“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

প্রেম ভালোবাসা, নারী মুক্তি ও কবি-সাহিত্যিক

  
                                                                 ।। সুদীপ নাথ  ।।
     
       
  গে হলে বলতাম, হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিতে ইচ্ছে হয়। আর এখন বলতে হচ্ছে, নেটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিতে ইচ্ছে হয়। সুবিধাবাদি পণ্ডিতেরা নরনারীর প্রেম অর্থাৎ যৌনপ্রেমকে কদাকার ভাবে মায়া, মমতা, স্নেহ, আদর, ভালবাসা, অনুরাগ, বন্ধুত্ব ইত্যাদি এবং সর্বপরি মানবপ্রেমের সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে আমাদের ঐতিহ্যের সর্বনাশা খেলায় মেতেছে। ওরা বুঝতেই পারছেনা যে, ওরা কীসের সপক্ষে উকালতি করছে। তার মধ্যে এসে জুটেছে বিশ্বায়নের কালো থাবা।

      
   যৌনতা একটা খাঁটি বাইওলজিক্যাল প্রক্রিয়া। এটা পুরোপুরি জন্মগত রিফ্লেক্সের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবার কথা। মানুষ ছাড়া সব প্রাণীর ক্ষেত্রে তা’ই হয়। আর মানুষের ক্ষেত্রে আরও একটা রিফ্লেক্স গড়ে উঠেছে, যা আমাদের প্রাণী জগতে শ্রেষ্ঠতম স্থানে আসীন করেছে, সেটা হল শর্তাধীন রিফ্লেক্স। এই শর্তাধীন রিফ্লেক্সের কারণেই আমরা সমাজ বানিয়েছি, নিজেদের ভিতর রিলেশন গড়ি আবার ভাঙ্গা গড়ার কাজও চালিয়ে যাই। সমস্ত কিছুর পিছনেই আছে কিন্তু সেই বেঁচে থাকার প্রবণতা, যাকে বইয়ের ভাষায় অভিযোজন বলা হয়।
 
        যৌনতা বেঁচে থাকার তাগিদে আসেনা, সেটা কিন্তু হরমোন সিক্রেশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অপরদিকে, মায়া, মমতা, স্নেহ, আদর, ভালবাসা, অনুরাগ, বন্ধুত্ব, মানবপ্রেম ইত্যাদি অভিযোজনের তাগিদেই প্রয়োজন হিসেবে হাজির হয় আমাদের মধ্যে, আর নিয়ন্ত্রিত হয় শর্তাধীন রিফ্লেক্স দ্বারা। একমাত্র জন্মগত পরাবর্ত (unconditioned reflex)-এর উপর যেসমস্ত প্রাণী নির্ভরশীল থাকেনা, তারা শর্তাধীন পরাবর্তের (conditioned reflex) আবর্তে ঘুরপাক খায়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।  আমরা তো আর প্রকৃতির বাইরে নই।  তাই আমাদের মনন, জীবন, সমাজ, আবেগ, এককথায় বলতে গেলে অভিযোজন কেন্দ্রিক জীবন প্রনালী শর্তাধিন পরাবর্তের দ্বারাই পরিচালিত হয়। তদুপরি মানুষের রয়েছে বাকযন্ত্র যার মাধ্যমে আমরা ভাব বিনিময় করে সমৃদ্ধ হতে পারি।
 
       মানবমন গুণগতভাবে পশুমন থেকে স্বতন্ত্র। অতীতে, মানসিক ক্রিয়ার অধঃস্তর (material substratum) তথা মস্তিষ্ককে বাদ দিয়েই মনকে বুঝার চেষ্টা করা হত। এখন অনুমান নির্ভর অন্তদর্শনভিত্তিক মনস্তত্ত্বের চর্চাকে, গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দূরে সরিয়ে দিয়ে, সংবেদন, প্রত্যক্ষণ, স্মৃতি, চিন্তন, স্বপ্ন, প্রক্ষোভ(emotion), ঐচ্ছিক নির্বাচন ইত্যাদি মননক্রিয়ার বস্তুনির্ভর অধঃস্তরের সন্ধান পাওয়া গেছে। মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ তরঙ্গের ও জৈব রসায়নের, যেমন হরমোন ইত্যাদির ক্রমবর্ধমান আবিষ্কারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মানুষের সবকিছু ধ্যানধারণার উদ্ভব ঘটে বাইরের জগতের ঘটনা এবং মস্তিষ্কের ধর্ম ও পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতিফলন থেকে। সামাজিক ক্রিয়া-কান্ডের সাথে মানুষের মনেরও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে। এখানেই ফ্রয়েডের মনগড়া তত্ত্ব দূরে হঠে গেছে।
 
       প্রত্যক্ষণের সহায়তায় নূতন নূতন সংকেতের উপর একটা বিমূর্ত রূপ অনুভূত হতে থাকে। এইভাবেই গড়ে উঠে ধারণা। আর তাকে সাধারণীকরণ করার মাধ্যমে তা হয়ে উঠে বিমূর্ত। মস্তিস্ক বাইরের পরিবর্তনের সাথে সক্রিয় এবং পরিবর্তনশীল সম্পর্ক স্থাপন করে প্রতিনিয়ত আমাদের অভিযোজনে সাহায্য করছে। তারই নাম স্বজ্ঞান ক্রিয়া।
 
বহির্বাস্তবের সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্র এবং জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে [পাঁচটি ইন্দ্রিয় হচ্ছে, শ্রবণেন্দ্রিয় (কান), দর্শনেন্দ্রিয় (চোখ), ঘ্রাণেন্দ্রিয় (নাক), স্বাদেন্দ্রিয় (জিভ) আর স্পর্শেন্দ্রিয় (চামড়া)] সম্পর্ক রক্ষার কাজই হচ্ছে স্বজ্ঞান প্রক্রিয়া বা চেতনা । 

       চেতনা সংবেদনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে বহির্বাস্তবের প্রতিফলন। আর এ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে কালজয়ী ‘প্রতিফলন তত্ত্ব’ যা The Theory of Reflection নামে সমাদৃত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, শর্তাধীন পরাবর্তের বাসা মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার তথা কর্টেক্সে। আর জন্মগত রিফ্লেক্সের বাসা স্পাইনাল কর্ড তথা সুষুম্না কান্ডে। অন্য সব কিছুর সাথে, এটাও পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই গ্রে ম্যাটার যদি চেঁছে বাদ দেয়া যায়, তবে দেখা যায় শর্তাধীন পরাবর্ত আর ওই প্রানীটির ক্ষেত্রে কাজ করছে না। তখন ওই প্রানীটিকে, জন্মগত রিফ্লেক্স নিয়েই চলতে হয়। 
 
      অতীতের প্রত্যক্ষণ যখন আমাদের মস্তিষ্কে অনুভুতি জাগায়, তখন তাকে বলা হয় চিন্তা। তা যুক্ত হতে পারে চলমান প্রত্যক্ষণের সাথেও। অতীতের অনেকগুলো ধারণা থেকেও আমরা নতুন নতুন ধারণা সৃষ্টি করতে পারি। এই পুরনো ধারণার উপর নির্ভর করে, নূতন ধারণা সৃষ্টি করাকে বলা হয় কল্পনা।
 
      মনের মধ্যে একবার ধারণা তৈরি হয়ে গেলে, খুশিমতো একটার সঙ্গে একটা জুড়ে দিয়ে কিম্ভূত কিমাকার অনেক ধারণা তৈরি করাও সম্ভব। জীন, পরী, দৈত্য, এমনকি ঈশ্বরও আমাদের মনে এভাবেই সৃষ্টি হয়, সম্পূর্ণ কল্পনার উপর দাঁড়িয়েই। উচ্চমার্গের মননক্রিয়া তথা ধারণা এবং চিন্তা (concept and thought) যেমন ভ্রান্তি দূর করতে পারে, ঠিক তেমনই আবার ভ্রান্তি তৈরিও করতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসবের মূলে আছে বস্তু।
 
     প্রত্যক্ষণ, ধারণা, চিন্তা এবং চেতনা আমাদের কার্যকলাপ এবং বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ থেকেই জন্মায়। আবার অতীতের  ধারণা, চিন্তা এবং চেতনা আমাদের কার্যকলাপ এবং জীবনক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহন করে।
 
     এবার আসা যাক প্রেম প্রীতি ভালবাসা এসবের বিষয়ে। বর্তমান প্রজন্ম শ্রমবিভাজনের শিকার। জ্ঞান অর্জন পুঁজিবাদী সমাজে সর্বদাই বিভাজিত। পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়মেই জ্ঞান অর্জনের পেছনে পেশাদারিত্ব ক্রিয়াশীল। পেশাদারী উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জ্ঞান অর্জনের ফলে, জীবনের মানবিক ও অতিপ্রয়োজনীয় দিকগুলি, বিষয় কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা সমাধান সূত্রের পথ খুঁজে পায়না। বুদ্ধিজীবীরা কেউ সমাজতত্ত্ব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে, কেউ জীবন বিজ্ঞান নিয়ে, কেউ মনস্তত্ত্ব নিয়ে, কেউবা আইন কানুন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। সমাজের জন্য প্রয়োজনীয়, মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত দিকগুলি নিয়ে একসঙ্গে বিচার বিশ্লেষণের জন্য, সমস্ত ধরণের তত্ত্বকে নিয়ে সামঞ্জস্যপুর্ণ কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আজকের বুদ্ধিজীবীরা অপারগ। এর কারণ মুখ্যত সমাজের শ্রম-বিভাজন। উপরন্তু, চাপিয়ে দেয়া পুঁজিবাদী দর্শনের যাঁতাকলে, মানবিক চিন্তার বিকাশ ঘটানোর পথও অবরুদ্ধ।
 
    এদিকে, সমস্ত আত্মীয়তা সম্পর্কের পেছনেই রয়েছে কোন না কোন একজোড়া নারী ও পুরুষের যৌন সম্পর্ক। মা বাবার যৌন সম্পর্কের কারণেই ভাই-বোন সম্পর্কের উৎপত্তি। নারীপুরুষের বিয়ে হওয়ার সাথে সাথেই শ্বশুর ও শাশুড়ি নামে আত্মীয়তার প্রশ্ন উঠে। মামা, মাসির সাথে আমাদের  সম্পর্কটাও মা বাবার বৈবাহিক সম্পর্কেরই জের। 
 
    বাঙালি সমাজে বর্তমানে বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীই বর্তমানের বিভিন্ন পরিবার প্রথার মৌলিক রূপটি দেখতে রাজি নন। তারা মাতৃতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক – এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই হাবুডুবু খান। তারা বর্তমানের পুরুষ শাসিত সমাজ তথা পুরুষাধিপত্যের বিষয় নিয়েই মাতামাতি করেন, কিন্তু বর্তমান পারিবারিক রূপটির অন্তর্নিহিত এবং মৌলিক গঠনের সামাজিক বিচার বিশ্লেষণে যান না। পরিবার প্রথার বিশ্লেষণে, সমাজ বিবর্তনের ধারাটিকে বিশ্লেষণ করেন না। তারা বর্তমানের রূপটির মধ্যেই, পুরুষ কর্তৃক নারী নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য কঠোর সমালোচকের ভূমিকা নেন, কিন্তু পরিবারের ভিতরের মৌলিক আন্তঃসম্পর্কের বিচার বিশ্লেষণ করেন না। অর্থনৈতিক তথা আর্থ-সামাজিক এবং যৌন বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কারগুলির ধারে কাছেও যান না। এমতাবস্থায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সমাজতত্ত্ব নিয়ে, বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগ অংশই, কোন ভূমিকা নিতে পারছেন না। 
 
    নারীপুরুষের প্রেম এখন এই সমাজব্যবস্থার কারণে আর্থিক স্বচ্ছলতা, সামাজিক প্রতিপত্তি তথা অবস্থান, জাতব্যবস্থা ইত্যাদি দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয়। যে অল্প কয়েকটা দৃষ্টান্ত ফলাও করে দেখানো হয়, তা বিচার করে সমগ্রকে ধারণা করা যায়না। আর আমাদের নব প্রজন্মের ধারণাটাগুলোও গড়ে উঠে টিভি সিরিয়াল, সিনেমা আর অসংখ্য আপাত মধুর গল্প উপন্যাস ইত্যাদি থেকেই। বেশিরভাগ প্রেমের পিছনেই থাকে একপক্ষের মানবীয় ভালবাসার অভিনয়। আর সত্যিকারের প্রেম, অঙ্কুরেই বিকশিত হবার পথ হারায়, উপরোক্ত নিয়ন্ত্রণকারী পূর্বশর্তগুলোর চোরা স্রোতের ফল্গুধারায়। কখনও বা আত্মহননের মত হৃদয় বিদারক ঘটনার মধ্য দিয়ে।
 

     বুদ্ধিজিবীরা আজ বুঝতে অসমর্থ যে, আজকের যুগে প্রতিটি বিবাহিত স্ত্রীই দাসী এবং বেশ্যা। বিয়ে প্রেম করেই হোক, আর সম্বন্ধ করেই হোক। তবে তাদের খদ্দের একজন, মনিবও সেইজন। বার বণিতাদের থেকে এইতুকুই যা তফাৎ। সামন্ততান্ত্রিক যুগে বহুপত্নী প্রথা ছিল আর এখন একপতিপত্নী প্রথা। আর নিহত উজ্জ্বল ঈশ্বরের জন্যে নৈবদ্য হিসেবে পশুবলিও যা, ফল ফুল পাতাও তা’ই। সবই নৈবদ্য। এখনও মহিলারা পুরুষের সম্পত্তি। আসামের বিবাহিত মহিলাদের হাসবেন্ডকে মালিক বলা হয়। আমাদের সমাজে পতি, স্বামী এইসব শব্দেই হাজবেন্ডদের বোঝানো হয়। মহিলারা পুরুষের নিকট নৈবদ্য ছাড়া আর কি ? বিয়েটা যে একটা সামাজিক সম্পর্ক, তা এখনকার বুদ্ধিজীবীরা ভেবেও দেখেনা। বলতে গেলে অনেক কথা। ধর্ষনের বিরুদ্ধে যততুকু না আমরা গর্জে উঠি, ঠিক ততটুকুই আমরা নীরব নিষ্ক্রিয় থাকি এই মালিকানার প্রশ্নে। প্রেম নিয়ে কবিতা লিখে লিখে আঙ্গুলে কড় বাধিয়ে ফেলছেন কবিরা। কিন্তু মেয়েদের অবস্থান যে এতো নিচে, তা নিয়ে যা কবিতা লিখা হয়, গল্প লিখা হয় তার অনুপাত কত ? সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। যেসব গল্প ও কবিতা, মানুষের মুক্তির জন্য নয়, সেই সব গল্প ও কবিতা আস্তাকুরের জঞ্জাল হয়েই থাকবে। এসবের শেষ পরিণতি হবে ডাস্টবিনে নিক্ষেপণ।
 
     এখানে আমরা কী করতে পারি ? আমরা যারা সংবেদনশীল, আমরা যারা সমাজ নিয়ে মাথা ঘামাই, তাদের আশু কর্তব্য হবে, ভুল ধারনাগুলোকে উর্ধে তুলে ধরা এবং যারা সমাজ নিয়ে ভাবে, অথচ কুপমন্ডুকতার বদ্ধজলায় হাবুডুবু খাচ্ছে, বিশেষত কবি-সাহিত্যিকেরা, তাদের উদ্ধার করে সমাজের কাজে লাগানো, নিদেন পক্ষে, ভুল ধারণা বা মিথগুলো ভেঙ্গে দেয়া। 
            ততদিন এইসবের অসম অযাচিত বিকৃত ইত্যাদি নানারকম ব্যবহার ও চর্চা চলতেই থাকবে।

কোন মন্তব্য নেই: