদের আপাতসামান্য অথচ অসামান্য
সংসারের টুকরো গুলিকে সেই লৌহ দানবের থাবা থেকে বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করে চলেছে।
সন্ধ্যাবেলায়
ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে শিবনাথ যখন অসংলগ্ন কথা বলতে থাকে, কুসুম বুঝতে পারে,
দুদিন আগেই শহরে গিয়ে এ সর্বনাশের ইঙ্গিত পেয়েছিল তার স্বামী। কিন্তু এত দ্রুত যে
তা ঘটবে,সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। ছোট ছোট মানুষদের ছোট ছোট আশা-আকাংখা গুঁড়িয়ে দিয়ে
বড়বড় মানুষদের দামী দামী জিনিস-পত্তর কেনাবেচার দোকান হবে সেখানে।
রাত
পোহালেই অবশিষ্ট সংসারকে একটা বাক্সে পুরে শিবনাথের পিছু পিছু বেরিয়ে পড়েছিল
কুসুম।শিবনাথের এক পরিচিত মানুষের সাহায্যে এই ইঁটভাটার বস্তির খোঁজ পেয়ে সেখানেই
নতুন করে ঘরকন্না সাজিয়েছিল তারা।ইঁটভাটায় একটা কাজ ও জুটিয়ে নিয়েছিল শিবনাথ। কিন্তু যত কুসুমের শরীরে গর্ভ চিহ্ন
স্পষ্ট হতে থাকে, ততই যেন একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে শিবনাথ।যে দুটি হাত মনের
ভালবাসা দিয়ে নমনীয় বেতের কমনীয় জিনিস বানাত, আগুনে ঝলসান ইঁট বানাতে বানাতে তারাও
যেন ক্রমশঃ দানবীয় হয়ে ওঠে।কুসুম বুঝতে পারছিল, ইঁটভাটার চুল্লিতে শুধু ইঁটই পোড়ে
না...প্রতিদিন ঝলসে যায় তার স্বামীর মন ও আত্মা। কিন্তু নিরূপায় সে কি করবে বুঝে
উঠতে পারছিল না। সন্ধ্যের পর নেশা করতেও
শুরু করেছিল শিবনাথ।প্রথম প্রথম কুসুম বাধা দিতে চেষ্টা করেছিল , কিন্তু একদিন
অশ্রাব্য গালিগালাজ করে তার চুলের মুঠি ধরে ঠেলে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল শিবনাথ। আর এখন তো নেশার
ঘোরে মাঝে মাঝে দিন রাতের ভেদ করে উঠতে পারে না সে।
এরকম
পরিস্থিতিতেই এক দিন ও সন্ধ্যার মিলন লগ্নে কুসুমের কোলে আসে পাতা। কুসুম ভেবেছিল
হয়তো বা মেয়ের মুখ বাবাকে বদলে দেবে...কিন্তু না। দিনে দিনে শুধু কুসুম নয়, মেয়েও
যেন অসহ্য হয়ে ওঠে শিবনাথের কাছে। আর
তারপর একদিন...মেয়ে কোলে কুসুম কে বেড়িয়ে পড়তে হয় বাবুদের বাড়ীতে কাজের
খোঁজে...সেইসব বাবুদের,যাদের শখ মেটানর জিনিষের দোকান গড়ে উঠেছে তাদেরই একান্ত
বাসভুমিটিতে।আর সেইদিন শিবনাথও আর এগিয়ে
আসে না ঘরের বউকে পরের বাড়ির কাজের বউ হওয়া থেকে আটকাতে।
আর
তারপর বহু ঋতু পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে থাকে কুসুমদের বস্তি।কিন্তু কুসুমের রোজকার
জীবন কোন পরিবর্তন দেখে না। ভোররাত থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রতি পল অনুপল শুধু
নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেওয়ার পালা। তার মধ্যেই হঠাৎ একদিন চমকে গিয়ে দেখে কুসুম
তার ছোট্ট পাতা কখন যেন শৈশব ও কৈশোরকে বিদায় জানিয়ে যৌবনকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে
।পাতা কিন্তু মেনে নেয় না শিবনাথের অনাচার। প্রায়ই বিদ্রোহ করে ,রুখে দাঁড়াতে চায়
জন্মদাতার বিরুদ্ধে আর সেইসব সময়ে আরও কঠিন ও দুঃসহ হয়ে ওঠে কুসুমের বেঁচে থাকার
প্রয়াস।
গতকাল
কুসুমের কাজের বাড়ি থেকে ফিরতে দেরি হয়েছিল।ফেরার পথে কিছু কেনাকাটা ছিল।
সেসব সেরে সে ঘরে ফেরার আগেই শিবনাথ ঘরে
এসে পাতার কাছে ভাত চেয়েছিল...পাতা দেয়নি মানে দিতে পারেনি, কুসুম ফিরলে তবে
রান্না হবে...বাড়িতে সব কিছুই বাড়ন্ত। সে কথাটাই পাতা শিবনাথকে বলেছিল।শিবনাথ
প্রচন্ড মেজাজ দেখিয়ে গালি গালাজ সুরু করলে পাতাও আর ধৈর্য রাখতে পারেনি, সেও
বাপকে যা নয় তাই বলে কথা শোনাতে থাকে। ঠিক
সেই মুহূর্তেই এক শরীর ক্লান্তি, এক পেট খিদে আর এক ব্যাগ বাজার টেনে নিয়ে ঘরে
ঢুকেছিল কুসুম...ব্যস...শিবনাথ আর দেরি করে নি...হিংস্র শ্বাপদের মত ঝাঁপিয়ে
পড়েছিল কুসুমের উপর...যে ভাবে ইচ্ছে,যেমন ভাবে ইচ্ছে বেধড়ক, এলোপাথারি মেরেছিল
কুসুমকে...যতক্ষন না কুসুম জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পাতা বাধা দিতে এলে মেয়েকেও দু লাথি
মেরে অন্ধকারে বেরিয়ে গিয়েছিল।......
ধীরে
ধীরে ঘুমের কুয়াশা থেকে বেরিয়ে আসে কুসুম। অনেক চেষ্টায় গলা দিয়ে ক্ষীণ শব্দ বের
করে মেয়েকে ডাকে। বিরক্তি ও বিতৃষ্ণা নিয়ে পাতা সামনে এসে দাঁড়ায়।
-কি বলবে বল?
দুর্বল হাতে মেয়ের হাত চেপে ধরে কুসুম।।চোখ দিয়ে জল
গড়ায়...
-আবার কাঁদছ কেন? পাতা ফুঁসে ওঠে...খালি মার খেতে আর
কাঁদতে জান, উল্টে মারতে পারনা?
-ওরকম বলিস না পাতা...
-কেন বলব না?মেয়ে-বউকে খাওয়ানোর মুরোদ নেই,আবার
মারতে আসে...?ওরকম হাত ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিলে তবে ঠিক হয়...।
-কিন্তু যন্ত্রণাও যে পায় সেটা বুঝতে পারিস না?
-যন্ত্রণা?
-হ্যাঁ পাতা...আমি তো জানি... মানুষটাতো এরকম ছিল
না। একমুহুর্তে বিনা দোষে যদি কেউ সর্বস্বান্ত হয় তাহলে সে কি ভীষণ যন্ত্রণা পায়
বুঝিস না?
-তাই বলে তুমি কিছু বলবে না?
- আমি পারি নারে পাতা...তোর বাবা যখন আমাকে মারে
আমারও খুব যন্ত্রণা হয়...কিন্তু আমি যখন সে সময় ওর চোখের দিকে তাকাই, সেখানে রাগ বা
হিংসা দেখতে পাইনা রে পাতা...সেখানে শুধু অসহায় যন্ত্রণা...।আমি কেন কিছু বলি না
জানিস...এখন তো তবু মানুষটা আমার কাছে তোর কাছে এসেই ভাত চায়, এখনও আমাদেরকে নিয়েই
বাঁচতে চায়...কিছু বললে যদি আমাদের ছেড়ে চিরদিনের মত চলে যায়,সে আমি সইতে পারব
নারে পাতা...আর সবাই অবুঝ হলে যে ভগবানের সৃষ্টি থেমে যাবে...।
কুসুমের
চোখ ভেঙ্গে নেমে আসা অঝোর ধারাকে পাতা দু হাতে মুছিয়ে দিতে থাকে।
সেই
সময়েই দূরে কোথাও ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি সহযোগে গণতন্ত্র দিবসের ত্রিবর্ণ পতাকা আকাশের নীলে মুখ তুলে
তাকায়...ইঁটভাটার বাঁখারি ঘেরা বস্তি ঘরে তার কোন ব্যঞ্জনা হয়তো বা পৌঁছায় না...
সেখানে তখন সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ মর্মে ,সমস্ত সৃষ্টির রক্ষাকল্পে যাবতীয়
দিনযাপনজড়িত গ্লানি ও যন্ত্রণা আত্মস্থ করে বেঁচে থাকার এবং বাঁচিয়ে রাখার
প্রচেষ্টায় নিবিড় হতে থাকে দুই মানবী মা—একজন বর্তমানের মা, অন্যজন ভাবীকালের...।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন