“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

‘আততায়ী খুঁজে খুঁজে আমাদের বর্শার ফলক কেবলি নিজের দিকে ফিরে আসে...’



।। সপ্তর্ষি বিশ্বাস।।


              গত দুই দিন রাতের সমস্ত কাজ, সমস্ত ব্যস্ততার আবডালে ভাবছিলাম ক্রোধের কথা। ভাবছিলাম, বিশেষতঃ, এই ‘বদন বই’ এর পাতায় উঠে আসা ক্রোধের আঁচ গুলোর কথা। ভাবছিলাম ঠিক কী কারণে কিছু মানুষ, যাদের আপাতঃ ভাবে কোনো স্বার্থের সংঘাত নেই, এমনি কি অনেক ক্ষেত্রেই মুখোমুখি পরিচয়টুকুও নেই – কি অবলীলায় তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে পরস্পরের উপর। ঐ ঝাঁপিয়ে পড়া যদি হতো একটি আদর্শের হয়ে অন্য একটি আদর্শের সঙ্গে লড়াই সে হতো, অর্থবহ, অবশ্যই। কিন্তু এসমস্ত তো নেহাৎ ব্যক্তিগত আক্রোশের হানাহানি, হাহাকার। হ্যাঁ, আমিও নিজেও ঐভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, পড়ি। হয়তো আবারো পড়বো। - কিন্তু কেন?
          কলকাতায় থাকাকালীন একদিন শিয়ালদা স্টেশানে গেছি। হঠাৎই এক মহিলা আরেক মহিলার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। ঐ মহিলা না’কি ইচ্ছেকরে তাঁর পা মাড়িয়ে চলে গিয়েছেন। আরম্ভ হলো বচসা। বিরাট সে বচসা। যাইহোক প্ল্যাট্‌ফর্মে গাড়ি এসে যাওয়ায় বচসার সমাপ্তি হলোনা। যে মহিলা বচসাটির সূত্রপাত ঘটিয়ে ছিলেন আপাতঃ বিজয়ী হয়ে তিনি ট্রেইনে উঠলেন। ঘটনাচক্রে ঐ একই কামরায় উঠলাম আমিও। ছুটির দিনের বিকেলের গাড়ি। তাই ট্রেইন বাঘাযতীন পার হয়ে যাওয়ার পরে প্রায় খালি। ঐ কামড়ায় তিনজন যাত্রী তখন। আমি। ঐ মহিলা আর আরো কেউ একজন। মহিলাটি জানালার কাছে। আমি উল্টো দিকের সীটে। মহিলাটির বচসাপ্রতিভায় আমি বেশ বিরক্তই ছিলাম তাঁর উপর। মাঝে মাঝে আড় চোখে দেখছিলাম আর ভাবছিলামঃ ‘বাব্বা, গলা একখানা দিয়েছিলেন বটে ...’ হঠাৎই টের পেলাম মহিলাটির চোখে জল। দেখলাম মহিলাটি জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে কাঁদছেন। জানিনা কতক্ষন...

ঐ ঝগড়াটে মুখটিকে তখন কি যে দুঃখী দেখাচ্ছিল ...

                 কথাটা আজ আবার ফিরে মনে এলো। আসলে সবাই দুঃখী। যারাই ঐভাবে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা সবাই দুঃখী। ঐ মহিলার দুঃখ হয়তো অনেক সরল তাই ঐ দুঃখজনিত হতাশায় যা ঘাটালেন তিনি তা’ও অত্যন্ত সরল। অর্থাৎ ঐ মহিলা সরল। আরো হাজার মানুষ সরল। তাই তাদের দুঃখও বিয়ে না হওয়া, ছেলের অকাল মৃত্যু, অর্থাভাবে মা’র চিকিৎসা না হওয়ার মতো সরল। সত্য। কিন্তু আমরা মধ্যবিত্ত। তায় “শিরখিত” তায় আবার আমাদের অনেকের ধারণা আমরা ‘শিল্পী’, ‘ভাবুক’ , ‘দার্শনিক’ তাই আমাদের দুঃখগুলো আরো জটিল। আর তাই মূলতঃ অন্তঃশ্বাস শূন্য। আমি হয়তো ভাবছি ‘শাল্লা, এদ্দিন ধরে লিখছি নিদেনে একটা লিট্‌ল ম্যাগ্‌ যদি একটা পুরস্কার দিতো’, ক’ ভাবছেন ‘অমুক স্যার ছিলেন বলে পুরস্কার একটা পেলাম বটে, তবে পাত্তা পেলাম কই? পাত্তা ত পেলো ঐ ব্যাটা খ’। এদিকে ক’এর প্রতি ঈর্ষায় গ’ কাতর। ‘সিনেমা’ত বাবা আমিও তুলেছিলাম, কিন্তু...’  ... কাজেই যখনি আমি, তুমি, সে, ক, খ,গ মুখোমুখি হচ্ছি আমাদের সব্বারই ভয় হচ্ছে অন্যে না দেখে ফেলে আমাদের দুঃখিত মুখ। টের পেয়ে যায় আমাদের গোপন বাসনার কথা। সুতরাং ‘আ-আ-ক্র-ম-ণ-...’ আর ঐ ‘আক্রমণ’ এর আমোদে আততায়ী আর আহত দুই পক্ষই ভুলে যাচ্ছি, যে, ঐ মুহূর্তেই আমরা আসলে সবচেয়ে বেশী দুঃখী। ঐ মুহূর্তেই যাকে আমি ভাবছি ক্রোধী, অহংকারী সে সবচেয়ে বেশী দুঃখভারবাহী। অপরপক্ষে আমি নিজেও ঐ মুহুর্তে সবচেয়ে বেশী দুঃখভারবাহী – যদিও ভাবছি ‘আমি যোদ্ধা...’ কেননা  ‘আমি দুঃখী’ বলার মতো গর্ব আমাদের নেই। স্পর্ধা আমাদের নেই। তাই...।

    মনে এলো মলয় কান্তি দে’র সেই অবিস্মরণীয় অনুভুতিঃ ‘আততায়ী খুঁজে খুঁজে আমাদের বর্শার ফলক কেবলি নিজের দিকে ফিরে আসে...’

কিন্তু ঐ ক্ষত নিয়ে কীভাবে বসবাস? অপরের সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গেই কী করে বোঝাপড়া? কার কাছে হাত পাতা মীমাংসা চেয়ে? শান্তি চেয়ে? – না, কোনো সহজ ঈশ্বরের কাছে নত হয়ে আব্দার জানানোর দিন গেছে (জানিনা, আবার আসবেও বা ফিরে, হয়তো... হয়তোবা আসবেও না ...) ... কিন্তু নিজের কাছে নত হতে ক্ষতি কি?

জানিনা নিজে কোনো দিন পারবো কি’না তবু মনে হলো এ একটা পথ। কথাগুলো লিখিত হলো এইভাবেঃ

এসো ঘরে ফিরি
ঝরে যাওয়া ইচ্ছা গুলি
মরে যাওয়া পাতাহেন
দুপায়ে মাড়িয়ে
এসো ঘরে ফিরি
গন্‌গনে মুখগুলি
দিবাদাহে যখন অঙ্গার
‘জন্ম’শব্দ অন্তর্গত বিভ্রমের বশে
শাণিত ক্রোধের মতো
অহংকারী মনেহয় তাকে –
অথচ সে অন্তরালে
সেইমাত্র অতলান্ত দুঃখভারবাহী
এসো ঘরে ফিরি আজ
হারানো বন্ধুর মতো
চুপে তার কাঁধে হাত রেখে –
তোমার সমূহ ক্ষত মুছেদেবে বলে
সে’ও ত ঘরেই আছে
অপেক্ষায়, ভোরবেলা থেকে ...

কোন মন্তব্য নেই: