(লেখাটি বেরুলো অনন্ত আচার্য সম্পাদিত 'চেতনা লহরে'র জানুয়ারি-জুন ২০১৪ সংখ্যাতে)
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষের একটি বই আছে। ‘বাংলার নবজাগৃতি’। লিখেছিলেন, ১৯৪৮নাগাদ। বাংলার নবজাগরণ নিয়ে উচ্ছ্বাসে
ভরা এর প্রতিটি অধ্যায়। বাইশ বছর পরে ১৯৭০এ তাতে একটি অধ্যায় জুড়েন
‘ বাংলার নবজাগরণঃ সমীক্ষা ও সমালোচনা’। তিরিশ বছর পরে ১৯৭৯এ এর আরেকটি অধ্যায় জুড়ে নাম দেন , ‘বাংলার নবজাগৃতি
একটি অতিকথা।’ অধ্যায় নামগুলো বলে দেয় তাঁর ভাবপথের ঠিকানা। বৌদ্ধিক সততার এমন
উজ্জ্বল নিদর্শন একটি বিরল ঘটনা। গ্রন্থটি যখন প্রথম লেখেন তখনো তিনি মার্ক্সবাদী।
যখন নিজের মত পালটে ভারত নিয়ে খোদ মার্ক্সের রচনাগুলোকেই কাঠগড়াতে দাঁড় করান তখন
তিনি আসলে বিশুদ্ধতর মার্ক্সবাদী। গোঁড়া মার্ক্সবাদ
বিরোধীদের এই প্রত্যয়ের অর্থ বোঝানো কঠিন। আমরা তা
বোঝাতেও যাব
না, শুধু বিপর্যয়টা ঘটে কেন, এই নিয়ে আমাদের নিজেদের কথা বলবার চাইতে তাঁর
মন্তব্যের ঝলক কিছু তুলে দেয়া মনে হয় না অপ্রাসঙ্গিক হবে। “...ইউরোপীয়
‘রেঁনেসাসে’র মডেলটি ইংরেজ ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে গ্রহণ করে আমাদের দেশে নির্বিচারে
যাঁরা প্রয়োগ করতে অত্যুৎসাহী হয়েছেন তাঁরা একজাতের অভিজাত কলেজে হয়তো শিক্ষালাভ
করেছেন (যেমন প্রেসিডেন্সি কলেজে) , পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় অন্য সকলকে দাবিয়ে টপকে
সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছেন, অতএব ‘ইতিহাস’ মানে ‘তিনি’ এবং ‘তিনি’ আর ‘ইতিহাস’
অভিন্ন এবং তাঁর মার্ক্সবাদী ব্যাখ্যানও অভ্রান্ত। এইটাই বিভ্রান্তিকর ট্র্যাজেডি।
অর্থাৎ এই মার্ক্সীয় ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাই নবজাগৃতির প্রত্যয়ের নিমিত্তকারণ। অবশ্য
এই ট্র্যাজেডির মূলে আরও একটি বড় কারণ আছে এবং সেটা হলো ‘ভারতে ইংরেজ শাসনের
ফলা-ফল’ সম্বন্ধে কার্লমার্ক্সের উক্তিগুলি ।” মার্ক্সের উক্তিগুলো নির্ভর করেই তিন দশক আগে যে বইটি
লিখেছিলেন, সেগুলো খণ্ডন করেই তিন দশক পরে শেষ দুটি অধ্যায়টি লেখেন তিনি। যে মূল
বিষয়টি বিনয় ঘোষকে নিজের পূর্বমত এবং মার্ক্সের মতকে পুনর্বিচারে বাধ্য করেছিল সে
ভারতের ‘জাতবর্ণ ব্যবস্থা’।
যে গুটি কয় মার্ক্সবাদী সত্তর দশক থেকে ব্যবস্থাটিকে
উপরিকাঠামোর বদলে যুগপৎ কাঠামো-পরিকাঠামোর বিষয় বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন বিনয়ঘোষ
তাদের মধ্যে অন্যতম। মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবিদের বিদ্রূপ করে লিখেছিলেন,
“পুথিপুস্তকগত বাস্তবতার সঙ্গে প্রকৃত সামাজিক জীবনের বাস্তবতার পার্থক্য দেখে
আমরা পদে পদে অবাক হয়ে যাই। তথাপি পুথিগত বাস্তবতার লেজ ধরে গরুর লেজ ধরে অন্ধের
নগর দেখার মতো, আমরা এগিয়ে চলি, সামাজিক পরিবর্তন-বিবর্তন-বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি,
প্রকৃত জীবন সত্য ও সমাজ বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাই। আমরা চোখ মেলে দেখি না,মন খুলে চাই
না যে সামাজিক চিন্তাভাবনা, সামাজিক ব্যবহার, সামাজিক ক্রিয়াকর্ম, সবকিছুরই
বিভিন্ন স্তর (levels)
আছে, বিভিন্ন
গড়ন (Structure)
আছে এবং অনেক
সময় এক একটি স্তরে, একই গড়নের চৌহিদ্দির মধ্যে এগুলি বেশ স্থায়ীভাবে বিরাজ করে,
পরিবর্তনের কোনো ঢেউএর আঘাতে বিচলিত হয় না। যেমন, আমাদের দেশের
জাতিবর্ণভেদ-ব্যবস্থা। শতশত শতাব্দীর নির্মম কশাঘাত সহ্য করে, শতসহস্র
রাষ্ট্রনায়কদের জাতিসাম্যের বাণী বিধিনিষেধের আইনকানুন আবর্জনাস্তূপে নিক্ষেপ করে,
আজও ১৯৭৮ সালেও যখন দেখা যায় যে সেই জাতিভেদব্যবস্থা হিন্দু সমাজের সবচেয়ে মজবুত
ভিত্তিরূপে প্রায় অটুট রয়েছে, অথচ অর্থনীতি-টেকনোলজির অগ্রগতি-উন্নতি অনস্বীকার্য
, তখন ভাবতে হয় যে এই ব্যবস্থাটা কী এবং তার অন্তর্নিহিত কোন জাদুবলে তার এই অমর
অক্ষয় রূপ আজও প্রকট।” মার্ক্স আশা করছিলেন বৃটিশ পুঁজির ধাক্কাতে বিশেষ করে রেলের
মতো প্রযুক্তির ধাক্কাতে ভারতের জাত-বর্ণব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে, বিশেষ করে বৃটেনে
বিপ্লব হবে, ভারত স্বাধীন হবে আর তার পরে এই অভিশাপটি দেশের সমাজে থাকবে না--সেই বিশ্বাস
থেকেই ভারতীয় মার্ক্সীয় তত্ত্ব গড়ে তুলতেন পঞ্চাশের দশকের ‘তেভাগা’র নেতৃত্ব, বিনয়
ঘোষ সেই আবহেই প্রথম লিখেছিলেন তাঁর বইটি। জাতবর্ণ ব্যবস্থা ভেঙে গেছে, এমনকি
হিন্দুতে মুসলমানেও সম্প্রীতিটাই মূল স্বর এই সমাজে---এমন একটা তত্ত্ব তিনি দাঁড়
করাচ্ছেন। তিনদশক পরে এসে তিনি প্রশ্ন তুলছেন মার্ক্সের পক্ষে ভারতের সমাজের
ভেতরটা দেখা তখন কতটা সম্ভব ছিল। মত দিচ্ছেন, মার্ক্স যা আশা করেছিলেন ঘটনা তেমনটি
ঘটেনি। শুধু তাই নয়, এই দেশে শিল্পবিপ্লব হয় নি, স্বাধীন পুঁজি গড়ে উঠেনি,
সামন্তবাদকে প্রত্যাহ্বান জানানোতো দূর, একে সঙ্গী করে নিয়ে এর সঙ্গে আঁতাত করেই
এগিয়েছে বৃটিশ ঔপনিবেশিক পুঁজি। সুতরাং
নাগরিক উপরতলাতে সামান্য নাড়াচাড়া হলেও সমাজের তৃণমূল নাড়ানো কোনো নবজাগরণও হয় নি
এই দেশে। তাঁর এই অধ্যায় পড়লে এই বিশ্বাস দৃঢ় হতে বাধ্য যে সমাজ এবং ইতিহাসকে
দেখার একটি ইউরোপীয় মডেল ছাড়া এই নবজাগরণের অর্জন বিশেষ নেই। যে মডেল আসলেই
জ্ঞান-কর্মযোগে বিভাজিত এই সমাজের বৌদ্ধিক সমাজকে দেশের থেকে আরো বেশি বিচ্ছিন্ন
করেছে বৈ কাছে নিয়ে যায় নি। অধ্যায়টি শেষ করছেন এই লিখে, “আমাদের দেশের বৃহত্তম
জনশ্রেণী কৃষকেরা নিম্নতম শূদ্রবর্ণভুক্ত হবার ফলে যে রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি ঘটেছে
তা আরও শোচনীয়। চীনে কৃষিজীবীরা সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত,
উচ্চতম
স্তরের পরেই তাদের স্থান, এ কথা আগে বলেছি। সেই জন্য চীনের কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং
কমিউনিস্ট পার্টি সহজেই গ্রামভিত্তিক ও কৃষক শ্রেণী নির্ভর হতে পেরেছে,
যা ভারতীয়
রাজনীতির কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে হয় নি। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন শহরভিত্তিক
মধ্যবিত্ত নির্ভর হবার জন্য আজ তার এই মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছে। ভয়াবহ দারিদ্র্য ও
শোসন পীড়ন সত্ত্বেও এদেশের যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টিগুলি আজও তাই শাসকশোষক শ্রেণির
লেজুড় হয়ে নিজেদের সত্তা কোনরকমে বজায় রেখে চলেছে, এমন কি যাঁরা কমিউনিস্টদের মধ্যে
সাচ্চা বিপ্লবী, প্রকৃত 'মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট '
বলে দাবি
করেন তাঁদের মধ্যে অনেকে (সকলেই অবশ্য নন) মধ্যবিত্ত বাবুপ্রধান রাজনীতিতেই মগ্ন,
কেবল
তত্ত্বকথার বীজগুড়ি কাটছেন, এবং গ্রাম বা কৃষক তাঁদের শহরের কফিহাউসের আড্ডা থেকে
অনেক দূরে। বর্তমান বিংশশতাব্দীর সত্তর দশকে যেমন মার্ক্সীয় তত্ত্বের বাঁধা সূত্র
প্রয়োগ করে, আমাদের হতভাগা দরিদ্র দেশে কেন বিপ্লব (Revolution) হয়নি এবং হবার আশু সম্ভাবনা নেই তা
ব্যাখ্যা করা যায় না, তেমনি উনিশ শতকের 'রেনেসাঁস'
বা নবজাগৃতি
মার্ক্স লিখিত 'ভারতে ইংরেজ শাসনের ফলাফল' বিষয়ে প্রবন্ধের সাহায্যে 'ঐতিহাসিক সত্য'
বলে প্রমাণ
করা যায় না। বাংলার তথা ভারতের নবজাগৃতি যে একটি অতিকথা (Myth) ,এ সত্য বাস্তব ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে প্রকট হয়ে ওঠে। ”
“জাগল কারা?” তিনি প্রশ্ন করছেন।
“কলকাতা শহর যদি ‘নবজাগৃতিকেন্দ্র’ হয়, যদি রেনেসাঁসের সূর্য ‘জ্যোতির কনকপদ্মের’
মতো কলকাতার আকাশে উদিত হয়ে থাকে, তাহলে কলকাতার খুব কাছাকাছি গ্রামেও, দেড়শো বছর
পরেও, কেন অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার?” এর আগে যিনি লিখছেন নগর কলকাতার নতুন
অর্থনীতি বর্ণের প্রাচীর ভেঙ্গে দিয়েছে, এবারে সেই তিনিই লিখছেন, “ বৃটিশ আমলে
হিন্দু সমাজে এই ঘটনাই ঘটেছে। কুলবৃত্তি ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ –ক্ষত্রিয়-বৈশ্যরা কেউ
জাতিচ্যুত হন নি, বরং প্রচুর অর্থ উপার্জন করে সমাজে তাঁদের কুলগত আধিপত্য আরও
মজবুত করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কুলগত বর্ণের সঙ্গে বিত্তগত বর্ণ মিশে এক বিচিত্র
বর্ণ সামাজিক প্রতিপত্তির বিকাশ হয়েছে সমাজে বৃটিশ আমলে। সমাজের কুলগত জাতিবর্ণগত গড়নের কোনো পরিবর্তন হয় নি, যে জন্য এদেশে
‘রেনেসাঁস’ হয়নি।” তিনি আরো লিখছেন, “বৃটিশ ভারতে তথা বাংলাতে “জাতি ( caste) ও শ্রেণী (class)
বিচিত্রভাবে
সমাজগড়নের স্তরে-স্তরে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। তারফলে সমাজের স্তরবিন্যাস আরো জটিল
হয়েছে। জাতিবিরোধ ও শ্রেণীবিরোধ বাস্তবতার স্তরে এমনভাবে মিলেমিশে আছে যে কোনটা কি
তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। বর্তমানে তাই ধনতন্ত্র ও টেকনোলজির যথেষ্ট উন্নতি সত্ত্বেও
আমাদের দেশে অধিকাংশ শ্রেণীবিরোধ জাতিবিরোধ বলে মনে হয় এবং বাইরের প্রতীতি যে
বাস্তব সত্য নয় তা অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বুঝি না।” বুঝিনা বলেই আজ যখন অসম তথা
পূর্বোত্তরের দিকে দিকে জাতিবিরোধগুলো দেখি তখন আমাদের অনেকেরই মনে হয় এগুলো
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মাত্র---‘শ্রেণি সংগ্রামে’র সঙ্গে দূর দূর অব্দি এর কোন সংযোগ
নেই। এতো এতো রক্তহানির ইতিহাস রচিত হবার পরেও আমাদের পুথিপড়া মনে এই প্রশ্নও
জাগেনা অনেক সময়, মার্ক্স তবে কেন লিখেছিলেন, “আজ অব্দি অস্তিত্বশীল সমস্ত মানব
সমাজের ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামেরই ইতিহাস ।” ফলে শ্রেণি সংগ্রাম স্তগিত রেখে
‘সাম্প্রদায়িক বিরোধ’ মেটাবার কাজে ব্যস্ত বহু মার্ক্সবাদী সমাজ ইতিহাস থেকেই মুছে
যাচ্ছেন, তবু চৈতন্যোদয় হয়ই না! অথবা আদৌ কি স্তগিত রাখছেন? দেখা যাবে, বর্ণহিন্দু
নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর জাতীয়তাবাদের ভেতরে মীমাংশার নিদান দিয়ে আসলেই তাঁরা শ্রেণি
সংগ্রামে প্রতিদিন অংশ নিচ্ছেন কিন্তু উপরের শ্রেণির সহযোগী হয়ে, এই ভাবে তাঁরাও
শরিক তথা রক্ষক হয়ে পড়ছেন ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতবর্ণব্যবস্থার।
ভারতীয় সমাজের জাত-বর্ণব্যবস্থা এমন একটি মূল বিষয় যে
‘ঈশ্বর’ কিম্বা কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের চেয়েও প্রবল শক্তি নিয়ে ইতিহাসের সমগ্র
সময় জুড়ে ভারতীয় সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করেছে । এটি একাধারে এই দেশে একটি ধর্মীয় তত্ব্ব এবং ধর্মনিরপেক্ষ আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থা। ধর্মীয় তত্ব্ব হিসেবে এর বিরোধিতা করতে গিয়ে চার্বাক,
যোগ, বৌদ্ধ, জৈন, বৈষ্ণব মতবাদের মতো যত মত এবং পথের উদ্ভবই হোক না কেন, কিম্বা
ইসলাম বা খৃষ্ট ধর্মের ঝড় বাইরে থেকে ভারতে আসুক না কেন ‘সনাতন ধর্ম’ এখনো ভারতের
অধিকাংশ মানুষের ধর্ম। সেই সমস্ত মানুষ এবং যারা এই ধর্মের
ভেতরে নেই তাদেরও চূড়ায় বসে আছেন ব্রাহ্মণ্য সমাজ। ধর্মটির আদৌ কোন নির্দিষ্ট নাম
ছিল না কোন দিন, না কোন স্থির উপাসনা পদ্ধতি, না কোন স্থির আচার অনুষ্ঠান। যার
জন্যে এর ‘উদারতা’ নিয়ে বহু ভারতীয়ই প্রশংসাতে পঞ্চমুখ। কিন্তু জন্মসূত্রে
ব্রাহ্মণ, জাতি বিচার এবং জন্মান্তরে বিশ্বাসকে বাদ দিয়ে কেউ এই ‘ধর্ম’টির কল্পনাও
আজও করতে পারবেন না। জন্ম মৃত্যু বিবাহাচারের সময়ে প্রতিজন হিন্দুকেই জীবনে তিনবার
হলেও ব্রাহ্মণের পায়ে প্রণাম ঠুকতেই হয়। এখানে কোন ব্যক্তি স্বাধীনতা চলে না।
ইতিহাসে বারে বারে এর উপর ভেতর কিম্বা বাইরে থেকে আঘাত পড়েছে, ক্ষয় হয়েছে, মনে
হয়েছিল বিলুপ্ত হয়ে যাবে---কিন্তু কোন এক ‘অলৌকিক’ শক্তি বলে এর পুনরুত্থান হয়েছে,
যেন নতুন নামে এবং চেহারাতে গোটা ধর্মটির পুনর্জন্ম হয়েছে। ঔপনিবেশিক ভারতে এই
পুনর্জন্ম পাওয়া ধর্মটিই সগৌরবে নিজের আপাত ‘চিরায়ত’ গুণের প্রতি সম্মানে নিজের
নাম দিয়েছে ‘সনাতন ধর্ম’, যে ধর্ম দুনিয়ার আর কোন ধর্মের মতো নয় বলে সে নিজেই
নিজের সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছে। এবং বাকি বিশ্বের থেকে আলাদা থাকবার
সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে প্রথমে তার প্রাচ্যের প্রতিপক্ষে এবং পরে পাশ্চাত্যের
প্রতিপক্ষের দেয়া নাম সে নিজেই মেনে নিয়েছে---নামটি ‘হিন্দু’ ধর্ম। যে ধর্ম ভারতের
বাইরে ছড়াতে পারেনি কোনদিন—এটিই তার সীমাবদ্ধতার উজ্জ্বল প্রমাণ। যার শেষ
পুনরুত্থান ঘটে উনিশ শতকের শেষের বৃটিশ ভারতের রাজনৈতিক রাজধানী কলকাতাতে এবং
পৃষ্ঠপোষকতা পেতে থাকে ভারতের প্রাচীন বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই থেকে। উনিশ শতকীয়
বাংলা তথা ভারতীয় ‘নবজাগরণ’ এসেও শেষ পর্যন্ত এর সঙ্গে আঁতাত করেছে বৈ উচ্ছেদ করে
নি। মহানাগরিক সমস্ত প্রগতিশীল ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের পরিণাম কিন্তু উনিশ শতকের
‘হিন্দু পুরুত্থানবাদ।’
আঠারো শতকের শেষে ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর সঙ্গে পশ্চিম
ইউরোপীয় ভাষার আত্মীয়তার সম্পর্কসূত্রের আবিষ্কার এক দিকে যেমন নতুন শাসকদের সঙ্গে
‘সনাতন’ ভারতের শাসকশ্রেণির আত্মীয়তাভাবের সুদৃঢ়করণে বৌদ্ধিক সহায়তা করে তেমনি
ভারত ইতিহাসের এক ‘অন্ধকার মধ্যযুগে’র কল্পনাও বিদেশী শাসক এবং দেশী মুৎসুদ্দীদের
একই ইতিহাসের শরিক হবার গৌরব প্রদান করে । বুঝিবা এই জুটি এবারে ভারতের ইতিহাসকে
‘মধ্যযুগের অন্ধকার’ থেকে ‘আধুনিকতার আলোয়’ এনে ফেলে দেবে। কদ্দূর কী ফেলেছে সেটি
নিয়ে অবশ্য বিশাল তর্ক করা যেতেই পারে। কিন্তু বৃটিশ যাবার অর্ধশতক পরেও
নব্য-ভারতীয় শাসকশ্রেণির প্রবল বিশ্বাস যে ‘পশ্চিমা জ্ঞান এবং সনাতন প্রজ্ঞা’ই
শুধু পারে আধুনিক ভারতের নির্মাণ করতে। তাই এই শাসক শ্রেণি এখনো বিল গেটস ভারতে
এলে এবং শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর আমেরিকা গেলে সমান উল্লাসে মেতে উঠে। ওদেশ থেকে পুঁজির
আসা এবং এদেশ থেকে শ্রমের যাওয়াকে সে নাম দেয় ‘পূর্ব-পশ্চিমে’র মিলন তথা
বিশ্বভ্রাতৃত্ব। এর উলটো কল্পনা খুব একটা করেও না, তার দরকারও নেই।
‘অন্ধকার মধ্যযুগ’ সম্পর্কে যা কিছু
বলা হয়ে থাকে তার মধ্যে একটিই শুধু পার্থক্য আছে। পশ্চিমে রাজ করত স্বধর্মের
চার্চ। যার শাসন এবং শোষন থেকে বেরিয়ে তারা নবজাগরণ এনেছিলেন, শিল্প বিপ্লব
করেছিলেন, সামন্তবাদ হটিয়েছিলেন, পুঁজিবাদ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আর
আমাদের দেশে রাজ করতেন বিধর্মী কিন্তু ধর্মান্ধ ‘বিদেশী’রা। যাদের থেকে আমরা
নিজেরাতো মুক্তি অর্জন করতে পারিনি, পশ্চিম এসে হাত ধরেছে আমাদেরও উদ্ধার করেছে।
মোটামোটি এই বিশ্বাস এবং ভালোবাসা ঔপবেশিক আমলে গড়ে তুলেছিলেন এবং এখন উত্তর
ঔপনিবেশিক সময়ে অস্তিত্বশীল ভারতীয় মধ্যবিত্ত সেই বিশ্বাসকে লালন করেন। অসম
বিকাশের দেশে নতুন যেসব জনগোষ্ঠী এই মধ্যবিত্তের সারিতে নাম লেখান, তারাও অচিরেই
স্কুল পাঠ্যক্রমের এই ইতিহাস মুখস্ত করতে শুরু করেন।
বলা হয়ে থাকে যে ‘অন্ধকার মধ্যযুগে’ ইসলাম ভারতীয়
হিন্দুদের উপর ব্যাপক নিপীড়ন চালিয়েছে, ধর্মচর্চার শাসন বলে কিছুই রাখে নি। হাজারো
মন্দির ধ্বংস করেছে। নারীর মান ধুলোয় লুটিয়েছে। ভারতীয় ‘নবজাগরণে’র অর্জন হলো এই
নবীন অন্ধবিশ্বাস। ঘটনা হলো এতো সব হবার পরেও এই সব গল্প বলবার এবং শুনবার মতো এক
শক্তিশালী ভারতীয় হিন্দু মুৎসুদ্দী শ্রেণিকে বৃটিশ এসে এই দেশে পেয়ে গেছে। তাঁরা
কেউ ধর্মান্তরিত হন নি। তখনো তাঁরা এই দেশের সিংহভাগ মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক
নেতা। বাকি পশ্চিম এশিয়াতে , উত্তর আফ্রিকাতে, ইরানের মতো আর্য ভূমিতে, তুরস্কের
মতো ইউরোপীয় দেশে যে পূর্বতন সমস্ত ধর্মকে প্রায় সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক করে ছেড়ে
দিয়ে একের পরে এক ধর্ম বিপ্লবও করে গেছে—ভারতে সেই ইসলাম হিন্দু ধর্মের টিকিটিও
নাড়াতে পারে নি। চীনে-জাপানে অবশ্যি ইসলাম ঐতিহাসিক অন্যান্য কারণ ছাড়াও প্রাকৃতিক
কারণেও বেশিদূর এগুতে পারে নি। সেসব দেশে একই সময়ে কিন্তু জাকিয়ে বসল একটি ভারতীয়
ধর্মই—তার নাম বৌদ্ধ ধর্ম। যে ধর্ম ভারতে ‘ব্রাহ্মণ্য’ ধর্মের কাছে হার মেনেছিল
‘অন্ধকার মধ্যযুগ’ শুরু হবার আগেই। বাকিটা বিলীন হয়ে গেল ইসলামের মধ্যে। বিশেষ করে
বাংলাদেশে। যদি কোন ধর্মকে বিপন্ন করেছে ইসলাম এই দেশে তবে সে বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দু
নয়।
আমাদের এই অভিমতের পক্ষে খুব সহজ সমর্থন যোগাবে আমাদের
‘ধর্মসাহিত্যে’র ইতিহাস। গোটা ‘অন্ধকার মধ্যযুগে’ আমরা ‘চর্যাপদে’র মতো আর দ্বিতীয়
বৌদ্ধ সাহিত্য পেলাম না, ইসলামী সাহিত্য বা মুসলমান রচিত সাহিত্যকে সেই সব
ঐতিহাসিকেরাই একটির বেশি অধ্যায়ে যায়গা দেন নি যারা তুর্কি আক্রমণের ইতিহাস এখনো
প্রবল ব্যথাহত বুকেই লিখে থাকেন। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ থেকে ‘অন্নদামঙ্গল’
অব্দি---সেযুগের বাংলা সাহিত্যের গোটা ইতিহাস আসলে ‘ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যে'র পুনর্জন্মের ইতিহাস। সেই আধিপত্য
যাদের রেখে দিয়েছিল সবার পিছে, সবার নিচে, সবহারাদের মাঝে তারা যদি রচনা করেছেন
কোনো সাহিত্য কিম্বা চর্চা করেছেন কোন ধর্ম তবে সেগুলো ঠাঁই পেয়েছে ‘অপ্রধান’
কিম্বা ‘গৌণ’ তালিকার ভিড়ে । খোঁজে পেতে বের করতে হয়। এমনকি দীনেশ সেনের মতো লোক
যখন বহু কষ্ট স্বীকার করে প্রাক-ব্রাহ্মণ্য বৌদ্ধ-ঐতিহ্য লালিত বা ব্রাহ্মণ্য
অধিকার বহির্ভূত বাংলার ধর্মসম্পর্ক শূন্য ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের বিশাল ভাঁড়ারকে
‘পূর্ববঙ্গগীতিকা’ নাম দিয়ে উদ্ধার করেন তখনো সেগুলোকে ‘গৌণ সাহিত্য’ ,
‘লোকসাহিত্য’ এমন ইত্যাদি বিচিত্র নাম দিয়ে ব্রাত্য করে রাখবার সমস্ত আয়োজন হয়।
এমনকি ‘জাল কর্ম’ বলে এগুলোর মানহানীরও সমস্ত আয়োজন হয়। এই নিয়ে স্বয়ং দীনেশ সেনই
আক্ষেপ করে গেছেন। এই সাহিত্যগুলো আসলে আমাদের সমস্ত ঔপনিবেশিক ইতিহাসবোধকে
ধ্বসিয়ে দেয়। চেনায় আমাদের সমাজ –ধর্ম –সাহিত্যের আসল স্বরূপ। এই কাজগুলো যারা
করেন, তারাই ইসলামের হাতে হিন্দু ধর্মের বিপন্নতার কথা বড় করে বলে থাকেন।
আসল ঘটনা হলো ধর্মের দিক থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদকে বিরোধিতা
করা সত্ত্বেও বৌদ্ধ ধর্ম বা বৌদ্ধ শাসকশ্রেণি ভারতের জাতবর্ণ ব্যবস্থাটিকে হয়
বোঝেনও নি, বা নিজেদের শাসনের সুবিধের জন্যে তাতে আঘাতও করেন নি। তাই এক সময়
ধর্মটি এই দেশে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া অন্তত শাসনের দিক থেকে অনিবার্য ছিল।
শাসিতের মধ্যে যারা ধর্মটিকে ধরে রেখেছিলেন, তাদের খুব ছোট অংশকে এখনো এই দেশে
দেখা যাবে, বাকিরা ইসলামের এবং ইসলামের শাসনে এবং প্রশ্রয়ে গোটা ভারতে দেখা দেয়া
বৈষ্ণব এবং সমধর্মী আন্দোলনের বিচিত্র শাখাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন । তাতে কি বর্ণবাদ
ধ্বসে গেছিল? মোটেও না। মুসলমান শাসনের গোটা অধ্যায় জুড়ে দেখা
যাবে ভারতীয় সমাজকাঠামোতে তারাও কোন ধরণের মৌলিক আঘাত হানে নি। আঘাত হেনেছে বলে
বলবার গল্প সেই সব ঐতিহাসিকদেরও বেশি নেই—যারা মন্দির ভাঙার গল্প ঘটা করে বলেন।
সেই মন্দির ভাঙ্গার গল্প আবার বাংলাদেশে নেইও খুব একটা। কারণ, পশ্চিমা আর্য-ভারতের
মতো সম্পদশালী মন্দির তথা ব্রাহ্মণ্যঘাটি বাংলাদেশে ছিলও না খুব বেশি। আমাদের
বক্তব্যের সমর্থনে খুব কঠিন বই পত্তর কাউকে পড়তে হবে না, অচ্যুৎ চরণ তত্ত্বনিধির
‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ পড়লেই যথেষ্ট। এখানে যা কিছু ছিল সবই বৌদ্ধ সম্পদ। নালন্দা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে। নালন্দা গিয়ে ব্রাহ্মণ্য অধিপতিদের খুব একটা অসুবিধে
করেছিল বলে মনে হয় কি? তাহলে গৌরব করবার মতো মিথিলা নবদ্বীপের গল্প সব জমা হলো কী
করে? মুসলমান যুগে এই কেন্দ্রগুলোর উত্থান হয়েছিল। সপ্তগ্রাম, কৃষ্ণনগর, সিলেট,
পঞ্চখণ্ডে
ছড়িয়েছিল । বৃন্দাবন দাস যখন নবদ্বীপের ধর্মের
অবক্ষয় নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন, তখন সেই ব্রাহ্মণ্য অবক্ষয় নিয়েই হাহাকার করছিলেন,
ইসলামের অত্যাচার নিয়ে নয়। ব্রাহ্মণেরা বরং কাজির কাছেই বিচার নিয়ে গেছিলেন
শ্রীচৈতন্যের বিরুদ্ধে। তাঁর অপরাধ ব্রাহ্মণ হয়েও তিনি দাঁড়িয়েছিলেন ‘ব্রাহ্মণ্য’
ধর্মের বিরুদ্ধে। কাজিতে -ব্রাহ্মণে আঁতাতের ছবিটা বরং স্পষ্ট হয় এতে। বৌদ্ধ
ধর্মের মতোই ইসলাম এই আঁতাতটাও করেছিল। শাসকীয় এবং
শাসিতের ইসলামের মধ্যে আদান প্রদান থাকলেও একটা আলাদা চরিত্র পেয়েছিল। সুফী
সাহিত্যের চর্চা হচ্ছে আরাকানের বৌদ্ধ রাজসভাতে। যে আরাকানের রোহিঙ্গিয়ারা বাঙালির
আত্মীয় হয়েও এখন আন্তর্জাতিক স্তরেই একটি ‘ব্রাত্য’ জনগোষ্ঠী। মূল বাংলাদেশের মুসলমান
শাসকদের দরবারে অনুদিত হচ্ছে হিন্দু পুরাণ—ভাগবত, রামায়ণ, মহাভারত। কিছুতো অর্থ
আছে এর। কিন্তু কোন পক্ষই জাতবর্ণব্যবস্থার মূলে আঘাত করলেন না। এমনকি বৈষ্ণব
শ্রীচৈতন্য বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মও না। তবে কিনা সংস্কৃতেই চর্চা হতে হবে সমস্ত
ধর্মসাহিত্য--- এই ব্রাহ্মণ্য সংস্কারকে প্রত্যাহ্বান জানিয়ে বাংলা
ভাষার বিকাশের শক্ত ভিত তৈরি করছে এই ঘটনা। সেই বাংলাভাষাতেই অকৃতজ্ঞের মতো আজকাল
আমরা মুসলমান শাসনকে কষে গালিগালাজ করি, তাও খাওয়া পরবার কোন সমস্যা নিয়ে নয় ,
ধর্মান্তর
ঘটাবার দায়ে। চৈতন্যত্তোর বৈষ্ণব ধর্মে আমরা যে ‘স্বকীয়া-পরকীয়া’ ,
‘বৈধী-রাগানুগা’ ইত্যাদি বিতর্ক দেখব সেগুলো নিতান্ত মতাদর্শগত সংঘাত ছিল না।
এগুলো উঠে এসছিল রীতিমত শ্রেণি-বর্ণগত স্বার্থের থেকে। ‘স্বকীয়া-বৈধী’ ধারাটি
ক্রমে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের দেখানো পথে সংস্কৃত ভাষা এবং ব্রাহ্মণ নির্ভর
প্রাতিষ্ঠানিক ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম’ হয়ে উঠছে। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তার তথাকথিত ‘ঔদার্যে’র বশে ধর্মের নতুন মত এবং
পথকে বরণ করে নিচ্ছে কিন্তু ‘জাতবর্ণব্যবস্থা’র অব্যয় আধিপত্য নিশ্চিত করে নিচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে শ্রীচৈতন্যের সময়েই আরেকটি ব্যাপার
ঘটছিল বাংলাদেশে । রঘুনন্দনের হাতে নতুন স্মৃতিশাস্ত্র রচিত হচ্ছে নীরবে এবং
ব্রাহ্মণদের বিতর্ক সভায় সভায় ছড়িয়ে পড়ছে। স্মৃতিশাস্ত্র দিয়ে শাসিত এবং
নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে চৈতনোত্তর বৈষ্ণব ধর্ম।
স্বয়ং
নিত্যানন্দের স্ত্রী জাহ্নবা দেবী সেই চাপে রাধাকে পরিণীতা বৈধ স্ত্রীর মর্যাদা
দিয়ে কৃষ্ণের বাঁ-পাশে বসিয়ে যুগল মূর্তির প্রতিষ্ঠা করছেন। ফলে নিজের গর্ভজাত
সন্তান রামচন্দ্র ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন মায়ের থেকে। মায়ের গুরু পরম্পরার
উত্তরাধিকার উঠে আসছে সৎপুত্র বীরভদ্রের হাতে। সত্য বটে তাঁদের পুরোনো ব্রাহ্মণ্য
পরম্পরার থেকে সরে আসা সবটা অথলে যায় নি, নইলে জাহ্নবা দেবী, সীতা দেবীর মতো অতি
শ্রদ্ধেয়া বৈষ্ণবগুরু দেখা দেবে কী করে? শুধু তাই নয়, বৈধীধারার নতুন শাস্ত্র
চর্চা করতে করতে এঁরা বিদ্যাসাগরের বহু আগেই ‘অন্ধকার মধ্যযুগে’ই নারী-পুরুষ
নির্বিশেষে শিক্ষা ছড়াচ্ছেন। এও সত্য যে সাহিত্য-দর্শনের সঙ্গে করে এঁদের হাতে
নতুন করে বাংলাদেশে বহু বৈষ্ণব মন্দির গড়ে স্থাপত্যশিল্পেরও এতোটাই বিস্তার ঘটেছিল
যে বৃন্দাবন হয়ে সেগুলো রাজস্থান অব্দি পৌঁছেছিল১—‘অন্ধকার মন্দির
ভাঙ্গার ইতিহাসে’র প্রবক্তরা যে কথাগুলো খুব ঘটা করে লেখেন না। কিন্তু এও সত্য যে
এদেরই উত্তরসুরীরা ক্রমে সহজীয়া চণ্ডীদাসেদের সেভাবেই অপাংক্তেয় করে দিচ্ছিলেন
যেভাবে এককালে চৈতন্যকে করতে চেয়েছিলেন নবদ্বীপের ব্রাহ্মণেরা। কিম্বা যে
পূর্বাধিকার রচিত হয়েছিল ডোম্বী প্রেমে মাতোয়ারা চর্যাপদের রচয়িতাদের বেলা । মূল ধর্মকথাগুলো লুকিয়ে গেছিল ‘সান্ধ্যভাষা’র আড়ালে। এই দুই পথের লড়াই
এরপরে নিরন্তর চলেছিল। পীড়িত, প্রত্যাখ্যাত, উপেক্ষিত এবং নিম্নতর জাতি-বর্ণগুলোর
সেই পথটিকে আমরা এককথাতে বলতে পারি, ‘সহজীয়া’ পথ । সেই বৌদ্ধ যুগ থেকে সুফী,
কিম্বা বৈষ্ণব ধর্মের রমরমার যুগে যার বাইরের পোষাক পাল্টালেও ভেতরের মর্মকথাটি
মোটের উপর একই। এরা কেউ, ঈশ্বরকে নিজের বাইরে কল্পনা করতে রাজি ছিলেন না। তাদের
একটাই কথা ‘মনের ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়।’ মন আর অচিন পাখির মাঝে কারো
গুরুগিরি এবং শাস্ত্রশাসন এরা মেনে নেন নি। যারা তা মেনেছেন তারা উবে গেছেন
ক্রমেই, বা প্রতিবাদী ধারাটি শুরু হয়ে গেছে সেই সঙ্গেই। এরই জন্যে এদের থেকে
উপাসনা পদ্ধতিটি কী--- জানতে চাইলে অনেকেই ভালো করে উত্তর দেন না। বিশেষ করে
বাউল-ফকিররা। একটি সাধারণ ভয় ছিল তাদের বা এখনো আছে-- সেরকম কোন পদ্ধতি দাঁড় করালে
কিম্বা লোক জানাজানি হলে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ঠিক সেগুলো নিজের আদলে গ্রাস করে নেবে।
এখন আবার তার সঙ্গে জুড়েছে বাজারের লালসা। ছায়াছবিতে অবদমিত নারীকে অর্ধনগ্ন করে
নিতান্তই যৌন লালসা মেটাতে গাওয়ানো হয় 'সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী'। যার সঙ্গে বৈরাগ্যের দূর দূর অব্দি
কোন সম্পর্ক নেই। বাজারের এই ব্যাপারটি বহু মধ্যবিত্ত বিদগ্ধজনেরা বোঝেন। যেটি বোঝেন
না, তা হলো সামন্তীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যাপারটি। আমরা সেটিই বুঝবার চেষ্টা করব
মতুয়া ধর্মান্দোলন থেকে একটি নজির নিয়ে। ‘মতুয়া ধর্মে’র প্রবর্তক হরিচাঁদ নিয়ে কথা
বলতে গিয়ে দেখাবো কী করে হরিচাঁদ ঠাকুর বারে বারে বাধা দিচ্ছেন তাঁর জীবনী লিখতে।
বাধা দিচ্ছেন তাঁর পুত্র গুরুচাঁদও। কিন্তু সমাজ এবং পরিবারের ভেতর থেকে তাদের
লড়তে হচ্ছে ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের সঙ্গে এবং লিখে ছাপার আয়োজন যখন হলো তখনো কেমন
আচরণ করছে বিশ শতকের ঔপনিবেশিক ব্রাহ্মণ্যবাদী কলকাতা।
তাঁর আগে খানিক বলে নেয়া ভালো হরিচাঁদ ঠাকুর ব্যক্তিটি
কে? বিবেকানন্দ-অরবিন্দের 'দত্ত-ঘোষ'দের দেশে আমরা কেউই কিন্তু স্কুলে
কলেজে এঁদের কথা পড়িনি বিশেষ। সেখানে এঁরা এখনো ব্রাত্য। হরিচাঁদ ঠাকুর বাংলার
সবচে’ বড় হিন্দু কৃষক এবং অন্ত্যজ জনগোষ্ঠী নমশূদ্র সম্প্রদায়কে সামন্তশাসকদের
বিরুদ্ধে লড়াইতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে। ক্রমে সেই লড়াই
রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দুই ধারাতে বিকশিত হয়। ব্রাহ্মণ্য বৈদিক ধারার বিপরীতে তিনি
এমন এক ধর্ম গড়ে তোলেন যা আজো ভারত বাংলাদেশের কয়েক কোটি নমশূদ্রদের মধ্যে ‘মতুয়া’
নামে পরিচিত। ১৮১২সনের ১১ মার্চ এখনকার বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার ওঢ়াকান্দির
পাশে সাফলিডাঙ্গা গ্রামে জন্ম নেন হরিচাঁদ ঠাকুর। পরে ওড়াকান্দি থেকেই পরিচালনা
করেন তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ড। সেখানেই ১৮৮৭এ তাঁর মৃত্যুর পরে পুত্র গুরুচাঁদ উত্তর
দায়িত্ব তুলে নেন। গুরুচাঁদের জন্ম ওড়াকান্দিতে ১৮৪৪এ। মারা যান ১৯৩৭এ। বাবা-ছেলের জীবৎ কাল ১২৫ বছর থেকে
হরিচাঁদের ছেলেবেলার প্রথম একুশ বছর –যে বয়সে তিনি তাঁর জন্মগ্রাম ছেড়ে ওঢ়াকান্তি
আসেন--বাদ দিলেও বলা চলে উনিশ-বিশ শতকের একশত বছর জুড়ে মতুয়া ধর্মান্দোলন ছিল
বাংলার অন্যতম প্রধান ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। যদি ব্রাহ্ম ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের
কথা মনে রাখি, তবে এতো দীর্ঘ নির্বিরোধ জীবন সেই ধর্মের ছিল না। এতো বিশাল সামাজিক
সমর্থনও ছিল না ব্রাহ্মধর্মের । তারপরেও ব্রাহ্মদের চিনি, মতুয়াদের না ।
আমরা তাঁর ধর্মমতের বিস্তৃত এখানে আলোচনা করতে যাবো না,
কিন্তু কিছু ঝলক তুলে না দিলে বুঝতে অসুবিধে হবে। বৌদ্ধধর্মের অষ্টাঙ্গিক মার্গের
আদলে হরিচাঁদেরও ছিল দ্বাদশ আজ্ঞাঃ ১) সদা সত্য কথা বলা। ২) পরস্ত্রীকে মাতৃজ্ঞান করা। ৩) পিতা মাতাকে ভক্তি করা। ৪) জগতকে প্রেমদান করা। ৫) পবিত্র
চরিত্র ব্যাক্তির প্রতি জাতিভেদ না করা ৬) কারো ধর্ম নিন্দা না করা। ৭) বাহ্য অঙ্গে সাধু সাজ ত্যাগ করা। ৮) শ্রীহরি মন্দির প্রতিষ্ঠা করা। ৯)
ষড় রিপুর থেকে সাবধান থাকা। ১০) হাতে কাজ মুখে নাম করা। ১১) দৈনিক প্রার্থনা করা।১২)
ঈশ্বরে আত্ম দান করা।
দেব-দ্বিজে, অবতারে, সাধুর ভেকে, মূর্তিপুজোতে,
পাপে-পূণ্যে, স্বর্গে নরকে, যাগ যজ্ঞে, অশৌচাদি আচার বিচারে এবং জন্মান্তরবাদে
মতুয়া ধর্মে বিন্দু মাত্র আস্থা ছিল না। মূল কথাটা ছিল, “জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।/
ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।” হরিচাঁদের আমলেই সামন্ত শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়াও, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ,
নরবলি, শাস্তিবিক্রি ইত্যাদি নানা পরম্পরার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন মতুয়ারা। পরে
গুরুচাঁদ নমশূদ্র ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষা, বাণিজ্যের বিস্তার এবং আইনী রাজনীতিতে
সক্রিয় অংশগ্রহণেও উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। তাঁরি প্রচেষ্টাতে 'চণ্ডাল' অববাদ ঘুচে জনগোষ্টীটি 'নমশূদ্র'
বলে পরিচিত
হয় ১৯১১র আদম শুমারির পরে থেকে।
মতুয়া ধর্মে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার প্রবেশের প্রক্রিয়াটি
কিন্তু শুরু হয়েছিল হরিচাঁদের জীবিতাবস্থাতেই। অথবা বলা সঠিক হবে আতারুণ্য তাঁকে
লড়ে যেতে হয়েছে এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত’ বলে একটি গ্রন্থকে
এখন অধিকাংশ মতুয়ারা তাঁদের আদি ধর্মগ্রন্থ বলে শ্রদ্ধার সঙ্গে পাঠ এবং অনুসরণ করে
থাকেন, সেটি লিখতে মানা করেছিলেন স্বয়ং হরিচাঁদই। কথাটি এই গ্রন্থেই আছে। এটি
লিখেছিলেন তারক চন্দ্র সরকার। তাঁকে কবি নিযুক্ত করে এই গ্রন্থটির পরিকল্পনা আসলে
করেছিলেন অন্য দুই ধর্মগুরু মৃত্যঞ্জয় বিশ্বাস এবং দশরথ বিশ্বাস। তাঁরা যখন
নিজেরাই খানিক লিখে হরিচাঁদকে পড়িয়ে অনুমোদন আনতে যান, তিনি মানা করে বলেন,
“...লীলাগীতি লেখা এবে উচিৎ না হয়।।/ ক্ষান্ত কর লেখালেখি বাহ্য সমাচার।/ অন্তরের
মাঝে রাখো আসন আমার।।” একজন যথার্থ বৌদ্ধ-বাউল সহজীয়া পরম্পরার গুরুর মতো নির্দেশ
ছিল। জেদ ধরেলে হরিচাঁদ উষ্মা প্রকাশ করেন এই ভাষাতে, “ মহাপ্রভু বলে জান এ
কর্ম্মে পুরস্কার।/ কুষ্ঠ ব্যাধি হবে চেষ্টা করিলে আবার।।” এই ঘটনাতে
মৃত্যুঞ্জয়-দশরথ জুটি ভয় পান নি, বইটির অষ্টম সংস্করণের ভূমিকাতে আছে মৃত্যঞ্জয়
বুঝি এই অভিশাপকে সাদরে গ্রহণ করেন, “সেতো আমার জীবনের লীলাগীতি লেখার পরম
পুরস্কার।” ২ কিন্তু কবি তারক চন্দ্র সরকার ভয় পেয়ে গেছিলেন। তিনি
আধখানা লেখা পাণ্ডুলিপি লুকিয়ে রাখেন। পরে যখন শেষ
করেন তখন এক ব্রাহ্মণ্য গল্প জুড়ে দেন, সেই পাণ্ডুলিপি বুঝি সরিয়ে ফেলেছিলেন দেবী
সরস্বতী। হরিচাঁদের
মৃত্যুর পরে আবার সেই সরস্বতী স্বপ্নে এসে তাঁকে পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে যান, সেই
সঙ্গে গ্রন্থ শেষ করবার জন্যে হরিচাঁদের ইচ্ছে জানিয়ে যান। তাতেও ‘মূঢ়মতি’ তারক
খুব উৎসাহ দেখান না লেখা শেষ করতে। শেষে মৃত্যুঞ্জয়-দশরথদের সহযোগী গোলক গোঁসাই
এসে জানান, “ স্বপনেতে কেহ যদি পুঁথি করে দান/ সেজন পণ্ডিত হয় পুরাণে প্রমাণ।” আরো
জানান, তারকনাথের প্রতি ব্রাহ্মণদের সমর্থন আছে, “ ইতিনায় ভট্টাচার্য পাড়া হয়
গান।/ সুকবি বলে তোরে দিয়াছে আখ্যান।” এতো সবেও যখন তারকনাথ সাহসী হন না, তখন গোলক
গোঁসাই এক ভোর রাতে রীতিমত নৃসিংহ রূপে এসে তারকনাথের বুকে নখ ঢুকিয়ে শাসিয়ে
দিলেন, “ ...বলে তোরে নখে চিরি করি খান খান।/ নৈলে ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত’ পুঁথি
আন।।” বোঝা যায়, ইতিমধ্যে মতুয়া ধর্মের জনপ্রিয়তাকে মূলধন করে যারা আখের গোছাতে
চাইছিলেন তাঁরা এর রাজনৈতিক সারবস্তুকে বিসর্জন দিয়ে একেবারেই ব্রাহ্মণ্যধারার
গুরু হয়ে বসতে উদ্গ্রীব ছিলেন । তাঁরাই প্রবল চাপে এই গ্রন্থ লেখান। আজ অনেক মতুয়া
ধর্মাবলম্বী বুদ্ধিজীবিরা একে ‘স্বগোষ্ঠীর প্রতি অমার্জনীয় অপরাধ বলে’ মনে করছেন।
এবং নতুন করে ভাবছেন। ৩ এ বইটি সরস্বতীর স্বপ্ন দেখানো, নৃসিংহ রূপ
ধরা, গুরুবাড়িতে দুর্গাপুজোতে গুরুচাঁদের সম্মতি, ব্যবসায়ী গোবিন্দ বিশ্বাস,
চৈতন্য বিশ্বাসের বাড়ির দুর্গাপুজোতে পাগল হীরামনের অবিশ্বাসের বশে দুর্গা মূর্তির
কোলে চড়ে গিয়ে দুধ খাবার বায়না ধরা এবং দুর্গার প্রকাশ্যে তাঁকে স্তনের দুধ খাইয়ে
শান্ত করা ---এমন আরো বহু অলীক গল্পে ভরা। এতো গেল ভেতর থেকে
‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’ চাপের কথা।
কিন্তু বাইরে থেকে যে চাপ ছিল, সেটি আরো ভীষণ এবং আরো
লজ্জার। হরিচাঁদের জীবিতাবস্থাতে বইটি ছাপার মুখ দেখেনি। তিনি মারা যান ১৯১৪তে।
১৯১৬তে বইটি ছাপান তাঁর কবিয়াল শিষ্য হরিবর সরকার। সম্প্রতি ২০১০এ ডা:
মণীন্দ্রনাথ
বিশ্বাস ‘হরি-গুরুচাঁদ চেতনামঞ্চের উদ্যোগে’ ‘হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত’ নামে একটি বই লিখে
বের করেছেন। সেখানে জানা যাচ্ছে,
‘শ্রীশ্রী
হরিলীলামৃত’প্রকাশে গুরুচাঁদেরও আপত্তি ছিল, ছেলে শশীভূষণ ঠাকুরের
চাপে সম্মতি দেন। “গুরুচাঁদ সম্মুখেতে আনা হলপুঁথি ।/শশীবাবু প্রতি পাতা দেখে পাতি
পাতি ।।/গুরুচাঁদে পড়ে পড়ে শুনাল এ গ্রন্থ ।/গ্রন্থের বন্দনা থেকে একেবারে অন্ত
।।/পড়া শুনে গুরুচাঁদ ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস ।/কিছু কিছু ভাব তত্ত্বে হইল হতাশ ।।...
লেখা যায় যাহা ইচ্ছা সাদা কাগজেতে ।/কালি লেখা কাগজেতে লেখে কিবা মতে ।।/সেই মত
ভুল তত্ত্ব শেখে যদি জাতি ।/কোনদিনও কাটিবে না এ আঁধার রাতি ।।/ঠিক তত্ত্ব বুঝানো
তো হবে বড় দায় ।/আমি সারা হই ভেবে সেই আশঙ্কায়।।” বইটিতে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের
‘মতুয়া’ তত্ত্ব ছিল না তা নয়, কিন্তু আদিঅন্ত ‘বৈদিক অলীক গল্পে’র মিশেল রয়েছে।
তার উপর সমস্যা হলো তখন অব্দি যদিও ‘নমশূদ্র সুরিৎ’ এর মতো বহু সাময়িক কাগজ
বেরুচ্ছে নানা কেন্দ্র থেকে, তারকচন্দ্রের মতো সম্মানিত কবি ছিলেন না সমাজে ।
সুতরাং ভবিষ্যত লেখকেরা এর থেকে সত্যিকার কাঠামো একটা দাঁড় করিয়ে দেবেন এই আশাতে
গুরুচাঁদ সম্মতি দিয়ে দেন। বাপ-ছেলেতে কথা হয় এরকমঃ “শশী বলে গ্রন্থে বাবা ধোঁয়া
যদি রয় ।/গুরুচাঁদ বলে অগ্নি খুঁজিবে নিশ্চয় ।।/শশী বলে থাকে থাক কিছু জল অংশ
।/গুরুচাঁদ বলে ছেঁকে খাবে রাজহংস।।” ৪ বইটির প্রকাশিকা অনিতা বিশ্বাস তারক চন্দ্রের প্রতি
যথেষ্ট শ্রদ্ধা নিয়েই লিখছেন, প্রবল দারিদ্র্যে তাঁর শৈশব কেটেছে। কবিয়াল পরিবারে
জন্মেছেন। বৈদিক পরম্পরার কথিকা পাঠ আর গান করেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। তার উপর
নবদ্বীপের বৈষ্ণবদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল। হরিচাঁদের সঙ্গে পরিচয়ের পরেই
তাঁর মধ্যে যে বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব শুরু হয় তার ছাপ রয়েছে বইটির পাতায় পাতায়। এই
দ্বন্দ্বের জন্যেই বইটি লিখতে তাঁর এতো দ্বিধা ছিল। কিন্তু মূল পাণ্ডুলিপির উপরে
কলম চালাতে হয়েছিল সম্পাদক হরিবর সরকারকেও। শ্রীগোপাল বলে এক ভক্ত টাকার যোগান
ধরলে হরিবর সরকার কলকাতার প্রেসে প্রেসে ঘোরেন বইটি ছাপাবার জন্যে। কেউই রাজি হয়
না। অনেকে এর ‘বেদ-ব্রাহ্মণ সম্মত’ সংস্কার করে আনতে পরামর্শ দেন। “কোলকাতা প্রতি
প্রেসে করে অনুরোধ ।/সর্বস্থানে পান তিনি সম প্রতিরোধ ।।/প্রচারে বৈদিক শাস্ত্র
ছিল যে সমিতি ।/বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা সপ্তসতী স্মৃতি ।।/ইহাদের ছাড়পত্র আগে প্রয়োজন
।/তবেই করিবে প্রেস এ গ্রন্থ মুদ্রণ ।।” সমিতিটির নাম লেখেননি ডাঃ মনীন্দ্রনাথ
বিশ্বাস । কিন্তু তাঁরা অনুমতি দেন নি, “...নিষেধাজ্ঞা জারি করে গ্রন্থ ছাপিবারে
।।/চিহ্নিত করিল গ্রন্থে বহু জায়গার ।/বলে আগে এই সকলি কর সংস্কার ।।/বৌদ্ধতত্ত্ব
বুদ্ধকথা না থাকে পুঁথিতে ।/অবৈদিক ভাবধারা হইবে মুছিতে ।।” বিবেকানন্দ বলছিলেন,
শূদ্রদের সংস্কৃত অধ্যয়নে মানা করেছে কে!৫
তাঁর মৃত্যুর
পরেও ‘নবজাগৃত’ মহানগর কলকাতার ছাপাখানাগুলোর বাস্তবে ছিল এমনি অবস্থান। বিপাকে
পড়ে হরিবর গেলেন শ্রীগোপালের সঙ্গে শলা করতে। আম ছাড়া আমসত্ব কী করে তৈরি করবেন
তিনি ? শ্রীগোপাল টাকা দিতে পারেন, কিন্তু তাঁরও অবদমিত সামাজিক অবস্থান বোঝা যায়,
এই উক্তিতে, “পড়িয়াছি হেন ফাঁদে উপায় তো নাই ।।/কিছু কিছু জায়গায় কর সংস্কার
।/দৃষ্টিমাত্রে দৃষ্ট হয় হেন দরকার ।।/স্থুলের ভাবভঙ্গি রাখিও বৈদিক ।/সূক্ষ্মভাবে
ঠিক রেখো অবৈদিক দিক ।।/ভাবীকালে সত্য ঠিক খুঁজিবে পাঠক ।/জাতি মাঝে জন্ম লবে
তাত্ত্বিক রচক ।।” ৬ সুতরাং যা দাঁড়ালো, “...লীলামৃতে বহুস্থান সংস্কার
করে।।/অলীকের গল্প যাহা গ্রন্থে দেখা দিল ।/পরিস্থিতি চাপে সব প্রক্ষিপ্ত হইল।।” এতো সব করবার পরেও যে প্রেস এক বইটি
ছেপেছিল তার ম্যানেজার তাঁদের থেকে কুড়ি টাকা ঘুস নিয়েছিল।
সত্যি সত্যি শ্রীগোপাল এই সূক্ষ্মভাবে ‘অবৈদিক দিক’ ঠিক
রাখার কথাগুলোই বলেছিলেন কিনা, আজ আর আমাদের জানবার উপায় নেই। কিন্তু একুশ শতকে
এসেও যখন একজন নবীন ‘তাত্ত্বিক রচকে’র কলমে এই কথাগুলো পড়ি, তখন মনেতো হয়ই আমাদের
‘অন্ধকার মধ্যযুগে’র বিরুদ্ধে যত ধিক্কার , ‘আলোকিত আধুনিকতা’ নিয়ে যত বড়াই কিম্বা
তাত্ত্বিক কচকচানি সবই আসলে পশ্চিমা আদলে নিজেদের স্বার্থে নির্মিত এক কৃত্রিম
আখ্যান। যে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রয়োজন হাজার বছর আগেকার বৌদ্ধ কবিদের চর্যাপদের
ভাষাকে ‘সান্ধ্যভাষা’ করে ফেলতে বাধ্য করেছিল, তার থেকে স্থানে এবং কালে খুব বেশি
একটা এগোইনি আমরা। বাংলার তথা ভারতের ‘নবজাগরণে’র দর্প আমাদের মানায় না। এখনো 'অনেক পথ আমাদের হেঁটে যাওয়া বাকি।
আমাদের ইতিহাসের আলো -আধারির খেলাটাই অন্য । পশ্চিমা 'নবজাগরণে'র কাঠামোতে এর বেশিটাই আসলে বোঝা যায়
না।
গ্রন্থসূত্রঃ
১) সুকুমার সেন;
বাঙালা
সাহিত্যের ইতিহাস-১ম খণ্ড; আনন্দ সংস্করণ,
ডিসেম্বর,
১৯৯৩;
পৃঃ ৩২১ ।
২) দুলাল
কৃষ্ণ বিশ্বাস; ‘শ্রী শ্রী হরিলীলামৃত’ এক ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক প্রয়াসঃ প্রসঙ্গ
হরিচাঁদ ঠাকুরের নিষেধাজ্ঞা।;চেতনা লহর, এপ্রিল-ডিসেম্বর, ২০১৩; সম্পাদকঃঅনন্ত
আচার্য; কলকাতা; পৃঃ ৮৯ ।
৩) ঐ; ১০৮।
৪) হরিচাঁদ
তত্ত্বামৃত;ডা: মণীন্দ্রনাথ বিশ্বাস; পৃঃ ২৪০-৪১; http://mulnivasijagoron.wordpress.com/book-0001/
৫)The
Future Of India; ; Lectures from Colombo to Almora; Complete-Works ;
৬) হরিচাঁদ
তত্ত্বামৃত;ডা: মণীন্দ্রনাথ বিশ্বাস ; পৃঃ ২৪২-৪৫;
http://mulnivasijagoron.wordpress.com/book-0001/
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন