“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৩

বিদিত কাকু / সুদীপ নাথ

(C)ছবি
 সুদীপ নাথ

খেলার শিবিরে সন্ধ্যাবেলা সবাই যখন খেতে বসেছিল, বান্টি তখন বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছিল । বাড়ির কাছেই জেলা ভিত্তিক খেলার শিবির শুরু হয়েছে গরমের ছুটিতে আজই। বান্টি শিবিরে যোগ দিতেই এসেছিল।
        সে চলে যাচ্ছিলো তাড়াহুড়ো করে, পেছন দিকে না তাকিয়ে। কেমন যেন ভয় ভয় করছিল তার, তাকে না আবার ফিরতে বাধ্য করা হয় । শিবিরের সীমানা ছাড়ার পরই মাত্র, বান্টি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছে।
      সুদীর্ঘ দেবদারু, বুড়ো বটগাছ আর সরু সরু সুপুরি গাছগুলো যেন তীব্র নিন্দার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো তার দিকে।
       বান্টি কিন্তু একাই বাড়ি আসছিলো না,  মা মমতাও তার সঙ্গেই ছিল। মমতা থেমে থেমেই বান্টিকে বোঝাচ্ছিলো আর বলছিলো-
-- দ্যাখ্‌ , খেলার শিবির এক সমুদ্র, তুই ছেড়ে চলে যাচ্ছিস, পরে তো তোর নিজেরই আফসোস হবে, পস্তাবি কিন্তু, চল আবার।  মমতা বিষণ্ণ মনে কথাগুলো বলে চলে।
-- না, মামণি,  আমি বাড়িই যাব। আমি বাড়িতেই থাকবো, তোমার সঙ্গে আর বাবার সঙ্গে।  মাকে মিনতি করে বান্টি।
--ঠিক আছে, ঠিক আছে। এক কথা বার বার বলতে হবেনা তোর। ক্লান্ত হয়ে মা বললেন, চল, আমরা বাড়িতেই তো যাচ্ছি ।
       চারদিকে পাখির কলকাকলি। কিন্তু, বান্টির কানে তা ঢুকছিল না । তার চোখ চারপাশের সৌন্দর্য এড়িয়ে চলছিল। সে মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করেই হাঁটছিল চোখের জল মুছতে মুছতে। ক্বচিৎ থামছিলও।
      --মা-মণি, আমি এখন কত সুখী! ওখানে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। ওখানে থাকলে আমার খুবই মন খারাপ হোত। তুমি আমাকে একটুকুও বুঝতে  পারছো না। মায়ের দিকে না তাকিয়েই চলছিলো  বান্টি।
মমতা ধীরে মাথা নাড়ে। বান্টি যদি তার মনের ভিতর একটুও উঁকি দিতে পারতো, তবে বান্টি দেখতে পেতো যে, সে নিজের ছেলের সঙ্গে নিজেই কেঁদে ফেলতে প্রস্তুত।  আরও আধ ঘণ্টা পর ওরা বাড়ি ফিরবে, তখন বান্টির বাবা শৌণ্ডিরের সঙ্গে দেখা হবে। বান্টির এই অপ্রত্যাশিত  খেলার জীবনের পরিসমাপ্তি দেখে, বান্টির বাবা কী ভাববে ?
         মমতা যেন শৌণ্ডিরের কন্ঠ শুনতে পাচ্ছে -  ‘এই হচ্ছে তোমার শিক্ষার ফল ! ছেলে নয়, যেন মেয়ে মানুষ করছ। এসব হচ্ছেটা কি ? যেন ও এখনও দুধের শিশু। ওকে বাড়িতে নিয়ে আসার দরকারটা কী ছিল ? আর তুমিই বা কেন ক্যাম্পে গিয়েছিলে শুনি ? ওর কিছুই হত না । দুয়েক দিন কেঁদে কেঁদে ঠিক হয়ে যেতো । পুরুষ মানুষকে আরো কত কিছুতেই অভ্যস্ত হতে হয়। তুমি তো দেখছি ওকে ন্যাকা বানিয়েই ছাড়বে।’বাড়ি ফিরলে আবারো তাদের মধ্যে সেই একই কথাবার্তা শুরু হবেঃ- মমতা ছেলেকে লাই দেয়। তার সমস্ত দোষ ক্ষমা করে দেয়, নিজের আদর আর করুণা দিয়ে বান্টিকে কেবল দুর্বলই করে তুলছে মমতা। সেজন্যেই নাকি বান্টির চরিত্রটাও পুরুষের মত হচ্ছেনা।
           মমতা ভেবেই চলে। অনেকেই তো বলে, বাবাকে কড়া হতেই হবে। অপরাধ করলে বাবা কিশোর ছেলেকে শাস্তি দেবেন, নয়ত ছেলের মধ্যে দায়িত্বহীনতা বাসা বাঁধবে। কিন্তু অনুশোচনা ছাড়া কেবল শাস্তিতে কোনও কাজ হয়না। শিশু যদি দোষ না বুঝে ও তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে না চায়, তাহলে শাস্তি তাকে কিছুই শেখাবে না বরং তাকে আরও চটিয়ে তুলবে। শৌণ্ডির যদি স্বৈরাচারী হতো, খুব বেশি কঠোর হতো, যারা নিজেকে ছাড়া আর কাউকে গ্রাহ্য করেনা, তাহলে সমস্ত বিষয়গুলো সঙ্গে সঙ্গেই স্পস্ট হয়ে যেতো মমতার কাছে। কিন্তু ও তো মনেপ্রাণেই বান্টির মঙ্গল কামনা করে সবসময়। সেও চায় বান্টি মানুষের মতো মানুষ হোক, পুরুষের মতো পুরুষ হয়ে উঠুক। আর তাই মমতা এখন দুশ্চিন্তায় ভোগছে। শৌণ্ডিরের কথায় সবসময়ই যে সত্যতা রয়েছে তা মমতা লক্ষ্য করেছে।
          এখন মমতার মনে পড়ছে, সেই অন্তহীন পারিবারিক সংঘর্ষগুলোর কথা, যা দেখা দিতো বান্টির জীবনের যেকোনও প্রশ্নকে ঘিরে। সংঘর্ষগুলো সাধারনত বাঁধতো খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েই! ‘শীতের সন্ধ্যায় বান্টি পা ধোচ্ছে - শৌণ্ডির চাইছে বান্টি যেন অবশ্যই ঠান্ডা জল দিয়ে পা ধোয়, কারণ একজন পুরুষকে তো ছোটবেলা থেকেই মজবুত হয়ে উঠতে হবে। কিন্তু মমতা ঠিক উল্টোটা চিন্তা করেঃ- ‘কি করে ছেলেটাকে এই ঠান্ডায় বরফের মত ঠান্ডা জলে পা ধুতে দেয়া যায়, যেখানে বান্টি এমনিতেই বছরে চার পাঁচ বার স্বর্দি জ্বরে ভোগে। বান্টি যখন স্কুলে যাওয়ার জন্যে তৈরী হয়, তখন মমতা ছোটে তাকে সাহায্য করতে’, কিন্তু শৌণ্ডির তাকে থামিয়ে দেয় আর বলে, ‘কতদিন আর ওকে এভাবে সাহায্য করবে? ‘আর আহ্লাদের কাজ নেই; বয়েস তো দশ বছর পার হয়েই গেলো, ও এখন নিজেই নিজের কাজগুলো করুক, ওকেই ওর সব করতে দাও, নিজের শার্ট পেন্ট নিজেই ইস্ত্রি করুক, কাপড়চোপড় জুতো মোজা টাই সব নিজেই পরুক’।
             বান্টি কী করে তার জামাকাপড়ই বা ধোবে আর ইস্ত্রিই বা কীভাবে করবে, ভেবেই পায়না মমতা। ওকে স্কুলেই বা কি করে একা পাঠাবে, এইসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে, আলো আবছায় নির্জন রাস্তায় হাঁটতে থাকে মমতা বান্টির এক হাত শক্ত মুঠোয় ধরে রেখে। বার বার শৌণ্ডিরের মুখটা ভেসে উঠে তার মনের আয়নায়।   
       মমতা চলতে চলতে ভাবছে, বান্টিকে স্কুলে পৌঁছে না দিয়ে এলে ও কী করে একা একা স্কুলে যাবে, বেচারা সারা দিন না খেয়েই কাটাবে, সব সময় পাশে না থাকলে ও কাপড়চোপড় নোংরা করে ফেলবে। ও তো একেবারেই ছোট, যেখানে বড়রাই সবসময় নিজেদের দেখভাল করতে পারেনা, সেখানে ...।
            নিত্যনৈমত্তিক ঝগড়ার আরও একটা বড় কারণ রয়েছে। বান্টি তার ঘরের দরজা রাতে খোলা রেখে শুতে চায়। তাতে তার সহজে ঘুম আসে, সে বড়দের গলার চাপা আওয়াজ শুনতে পায় এবং নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে। আর শৌণ্ডির বলে, এ নাকি বিলাসিতা! ক্ষেপে গিয়ে বলে, ‘দরজা বন্ধ করে ঘুমা তো, তাহলে তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে’। আর মমতা ভাবে, বাবা তো দেখতে পাচ্ছেনা যে ছেলেটা কত একা, সে ঘুমানোর সময়ও মা বাবার সঙ্গ চায়। এতে খারাপের কি আছে? এইসব তুচ্ছ ব্যাপারেও কেন যে ছেলেটিকে সরাসরি না বলে দেয়া হয় !
            আর বান্টির প্রতি মায়ের স্নেহ নিয়ে কত কথাই না শুনা যায়। মা কাজ থেকে এলে বান্টি মমতার কাছে ছুটে যায়, মাকে চুমু দেয়, জড়িয়ে ধরে, কারণ মা সারাদিন কাছে ছিলনা বলে তার   মনে দুঃখ জমে আছে, মন কাঁদছে।
        কিংবা ও যখন পড়ছে, মা কাছে এসে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, পাশে বসে থাকে, আর বান্টি পড়া তৈরি করে। আর তখনই শৌণ্ডির এসে বলতে শুরু করেঃ ‘তুমি ওকে এতো আদর দিয়ে দিয়ে তো দেখছি একেবারে তুলোর মত নরম করে ফেলছ। পুরুষের এতো স্নেহ-মমতার  দরকার নেই ! ওর সঙ্গে কিন্তু তোমার রুক্ষতা, কঠোরতা আরো বাড়িয়ে তুলতে হবে, আরও আরও সংযমী হতেই হবে। নইলে ও মানুষ হবেনা বলে দিচ্ছি’ ।
           মমতা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা, ছেলেটিকে একটু বেশি আদর ও চুমু দিলে ক্ষতি কি ! মমতা মনে করে ছেলের সঙ্গে তো এরকম আচরণই দরকার। ওর গালে একটু চুমু দিলে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে, ও খুব খুশিই হয়। তখন আনন্দে বান্টির মনটা ভরে উঠে, ও শান্ত হয় আর মন দিয়ে কাজ করে।  তখন সব কাজই ভালো এগোয়। মমতা আরো ভাবে, এই শিশুটিকে কি করেই বা এইসব অতি সাধারণ আদর, মনোযোগ, আন্তরিকতা আর স্নেহমমতা থেকে বঞ্চিত করা যায়!
          তা সত্ত্বেও মায়ের মন বাধা আর কঠোরতা সইতে পারেনা। ছেলেটার জন্যেও কষ্ট হয়। একদিকে তার স্বামী শৌণ্ডির, আর অপরদিকে একমাত্র ছেলে বান্টি। দুজনের জন্যই মমতার দুচোখ বেয়ে নামে দুই অশ্রুধারা। মমতা এগিয়ে চলে।  
         ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বিদিত কাকুর কথাগুলো মমতার মনে পড়ে যায় । যাদের কাছে মমতা মনের সব কথা বলতে পারত, তাদের সবাই বলত, কি করে বলি, কে সঠিক ! কোনও সুহৃদই কোনও সমাধান দিতে পারছিল না। কেউ বলত শৌণ্ডির ঠিকই করছে, আবার কেউ বা বলত, মা তো এমন আদর দেবেই। এখানেই শেষ নয়, কত সব বিশ্রী কথা বলে বান্টির কোমল মনে আঘাত দিতো। অনেকেই বান্টিকে জিজ্ঞেস করত, ‘কি বান্টি, তোমাকে কে বেশি ভালবাসে, মা ? না বাবা’। বিদিত কাকুর সামনে কোনও একদিন এমন কথা তার সায়ন মামাকে বলতে দেখেছিলো মমতা, একটি ছোট্ট মেয়েকে। আর যায় কোথায়। বিদিত কাকু অমনি সায়ন মামাকে এক হাত নিলো। শিশু কেন, যেকোনো সন্তানের কাছেই মা  বাবা সমান। বিশেষত শিশুদের এই প্রশ্নটা করা শুধুমাত্র বোকামিই নয়, অত্যন্ত অন্যায়ও বটে। বিদিত কাকুর খপ্পর থেকে সায়ন মামা আর বেরোতে পারেনি। বিদিত কাকু শিশুদের প্রতি কোনও অন্যায় অবিচার সইতে পারেন না। আর এ নিয়ে সবসময় প্রখর নজরদারি জারি রাখেন। ওনার শিশু-মনোবিজ্ঞানে কোনও ডিগ্রি নেই সত্যি, কিন্তু অজস্র বইয়ে ঠাসাঠাসি ওনার বাড়ির লাইব্রেরিটা।  সায়ন মামাকে তার পর থেকেই, মমতা প্রায়ই দেখত, বিদিত কাকুর থেকে শিশু-মনোবিজ্ঞানের বই নিয়ে যেতে। বিদিত কাকু শিশু সাহিত্যের অনেক হাবিজাবি বই, শিশুদের পড়াতে বারণও করতে দেখেছে মমতা। কিন্তু অতশত বুঝতে পারতনা সে। মনে মনে ভাবতো, শিশুদের নিয়ে আবার অতশত চুলচেড়া ভাবার মত কি আছে !
               দ্বিধা দ্বন্দের দোলায় দুলতে দুলতে একদিন বিদিত কাকুর সাথে দেখাই করে ফেলেছিলো মমতা। তাদের মধ্যে অনেক কথাই হয়েছিল বান্টি আর শৌণ্ডিরকে নিয়ে আর নিজের কার্যকলাপ নিয়ে।  বিদিত কাকুকে সবই খুলে বলেছিল মমতা। ঘটনাটা সবার কাছে এমন দাঁড়িয়েছিলো – শৌণ্ডিরও ঠিক, মমতাও ঠিক; বাবাও ঠিক, মা’ও ঠিক ! ছেলের সঙ্গে সবসময় লোহার মত  শক্ত ও কঠোর হতে হবে , এই প্রশ্নে মমতা কিন্তু শৌণ্ডিরের সঙ্গে কিছুতেই একমত হতে পারেনি। অথচ ওদেরই পরিচিত কোন এক পরিবারে ছেলেকে ‘লৌহ’ পুরুষ করে তুলছেন তার বাবা । সে চমৎকার খেলোয়াড়, তার সাহসও প্রচুর । তার জীবনের গতি সুস্পষ্ট এবং পরিস্কার ।
          নিজের চিন্তাধারা, আর কার্যকলাপে সেই ছেলেটি অটল, দোদুল্যমানতা কী জিনিস তা সে জানেই না । কিন্তু ছেলেটির সঙ্গিসাথীরা বলে যে, ছেলেটি খুবই রুক্ষ । ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সে নিষ্ঠুর ব্যবহার করে  এবং কাউকেই সে গ্রাহ্য করেনা । এটাও মমতার পছন্দ হয়না । আবার খারাপ ভাবতেও কষ্ট হয়।
          কিন্তু এটাও সত্যি, বাপের প্রতি বান্টির যতটুকু না টান, তার থেকে অনেক বেশি ভয় । শৌণ্ডিরকে  বাঘের মতো ভয় করে বান্টি । এমনকি রাস্তায় চলার সময়, বাপের সঙ্গে আসন্ন সাক্ষাতের কথাটি ভাবতেই সে ভয়ে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে যায় । বাড়িতে ছেলে বড় হচ্ছে , বাপের প্রতি তার বেশি টান থাকবার কথা, সে এখন আর কচি শিশুটি নয়। মায়ের সামনে তার আর শৌণ্ডিরের পুরুষের সংহতি থাকা দরকার ।
              কিন্তু সব কিছুই যেন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে । সে এখন বাপের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে, বাবার সঙ্গে সে খোলাখুলি কথা বলতে পারেনা । কিন্তু মায়ের সঙ্গে আছে তার প্রকৃত , আন্তরিক এবং মৈত্রীপূর্ণ সংহতি । সে সর্বান্তঃকরণে মাকে ভালোবাসে, নিজের সমস্ত দুর্বলতা নিয়েও সে মায়ের কাছে এসে যখন তখন হাজির হয়। বিকাল বেলা মায়ের অপেক্ষায় বসে থাকে, কখন মা কাজ থেকে ফিরবে । মা বাড়ি ফিরলে বান্টি সমস্তকিছু মাকে খুলে বলে। কারণ সে জানে মা’র কাছে সহানুভূতি ও সমর্থন মিলবে।
             বিদিত কাকু বলে চলে মমতাকে। কেন আমরা এমনটি ভাববো যে করুণা মানুষকে অবনমিত করে। ঠিক উল্টোটাওতো ঘটে। করুণা মানুষকে রক্ষা করে, মানুষকে বাঁচতে সাহায্য করে । আর মানুষ করুণা দেখায়, করুণা তাকে মানবিক গুণে মহীয়ান করে তুলে। আর শিশুদের প্রতি করুণা, বিশেষত মায়ের করুণা, সম্ভবত পৃথিবীতে সবচেয়ে সঙ্গত বিষয়। যে সমস্ত পুরুষ নিজের স্ত্রীদের এই গুণটি দম্ভভরে উপেক্ষা করে, তাদের কোনও মতেই সমর্থন করা যায়না।   
             জীবনে এবং সাহিত্যে এমন অনেক ঘটনার নজীর রয়েছে, যেখানে সন্তানের প্রতি মায়ের ঠিক স্নেহপূর্ণ ও সোহাগভরা সম্পর্কে , মা এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে অপূর্ব ও পারস্পরিক সমঝোতাপূর্ণ সম্পর্কের মঙ্গল জনক ভিত্তি গড়ে দিয়েছে । উল্টো দিকে, বাপের অত্যধিক শুষ্কতা এবং কঠোরতা,  কেবল উদাসীনতা আর অনাত্মীয়তারই জন্ম দিয়েছে । কোমলতা আর দরদ, শিশুর মধ্যে এই বিশ্বাস জাগায় যে, সে প্রয়োজনীয় সহানুভূতি পাবে । নম্র এবং আন্তরীক সম্পর্ক তাকে মেলামেশা করতে এবং আস্থা পোষণ করতে উদ্বুদ্ধ করে । আর, চির-কঠোরতা শিশুকে ভীত করে ও দূরে সরিয়ে দেয় ।
      এমনটাও অবশ্য ঘটে যে, ছেলেমেয়েরা মিলেমিশে খেলার শিবিরে থাকতে পারেনা । তাদের কারো সাথে হয়তো বন্ধুত্ব হলনা, কারণ স্বভাবের দিক থেকে সে আত্মবদ্ধ, হৈ-হল্লা পছন্দ করেনা, দৈনন্দিন জীবনের কঠোর নিয়মে সে অভ্যস্ত নয়।
      তবে, মমতা বান্টির ব্যাপারে এখন যেমনটা বুঝতে পারলো, আসলে তা ছিল, সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। জীবনে প্রথম বারের মত ছেলেটিকে খেলার শিবিরে পাঠানো হয়েছিল। সে তাতে অভ্যস্ত ছিলোনা ।  সেকারণে সঙ্গে সঙ্গেই তার মন মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিলো আর নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করেছিলো। বান্টি একেবারেই নিরাশ হয়ে পড়েছিল।
     কিন্তু মমতার মন ভার হয়ে আছে । বান্টি প্রথম বারের মত অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গেই একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছে। সে শেষ পর্যন্ত বাধাবিপত্তি অনুভব করেনি, তা অতিক্রমও করতে পারেনি। মমতা বস্তুতপক্ষে সমস্যার বেঠিক সমাধানে ছেলেকে সমর্থন জুগিয়েছে। ছেলেকে শেষ অবধি ব্যাপারটি বুঝতে দেয়নি। এই সমস্ত কিছু মানুষের মনকে শক্ত করে না, দুর্বলই তিলে তিলে করে তুলে। 
     এতদিনে মা একটা কাজের কাজ অর্থাৎ সঠিক কাজ করলো। বিদিত কাকুর সঙ্গে দেখা করে। কারণ, কোনও ব্যাপার-সেপারই সঙ্কট জনক অর্থাৎ চরম অবস্থা অবধি টেনে নিয়ে যাওয়া উচিৎ নয়। মমতা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরছে যে, তার ছেলে কত সঙ্কট জনক অবস্থায় এসেছে।
     বিদিত কাকুর আলাপচারিতায় মমতা বুঝতে পারলো , এই প্রথম বুঝতে পারলো যে, মা এবং বাবা, মমতা এবং শৌণ্ডির, দুজনকেই তাদের ছেলের প্রতি তাদের আচরণ পাল্টাতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
     শৌণ্ডির তার রুক্ষতা, শুষ্কতা এবং কঠোরতা অনেকাংশে সীমিত করবে, মমতাও তার করুণা এবং অত্যধিক কোমলতা অনেকাংশে সীমিত করবে। বিদিত কাকু শৌণ্ডিরকে আর মমতাকে বিষয়ের গভীরতার সন্ধান দিলেন। দুজনেই দেখা করেছিলেন তাদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনে যায় দুজনে।
     বিদিত কাকু বলে চলে, প্রাচীন ভারতীয় প্রবচনে অকারণে বলা হয়নি- ‘পাঁচ বছর অবধি ছেলেকে রাজা ভাববে, পাঁচ থেকে পনের বছর অবধি তাকে গোলাম ভাববে, আর পনেরো-র পর থেকে তাকে বন্ধু ভাববে’।
     কিশোর আর বালক ছেলেদের সঙ্গে নিজের সমস্ত পারস্পরিক সম্পর্কগুলোতে যুক্তি মেনে চলা এবং অটল থাকা খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু সন্তানের উন্নত ভবিষ্যতের প্রত্যাশী প্রতিটি মা-বাবাকে কম-বেশি ত্যাগ স্বীকার করেই এই কঠিন কাজটি আয়ত্ত করতে হবে।

( শেষ )

কোন মন্তব্য নেই: