“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

‘এইখানে শূন্যে অনুধাবনীয় পাহাড় উঠেছে’: বিষয় সন্দীপন ভট্টাচার্যের তিনটি সিনেমা

    ।। সপ্তর্ষি বিশ্বাস

  (লেখাটি   সাময়িক প্রসঙ্গ, শিলচরের ৯ অক্টোবর, ২০১১ সংখ্যাতে প্রকাশিত হয়)
সিনেমা নির্মাণ’ এই শব্দবন্ধটির অর্থ কেম্‌কর্ডার আর ডিজিট্যাল মিডিয়া এসে প্রায় রাতারাতি আমূল বদলে দিলেও ‘সুপার এইট্‌’ ইত্যাদি প্যারালাল্‌ মিডিয়ামে অনেক কাজই হয়েছে আগেও। হয়েছে এদেশে। হয়েছে বিদেশে। এমনকি আসামের প্রত্যন্ত বরাক উপত্যকাতেও। তথাপি ‘সুপার এইট্‌’ থেকে ‘ভিডিও ফিল্ম্‌’ হয়ে ‘কেম্‌কর্ডার’ পর্যন্ত বহু ছবি তোলা হলেও সেই ছবিগুলি ‘বরাক উপত্যকা’, ‘ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা’ বা ‘নর্থ ইষ্ট’ ইত্যাকার সীমানা টেনে বিচার না করলে ধোপে আদৌ কতোটা টিঁকবে তা ঐ সব ছবি ও নির্মাতাদের বর্তমান দেখেই আন্দাজ করে নেওয়া যাচ্ছে। ঠিক এমনি একটা সময়ে হাতে এসে পরলো আসামের করিমগঞ্জ নিবাসী মূলতঃ চিত্রশিল্পী সন্দীপন ভট্টাচার্যের ‘হ্যান্ডি ক্যাম্‌’ এ তোলা তিনটি ছবি ... ‘ছায়ানট’, ‘সিলেটনামা’ আর ‘রেল পাহাড়’ ...

               যদিও আমার এগারো ক্লাসের থেকেই সন্দীপনদা আমার অতি ঘনিষ্ঠজন তথাপি গ্রাসাচ্ছদনের সন্ধানে করিমগঞ্জ ছাড়ার পর থেকে বছরে দু’বছরে একবার দেখা হওয়া আর মাঝে মাঝে টেলিফোনে আড্ডা ভিন্ন অন্য সব যোগাযোগের রাস্তা গেছে বন্ধ হয়ে। আমি জানতাম ছবিগুলো নিয়ে সন্দীপনদা কাজ করছে, জানতাম কাজ শেষ হয়েছে কিন্তু ছবিগুলি হাতে আসতে লেগেগেলো অনেকদিন। এর আগেও একটা ছবি করেছিল সন্দীপনদা। ‘শিশিরের শব্দ’। ঐ ছবিটিও শেষ বিচারে ছিল ঐ সীমানা নির্দিষ্ট ছবি ... পুকুর থেকে তুলে সাগরে নিয়ে ফেললে ঐ ছবি বরাক উপত্যকায় তোলা অন্যান্য ছবিগুলির মতনই যায় হারিয়ে ... ফলে এই তিনিটে ছবি হাতে পেয়েও সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে দেখার মতো উৎসাহ পাইনি ... কিন্তু যখন দেখলাম ... বলা উচিত দেখতে আরম্ভ করলাম ... পাঠক, আমি জানলাম, এই প্রথম বরাক উপত্যকায়, চলচ্চিত্রে, কোনো কাজ হলো যা সত্যিই কাজ ... যা কেবল মাত্র হ্যান্ডিক্যাম্‌ শস্তায় কিনে নিজের পিসি’তেই এডিট্‌ করে নিয়ে পাড়া পরশীকে দেখানোর বা আঞ্চলিক সিনে কেলাবে চালিয়ে নাম কুড়ানোর জন্যই তোলা নয় ... জানলাম এই প্রথম প্রথম বরাক উপত্যকায়, চলচ্চিত্রে, কোনো কাজ হলো যা অনায়াসেই, তাদের মার্জনীয় দোষ-ত্রুটি সহ, হয়তো এই মুহুর্ত্তে পাশাপাশি দাঁড়াতে না পারলেও, মনে পড়ায়  ‘ম্যান্‌ উইথ্‌ এ মুভি ক্যামেরা’, ‘রেড্‌ বেলুন’,‘লাইফ এন্ড্‌ নাথিং এলস্‌’, ‘নট্‌ ওয়ান্‌ লেস্‌’  বা ‘কান্দাহার’কিংবা ‘ইনার আই’ কে ......

কেন মনে পড়ায়? পাঠক, ক্রমে বুঝিয়ে লেখার চেষ্টা করি সেই কথাটাই...

২।

          অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে প্রথমেই ভেবে দেখা যাক্‌ ‘ছায়ানট’, ‘সিলেটনামা’ আর ‘রেল পাহাড়’ ... এরা ঠিক কি জাতের ছবি? এরা কি ডকুমেন্টরি না’কি ফিকশান ফিল্ম? না’কি দু’য়ে মিলে ইন্টেলেক্‌চুয়ালরা যাকে বলেন ‘ডকু ফিকশান ফিল্ম’ এরা তা’ই? জানিনা। তবে আমি খারিজ করে দিতে বাধ্য হই ঐ তিনিটি সংজ্ঞাকেই ... খারিজ করে দিতে বাধ্য হই কেননা চে’র ‘মোটর সাইকেল ডায়রি’ নিয়ে তোলা ছবিটিকে ফিকশান ফিল্ম ফিল্ম হিসাবে পুরষ্কৃত করা হলেও ছবিটি দেখতে দেখতে আমি টের পেয়েছি, যে, ছবিটি ‘চে’র ‘মোটর সাইকেল ডায়রি’র বিশ্বস্ত ডকুমেন্টেশান ছাড়া আর কিছুই নয়। ঠিক তেমনি ‘বেটেল্‌ ফর আলজেরিয়া’ দেখতে দেখতে আমাকে অনুভব করতে হয়েছে, যে, কেবল মাত্র আলজিরিয়ার মুক্তি যুদ্ধের ডকুমেন্টেশানেই থেমে থাকেনি ছবিটি – এতে সমন্বিত হয়েছে ‘ফিক্‌শ্যান’এর সমস্ত অন্তর্দৃষ্টি ও গুনাবলী ... অথচ একে বলা হচ্ছে ডকুমেন্টরী ...

    সন্দীপনের ছবি গুলির জাত বিচার করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, ফিকশান ফিল্ম ফিল্মের মূল সত্ত্বা যা, অর্থাৎ একটি কাহিনীর রেখা, তা গল্প না’ও হতে পারে, সেই রেখা, তাঁর স্কেচের মতোই, ছবি গুলিতে স্পষ্ট। পাশাপাশি ডকুমেন্টিরী’র কাছে দর্শকের যে প্রত্যাশা থাকে তথ্যের তা’ও সন্দীপনের ‘ছায়ানট’ ও ‘সিলেটনামা’য় রয়েছে লক্ষ্যণীয় ভাবে। তথাপি ডিস্‌কোভারি চ্যানেলের ডকুমেন্টরীহেন কেবল তথ্য প্রদানেই বা মারাত্মক সব ‘ভিস্যুয়াল’ দেখিয়েই নিঃশেষ হয়ে যায় না ছবিগুলি। কাজেই এই ছবি গুলিকে ডকুমেন্টরী বললে এদেরকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয় মারাত্মক ভাবে।

                    আবার ফিকশান ফিল্ম ফিল্মের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা, হলিউড থেকে ভিয়েৎনামের, এই ছবিগুলি যে মেনে চলেনা কোনো ভাবেই , তা বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার হয়না কোনো সামান্যতম দীক্ষিত দর্শককেও ...

                           বাকী থাকে ‘ডকু ফিকশান ফিল্ম’ নামের ফর্মটি। নামের মতোই এই ফর্মটিও খুব গোলমেলে একটি ধারনা কেননা মূলতঃ বাম ঘেঁষা তথাকথিত সিনেমা বোদ্ধারা যখন যে কিছু ছবি’র, সংজ্ঞা নির্ণয়ে ব্যর্থ হলেন, যেমন, তথাকথিত মাস্টার্সদের মধ্যে বার্গম্যানের ‘সীন্‌স্‌ ফ্রম্‌ এ ম্যারেজ’ বা পরবর্তীতে ‘লাইফ্‌ এন্ড নাথিং এল্‌স্‌’ তখনি সেই ছবি গুলিকে তাঁরা বন্দী করতে চাইলেন ‘ডকু ফিকশান ফিল্ম’  নামের হ-য-ব-র-ল’তে ...সুতরাং সন্দীপনের ছবিগুলিকে, আমার দরকার নেই ( বা দায়িত্বও নেই) ঐ রকম কোনো  হ-য-ব-র-ল’ ফর্মূলায় ফেলে দেখবার ...বরং সন্দীপনের এই ছবিগুলি আমাকে মনে পড়ায় সেই ‘দ্যা ম্যান্‌ উইথ এ মুভি ক্যামেরা’ ... পাঠক, ঠিক কোন জাতে ফেলবেন ঐ মারত্মক ছবি ‘দ্যা ম্যান্‌ উইথ এ মুভি ক্যামেরা’কে? ... অথবা ‘ক্যামেরা বাফ্‌’ এর প্রোটাগোনিষ্টের ছবি তুলবার সেই দুর্মর বাসনাকে? ...পাঠক, ছবিগুলি দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে ‘আমেরিকান বিউটি’র সেই যুবককে যে মনের আনন্দে ভিডিও তুলে বেড়াতো যা’ই তার চোখে ধরে তার ... আর ঐ আনন্দের সত্য অতোটাই নিবিড়, যে, অবলীলায় তার চোখ জেনে যেতো, চিনে নিতো সুন্দরকে ... আলাদা করে নিতো অসুন্দরের থেকে ...

   সন্দীপনের এই তিনিটি ছবির প্রতিটি দৃশ্যে ক্যামেরার ঐ অবিলীল চলন ছবি গুলিকে দিয়েছে ভিন্নতর মাত্রা।

৩।

‘ছায়ানট’, ‘সিলেটনামা’ আর ‘রেল পাহাড়’ ...

‘ছায়ানট’ আর ‘সিলেটনামা’র আবহ বাংলাদেশ ( ‘বিষয়’ বলছিনা, কেননা সন্দীপনের ছবি’র বিষয় যে ঠিক কি তাকে আবিষ্কারের পথে এগিয়ে যাওয়াই এই রচনার ধ্রুবপদ ...) ... ‘রেল পাহাড়’এর আবহ করিমগঞ্জ মহকুমার বদরপুর জংশান থেকে লামডিং জংশান অব্দি যাওয়ার মিটারগেজ্‌ রেলপথ যা অচিরেই আর থাকবেনা, পরিবর্তে, সময় ও তথাকথিত সভ্যতার নিজস্ব দ্বান্দ্বিক নিয়মেই নির্মীত হবে ব্রডগেজ লাইন ... ফলতঃ হারিয়ে যাবে একদা জীবিত এই মিটারগেজ্‌ লাইনের যাত্রীরা, হকারেরা, সেই ছোটো ছোটো, প্রায় রূপকথিকার মতো ইস্টিশান গুলো, হারিয়ে যাবে সেইসব রেলযাত্রীদের চোখে দেখা সমস্ত দৃশ্য ...

     প্রোটাগোনিষ্টের ( যে প্রোটাগোনিষ্ট গোটা ছবিতেই অদৃশ্য , যার স্বরটুকু’ই এ ছবির ভাষ্য ...) দুইটি দিনের,  দিনলিপি’র চলচ্চিত্র রূপ ‘ছায়ানট’ ... বাংলাদেশে’র এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক ভূতপূর্ব জমিদার বাড়িতে কাটানো দুটি দিনের প্রায় পুংখানুপুংখ বৃত্তান্ত রয়েছে এতে ... সেই বৃত্তান্ত সদর থেকে অন্দর ছাড়িয়ে সন্দীপনের ক্যামেরার অন্তর্দৃষ্টিকে সম্বল করে ক্রমে চলেযায় মানুষের, মানবের অভ্যন্তরেও ...

   ‘সিলেটনামা’য় সেই প্রোটাগোনিষ্ট’ই ঘুরে দেখছে বাংলাদেশের সিলেট শহরকে ... যে সিলেট বা শ্রীহট্ট এই প্রোটাগোনিষ্ট’এর’ও পূর্বপুরুষের আদি বাসস্থান। প্রোটাগোনিষ্ট’ই ঘুরে দেখছে সিলেট শহরকে  আর তার স্বগতোক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে ছবি। এই স্বগতোক্তিতে  দর্শক যা পাচ্ছেন তা কদাপি ডিস্‌কোভারি চ্যানেলের ডকুমেন্টরীতে কিংবা ‘লাইভ্‌ ট্র্যাভেল শো’তে পাওয়া যাবেনা  কেননা সন্দীপনের দেখার সঙ্গে মিশে আছে তার ছিন্নমূল অস্তিত্বের শিকড় সন্ধানের প্রক্রিয়া ... যে প্রক্রিয়া দ্বান্দ্বিক কেননা দেশভাগ নিয়ে প্রকৃত কোনো যন্ত্রণা, সন্দীপন বলেন, তাঁর এতোদিন ছিলোনা কেননা সন্দীপনের প্রজন্ম আরো অনেক প্রজন্মের মতোই ঐ দেশভাগ স্বচক্ষে দেখেননি । তাই এতোদিন দেশভাগ ইত্যাদি ছিল বইয়ে পড়া তথ্য আর বহুদিন মৃত ঠাকুর্দা, ঠাকুমা’র মুখে শোনা রোমহর্ষক কাহিনী মাত্র ..... কিন্তু এইবার সেই বাংলাদেশের এসে, তার পথে পথে যাযাবরের মতন হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে সন্দীপন কেবল বাংলাদেশকে’ই আবিষ্কার করেন না আবিষ্কার করেন আপনাকেও ...তাই সন্দীপনের দেখার সঙ্গে মিশে আছে তার ছিন্নমূল অস্তিত্বের শিকড়ের সন্ধানের মর্মগত দ্বন্দ্ব শুধু নয়, তার প্রতি সম্মানও। ফলে এখানে ভাষ্যের ভাষা সিলেটী ... আর ঐ সম্মানের নিবিড়তার জন্যই বোধহয় এই প্রথম টের পেলাম সিলেটি ভাষাকেও এইভাবে যায় ব্যবহার করা ...ইতোপূর্বে সিলেটি ভাষার করা, মূলতঃ  নাট্যপ্রচেষ্টা’ই , সেগুলিকে মনে হয়েছে বানানো আর দায়সারা কেননা সেগুলির উদ্ভব এক রকমের ‘সোসাল কমিট্‌মেন্ট্‌’ থেকে। সন্দীপনের ছবিতেও রয়েছে সেই সোসাল কমিট্‌মেন্ট্‌ তবে তা’র বিস্তার, যে কোনো মহৎ শিল্পের মতোই অতলস্পর্শী ... যেনবা রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলি ... যেনবা ‘ডক্টর জিভাগো’র মর্মে পাস্তেরনায়েকের সমাজ সুচিন্তা...

              ঐ ভ্রমণে, সিলেটে, ক্রমে, সন্দীপনের মর্মে এক বিচ্ছেদের বোধ শাখা বিস্তার করলেও,নিজেকে পরাজিত মনে হলেও অন্তিমে,এই ভ্রমণই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে আরেক গৌরবাণ্বিত বাঁচার সম্ভাবনার দিকে ... জীবন থেকে মহাজীবনের দিকে যাত্রার পথটিকে সর্বত্র চিনে নেওয়া, চিনিয়ে দেওয়া যদি হয় সন্দীপনের প্রথম ধ্রুবপদ তাহলে, অন্তিমে, একটি শুভের ইঙ্গিতও তাঁর শিল্প সৃষ্টির দ্বিতীয় ধ্রবপদ অথবা স্থায়ী অন্তরা।

   কিন্তু  কোন্‌ বিচ্ছেদের বোধ’এর কথা মূলতঃ বলতে চান সন্দীপন ? সে’কী শুধু ‘দাফনের দশহাত মাটী রয়েগেলো কুশিয়ারা নদীর ওপাড়ে’হেন কোনো বিলাসী শূন্যতার চতুর উচ্চারণ? চা’এর দোকানে বসে বন্ধুদের সব হাততালি কেড়ে নেওয়ার ফ্রেঞ্চকাট্‌ প্রয়াস? পাঠক, আসুন খতিয়ে দেখাযাক্‌ এই প্রশ্নটিকে –

              যে বিচ্ছেদের বোধ মিশে আছে তাঁর ‘ছায়ানট’এ সেই বিচ্ছেদের বোধ ঐতিহ্যের বিলুপ্তি সঞ্জাত ... আপনার ও আপন জাতির, ভাষিকের উচ্চতার, বিস্তৃতির লাঘবহেতু । সেই যে বাঙ্গালী ছিল একদিন, সেই যে “লার্জার দ্যান্‌ লাইফ” বাঙ্গালী আর তার বাঙ্গালীয়ানা – যার একদিকে বঙ্কিমের নগেন্দ্র, গোবিন্দলাল, রবীন্দ্রনাথের গোরা না নিখিলেশ আরেকদিকে শশী ডাক্তার, হুসেন মিঞা, ‘মহাস্থবির জাতক’এর বাড়ি পালানো স্থবির বা ‘ঈশ্বর-পৃথিবী-ভালোবাসা’র শিবরাম চক্রবর্তী সকলে মলে মিশে পূর্ণ করেন যে বৃত্তটিকে ... সেই বিরাট বাঙ্গালীয়ানা’কে, সেই বিপুল ‘সিলেটিয়ানা’ কে হারিয়ে ফেলার বিচ্ছেদ ... যে বিচ্ছেদের সহোদর, ‘অযান্ত্রিক’এর সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার হেন, সেই জমিদার বংশের অধুনা জীবিত দুই অপুত্রক ভ্রাতা ... যাঁদের একজন জীবনটাকে কাটিয়ে দিচ্ছেন, দিলেন, নিজ বাসগৃহ থেকে একটু দূরের এক জঙ্গল-মহলে বসে বসে, একা একা,কেবল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গেয়ে গেয়েই ... যদিও প্রতিভা ছিল বিপুল, ক্ষ্মমতা ছিল কন্ঠের, যদিও দু একবার মঞ্চের আলোয়, দূরদর্শনের পর্দায় গিয়েওছিলেন, তথাপি, অন্তিমে নিভৃতচারী সাধকই তিনি রয়ে গেলেন সঙ্গীতের ... এই ভেঙ্গে আসা জমিদার গৃহটির মতোই একদিন ভেঙ্গে যাবেন তিনিও ... ঠিক যেমন গিয়েছিল ‘অযান্ত্রিক’এর সেই ড্রাইভার ... ‘জলসাঘর’এর সেই জমিদার ...

      অপর ভ্রাতা’ও ‘সাধক’, সন্দীপনের ভাষায় ‘বিষয় দেবতা’র। তিনি ঘুরে বেড়ান পকেটে রিভলবার নিয়ে। দেখা শোনা করেন জমি জিরেতের আর সেই ভাবে একাধিক গ্রামবাসীর অন্নদাতা হয়েওঠেন তিনি ...

   এই দুইটি আপাত বিরোধী অথচ গহনে এক’ই চরিত্রের নির্মাণ কি সম্ভব তথা কথিত ডকুমেন্টারীর নিয়মে অথবা যে ছবি, মাত্র ৪৫ মিনিটের পরিসরে আরো অনেক মাত্রার সঙ্গে উন্মোচিত করতে পারে এমন জটিল একটি মাত্রা, এমন অবলীলায়, সেই ছবিকে কি আখ্যায়িত করা চলে কেবলি ‘ডকুমেন্টারী’ বলে?

                     টেরপাই সন্দীপন যেন বলতে চান, ‘ছায়ানট’ আর ‘সিলেটনামা’ মিলিয়ে একই কথা ... যেন বলতে চান “এই ছিল বাঙ্গালী। এই ছিল সিলেটিরা। এই ছিল সিলেট শহর। ছিলেন প্রভু চৈতণ্যদেব, ছিলেন মুক্তি যুদ্ধের প্রাণপুরুষেরা, ছিল ‘মুরারীচাঁদ’ কলেজ ... দেখো এঁরা সব নেই তবুও এই মানুষগুলির মর্মে রয়েগেছে নিরলসতার মন্ত্র ... দেখো কোথাও একটু ফাঁকা জমি পেলেই এরা শাক-পাতার চাষ লাগায় ...দেখো এরা আর আমরা কিন্তু আদতে ছিলাম একই ... দেখো এখনো আমরা পারি কি’না ... নদীর এপার ওপার মিলে ... পুনর্যাত্রায় যেতে ... আমাদের ঐ আকাশচুম্বী ঐতিহ্যের দিকে ...”

                            মূলতঃ ঐ ঐতিহ্যের দিকেই যাত্রা সন্দীপনের যে ঐতিহ্য অযান্ত্রিক, যে ঐতিহ্য জলসাঘর ...যে ঐতিহ্য হাসন্‌ রাজার গান ...যে ঐতিহ্য নিহিত সেই জমিদার গৃহে অদ্যাবধি দেবতা শ্রীধরের নিত্য পূজার মর্মে ...হত পিতা ও ভ্রাতার অন্তিম সংস্কারভূমিতে প্রত্যহ একমুঠো ফুল ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে ...

         ‘রেলপাহাড়’তেও তা’ই তাঁর ছবিতে ঘুরে ঘুরে আসে দেবাশিস্‌ তরফদারের সেই অনবদ্য কবিতা ‘দেববীথি’ যেখানে দেবাশিসও আসামের বিলুপ্ত হতে চলা নানা ঐতিহ্যের কাছে তাঁর উত্তরাধিকারের কথা বলেছেন ... বলেছেন এই টানেলময় পাহাড় লাইনের ট্রেইনে চেপে যাওয়ার গল্পকথাও ......ঐ  ‘রেলপাহাড়’এর ঐ ‘পাহাড় লাইন’ও আসামবাসীর তেমনি এক ঐতিহ্য যা সামাজিক, ভৌগলিক আর রাজনৈতিক কারনে, অপর বহু ঐতিহ্যের মতো, ক্রমে চলেছে বিলুপ্তির পথে । অথচ ঐ একটি দিনের রেলযাত্রা যেন অমরাবতী’র পথে যাত্রার মতোই মুক্ত, শান্ত, উদার ...ঐ ট্রেনের ঐ গায়ক-ভিক্ষাজীবির কন্ঠের মতোই অমসৃণ, কিন্তু সুরেলা ... হায়, ঐ সবই আর থাকছেনা, থাকবেনা ... হায়, কে তাদের লিখে রাখবে, এঁকে রাখবে  না রাখলে সন্দীপন, না রাখলে দেবাশিস তরফদার? ...

        একদিন ঐ সবই হয়ে উঠবে ‘ছায়ানট’...ছায়া আর মায়ার কূহকে নির্মীত আরেক বিলুপ্ত বাস্তবতা...পরাহত ট্র্যাডিশান... ... ঐ ভাবনাই, ঐ কল্পণাই ছায়াফেলে রোমান্টিক সন্দীপনের মর্মে ...একদা তাঁর তুলিতে যেমন ভাস্বর হয়েছে সন্ধার পুকুরঘাট, গোধুলির রেল ষ্টেশনে বসা একলা মানুষ আজ তাঁর ক্যামেরা সন্ধান করে তাদেরি মর্মের অন্যরূপ কাহনের ...ফলে নীরস, নিছক ডকুমেণ্টারি’র নিয়মে, ভাষায় কথা বলেনা তাঁর ক্যামেরা, তাঁর ভাষ্য ... ‘রেলপাহাড়ি’ ছবিতে বন্ধুর কাছে লেখা প্রোটাগনিষ্টের একটি চিঠিরি চলচ্চিত্রায়নে নিমগ্ন হন সন্দীপন ...আর ঐ চিঠিটি, ঐ গমনের সাথে মিশে গিয়ে, সেই যাত্রাকে যেন করে তোলে আদিহীন, অন্তহীন এক এক্সোডাস ... মনেপড়ে  নিশ্চিন্দিপুর, মনেপড়ে অপু’র চলার পথ, জীবনের পথে, মহাজীবনের আঙ্গিনার দিকে ... মনে আসে “তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই...” ... সেই গমনকে আশ্রয়ের মতো  ঘিরে থাকে, ঢেকে রাখে সুউচ্চ বৃক্ষরাজি, দূরের পাহাড়, সেই পাহাড়ের শীর্ষে ক্রীড়ারত মেঘের বাহিনী... কিনারে কিনারে বয়েযায় পাহাড়ি নদী জাটিঙ্গা... আর সন্দীপনের সঙ্গে ঐ পথে চলতে চলতে টেরপাই, যে, সকল নদী’ই মূলতঃ এসেছে ‘মহাদেবের জটা হইতে’ ...

  চিন্তাবীদ তারক্‌ভস্‌কি’কে আজ আমার যেমনি লাগুক তবু আজো ফিরে ফিরে মুগ্ধ হতেহয় তাঁর ভিসুয়েলে ... ‘মীর্‌র্‌স্‌’, ‘সেক্রিফাইস্‌’ বা ‘ষ্টকার’ এর কিছু কিছু দৃশ্যের কাছে ফিরে ফিরে যেতে হয়, তাই, অদ্যাবধি। যেতেহয়, মূলতঃ তাদের ‘পিক্‌চার পার্ফেক্ট’ চরিত্রহেতু। সন্দীপনের ছবিগুলিতেও যেন পাই তারক্‌ভস্‌কি’র ঐ ‘পিক্‌চার পার্ফেক্‌শান’এর  ইঙ্গিত। তবে, অন্তিমে, মনেহয় সন্দীপন ছাড়িয়ে যান তারক্‌ভস্কিকে’ও কেননা তারক্‌ভস্কি’র ইন্টেলেক্‌চুয়াল মেধা প্রায়শই প্রতিবন্ধক হয় প্রতীকহীন, নির্মল দৃশ্য রচনার ... আর সন্দীপনের যাত্রায় থাকেনা সে রকম কোনো ‘ফল্‌স্‌ ইন্টেলেকচুয়াল কমিট্‌মেন্ট্‌’ ... বরং যে অর্থে বলাহয়ে থাকে, যে, সত্যজিতের ‘অপরাজিত’ থেকে পুনর্নিম্মাণ করা যেতেপারে সেদিনের কলকাতাকে ( বা বলাহয় রেঁনোয়া’র ‘রুল্‌স্‌ অব্‌ দা গেইম’ থেকে  পুনর্নিম্মাণ করা যেতেপারে সেই সময়ের ফরাসী অভিজাত সমাজ কে ) সেই অর্থে সন্দীপনের ‘ছায়ানট’ থেকে পুনর্নিম্মাণ করা যেতেপারে পূর্ব বাংলার প্রাণের নিহত স্পন্দনকে ... ‘রেলপাহাড়ি’ থেকে ‘লোয়ার আসাম’কে ... আর সমস্ত মিলিয়ে মানবের মর্মের সেই বোধকে যে সততই ঐতিহ্যের বিলুপ্তির বিপক্ষে ... যে সততই উদ্‌গ্রীব শিলালিপি রচনায়, গুহাগাত্রে চিত্রাঙ্কনে...
সন্দীপন ভট্টাচার্য


৪।

   ঐতিহ্যের দিকে, ধ্রুপদের দিকে ঐ যাত্রায় সন্দীপনের উপকরনগুলি কিন্তু অতি নগণ্য। একটি অতি পুরাতন জমিদার গৃহে দুই দিনের আতিথ্য অথবা নেহাৎই সাধারন ভ্রমণকারীর মতো পথে ঘাটে, রেলে-বাসে ঘুরতে ঘুরতে নিজের ক্যামেরায় বন্দী করে রাখা কিছু দৃশ্য ... সেই ‘ম্যান উইথ্‌ এ মুভি ক্যামেরা’র পরিচালকের মতোই ... তারপর স্বীয় কল্পণা প্রতিভাহেতু ঘটে যায় ঐ ম্যাজিক, ঐ এডিটিং... কখনো ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের চালে এগিয়ে যায় ছবি... কখনো কয়লায় টানা রেলের কু-ঝিক্‌ কু-ঝিক্‌ চলনের তালে...সঙ্গে নিয়ে চলে দর্শককেও ... এযেন জীবনানন্দের সেই উক্তিঃ

‘এইখানে  শূন্যে অনুধাবনীয় পাহাড় উঠেছে

 ভোরের ভিতর থেকে অন্য এক পৃথিবীর মতো;

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...

... কেননা এমন স্থান পাথরের ভারে কেটে তবু

প্রতিভাত হয়ে থাকে নিজের মতন লঘুভারে;’ (মহিলা,জীবনানন্দ দাশ, বেলা অবেলা কালবেলা)

“শূন্যে” কেননা তেমন কোনো কাহিনী, কোনো অভাবনীয় তথ্য তাঁর ছবিকে দেয়না দাঁড় করিয়ে।

“অনুধাবনীয়”  কেননা এই বরাকেরি যারা অপর চলচিত্র নির্মাতা (?) তারাও এতাবৎ অন্ততঃ তিনশোবার পারাপার করেছেন এই পাহাড় লাইন অথবা সাংস্কৃতিক ঐক্যের ডাকে সারা দিতে হাজির হয়েছেন বাংলাদেশ, সিলেট। তথাপি তাঁদের মর্মে জাগেনি ঐ আলোড়ন যা সন্দীপনের এই কাজ গুলির মূল প্রেরণা ...আর যদিবা জেগেও থাকে তাহলেও মর্মের ঐ আলোড়নকে সচেতন মেধার প্রয়াসে প্রকাশের প্রতিভার অভাবহেতু ‘ছায়ানট’, ‘সিলেটনামা’ বা ‘রেল পাহাড়ি’হেন কোনো অপরূপ সৃষ্টি সম্ভব হয়নি এতাবৎ।

“অন্য এক পৃথিবীর মতো” কেননা ঐযে জমিদার বাড়ি, ঐ যে জমিদার বাড়ির পুকুরঘাট, ঐযে মাছরাঙ্গাটির উড়ে যাওয়া...ঐযে পাখিদের ডেকে এনে রোজ ভোরে বিস্কুট খাওয়ানো – জ্যেষ্ঠভ্রাতা মানবের ... ঐযে বয়ে যাওয়া জাটিঙ্গা নদী ... ঐযে টানেলগুলি ... ঐ’যে রেলব্রীজ ধরে একা একা হেঁটে যাওয়া মানুষটি... এই সমস্তকে নিয়ে অন্য এক পৃথিবী নির্মাণ করে তাদেরকেও আরো অনেকের অনেক পৃথিবীর শামিল করে দিলেন সন্দীপন ...ঐ জমিদার বাড়ি হয়ে উঠলো চিরকালীন ঐতিহ্যর প্রতিমা, ঐ পাহাড় লাইন হয়ে উঠলো মহাপ্রস্থানের পথের সহচর ...

“প্রতিভাত হয়ে থাকে নিজের মতন লঘুভারে”  কেননা ঐ অপরূপ দৃশ্যগুলির নির্মাণে, ঐ কবেকার সহপাঠী ডানিপিটে, পিঠে বস্তা নিয়ে, টিকিট বাবুর চোখ এড়িয়ে ট্রেইনের চালে চেপে বসা সুজিতের গল্প বলতে বা ঐ দুই ‘সাধক’ ভ্রাতার সাধন-মার্গগুলির বৈপরীত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে সন্দীপনকে চালিত হতে হয়না কোনো তত্ত্ব-তাড়িত পথে ...তাঁর মর্মের যে ‘আমি’টি যে সহস্রবার পাহাড় লাইনে এসে গিয়েও, তবু, আবারো ঐ পথে যেতে যেতে নিমগ্ন হয়েযায় ‘আমি চঞ্চল হে’র আবহ সঙ্গীতে, সেই ‘আমি’র মর্ম থেকেই উঠে আসে এই ফর্ম ... ক্যামেরার এই কাট্‌হীন, জার্কহীন ব্যবহার ... প্রায় কুরোসাওয়ার মতো ...গমন..যেন মন্দাক্রান্তা লয়ে ...

       আমাকে মুগ্ধ করে ছবিগুলির আবহ সঙ্গীতও। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের মুগ্ধ শ্রোতা হিসাবে আমি ‘ছায়ানট’এ (অধুনা পরলোকগত) তপনবাবু’র ( অর্থাৎ সেই দুই ‘সাধক’ ভ্রাতা’র কনিষ্ঠজনের ) কন্ঠের মাধুর্য্যে ভেসেযাই ... ভেসেযাই তাঁর কন্ঠে গাওয়া নানান রাগের নানান দৃশ্যে ব্যবহারের নৈপুণ্যে ... আবিষ্ট বোধকরি ‘রেলপাহাড়ি’র ‘স্থায়ী’ থীম্‌ হিসাবে যন্ত্রে বাজানো ‘আমি চঞ্চল হে’র প্রয়োগে ...

      ৫।

যদিও সিনেমা, সে সেলুলয়েডই হোক্‌ আর হেন্ডিক্যাম্‌ এ তোলাই হোক, মূলতঃ নয় ঠিক একের প্রয়াস, তথাপি, ডিজিট্যাল মিডিয়া একা’র হাতে ন্যস্ত করেছে যতোটুকু ক্ষমতা তার প্রায় শতভাগই সাবলীল ভাবে ব্যবহার করেছেন সন্দীপন। পাহাড় লাইনের ট্রেইনের ছাতে বসে ক্যামেরা চালানো থেকে এডিটিং ... যে এডিটিং’ই মূলতঃ সংগীতের  ব্যবহারকে ছবি গুলিতে করেছে এতোটাই সফল, যে, ছবিগুলিই যেন কখনো হয়ে উঠেছে সঙ্গীত ... সেই সমস্তই সন্দীপনের একা’র হাতের কাজ। ভাষ্যপাঠ করেছেন নাট্যকর্মী সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য, সিদ্ধার্থকে, প্রোটাগনিষ্টের অল্টার ইগো হিসেবে মাঝে মাঝে দেখা গিয়েছে ‘রেল পাহাড়’এ’ও । ( প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, যে, সন্দীপনের প্রথম ছবি, যা ফিচারের নিয়মেই তোলা, সেই ছবি ‘শিশিরের শব্দ’র কিছু কিছু মারাত্মক ভিস্যুয়াল ছাড়া ছবিটিতে আর যদি কোনো কিছু থেকে থাকে তা ঐ ছবিতে  নায়কের বস্‌ এর ভূমিকায় সিদ্ধার্থ’র সামান্য সময়ের অভিনয়।) ছবি গুলিতে সিদ্ধার্থ’র ভাষ্যপাঠ, সব সময়ে না হলেও, অনেক সময়েই পেরিয়ে গিয়েছে ‘ভাষ্য পাঠ’এর ছক কাটা গন্ডীকে। ঐ পেরিয়ে যাওয়ার মূল্যেই ঐ ভাষ্য, কখনো কখনো যেন হয়ে উঠেছে ক্যামেরার সঙ্গে ভাষ্যের প্রকৃত যুগলবন্দী।

তবে এ কথা ঠিক, যে, ভাষ্য রচনা ও ভাষ্যপাঠ, সন্দীপন ও সিদ্ধার্থ’র, দাবী রাখে আরো পরিণতির।

৬।

ছবিগুলি এক নিঃশ্বাসে দেখার পরে, ভারতের এই সিলিকন্‌ ভ্যালী’তে আমার এই অধুনা জীবন, এই আই.টি জীবন, এই নাগরিকতার বৃত্ত – ঠিক সেভাবেই কেঁপে উঠলো ঠিক যেভাবে কেঁপে ওঠে ঋত্বিকের ছবিগুলি দেখলে ... এর একটি হেতু, অবশ্যই আমার নস্টালজিয়া আমার জন্মের ভূমিকে ঘিরে, তার ফেলে আসা হারিয়ে আসা দিনরাত্রিকে ঘিরে ... তথাপি, যে কোনো সংবেদনশীল মনকেই ছবিগুলি নাড়া দিতে বাধ্য, জানিয়ে দিতে বাধ্য তার যাপনের বাঁধা ছকের সীমাবদ্ধতার কথা ... তার নিহিত সংবেদনকে আকূল করে তুলতে বাধ্য কোন এক অনন্ত যাত্রার আহ্বানে ...

                    আমার ‘আমি’কেও ভেঙ্গে ছবিগুলি যে কোথায় নিয়ে যেতে চায় আমাকে,আমি জানিনা ..... আমার কেবলি মনেপড়ে বহু বছর আগে, যখন প্রায় বালকই ছিলাম আমরা, সন্দীপনদা ভ্রমণে গিয়েছিল, যথারীতি, সিমলা না কোথায় যেন ... ফিরে এসে তার ঐ ভ্রমণের দিনিলিপিটি আমাকে দিয়েছিল পড়তে ... সেই পাঠের মূল্যে সেদিন সন্ধায় আমার মতো অলসজনের চেতনাও হয়ে উঠেছিল পথিক ... তৎকালীন দাঙ্গাবিদ্ধস্ত পারিপার্শ্বিকের কথা ভুলে গিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম আমাদের ছোট্ট মফস্বল ছাড়িয়ে অনেক অনেক অনেক দূরের কোনো গাঁয়ে আর যেহেতু অনেক রাত হয়েছিল ফিরতে আর যেহেতু সময়টা ছিল বাবরী মসজিদের সেই উত্তাল অসময়, ফলতঃ তিনজন উগ্র সাম্রদায়িকের হাতে, পথে মারও খেতে হয়েছিল আমাদেরকে ...

৭।

সেই যে যাত্রা শুরু হয়েছিল সন্দীপনের, সেই কবে থেকে, ট্রেনে করে, বাসে চেপে পায়ে হেঁটে... কখনো পাহাড়ে ... কখনো অরণ্যে, কখনো সমুদ্রে ... এ যেন তারি একটা বাঁক ... অনেকটা পেরিয়ে এসে,অনেকটা পরিণত হয়ে, সেই যাত্রা, বাহির থেকে, ক্রমে পাল তুলে দিচ্ছে তাঁর শোণিতের স্রোতে ... বাহির কে উপলক্ষ্যমাত্র করে,নির্মীত হচ্ছে, মূলতঃ, এক মানসযাত্রার দিনলিপি ... যে লিপির একমাত্র আবহ ‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী...’ ...

সেই দিনলিপি পাঠ করতে পেরে, সেই দিনিলিপির মর্মোদ্ধারের দিকে অন্ততঃ কিছুদূর যেতে পেরে, আমি ধন্য।

পাঠক, আপনিও ধন্য হোন্‌ ঐ ছবিগুলি,অন্ততঃ একবার, দেখেনিয়ে ...

এখানে দেখুনঃ


১৭/০৯/২০১১ - ১৮/০৯/২০১১,  বেঙ্গালোর

প্রথম প্রকাশঃ  http://amarsonarbanglaamitomaybhalobasi.blogspot.in/2011/10/blog-post_4463.html

কোন মন্তব্য নেই: