(প্রতিবেদকঃসুশান্ত কর)
২০০৯এ ডিগবয়ের কয়েক দশকের
পুরোনো নাট্যসংস্থা ‘বলাকা’ যখন প্রথম উত্তরপূর্বাঞ্চল ভারত বাংলা কবিতা
প্রতিযোগিতার আয়োজন করে তখন বাৎসরিক রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীতে অভ্যস্ত আমাদের
বহু আবৃত্তি শিল্পীরা বেশ মুস্কিলে পড়েছিলেন। তিনসুকিয়া শহরের জনা কয় শিল্পী আমার
কাছে এসছিলেন ‘বলাকা’র তালিকায় থাকা রবীন্দ্রোত্তর কবিদের কবিতার সন্ধানে। তেমনি
একজন যখন জীবনানন্দের কবিতা চাইলেন। প্রথমেই আমার মনে পড়ল ‘বনলতা সেন’এর কথা। জয় গোস্বামীর চাইলেন, আমার মনে পড়ল ‘ মালতিবালা
বালিকা বিদ্যালয়’এর কথা। পড়ালাম। আমাকে বললেন, এটা না এটা না। এগুলো ভালো নয়। আপনি
ভালো দেখে কিছু দিন।
|
প্রথম হয়েছেন
তিনসুকিয়ার পৌষালি ঘোষ |
বুঝতেই পারছেন, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জন্মজয়ন্তীতে পুরস্কার পেতে
গেলে যে গুলো মুখস্থ না করলেই নয়, আমাদের শিল্পীদের এর বেশি বড় একটা বাংলা কবিতা
চর্চা ছিল না এই সেদিন অব্দি। এটা তাদের ব্যক্তিগত অজ্ঞতার দায় নয়। আমাদের পরিবেশ কত প্রতিকূল ভেতরে বাইরে তারই একটা ধারণা দেয়। সেখানে তিনবারের মতো একটু অন্যরকম ধাঁচে বাংলা কবিতা
আবৃত্তির আয়োজন করে বলাকা যে গোটা অসমেই এক নজির রেখেছে এবং বাংলা কবিতা এবং বাচিক
শিল্প চর্চাতে এক নতুন উৎসাহের বাতাবরণ গড়ে তুলছে এই নিয়ে আজ আর কোন বিতর্ক থাকা
উচিত নয়। যদিও শুরুর বছরেই তিনসুকিয়ার এক পরাজিত প্রতিযোগী কাগজে চিঠি লিখে তাঁর ঈর্ষার বহর দেখিয়েছিলেন। বৃহত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়ের কথাটি তাঁর মনে ছিল না। সেই থেকে অসমের কোন বিচারক না রাখার 'বলাকা'ও এক অস্বাস্থ্যকর প্রবণতা দেখিয়ে আসছেন। যেটিকে অনেকেই সুনজরে নিচ্ছেন না।
|
দ্বিতীয় শিলচরের অপর্ণা নাথ |
২০০৯এর পরে, ২০১১ এবং এবারে ৭,
৮ এবং ৯ডিসেম্বর , ১৩ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ডিগবয় ইণ্ডিয়া ক্লাব প্রেক্ষাগৃহে।
গেলবার এই উদ্যোগে যোগ দিয়েছিল তিনসুকিয়ার উজান সাহিত্য গোষ্ঠী। সেপ্টেম্বরের শেষে
সফল ভাবে আয়োজন করেছিল ‘উজান অসম বাংলা কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা’ । বলাকার
আয়োজনও এদ্দিন মূলত উজান অসমেই সীমাবদ্ধ ছিল। এবারে শিলচর গুয়াহাটি থেকে প্রতিযোগী
এসে একে এক সারা অসম চরিত্র প্রদান করেন। প্রথম বার প্রায় ৮০ জন, দ্বিতীয়বার
৫৫জনের বিপরীতে এবারে ৩৩জন প্রতিযোগীর উপস্থিতি আয়োজকদের সামান্য হতাশ করলেও, মনে
হয় অনেক সময় দিন ক্ষনের নির্বাচনও উপস্থিতির হারের উপরে প্রভাব ফেলে। গেলবার উজান
আয়োজিত প্রতিযোগিতাকে বেশ সফল মনে করা হয়েছিল। এবং সেখানেও প্রতিযোগীর সংখ্যা ৮০র
ঘরেই ছিলেন। কিন্তু দুটো বিভাগে বিভক্ত ছিল। পঞ্চম শ্রেণি অব্দি ছোটদেরো
অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। বলাকার আয়োজনে তাঁরাই শুধু যোগ দিতে পেরেছিলান, যাদের বয়স
১৫ পার করেছে।
|
দৃষ্টিনন্দন
স্মরণিকা |
তিনপর্বে
ভাগ করা হয়েছিল প্রতিযোগিতা। প্রতি পর্বের
বিজয়ীরাই শুধু পরের পর্বে অংশ নিয়ে পেরেছিলেন। যাদের কবিতা আবৃত্তি করতে হয়েছিল, তাঁরা
হলেন, প্রথম পর্বেঃরবীন্দ্র নাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, নজরুল,জীবনানন্দ, সুকান্ত, সুভাষ,
অচিন্ত্যকুমার, সুকুমার, এবং অন্নদা শংকর । দ্বিতীয়
পর্বেঃ শক্তি, জয়, নীরেন্দ্রনাথ,
সুবোধ, কৃষ্ণা বসু, মল্লিকা সেনগুপ্ত, রামচন্দ্র পাল, শামসুর রহমান, অমিতাভ দাসগুপ্ত এবং সব্যসাচী
দেব। তৃতীয় পর্বে প্রথম ভাগেঃ
পূর্বোত্তরের কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, অনিল
সরকার, অমলেন্দু গুহ, ঊর্ধ্বেন্দু
দাস, রণজিৎ দাস, সঞ্জয় চক্রবর্তী,
বিমলেন্দু চক্রবর্তী, এবং অমিতাভ দেব
চৌধুরী তৃতীয় পর্বে শেষ ভাগে শুধুই সুনীল গাঙুলী। বিচারক হয়ে এসছিলেন, পার্থ
ঘোষ, গৌরী ঘোষ এবং রোকেয়া রায়। ৯ ডিসেম্বর, শেষ দিনে আলাদা করে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলাকার শিল্পীদের সঙ্গে এই তিন সুপরিচিত বাচিক শিল্পীদের অনুষ্ঠান।
|
তৃতীয় ডিব্রুগড়ের মালবিকা
দত্ত |
প্রথম বারের আয়োজন থেকেই গুটি কয় পূর্বোত্তরের কবিদের কবিতা আবৃত্তির জন্যে থাকলেও সেগুলো আবৃত্তি করবার কোন
বাধ্যবাধকতা না থাকাতে প্রতিযোগীদের এড়িয়ে যেতেই দেখা গেছে। এই অবস্থাটি পাল্টায়
গেলবার ‘উজানে’র আয়োজনে। ২য় পর্বে পূর্বোত্তরের কবিদের কবিতা আবৃত্তি বাধ্যতামূলক
ছিল এবং পরিণাম ছিল অসাধারণ উৎসাহ ব্যঞ্জক। প্রায় সমস্ত কবিদের সঙ্গে বাচিক
শিল্পীদের প্রথম পরিচয় ঘটল বললেও অত্যুক্তি হয় না। বলাকাও এবারে চূড়ান্ত পর্বে তাই করেছিল।
পর্বটিকে দুই ভাগে ভাগ করেছিল। এবং বিজয়ী দশজন প্রতিযোগীকেই দশটি কবিতা আবৃত্তি
করতে হয়েছিল। বাকি বিশ্বের কাছে এগুলো স্বল্প পরিচিত কবিতা বলে, আমরা সেগুলো এখানে
ইউ ট্যুবে তোলে দিয়েছি। আপনারা সবগুলোই শুনতে পাবেন।
বিজয়ীদের মধ্যে প্রথম (প্রয়াত ধীরেন্দ্র চন্দ্র আইচ এবং
প্রয়াত লতিকা আইচএর স্মৃতিতে)হয়েছেন
তিনসুকিয়ার পৌষালি ঘোষ, দ্বিতীয় ( প্রয়াত নন্দ গোপাল ভট্টাচার্যের স্মৃতিতে) শিলচরের অপর্ণা নাথ, তৃতীয় ডিব্রুগড়ের মালবিকা
দত্ত, চতুর্থ ডিগবয়ের সুপ্রতীম পুরকায়স্থ, যিনি গেল বারের ‘উজানে’র প্রতিযোগিতাতে
প্রথম পুরস্কার বিজয়ী ছিলেন। পঞ্চম পুরস্কার মেলে যুগ্মভাবে দু’জনের । দু’জনেই
ডিগবয়ের শিল্পী, উমা ভাওয়াল এবং রূপজ্যোতি মিশ্র। প্রথম তিনটি পুরস্কারের
অর্থমূল্য ছিল যথাক্রমে ১০, ৫ এবং ৩হাজার টাকা, একটি সম্মান ফলক এবং প্রমাণ পত্র। শেষ
তিনটিই ছিল প্রয়াত পবিত্র মোহন দেব স্মৃতি পুরস্কার।
(ছবিগুলো এখানে দেখতে পাবেন একত্রে)
অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটি রুচি সম্পন্ন, দৃষ্টিনন্দন
স্মরণিকা ‘স্বর ও শ্রুতি’ প্রকাশিত হয় অজিত করের সম্পাদনাতে। সহ সম্পাদকদ্বয় হলেন
বিদ্যুৎ রক্ষিত এবং পার্থসারথি দত্ত। এটি স্বর ও শ্রুতির ২য় সংখ্যা। দ্বিতীয়বারের
আয়োজনে কোন স্মরণিকা বেরোয় নি। ডিগবয় তথা উজান অসমের সাহিত্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের
ইতিবৃত্ত জানতে স্মরণিকাটি আকর গ্রন্থের কাজ করবে বলে নির্দ্বিধাতেই বলে দেয়া যায়।
(পূর্বোত্তরের দশটি কবিতার আবৃত্তি শুনতে পাবেন এখানে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন