জ্যোৎস্নাময় দাসের আঁকা প্রচ্ছদ |
নীচে চিরকালের কৃষ্ণপক্ষঃ
“প্রকাণ্ড শহর। লাখ দু’লাখ
লোকের বাস। ভোর না হতেই লোকজনের হৈ চৈ, যান-বাহনের বিকট চিৎকারে আকাশ ছেয়ে যায়।
যতই বেলা বাড়ে ততই ভীড় এবং সেই সঙ্গে হৈ–হল্লাও সমান তালে বেড়ে চলে। শেষটায়
সন্ধ্যার মুখে এমন অবস্থা দাঁড়ায় মনে হয় এই বুঝি শহরটার নাভিশ্বাস উঠলো।কিন্তু এই
শহরেই একটি নীরব জায়গা আছে;এবং সেটি শহরের কেন্দ্রস্থলে। ইন্দিরা ওভারব্রীজের
তলা।” এই ভাবেই লেখা শুরু হয়েছে উপন্যাস 'ইন্দিরা ওভারব্রীজ'। শহরের সেই নীরব
জায়গাটির ভাষা নির্মাণের চেষ্টা করে করেছেন-- লেখক । কোন সে শহর? না নেই। লেখা
আছে, “রাজহাট থেকে তিনসুকিয়া পর্যন্ত যে রেললাইনটি গিয়েছে, সেটি এই শহরকে দু’ফালি
করে দিয়ে গেছে। উত্তরে ও দক্ষিণে।” উজান অসমের পুরোনো রেলশহর তিনসুকিয়ার কথাটা
আমরা সবাই জানি, রাজহাট মনে হয় পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলার গঞ্জটির কথা বলা হচ্ছে।
এই নামে কোন রেলস্টেশন এখন নেই। রাজহাটের খুব কাছের স্টেশন ব্যাণ্ডেল। সুতরাং মনে হয় এর কথাই লিখতে চাইছিলেন। কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে উপন্যাসে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকারই কোন এক শহরের কথা
হচ্ছে। এখানকার প্রায় সমস্ত শহরকেই রেল লাইন ভাগ করে গেছে উত্তরে দক্ষিণে। এই শহরে উত্তরে দক্ষিণে মানুষের যাতায়াত লেগেই
থাকে। কাছের “লেভেলক্রশিং-এর গেটম্যানরা লাল নিশানের মাহাত্ম্যে জনসাধারণকে আটকে”
রাখত যখন রেল আসত। তারপরেও দুর্ঘটনা ঘটত এখানে। “ এই কর্মচাঞ্চল্যের যুগে মানুষ
সময়কে জীবনের সঙ্গে এমন ভাবে একাকার করে দিয়েছে যে সময়ের অপব্যয় জীবনের অপব্যয়ের
সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই জীবন বিপন্ন করেও সময়ের ফাঁকগুলোকে ভরে দিতে মানুষ
দ্বিধা বোধ করে না।” শেষে সরকারের টনক নড়ল যখন
দু’জন গেটম্যানই প্রাণ হারালো। তৈরি হয়ে গেল এই ওভারব্রীজ। “তারপর এক শুভদিনে,
শুভলগ্নে দেশসেবিকা শ্রীমতি ইন্দিরা দেবী জনসাধারণকে এই ওভারব্রীজটি উপহার স্বরূপ
প্রদান করলেন।”
“চ্যাপ্টা থামগুলোর উপর প্রাগৈতিহাসিক যুগের
সরীসৃপের মতো সে শুয়ে আছে” সেও হয়ে গেছে আঠারো বছর। “প্রত্যেহ হাজার হাজার লোক এর
উপর দিয়ে হেঁটে, ট্যাক্সিতে, বাসে, ঘোড়ার গাড়ীতে, রিক্সায় যাওয়া আসা করছে।...
কর্মচঞ্চল শহরের ব্যস্ততার সে এক নীরব দর্শক। অথচ এই ইন্দিরা ওভারব্রীজের নীচেই
রয়েছে এক অপার্থিব নীরবতা। উপরের হৈ চৈ গুলোর শতাংশের একাংশও নীচে এসে পৌঁছোয় না।
রাতের ইন্দিরা ওভারব্রীজ আলোয় আলোয় পূর্ণিমা, নীচে চিরকালের কৃষ্ণপক্ষ।” সেখানে
“সাতফুট পুরু কংক্রীটের আর্থকোয়েক প্রুফ থামগুলো একের পর এক সার বেঁধে দাঁড়িয়ে
আছে। ব্রীজটিকে মাথায় করে দাঁড়িয়ে থাকার দায়িত্বের ভারে হয়তো তারা রুদ্ধশ্বাস;
কিন্তু তারা নিঃসঙ্গ নয়। একটি থেকে অন্যটির ব্যবধানের মাঝখানে শূণ্য জায়গাগুলো
রয়েছে খোপের মতো; এইসব খোপে খোপে কতকগুলি মানুষের জীবন জমাট বেঁধে আছে নিরেট
থামগুলোর মতোই। ” এই জীবন যে ‘দেশে’র বাইরে এই সংকেততো সম্পূর্ণ শুরুতেই। শুরুতেই
আমরা এদ্দূর তুলে দিলাম, দেখাতে কেমন পরিবেশ রচনা করতে জানেন লেখক, এবং ক্রমেই
কেমন কাব্যিক হয়ে উঠে তাঁর গদ্য। তিনি নির্মল চৌধুরী।
ইন্দিরা ওভারব্রীজ! নামটি
সেদিন হঠাৎ অজিতদার মুখে শুনেই চমকে গেছিলাম। অজিত কর, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের
শিক্ষক। মূল নিবাস করিমগঞ্জে হলেও উজান অসমের ডিগবয় শহরে এখন থাকেন। ‘বলাকার বর্ষশেষ’
নামে একটি বাংলা এবং ‘পথিকৃৎ’ নামে একটি দ্বিভাষিক কাগজ সম্পাদনা করেন। কবিতা লেখেন,
তার চেয়েও ভালো লেখেন গল্প। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল উজান অসম , বিশেষ করে
ডিগবয়-তিনসুকিয়ার বাংলা কথা সাহিত্য নিয়ে। হঠাৎই তিনি এই উপন্যাসের নাম
করলেন,লেখকের নামও বললেন, নির্মল চৌধুরী! আমি বিশ্বাসই না করতে পেরে, আবারো
জিজ্ঞেস করলাম, ইন্দিরা ওভারব্রীজ! নির্মল চৌধুরী? এই ডিগবয়ে
থাকেন? তাঁর উত্তর, হ্যা।
আমার চমকে যাবার কারণ ছিল। উপন্যাসটি আমি পড়েছিলাম সেই আশির দশকের শুরুতে ।
শিলচরের বাড়িতে। স্কুল জীবনের শেষ বা কলেজ জীবনের শুরু তখন। বইটা এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আনা
গেছিল, তার মলাট ছিল না । কিন্তু উপন্যাস পুরোটি ছিল। সেই উপন্যাস সে যুগেই পাঠক
হিসেবে প্রবল নাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রথম একটা বাংলা উপন্যাস, যা কিনা কিশোর
পাঠকের সঙ্গে তার নিজের প্রদেশের সংযোগটি ঘটিয়ে দিয়েছিল। বহু বই এর পরে হাত
ছাড়া হয়েছে, কিন্তু সেই মলাটবিহীন উপন্যাসটি এখনো যত্নে রাখা আছে। এর পর এই তিন দশকে
কোত্থাও এই বইটির কোন উল্লেখ দেখিনি। অথচ, অসমের বাংলা গল্প
উপন্যাস নিয়ে পড়া হয়েছে অনেক কিছু। তাই লেখক কিম্বা প্রকাশকের কথা নিজেও মনে
রাখিনি। সেদিন হঠাৎই অজিতদা যখন কথাগুলো বলছিলেন, যেন সেই বহুদিন ধরে, বহুক্রোশ
দূরে বহুব্যয় করি, বহুদেশ ঘুরে একটি ঘাসের শিসের পরে একটি শিশির বিন্দু দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মনে মনে
খুঁজে ফেরার পর যেন কোন পরমআত্মীয়ের সন্ধান পাওয়া।
কিন্তু জানা গেল তিনি
অসুস্থ। সুতরাং তাঁর সঙ্গে নয়, কথা হলো তিনসুকিয়াতে থাকেন তাঁর দাদা নিখিলেশ্বর
চৌধুরী এবং ভাইপো নক্ষত্র বিজয় চৌধুরী –তাদের সঙ্গে। ফিরে এসে। তাতে ‘উপন্যাস’টির লেখকের
কাছে থাকা এক পরিছন্ন এবং সম্পূর্ণ প্রতিলিপি সংগ্রহ করা গেল। যেটি দেখে জানা গেল এর প্রকাশ
শ্রাবণ,১৩৬৯ বাংলা অর্থাৎ ১৯৬২ ইংরেজি। শিলচরের বাড়িতে খবর করে আমার নিজের
প্রতিলিপিটাও ঠিক আনানো গেল দিন কয় পরে। অজিত দা’ই জানিয়েছিলেন, তিনি প্রচুর গল্পও
লিখেছিলেন সে কালে। সেগুলোর কোন হদিশ পাওয়া যাবে কিনা, জিজ্ঞেস করতেই দু’জনেই
জানালেন সেগুলো কৈ কৈ আছে কেউ জানে না। পরে একদিন, সরাসরি অজিতদাকে নিয়েই হাজির
হলাম তাঁর বাড়িতে। সত্যিই তিনি এতো অসুস্থ যে বাক এবং দৃষ্টি শক্তির কোনটাই দেখলাম
তেমন সাহায্য করছিল না, সম্ভবত কিছুটা স্মৃতিও। কিন্তু লাভ হলো তাঁরই স্ত্রী
অপর্ণা চৌধুরীর সঙ্গে আলাপে। যিনি নিজেও একজন সাহিত্যের শিক্ষিকা। স্বামী কাজ করেছেন বিবেকানন্দ বিদ্যালয়ে তো স্ত্রী বালিকা বিদ্যালয়ে। শুধু তাই নয়, বাংলা সাহিত্যের খবরাখবরের সঙ্গে স্বামীর
সাহিত্য কর্মের খবরও দেখলাম তাঁর স্মৃতিতে সাজিয়ে রাখা। তিনিও জানালেন, তাঁর
আগেকার প্রকাশিত অপ্রকাশিত লেখাগুলো আছে ঘরে, কিন্তু কোথায় তুলে রাখা --সে শ্রম
সাধ্য সন্ধানেই শুধু পাওয়া যেতে পারে। যে সন্ধানে এখন জটিল সব সমস্যা আছে। কিন্তু
সেই সমস্যাকে গভীর করেছে, বহুদিন ধরেই লেখালেখির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ।
পরে ডিগবয় তিনসুকিয়ার
অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানলাম, তাঁরা এই উপন্যাসটির কথা জানেন বটে। অনেকরই
ব্যক্তিগত সংগ্রহেও আছে, কিন্তু এর বাইরে যারাই অসমের বাংলা সাহিত্যের খবর রাখেন
তাদের প্রায় কেউই কিছু বলতে পারলেন না। অনেকে এই লেখককে চেনেনও না। বস্তুত যে
উপন্যাস তার ভালোবাসার মূল্যেই প্রায় দেড় দশক প্রবাস বাসের পরেও আমার মূল বাড়িতে খোঁজে পেতে অসুবিধে
হয় না, সেটিকে অন্যেরা চেনেন না বলেই দীর্ঘদিন আমি নিজেও এই নিয়ে কারো সঙ্গে কথা
বলবার, বা কাউকে প্রশ্ন করবারও সাহস গোটাই নি। সাহিত্যকে যতই ব্যক্তিগত ভালোলাগা
নালাগার ব্যাপার বলি না কেন, সত্য হলো আমরা সেই ভালোলাগাকে বাইরে প্রকাশ করি যদি
সেটি সামাজিক ভাবে মান্য কিছু কাঠামোতে খাপ খেয়ে যায়। এই যেমন--- খ্যাতিমানেরা এর কথা কোথাও বলেছেন , বা
বড় কাগজে ছাপা হয়েছে, বা লেখাটি পুরষ্কার পেয়েছে। আমাদের অধিকাংশ সৃষ্টি বা লেখকই
হারিয়ে যায় শুধু এই সব ‘মান্য-মাপকাঠি’তে দাঁড়াতে পারেন না বলে, লেখক মন্দ বলে নয়।
আর এই মাপকাঠিগুলো আর্থ-সামাজিক নির্মাণ, রাজনৈতিকও বটে-- আমাদের অসমের সমাজ নিজের
জন্যে সেটি নির্মাণ করে উঠতে পারে নি।বাংলা সাহিত্যে এই ‘মাপকাঠিগুলো’ নির্মিত
হয়েছে সেই পশ্চিম বাংলাতে—সেই বাংলার মোহতে তাই সহজেই পড়ে থাকেন
পাঠকতো বটেই, বহু লেখকও। ডানে, বামে যে পথের পথিক না হোন লেখক-শিল্পী সবারই সেই
একই দর্শন। আর তাই,সমর দেবের ‘লোহিত পারের উপকথা’-যাকে এই উপন্যাসের আধা শতক পরে
লেখা পরের পর্ব বলে দাবি করা যেতে পারে-- সেটিরও শেষ প্রচ্ছদে দরকার পড়ে পশ্চিম
বঙ্গীয় ‘বিপ্লবী’ আজিজুল হকের শুভেচ্ছাবাণীর, যে বাণীর শুরু আবার হয় ঔপনিবেশিক
মননের চিহ্ন রেখে ইংরেজিতে, ‘চেঞ্জিং দ্য ট্রুথ, নট পকেটিং দ্য ট্রুথ’ লিখে। তিনি
আদৌ সাহিত্যের লোক কি না, অসমের সাহিত্য এবং সমাজজীবন নিয়ে আসলেই কোনো ধারণা আছে কি না সেটি লেখকের
পক্ষেও আদৌ কোন বিবেচনার বিষয় হয় নি। আমাদের চেতনার রেলগাড়ি
সর্বাবস্থাতেই এসে পৌঁছোয়, ‘রাজহাট’ থেকে তিনসুকিয়াতে। উলটো যাত্রা করে না। সে
‘রাজহাট’ নামে কোন স্টেশন থাকুক চাই নাই থাকুক। অথবা বাস্তবের রেল পথে প্রচুর
ফেরিঘাটের যাত্রাবিঘ্ন থাকলেও , আমাদের চেতনাতে তারও কোনো চিহ্ন পড়তে পায় না।
যাদের জন্যে লেখা হয়, সেই
পাঠককুলের কিম্বা সাহিত্যকর্মীর কিম্বা গবেষকের মমতা পেলে আমাদের এই লেখকদের হারিয়ে
যাবার ব্যাপারগুলো কিছুতেই ঘটতনা। কিন্তু , আমরা কি আর আমাদের পড়বার ঘরের তাকে বা
টেবিলে ডিগবয়ের লেখকের উপন্যাস সাজিয়ে রেখে সামাজিক সম্মান অর্জনের মতো কোন
বাস্তবতা আদৌ গড়েছি, না গড়তে আগ্রহী, আমাদের প্রতিবেশি অসমিয়াদের মতো? আমাদের এই
সাংস্কৃতিক দুর্বলতাটি রয়েছে । আমরা নিশ্চয়ই এতো
গ্রন্থবিরোধীও নই। বই পত্রিকা আমাদের ঘরেও থাকে, কিন্তু সেসব কলকাতার
বাজারের জনপ্রিয় বই, ‘আনন্দবাজার’ ‘আজকাল’ , ‘দেশে’ যেগুলোর বিজ্ঞাপন সহজে মেলে।
ধর্মপত্রিকা বলতেও সেই ‘উদ্বোধন’ কিম্বা ‘অখন্ড সংহিতা’ যেন মধ্যবিত্ত অভিমানের প্রতীক
হয়ে বসে আছে। সেই কলকাতাতেও বিকল্প চিন্তার ঢেউ তুলে বাজারে যেগুলো অজনপ্রিয় থেকে যায় অধিকাংশ পাঠক
সেগুলোর সন্ধান অব্দি হয় পান না, নতুবা পেলেও আদর করবার দরকার বোধ করেন না। ‘কে
হায় হৃদয় খোঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’আর এতেই রামকুমার নন্দী মজুমদারের
‘মালিনী উপাখ্যান’, সুরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তীর ‘স্নেহের বাঁধন’ কিম্বা
‘অশ্রুমালিনী’ উপন্যাসের কথা যদিও বা অধ্যাপক গবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য এবং তেমন
কারো কারো সৌজন্যে আমরা জেনেছি পরের অনেকের কথা হয় জানাই যায় না। আর জানা গেলেও নির্মল চৌধুরীর
আগে কোন লেখকের উপন্যাসের প্রতিলিপি এখন পাওয়াটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। লিখে যিনি
পারিবারিক খ্যাতি কিছুই বাড়াতে পারেন নি, বরং জটিলতা বাড়িয়েছেন বহু, সেরকম লেখকদের
নিয়ে পরিজনদের আগ্রহও থাকে না বিশেষ।
কালের আনুভূমিক বা উলম্ব
ভ্রমণ করে অসমের বাংলা সাহিত্যের সন্ধান করে ফিরবার কাজটা অতি সম্প্রতি শুধু বেগ
পেতে শুরু করেছে। সম্ভবত তাতেই আমারও লেখক নির্মল চৌধুরীকে পুনরাবিষ্কার করে ফেলা।
‘মান্য-মাপকাঠি’র থেকে বেরিয়ে এসে---উপন্যাসটি যে আমার ভালো লাগাগুলোর অন্যতম-- সে
কথা প্রকাশ্যে বলবার সাহস গোটানো। ঘটনাটি আকস্মিকই বটে, তবু এমনি এমনি বলিনি এই
কথা। দেখা করতে গেলে লেখক জিজ্ঞেস করছিলেন, উপন্যাসটি আদৌ পড়বার মতো কিছু কি?
বললাম, বলেন কি! এই তিরিশ বছর পরে পড়েও তো আমার মুগ্ধতা সামান্যও হ্রাস পেলো না!
জিজ্ঞেস করলেন, এর ভাষা বুঝি সাহিত্যে চলে না! আমার পাল্টা প্রশ্ন কেন বলছেন এই
কথা? উত্তর, না তখন অনেকেই বললেন, আমি বুঝি সাহিত্যের ভাষা ব্যবহার করিনি। যিনি
লিখতে পারেন, ‘রাতের ইন্দিরা ওভারব্রীজ আলোয় আলোয় পূর্ণিমা, নীচে চিরকালের
কৃষ্ণপক্ষ।’ কিম্বা, ‘এইসব খোপে খোপে কতকগুলি মানুষের জীবন জমাট বেঁধে আছে নিরেট
থামগুলোর মতোই।’ এই সব রূপক বাক্য-- তিনি জানেন না সাহিত্যের ভাষা!
আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধে হলো না, আমাদের
পাঠ্য সাহিত্যের উপভাষাটাওতো আবার মেদিনীপুর চব্বিশ পরগণার ! এখানে প্রেম করতে
হলেও ট্রামে চড়ে ভিক্টোরিয়ার মাঠে গিয়ে বসতে হতো এককালে , নইলে ঠিক জমে উঠত না।
আমাদের আন্তর্জাতিকতার দৌড়ও কলকাতার ট্রামের, বড় জোর দোতলাবাসের বেশি এগুতো না। গিয়ে
পৌঁছুতো বড় জোর লেনিন সরণি। সুরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী সাহস করে তার
প্রেমোন্মাদ নায়ককে আসাম বাংলা রেলে চড়িয়ে লামডিং নিয়ে এসছিলেন। সেই বাবু-সংস্কৃতির রমরমার
দিনগুলোতে কিনা আমাদের লেখক কাহিনির শুরুতেই বাঁশের বেহালা বিক্রি করে বেড়ায় যে দিনি, সে
তার প্রসূতি বৌকে সম্বোধন করে বিশুদ্ধ সাদ্রিতে বলছে , “শালী! সকল বরবাদ কইরে
দিলো। বাচ্চা দিবিতো দে কেনে জলদি! বেলা ভাইটল ধইরেছে , কখন ইগুলান বেইচব?” আমাদের
রাজ্যের বাঙালিবাবুরা একে বলেন, কুলির ভাষা। তার উপর যদি কোথাও কেন্দ্রীয় চরিত্রটি
কথা বলে উঠে কোন পূববাংলার ভাষায়, তবে আর সেই পূববাংলা ---মূলের অসমের বাঙালির মুখ দেখাবার জায়গা থাকে না। লেখককে বাতিলের তালিকাতে
ঠেলে দিতে তখন লোকের অভাব হবার কথা ছিল না বটে, এখনো অনেকে ধন্দে পড়েন এই নিয়ে। আর
তাই এখনো কিছু কলকাতার প্রতিষ্ঠানমোহিত কবি যখন আমাদেরই বাড়ির দোয়ারে বসে লেখন এমন
বর্ণবিদ্বেষি কবিতা, আমাদেরই বহু কবি-লেখকই এতে অন্যায় কিছু দেখে শিউরে উঠেন না।
আর কতদিন পর উপত্যকা থেকে কলকাতায়
ফিরবে ভেবেছো?
এই প্রশ্নের গায়
হাত দিয়ে টের পাই চারপাশে আসন্ন সন্ধ্যার
দ্বিধা ও দুর্যোগময় সমাধান হীন অন্ধকার
আরেকটু এগিয়ে এক দাপুটে বন্ধুর সাথে দেখা
সিলেটের তীরে বসে সেও একা একা
ভাষার সৌজন্য মেনে সমবেত গান গায়
আমাদের খুব কাছে বরাকের সূর্য রোজ
আন্দোলনহীন ডুবে যায়
কখনো গভীর রাতে আমরা সম্ভ্রান্ত হয়ে বসে
কথা বলি পরাস্ত ব্রডগেজ নিয়ে; কেন , কার দোষে
ভুল বাংলাতেও কেউ কাউকেই বাড়িতে ডাকে না
কলকাতা থেকে এসে কেউ কেন বেশিদিন এখানে থাকে না
বেলা বাড়ে, আরও বুড়ো হয় এই দোমড়ানো শহর
অনুন্নত উচ্চারণে ভরে ওঠে ভাঙা রাস্তা, নোংরা বাড়ি ঘর।
(পরাবাস্তব,সুমন গুণ)
কুলপতি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কথা বলে কিনা এমন কইর্যা, “ কি হইলো? ও, বারডা মনে নাই?
সিই কথাডা তো? হেঃ হেঃ, দ্যাখেন, আমারও মনে নাই! তার লেগে আমি ভাবি না, আপনেও
ভাইবেন না। মিতিরে আসনের দ্যান, তারে জিগাই। মনে লয় ঠিক কইতে পারবো। হঃ ! পারবো।
উই মাইয়া বড় ভারী মাইয়া গো। হইবো না কিসের লেগে? কার মাইয়া সেই দিশা তো পান নাই।”
নির্মল চৌধুরী মনে হয় সেইসব পূববাংলা মূলের পাঠকদের ‘বাবুয়ানা’কে মোকাবেলা করতে
পারেন নি সেকালে --তাঁর সমস্ত দক্ষতা সত্বেও।
নির্মল চৌধুরীর জন্ম কাছাড়ের সুভং চা-বাগানে। তাঁর
স্ত্রী অপর্ণা চৌধুরীরও জন্ম শিলচরে। সেখানে এই সেদিনও সাহিত্যে সিলেটি ব্যবহার
করলে অনেক সিলেটি পণ্ডিতই চোখ লাল করতেন। সুতরাং অনুমান করতে পারি, এই উপন্যাসকে
নিয়েও সেই ষাটের দশকে তাঁকে এমন বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়েছিল। তাতেই হারিয়ে গেছিল
এই উপন্যাস। ১৩৬৯ বাংলা তথা ১৯৬২ ইংরাজির শ্রাবণে উপন্যাসটি বই হয়ে বেরোয়। ছাপাটি
কলকাতার শ্রীভূমি প্রেসে , কিন্তু প্রকাশক হিসেবে নাম রয়েছে তাঁর স্ত্রী অপর্ণা
চৌধুরী আর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ‘উদয়াচল প্রকাশনে’র । ঠিকানা, কমার্শিয়াল
ইনস্টিটিউট বিল্ডিংস, ডিগবয়। দাম দু’টাকা পঁচাত্তর নয়া পয়সা।
তাঁর দাদা নিখিলেশ্বর
চৌধুরী এবং পরিবারের আরো কেউ কেউ এর আগেই ডিগবয়ে এসছিলেন জীবিকার সন্ধানে।
সাহিত্যের প্রতি গোটা পরিবারেরই একটা আগ্রহ ছিল। দাদা নিখিল চৌধুরী নিজে কবিতা
লেখেন এখনো। ১৯৪৪এ জন্ম নেয় দ্বিভাষিক হাতেলেখা কাগজ ‘যাত্রী’ বের করতেন ডিগবয়
থেকে। এখানেই তাদের হাতে খড়ি। ডিগবয় কমার্শিয়াল ইন্সটিটিউট নামের প্রতিষ্ঠানটি এখনো আছে
তিনসুকিয়াতে, চালান সেই অতি বৃদ্ধ নিখিলেশ্বর চৌধুরীই। সেই ইন্সটিটিউটেরই এককালে
অধ্যক্ষ ছিলেন কবি মলয় বসু। যার সম্পাদনাতে স্বাধীনতা উত্তর ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার
প্রথম সাহিত্যের ছোট কাগজ ‘মরশুমী’ বেরিয়েছিল ১৯৫২থেকে। সেই ইন্সটিটিউট থেকেই
নিয়মিত বেরুতো আরেকখানা হাতে লেখা কাগজ ‘কোরক’। নির্মল চৌধুরী নিজেও ষাটের
দশকে সম্পাদনা করেছিলেন একটি কাগজ ‘নবজাতক’। তাঁদের অর্দ্ধেক পরিবার এখনো থাকেন
শিলচরে। সে পরিবারের ভাইপো নিলোৎপল চৌধুরী অসমের জনপ্রিয় দৈনিক যুগশঙ্খের
কার্যবাহী পরিচালক। অন্যদিকে স্ত্রী অপর্ণা চৌধুরীর রয়েছে শিলচর শহরে বিবাহ পূর্ব
জীবনে গণনাট্য সংস্থার হয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কাজ করবার অতীত। সম্পর্কে ইনি
কবি-প্রাবন্ধিক-সমাজকর্মী প্রয়াত অনুরূপা বিশ্বাসের ছোট বোন। সুতরাং খানিক ইচ্ছে
করলেই লেখক নির্মল চৌধুরী অসমের ‘খ্যাতনামা’ লেখক হতে পারতেন। তিনি এবং
তাঁর পরিবার দু’তরফেই এই উদাসীন্য প্রশ্ন জাগায়।
সরীসৃপে মতো সিমেণ্টের সাঁকোটির কাহিনি সেটুকুই যেটুকু আমরা তুলে ধরেছি
শুরুতেই। বাকিটা তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীবনের গল্প। জোরটা অবশ্যই যেদিকে জমাট বেঁধে আছে চিরদিনের
কৃষ্ণপক্ষ। ব্রীজের নিচের তলায়। যে দিকটিতে সদা পূর্ণিমা, যারা সময়ের সঙ্গে জীবনের
ফাঁকগুলো ভরাট করে দিতে ছুটে চলেছে নিরন্তর এর উপর দিয়ে তারা সমাজ হিসেবেই এই উপন্যাসের প্রতিচরিত্র। সোজা করে বললে খল চরিত্র।
একুশ শতকের প্রথম দশকে দাঁড়িয়ে বাংলা সাহিত্যের যেকোন পাঠকের কাছেই এভাবে শুরু
যেকোন গল্পকেই বহু চেনা মনে হবে। বস্তুত একে অনেকে এখনকার কোন গল্প বলে ভেবেও পড়তে
শুরু করতে পারেন। এখনো গোটা বিশ্বের প্রতি ছ’জন ব্যক্তির একজন এরকম ইন্দিরা
ওভারব্রীজের নিচেই বাস করেন। তার জন্যেও এটা এখনকার গল্প । আর “সময়কে জীবনের সঙ্গে
এমন ভাবে একাকার করে” মানুষের ছুটে চলাটার গতি এখনো তেমনি দ্রুত আর এই দ্রুতির
সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শহরে শহরে ওভারব্রীজ গড়ে উঠাটা এখনও বহু পুরোনো শহরের নতুন
গল্প। যে ভাষা এবং কাঠামোতে গল্পকে নির্মাণ করেছেন লেখক সেই শৈলী কম হলেও
ব্যবহার করেন এখনো অনেক লেখক। নির্মল চৌধুরী এই কাজটি করেছেন, আধা শতক আগে তাও
অসমের এক প্রান্তীয় শহর ডিগবয়ে বসে। উজান অসমে এখনো তাঁর মতো মসৃণ গদ্য লিখতে পারেন, অতি
অল্প লেখক।
উপর তলার এই নাগরিক সভ্যতা শুনে ছি ছি দেবে যদি শুনে যে কোনো হবু বাপ তার
আঁতুড় ঘরে প্রসব যন্ত্রণাতে কাৎরাচ্ছে যে বৌ তাকে সম্বোধন করে বলছে, “শালী! সকল
বরবাদ কইরে দিলো…।” পুরো সংলাপটা আমরা ইতিমধ্যেই তুলে দিয়েছি।সে বাঁশের বেহালা বিক্রি করে
ঘুরে বেড়ায় শহরের পথে পথে বেরুতে দেরি হচ্ছে। বিক্রিবাটা না হলে ওবেলা চুলো জ্বলবে না।
দুর্ভাবনা এই নিয়েই। মোটের উপরে এই দিয়েই গল্পের শুরু!
প্রসূতি বৌকে দিনি ‘শালী!’ বলে গালি দিচ্ছে দেখে এটা
ভাববার কোন কারণ নেই যে সে বৌকে মোটেও ভালোবাসে না। তবে কিনা গল্পের শুরুতেই ওর
যখন মেয়ে জন্মায় এই সংবাদে সে সন্তুষ্ট হয় না। হাতুড়ে চিকিৎসক কুলপতির ফীজ না দিয়ে
চলে যায়, বেহালা ফিরি করতে। বৌ থাকে পড়ে। এই গল্পকে যদি বলি ‘মেয়ে জন্মে’র গল্প
ভুল হবে না। না, দিনি কিম্বা ওর মেয়ে-বৌ কেউ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়। এই গল্প ঠিক
দিনির গল্প নয়। কুলপতি আর তার মেয়ে মিতির গল্প। সেই গল্পের সমান্তরাল আরেকটি গল্প
আছে কৌশল্যা আর তার বাবার। যারা এই বসতিতে এসছে মাত্র এই আগের দিন বিকেলে। চলে যাবার জন্যে পা বাড়িটেই
আছে। দিনির গল্পটাকে যত ইচ্ছে টানা যেত, কুলপতির গল্পকেও মনে হয় অতি বেশি দ্রুত
এগিয়েছে। কিন্তু এই দ্রুতির মূলে কৌশল্যাদের যাবার তাড়া। এরা চলে গেলে লেখকের কৌশল
মাঠে মারা যায়। কৌশল্যার বাবা হাঁপানীর রোগী। মারা গেলে দুটি কচি সন্তান নিয়ে
নিঃসঙ্গ কৌশল্যার কী হবে এই ভাবনা যেমন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তেমনি খাচ্ছে
কুলপতিকে। বুড়ো হয়েছে, মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়েও হয়ে উঠল না। ও না থাকলে একা মেয়ের কী
হবে! কুলপতির দিক থেকে প্রশ্নটি বড়ই শীতল। একে উত্তপ্ত করে একটা উত্তেজনার বেগ এনে
দিয়েছে কৌশল্যার বাবা। তাতেই গল্প এগোয় দ্রুত। আধা বেলা আর একটি পুরো রাতে ফুরিয়ে
যায়। বাকি গল্প এগিয়েছে স্মৃতি চারণে আর সংলাপে।
সে বহুকাল আগের কথা...
কুলপতি-মালতি-মিতির
গল্পঃ আমাদের যদি পুরো গল্পটার একটা ধারণা দিতে হয়, তবে এই স্মৃতিচারণের
আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে এগোনো পিছোনো কঠিন বড়। আমরা তাই, একে সরল রেখাতে বেঁধে ফেলি
আগে।
কুলপতির দেশের বাড়ি কোথায়
ছিল উল্লেখ নেই। কিন্তু মুখের ভাষা দেখে অনুমান করে নিতে কষ্ট হয় না, সে ছিল
বাংলাদেশ। সেদেশের কোন এক জেলার , কোন এক গ্রামের কোবরেজ ছিলেন ওর বাবা। তাঁর কাজে
হাত এগিয়ে দিতে দিতেই কুলপতি কিছু শিখেছিল কোবরেজি। গায়ে পড়ে মানুষের সেবাতে নেমে
পড়া মানুষটির চিরকেলে স্বভাব। দেশের বাড়িতে এক মঙ্গলবারে এক হাঁপানী রোগী এসে
উপস্থিত যখন বাবা নেই। তিনি হাঁপানী রোগীদের ওষুধ দিতেন না। বুকে তেলমালিশ
করতে দিতেন। শনি কি মঙ্গল এই দুই বারের একটাতে তাবিজ তৈরি করে রোগীর গলায় ঝুলিয়ে দিতেন
। রোগীর ভীষণ কষ্ট দেখে কুলপতি ঠিক করলেন সেদিনই মাদুলি করে দিতে হবে। নইলে
পরের শনিবারে দেরি হয়ে যাবে। নিয়ম ছিল এই তাবিজের জন্যে উলঙ্গ অবস্থায়
ডালিম গাছের পরগাছার শেকড় এক নিঃশ্বাসে তুলে আনতে হয়। গ্রামের শেষ মাথাতে লোচন
দত্তদের বাড়ির ডালিম গাছে পরগাছা মেলে। সে বাড়ির পেছনে গোয়াল ঘরের পাশেই আছে।
ন্যাংটো হবার ইচ্ছে ছিল না, কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পা দিয়েছে সে। ইদানিং যে কাজটি
করে, বাড়ির চাকর নবীন সে গেছে মাঠে গরু চরাতে । অগত্যা সেই সন্ধ্যায় কাপড় চোপড় খুলে এক দীর্ঘ
শ্বাস নিয়ে যেই পরগাছাতে ধরে টান দেবে, ওমনি বাড়ির মেয়ে মালতী এসছে গোয়াল ঘরে আলো
দেখাবে বলে। উলঙ্গ কুলপতিকে দেখে তার ভয়ে অজ্ঞান হবার জোগাড়। ওর চীৎকারে দৌড়ে এলেন
মা, কী করবে ঠিক করতে না পেরে ওমনি দাঁড়িয়ে রইল কুলপতি। মালতির সঙ্গে এই প্রথম
দেখা, এর পরে প্রেম এবং বিয়ে। এই ঘটনা নিয়ে এর পরেও দু’জনে বেশ হাসি ঠাট্টা হতো।
কুলপতি জিজ্ঞেস করতো মালতীকে, এই ন্যাংটো মানুষটায় কী পেয়েছে সে, মালতী জবাব দিত,
“ আমার মহাদেবেরে পাইছি...।”
প্রভূত জমিজমা রেখে মা, বাবা অকালেই চলে গেছিলেন।
সবই হারালো সহজ কুলপতি কাকাদের ষঢ়যন্ত্রে । উপায় না দেখে মাইল পাঁচেক দুরের একটি
পাঠশালাতে শিক্ষকতা শুরু করে সে। কোনোদিন দু’টো ভাত রান্না করে মাটির বাসনে বেঁধে
দেয় মালতী, কোনদিন গামছাতে বেঁধে চিঁড়ে গুড় দেয়। ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। ফিরতে
দেরি হলে মালতী ভয়ে মরে। কোনোকোনদিন অনেক রাত হয়ে যায়, ভরা বর্ষাতে তাতে আতঙ্ক
বেড়েই চলে। একদিন ফিরে দেখে মালতী কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলে কোন উত্তর দিচ্ছে না। অনেক
পরে জানায়, এতো দেরি করে কেন ফিরতে? একা একা ওর ভয় করে! উত্তরে কুলপতি জানায়, “কয়দিন ধরে কি জলই না
বর্ষাইতাছেন। সনসারডা অন্ধকার হইয়ে আছে। বেলার দিশা কেমনে পাই কও দেখি?...” যখন শোনে পাশের বাবুদের
রাজবাড়িতে শঙ্খঘণ্টা বাঁজছে তখন পাঠশালা ছুটি দিয়ে চলে আসে।
সেই রাতে পাশে শুয়ে মালতীও
পরদিন পাঠশালা যাবার ইচ্ছে জানালো। সে ভাবল , লেখা পড়া শিখবার জন্যে বুঝি। বলল, ছেলেমেয়ে কয়েকটা হোক, তখন
বাড়িতেই পাঠশালা খুলে বসবে। কষ্ট করে এতো দূর যাবে কেন মালতী? মালতী জানালো যে
ঠাট্টা করছে না। বৃষ্টি বাদলার দিনে একছাতার তলায় স্বামী স্ত্রীতে যাবে কী করে,
লজ্জা করবে না? কুলপতি জিজ্ঞেস করে। মালতীকে মানানো যায় নি। পরদিন সকালে কুলপতি
ঘুম থেকে উঠে দেখে তার অনেক আগেই মালতী তৈরি হয়ে বসে আছে। খাবার ছাড়াও একটা
টুকরিতে করে সে শেকড় শুদ্ধ ঝিঙে লতা নিয়েছে। এটা দিয়ে কী হবে, জিজ্ঞেস
করে কুলপতি কোন জবাব পেল না। বেরুবার বেলা আকাশের ভাব দেখে কুলপতি খানিক রাগই করল।
মালতী এবারেও কোন জবাব না দিয়ে কুলপতিকে বলল টুকরিটা কাঁধে তুলে নিতে, সে খাবার
পোটলাটা নিচ্ছে। গোটা পথে রাগে গিজগিজ করছিল কুলপতি। পাঠশালাতে পৌঁছেই মালতী
দাওয়ার কাছে ঝিঙে লতাটি রোপন করল। মাঠ থেকে শুকনো গোবর এনে গোড়ায় দিল। ছাত্রদের
নিয়ে চারপাশে বাঁশের বেড়াও দিল। তারপর থেকে আর পাঠশালা থেকে ফিরতে দেরি হয় নি
কুলপতির। ঝিঙে ফুলের সুবাস নাকে এলেই মনে হতো ,” আমার মালতীমালা ডাকতাছে।” ইন্দিরা
ওভার ব্রিজের তলাতে এখনো ঝিঙের গাছ লাগিয়ে রেখেছে কুলপতি, তাতে ফুল ধরলে সে গন্ধ
পায় মালতীর গা’র।
এমনি করেই দিন চলছিল দু’জনার, কিন্তু কাকারা
তখনো পিছু ছাড়ে নি। এক শুক্রবারে পাঠশালা পরিদর্শনের জন্যে গাঁয়ের পঞ্চায়েৎ
আসবেন। তাই একটু আগেভাগেই গিয়ে গুছিয়ে রাখতে হবে। ওদিকে বৃষ্টিও আসছিল। ছাতাটাও
ছিঁড়ে গেছে। মালতী তাড়াতাড়ি করে ছাতাটা সেলাই করে দিচ্ছিল। দেরি হচ্ছিল বলে দু’জনে
কিছু কথা চালাচালিও হলো। সেই সময় লাল পাগড়ির কয়েকজন পুলিশ এসে বাড়ির উঠোনে হাজির। পুলিশ জানালো এক্ষুনি ওকে
বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে, কারণ বাড়িটি কুলপতির নয় তার কাকার। কুলপতির বাবা নাকি কাকাদের
কাছে অনেক টাকা ধারতেন। বাড়িটার দখল দিয়ে সেই টাকা শুধতে হবে। কুলপতি রেগেমেগে
ঝগড়াঝাটিও করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না, তাকে জানানো হলো বাড়ি না ছাড়লে তাকে
জেলে যেতে হবে। মালতীকে বলেছিল কুলপতি দিন কয় বাপের বাড়ি ঘুরে আসতে। একটা কিছু ব্যবস্থা
করে নিয়ে আসবে বলে। সে কুলপতিকে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় নি। গোটা দিন মাঠে মাঠে
ঘোরাঘুরি করে বিকেলের দিকে নিতান্ত আশ্রয় একটার সন্ধানে সে স্টেশনে এসে হাজির
হয়েছিল। কী করবে ভাবতে ভাবতে কুলপতির মনে পড়ে যায় বাবার এক বন্ধুর কথা, যিনি অসমের
ডিব্রগড়ে ব্যবসা করেন। তিনদিন তিন রাত এর পরে ওদের গাড়িতেই কেটে গেল । পথে
মালতী অসুস্থ হয়ে গেল । বমি আর দাস্ত। সহযাত্রীরা ওকে গালি দিয়ে নেমে যেতে বলল,
রোগটা বুঝি ওলাওঠা। এই স্টেশনে আসতেই সরকারি লোকেরা এসে তাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে
প্ল্যাটফর্মের বাইরে বের করে দিল। কোকিলা তখন এদিক দিয়ে শহর
থেকে ফিরছিল, সে এই পুলের তলার সন্ধান দিল। শেষ যে ক’টি পয়সা ছিল, তাতে ঘোড়ার গাড়ি
নিয়ে এখানে এসে পৌঁছুলো কুলপতি। তারপরে সে রাতেই
ব্রহ্মপুত্রের পারে গিয়ে মালতীর শ্মশান কর্ম সারে কুলপতি। ছাইগুলো ভাসিয়ে দিয়ে ভাবছিল
নিজেও ভেসে যাবে। ইচ্ছে হচ্ছিল চলে যায় কাশী বৃন্দাবন। কিন্তু তখনই মনে পড়ে গেল টিনের
ট্রাঙ্কে ওর আর মালতীর একটি তোলা ছবি আছে। সদরে গিয়ে দু’টাকা খরচ করে তুলেছিল বিয়ের
পরে। ট্রাঙ্কটা এখনো আছে, পড়ে ছিল পুলের নিচে। এখানে আসতেও ভোরের অস্পষ্ট আলোতে সে
দেখে ওকে দেখেই একজন স্ত্রীলোক দ্রুত একটি দাঁড়ানো ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে চলে যাবার
উদ্যম নিচ্ছে। গাড়ির পাশে যেন কিছু পড়ে আছে। কাছে এসে সে দেখে ন্যাকড়াতে জড়ানো একটি
শিশু। এক হাতে ওকে বুকে চেপে ধরেছে, আর হাতে ধুতিটাকে হাঁটুর উপরে তুলে বেদিশার
মতো দৌড়োচ্ছে গাড়িটাকে ধরবে বলে। ধরে ফেলে সে গাড়িটি। দেখে ভেতরে দু’জন মেয়ে
মানুষ। বসে থরথর করে কাঁপছে। “পূবাকাশ লাল হয়ে উঠছে। সেই রক্তিমাভাতে মিতির
মাকে দেখছিল কুলপতি। চেহারা বিবর্ণ, ঠোঁট যেন নীল, বিহ্বল দৃষ্টি। কিন্তু কী
সুন্দর। যেন দুর্গাপ্রতিমা।” মিতির মা বলেছিল, ব্রহ্মপুত্রে ঝাঁপ দিয়ে সে
আত্মহত্যা করবে। কুলপতি বলেছিল, “ থাকেন, বাঁইচে থাকেন। আপনার মরণে কি উয়ার প্রাণ
শেতল হইবো মা?...সন্তানের জ্বালা কি আপনার মরণের জলে ধুইয়া নিবো জননী?” সঙ্গের মেয়েটি, ধাই বা ওদের
বাড়ির ঝি হবে, কুলপতির হাত ধরে বলেছিল, “ ...কুমারী মেয়ের লজ্জা রাখো।” এর পরে আর
কুলপতির যাওয়া হলো না কোথাও। মাটিতে পাওয়া মেয়ের নাম দিল মৃত্তিকা। মিতি। সেই
মিতিকে নিয়েই থেকে গেল এই পুলের তলায়।
একাধারে বাবা এবং মায়ের ভূমিকাতে নামতে হলো কুলপতিকে
সেদিন থেকেই। মিতি তখন একেবারেই শিশু। ভোরের ঠাণ্ডা লেগে চেহারা
ওর নীল হয়ে গেছিল। বুকে জড়িয়ে ধরেও গা গরম করতে পারছিল না। একে তাকে ধরে সন্তানের
মাকে পয়সা দিয়ে, বা না দিয়ে বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছিল ওকে। মিতিকে নিয়ে কুলপতি
প্রায়ই শহরে বেড়াতে গেছিল কুলপতি। মাকে দেখাবে বলে। একটি দোতলা বাড়ির সামনে
দাঁড়ায় প্রায়ই। বাড়িটি দেখে , মিতিকে দেখায়। কোন কোনদিন গায়ে পড়ে বাড়ির ঝিয়ের সঙ্গে কথা
বলে আসে। শেষবার এসছিল, যখন ওর বয়স পাঁচ বা ছয়। সেদিন দেখা গেল সে বাড়িতে
প্রচুর মানুষের ভিড়। ফুলে আলোতে সেজে উঠেছে পুরো বাড়ি। ভেতর থেকে ভেসে আসছে
সানাইয়ের সুর। ঝিকে জিজ্ঞেস করলে অত্যন্ত বিরক্তিভরে বলল, “ কেন বাছা, এত ঘন ঘন
আসা কেন? এইতো পরশু এসেছিলে, আজ আবার কেন? কি চাই?” কুলপতির সবিনয় উত্তর, “...কিছু
না। শুধু এ্যাই মিয়াডার লেগে।...” ঝির প্রতিপ্রশ্ন, কতটাকা দিলে সে আর এই পথ মাড়াবে
না। কুলপতির স্ববাবসুলভ জবাব, কতটাকা নিয়েছে সে এই অব্দি যে টাকার জন্যে আসবে, বা
পেলে আসা বন্ধ করবে? সে বলে, “... একদিন মা জননী দর্শন দিবেন। ... তার লেগেই বারে
বারে আসি। টাকার লেগেতো আসি না।” তখনই ঝি জানায় তবে সেই কুলপতির শেষ আসা, সেদিনই
মিতির মায়ের বিয়ে। ঝি চলে যাচ্ছিল। মিতি তবে কোনদিনই ওর মাকে দেখতে পাবে না! সে
প্রায় কেঁদেকুটে মিনতি করল একটা বার যদি মেয়েটাকে দেখা দিয়ে যান। কিছুতেই যখন রাজি হয় না, সে
মিতিকে কাঁধে তুলে বলে, “মাগো এট্টাবার চিৎকার কইরে মা বইলে ডাকো।” ঝি ভয় পেয়ে রাজি হয়ে গেল
কুলপতির প্রস্তাবে। বাড়ির ভেতরে গিয়ে কিছু পরে ফিরে এসে বাড়ির পেছন দিয়ে ওদের
ভেতরে নিয়ে গেল। দোতলার একটা জানালা দেখিয়ে বলল, ওটা খুলে মিতির মা দাঁড়াবে। কোন
কথা চলবে না, দেখবে আর চলে যাবে। তাই হলো, সন্ধ্যার ম্লান আলোতে এক অপরূপা
মূর্তি এসে দাঁড়ালো জানালা খুলে কিছুক্ষণ পরে। কুলপতি সেদিকে তাকিয়ে পরে মিতিকে
বলল, “এট্টাবার চুপে চুপে দেইখে লও, মনে মনে ডাইকে লও মায়েরে। আর আমারে জিগায়ো না,
নিজের মায়েরে ক্যানে উমন চোরের পেরায় লুকাইয়ে দেখতে হয়, সিই কথাডা আমারে জিগায়ো না। জবাব আমি জানি
না।” আরো কিছু বলতে গিয়ে সে দেখে মিতির মা কাঁদছে। চোখের জলের সঙ্গে দু’টো
সোনার কাঁকন কাছেই ঘাসের ওপর এসে পড়ল। কাঁকনের দিকে একবার তাকিয়ে
আবার যখন চোখ ফেরালো ততক্ষণে জানালা বন্ধ হয়ে গেছে। সেই কাঁকন কুলপতি রেখেছিল তারই
বালিশের নিচে চাটাইয়ের নিচে মাটির তলায়।
মেয়ে বড় হচ্ছিল । তাকে নিয়ে বাবার ভাবনাও
বাড়ছিল। এখানে মেয়েরা নিরাপদে থাকে না। নাগরিক হায়নারা এসে হামলে পড়ে। তখনকার অনেকেই এখন নেই। আছে
শুধু দিনিরা আর লক্ষণ। বাদশা, দুখীচরণ, মঙ্গলদাস, কোকিলা, ফুলমতি, যমুনা, রাজরানী
এমন অনেকেই ছিল। বংশীকে প্রায়ই বলে কুলপতি, “ জানলেন, সমুদ্রের তীর হইছে গিয়া
আমাদের এই পুলের তলাডা। জোয়ারের ঝাপট ঠেইলে আমাদের থুইয়া গেছে ইখানে। ভাটীর টানে
কোনদিন আবার ভাসাইয়ে লইয়ে যাইবো অন্য কোনখানে। দ্যাখেন, চক্ষু কইরে দ্যাখেন, কোথায়
গেলেন সি সকল মনুষ্য! সিই দুখীচরণ—মঙ্গল দাস—রাজরাণীরা। নাই, হেঃ হেঃ। জোয়ার ভাটার
তাড়নায় কোন অতলে তলাইয়ে গেছেন। ” হাসতে হাসতেই বলত , বলতে বলতে চোখে জল আসত। মঙ্গল
দাস ডুগডুগি বাজিয়ে বাউল গান গাইত, ভালো গাইত। মাঝে মধ্যে পুলের উপর দিয়ে যেতে
যেতে পথযাত্রীরা নেমে এসে তার গান শুনে দু’চারটাকা দিয়ে যেতেন। বাদসা দেখাতো
যাদুবিদ্যা, ভানুমতির খেলা। একবার এমনই এক খেলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল
মিতি। লক্ষণও ছিল। কয়েকটি বাবু কাছে এসে মিতিকে দেখিয়ে দেখিয়ে কী সব কথা বলছিল।
লক্ষণ মানুষ সুবিধের নয়। কুলপতি সেদিনই মিতিকে ডেকে আলাদা নিচে শুতে মানা করে। সেই
রাতেই মিতির চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। দেখে ক’জন লোকে মিতিকে টানতে টানতে থামের
ওপাশে নিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার শুনে বাদসা, মঙ্গল দাস, দুখীচরণ সবাই জেগে উঠে মিতিকে
ওদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনে। সেদিন মিতিকে কোলে নিয়ে অনেক কেঁদেছিল কুলপতি। বলেছিল,
“মাগো, শেতল হইয়ে আমার বুকে তুমি বিরাম লও। এ্যাই, সমূদ্রের ঝড় থিকে তোমারে আগল
দ্যা রাখুম মাগো।” সেদিন থেকে আর রাতে কুলপতির চোখে ঘুম নামে নি। সারারাত জেগে
মেয়েকে আলগে রাখে।
ফলে নন্দী ড্রাইভার প্রথম যখন আসে মিতির জীবনে সহজ ভাবে নেয়নি শুরুতে
কুলপতি। সে মিতিকে বিয়ে করবে বলেছিল। রোজ সকালে ওভারব্রীজের নিচে
এসে সে তার লরিটি মেরামত করত। গায়ের রং মিতির থেকে অনেক ময়লা হলেও ও যখন
বুশসার্টটি খুলে কাজ করত ওর বুকের কোঁকড়ানো রোম থেকে পায়ের পেশি সবেতেই মিতির চোখ
এক দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং পৌরুষের সন্ধান পেত। কুলপতি প্রথমে মিতিকে আগলে রাখবার
চেষ্টা করত। কিন্তু পরে যখন দেখল ও যতই মিতিকে মানা করে মিতি ততো লজ্জাতে লাল
হয়—সে হাল ছেড়ে দিয়ে ড্রাইভারের খবর নিতে শুরু করে। ওর বন্ধু নিবারণ ড্রাইভারের
সঙ্গেও কথা বলে। কুলপতি আবিষ্কার করে, “ শীতের শেষে বসন্তের সমাগমে বৃক্ষ-লতায়
সোনালী কুঁড়ির উদগমের মতো মিতির দেহে বসন্ত জেগে উঠেছে।” সামান্য পানের নেশা ছাড়া
ছেলেটি মন্দ নয় বলে সে নিশ্চিত হলো। মনে হলো, ওকে ঘিরে যদি মিতি তার জীবনের
সার্থকতা খোঁজে পায় তবে সে বাধা দিতে যাবে কেন? অপেক্ষা করতে থাকে কবে সে তার কাছে
প্রস্তাব নিয়ে আসবে। এক সন্ধ্যেবেলা এলোও, কুলপতি তখন বংশীর মচকানো পায়ে তেল মালিশ
করছিল , “আপনি মত দিলে আমরা বিয়ে করবো।” কুলপতি ওকে সোজা , হ্যা বলে নি। বরং মেয়ের রূপের বানে
গৌরবান্বিত বাবা ‘কার মাইয়া সেই দিশাতো পান নাই’ বলে ওকে নিয়ে গিয়ে ঢিবিতে বসে।
মিতির দিকে তাকিয়ে দেখতে বলে কেমন দেখায়?“সূর্যের মলিন আলোয় মিতির মুখের এক পাশ
দেখা যাচ্ছিল। আরক্ত গাল, নাক, ঠোঁট।মৃদু বাতাসে চুলগুলো একটু একটু কাঁপছিল।
কেমন দেখতাছেন?
নন্দী এতক্ষণ মিতির দিকে এক দৃষ্টে চেইয়ে রয়েছিল। কুলপতির প্রশ্ন শুনে
সংক্ষেপে বলে, সুন্দর।” কুলপতি বলে, “হো সুন্দর । কিন্তু...” নন্দীর হাত চেপে ধরে
কিছু টাকা চেয়ে বসে। সেই টাকাতে সাবান , তেল আর একটা শাড়ি নিয়ে আসবে। কথা দিল, “
...শুভকার্যের আগেই আমি শোধ কইরতে দিমু।” নন্দী পনেরো টাকা দিয়েছিল।
পরের দিন নিজের হাতে সাবান মাখিয়ে স্নান করে দিয়েছল চিল ধুয়ে দিয়েছিল কুলপতি। আর
দু’জনকে দু’জনার থেকে বিদেয় নিতে হবে ভেবে দু’জনেই বুক খালি করে কাঁদল। মিতি
কুলপতির পা দু’খানা জড়িয়ে ধরল, “ বাবা গো! তোমারে ছেইড়ে আমি থাকুম ক্যামনে কও?”
“কুলপতির সমস্ত অন্তর কেঁদে উঠলো। আর সঙ্গে সঙ্গে বিগত দিনের সুখ-দুঃখের স্মৃতি
ভেসে এসে তার সত্তাকে ছুঁয়ে গেল! তারও তো মা ছিলেন, বাবা ছিলেন। তাকে ছেড়ে তাঁরা
চলে গেছেন। পথের সাথী ছিলো মালতী। সেও চলে গেছে। তবুও তো কুলপতি বেঁচে আছে। কেমন
করে বেঁচে আছে এ প্রশ্নের উত্তর কি কুলপতি জানে?” কুলপতিও কেঁদে ফেলে বলে, “ মাগো
উই কথাডা ক্যানে জিগাও। জবাব যে আমি জানি না। মাঝে মাঝে সন্দ হয় বুঝি বেঁইচে থাকতে
হইলে ছেইড়েই বাঁচতে হয়। ...”
একদিন নন্দী ড্রাইভার এই
টিপ উপহার দিয়েছিল তাকে। রাত সাড়ে আটটার গাড়ি চলে গেলে নন্দী এসে মিতিকে শহরে ঘুরে
আসবে বলে বায়না ধরল। মিতি ইতস্তত করল, কুলপতিও সম্মতি না দিলেও মানা করল না, অনেক
রাত অব্দি রিক্সাতে করে শহরে ঘুরে এরা । একটা মিষ্টির দোকানে মিষ্টি খায়, বাবার
জন্যেও দু’টো মিষ্টি নেয় মিতি। পানের দোকান একটাতে আয়নাতে মিতিকে দেখে তার মনে হলো
টিপ ছাড়া ওর সৌন্দর্য খুলছে না। টিপ নিয়ে এ গলি ওগলি ঘুরে একটা বাড়ির সামনে এসে
দাঁড়ালো রিক্সা। সে বাড়ির তেতালাতে এরা রাত কাটালো। সেদিন খানিক মদও খেল নন্দী ওর
সামনেই। ভোরে বাড়ি ফিরবার পথে মিতিকে কাঁদতে দেখে সে আশ্বস্ত করল দিন কয়েকের মধ্যেই তারা
বিয়ে করছে। আর দেখা হয় নি দু’জনের। হয়ে গেছে অনেক দিন। মিতির ছেলে হলো। রাতের
অন্ধকারে ওর বুকের উপর হাঁটু গেড়ে ওকে হত্যা করে পানাডোবার কাছে পুঁতে ফেলেছিল ।
কুলপতির অজান্তেই। জানবার পরে যখন সে জিজ্ঞেস করেছিল, এটা করল কেন? গর্জে উঠেছিল
মিতি। এই পানাডোবাতে একদিন শুয়ে পড়তে পারত মিতি, শুয়ে আছে এমন অনেক শিশু। এখন শুয়ে
আছে মিতির সন্তান।
কৌশল্যা আর তার বুড়ো বাবার কথাঃ কৌশল্যাদের বাড়ি তখনকার
দক্ষিণ বিহারের কোথাও। এখনকার ঝাড়খণ্ড। অতি দরিদ্র আদিবাসি বাবার মেয়ে সে। মা নেই।
এক রাতভোরে হটাৎ বাবা ওকে ডেকে জাগিয়ে বলে কিনা, “...গাং সিনানে যা।” গ্রামের
কাছেই গাং। বান্ধবীদের সঙ্গে গিয়ে স্নান করে এলে বাবা একজোড়া চাঁদির খাড়ু, নানা
রঙ্গের রেশমী চুড়ি আর একটা লাল টকটকে পাটের শাড়ি বের করে দিল। ‘দুপুরে বর এলো।
তাড়ি খেয়ে বেহুঁস।” অসমের কোন এক চা-বাগানের সর্দার বর বিয়ের রাতেও শুয়ে শুয়ে
আবোলতাবোল বকছিল নেশা তার তখনো কাটেনি। বিয়ের দিন কয় পরেই সর্দার চলে গেল । আর তার
খবর করে নি। এক ছেলে হলো, তাকে খবর দেয়া হলো। তবু সে সাড়া দিল না। বছর তিনেক হয়ে
গেল। বাবাও পঙ্গু হয়ে গেলেন। সংসার আর টানতে পারছিলেন না। শেষে সেই পঙ্গু বাবাকে
নিয়ে নিজেরাই দিনজানে যাওয়া ঠিক করল। কাটিহার স্টেশনে গাড়ি পাল্টাতে হয়। সে গাড়ি
থেকে নামার সময় পড়ে গিয়ে বাবা ভীষণ চোট পেল। অচেতন অবস্থায় কিছু লোক বাবাকে
প্ল্যাটফর্মের এক পাশে রেখে গেল। গোটা দিন উদ্বেগে, খিদেয় ছেলে কোলে নিয়ে কেঁদে
পার করল কৌশল্যা। কেউ ফিরেও তাকালো না। রাত্রিবেলা এক মজুর এসে
তাদের কথা সব শুনে নিজের বাড়ি নিয়ে গেল। লোকটি খুব খাটতে পারত, রোজগারও করত ভালো।
কৌশল্যা সেখানেই থেকে গেল। কিন্তু একদিন সেও পালিয়ে গেল। জানা গেল, সে বিহারে তার
দেশের বাড়িতে চলে গেছে। ওখানে তার বৌ ছেলে মেয়ে সবই আছে। কিছুদিন অপেক্ষা করে আবার
পথে নামল কৌশল্যা। এবারে তার সঙ্গী আরেকটি ছেলে, সেই মজুরের দান। এই দ্বিতীয় ছেলের
জন্যেই সর্দার তাকে ঘরে তুলবে কিনা, এই নিয়ে তার অবিশ্বাস আরো বড়। পথে গাড়ি
পাল্টাতে হয়। ওদিকে বাবাও অচল প্রায়। তাতেই এই ব্রজের তলাতে এসে উঠেছে আগের দিনে
বিকেলে। খাবার নেই দাবার নেই, এমনকি হাঁপানির রোগী বাবার বুকে ডলে দেবার জন্যে
তেলটুকুও নেই। খালি হাতেই ডলে দিচ্ছিল কৌশল্যা। পাশে কচি শিশু দু’টো উপোস।
দিনি-যশোমতীর গল্পঃ দিনির বৌএর নাম যশোমতী।
চরণদাস আর যশোমতীর সঙ্গে দিনির দেখা হয়েছিল মুকুন্দপুরে। চরণদাস সেদিন বাজারে দোতারা বাজিয়ে গান করছিল।
মাথায় জটা, মুখময় পাকা দাড়ি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গায়ে আলখাল্লা। সে
গাইছিলঃতোমার পথ ঢেক্যেছে মন্দিরে মসজিদে;/ও তোর ডাক শুনে সাঁই চলবার না পাই/আমারে
রুইখে দাঁড়ায় গুরুতে মুরশেদে।।
দিনি হাটে ঘুরে ঘুরে এদোকান ওদোকানে চালটা ডালটা চুরি করে করে পেট চালাতো।
চরণ দাসের গান শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, মনে হচ্ছিল এভাবে চুরি করে পেটা চালানোর মানে
হয় না। চরণের পাশে পটের ছবির মতো নির্বিকার বসে ছিল যশোমতী। গান শেষ হলে ওরা যখন
চলে যাচ্ছিল, দিনি এসে পথ আটকালো। চেলা হবার ইচ্ছে জানালো। চোখের কোঁকড়ানো চামড়ার
ভাঁজগুলো অনেক কষ্টে সরিয়ে দিনিকে সেদিন দেখেছিল ষাটোর্ধ চরণদাস। আর দিনি
তাকাচ্ছিল যশোমতীর চোখের দিকে। দীর্ঘ ছ’বছর সে ঘুরেছে ওদের সঙ্গে। যশোমতির প্রতি
আসক্তির কথা বুঝেছিল চরণদাস। প্রথমদিকটায় ধমকে ছিল। অভিশাপ দেবার ভয় দেখিয়েছিল।
যশোমতিই বলেছিল, দিন কয় সবুর করতে বুড়ো আর বেশি বাঁচবে না বেশিদিন। দিনি অপেক্ষা করতে রাজি হলো
না , যশোমতিকে নিয়ে পালাবার তালে রইল। একদিন রামপুর হাটের থেকে রাতের বেলা ওরা
দু’জনে পালালো। সারা রাত পায়ে হেটেঁ একটা নদী ঘাটে এসে এরা খেয়ার অপেক্ষা করছিল।
দিনি দেখে যশোমতী কাঁদছে। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে যশোমতী আরো কাঁদল কোনো উত্তর
করল না। বেলা হলে খেয়ানী ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে দিনিকে ডাকল। যশোমতী উঠল না। দিনি
বিরক্ত হলে যশোমতী কাতর অনুরোধ জানালো তাকে চরণদাসের কাছে নিয়ে যেতে তাকে ছাড়া
বুড়ো বাঁচবে না। ওর ফিরতে এলো, চরণদাস তখন গাইছেঃ ভোলা মন,/তুমি কার বা আশায়
রইলায় বইয়া।/তুমি কি লইয়া সংসার বান্ধিলে...
চরণদাসের কোলে লুটিয়ে পড়ে
ক্ষমা চেয়ে অনেক কেঁদেছিল যশোমতী। সেদিন থেকে চরণদাস পালটে গেছিল। নিজেই দিনিকে
ডেকে এনে আবার সঙ্গী করে ফেলে । দিনি ওদের সঙ্গে আবারও ঘুরে বেড়ালো অনেক বছর। পায়ে
ব্যথা হলে চরণ দাসের পা টিপে দিত, যশোমতীর রান্নার আয়োজনে হাত বাড়াতো। স্থানান্তরে
যাবার সময় সমস্ত গেরস্থালীর জিনিস নিজের কাঁধে তুলে নিত। চরণ দাস মারা গেলেও
বহুদিন তারা দু’জনে এই করেই বেড়াতো। কিন্তু দিনির গলায় সুর নেই, তাই গান জমত না।
আয় বন্ধ হলো। শেষে এই বাজনা তৈরির কাজে হাত দিল] এভাবে ঘুরতে ঘুরতেই এই দম্পত্তির
এখানে এই পুলের তলাতে এসে পড়া। তবে সেও বিপদে পড়ে। যশোমতির কোলে তখন সন্তান। শীতে
বাঁচানো কঠিন হয়েছিল। সময়টা ছিল রাত। প্রচণ্ড শীতে মনে হচ্ছিল জলের মাছ বুঝি ডাঙ্গায় এসে আশ্রয়
নেবে। কুলপতি এই ঠাণ্ডার থেকে শিশু মিতিকে বাঁচাতে নিজের গায়ে ছাই মেখে , দুটো
ধুতিতে মিতিকে জড়িয়ে বুকে চেপে রেখেছিল। দিনি এবং দিনির বৌ কাঁপছিল
শীতে। দিনির কোলে বড় মেতে মেয়ে মনা। দেখে, কুলপতির মনে হলো-- ঠাণ্ডাতে জমে গেছে।
গায়ে ছাই ডলে আর মিতির জন্যে তুলে রাখা মধু খাইয়ে বাঁচিয়েছিল কুলপতি মনাকে। সেই
থেকেই সে এখানে সবার চিকিৎসক হয়ে গেলো। সেই মনা মিতির সঙ্গেই বড় হলো, দু’জনে বেশ ভাবও
ছিল। কিন্তু ক্রমেই সে যখন বাবুদের সঙ্গে ঢলাঢলি শুরু করল মিতিকে ওর থেকে সরিয়ে নিল কুলপতি। সারাক্ষণ
ওর উপরে চোখ, তখন থেকে সত্যি সত্যি রাতের ঘুম গেছে কুলপতির।
সেই দিনির দ্বিতীয় সন্তানের
জন্ম এবং কুলপতির কোবরেজি দিয়েই, আমাদের উপন্যাসের শুরু, সে আগেই লিখেছি। পাশেই
বসে আছে কৌশল্যা ওর হাঁপানি কাতর আর উপোসী দুই সন্তানকে নিয়ে। যারা আগের দিনে
বিকেলে এসে এখানে পৌঁছেছে। মনা চলে গেছিল বলেই দিনি এবারে চাইছিল ছেলে, যে তার
রোজগারে সহায়ের হাত বাড়াবে। তা ,নইলে আর তার উত্তরাধিকারের ভাবনা কি? দিয়ে থুয়ে
যাবার আছেই কি! মনাকে সে রাখতে পারেনি, কৌশল্যাকে রাখা নিয়ে ওর বাবার যত উদ্বেগ,
আর মিতির কী হবে-- এই প্রশ্ন নিয়ে কুলপতির যত ভাবনা। তিন গল্পের ধারা এসে এইখানে
এক সুতোতে বাঁধা পড়েছে। এবং নিজের মতো করে পরের প্রায় আঠারো ঘন্টাতে একটা সমাধানে
গিয়ে ফুরিয়েছে। বোঝাই যায়, লিখবেন বলেই লিখতে বসেন নি লেখক। আধার এবং আধেয়র সামঞ্জস্য
নিয়ে শুরু থেকেই ছিল তাঁর সযত্ন ভাবনা। একজন লেখকের যাত্রাতো শুরু হয় নির্মাণ
থেকে! নির্মাণকে এর পরে তার তাৎক্ষণিক কোন দরকার থেকে বের করে দিয়েই তিনি স্রষ্টা।
রূপ থেকে অরূপে পৌঁছুবার এই বোধটুকু নির্মল চৌধুরীর ছিল পাকা।
তারপরে কী হলো...
মূল গল্পটি কিন্তু
কুলপতিরই। মাথায় এক রাশ জটাধরা ঝাঁকড়া চুল, টিকালো নাক, গলায় তুলসীর মালা, ডানহাতে
লালসুতোতে বাঁধা অনেকগুলো তাবিজ কবচ আর পরনে হলদে লুঙ্গি—এই চেহারা কোবরেজ
কুলপতির। এক পীর সাহেব একবার এসছিলেন, তাঁর দিয়ে যাওয়া আলখেল্লা একটাও রয়েছে। মাঝে
মধ্যে পরে। অর্থাৎ এক পুরো দস্তুর অবতার পুরুষ সে এই পুলের তলার সংসারে। একদিকে বৌএর বিয়োনো দেরি
হলে দিনের আয় কমবে বলে দিনির উদ্বেগ, অন্যদিকে কৌশল্যার বাবা কাশতে কাশতে এই মরে
কি সেই মরে, তখন সে নাজন্মানো শিশুকে , কুলপতি এই বলে আবাহন জানিয়ে নিজের জাত
চিনিয়ে দেয়, “আসেন মশয়, আসেন। ওক্ষণ আর ঠাট্টা করনের কাম নাই। আগে তো নাইমে আসেন
মাটিতে—পিরথিমীর ঠাণ্ডা মিঠা হাওয়া লাগুক শরীলে। তারপর যখন চক্ষু মিইলে ঠিকে ঠাকে
চাইবেন তখুন মনে হইবো, ধুত্তুরি! খামখা মায়ের গর্ভে ওত বেলা ধইরে ঠাট্টা মজলিশ
করছি...।” “...মেইয়ে হওনের চিকিচ্ছা কি?...” বলে দিনি যখন কবিরাজের ভিজিট না দিয়ে
চলে যায় শহরে তখনো সে নির্বিকার। বেশি কিছু ছিল না ভিজিট, পাঁচটি মাত্র সিগেরেট আর
দু’বেলার চাল। উলটে হাত ধুয়ে থুয়ে কুলপতি জিজ্ঞস করে মিতিকে যদি ওর বুকে কিছু দুধ
আছে, দিনির সন্তানকে খাইয়ে আসতে। ওর মায়ের বুকে নেই। মিতি কেন পারবে, এই কৌতুহল
মেটাতেই গল্প একই সঙ্গে প্রবেশ করে মিতিকে কুড়িয়ে পাবার প্রথম দিনে আর মিতি-নন্দি ড্রাইভারের
প্রেমের গল্পে। কিন্তু যদ্দূর দরকার ততটুকুই। বাকিটা রয়ে সয়ে ঠিক যখন দরকার বলে গেছেন লেখক,
কৌতুহলকে চাগিয়ে দিতে দিতে। সেখানেই দারিদ্র্যের সংকীর্ণতার সঙ্গেও
আমাদের আলাপ হয়, হয় ঔদার্যের সঙ্গেও। মিতিকে পাবার প্রথম দিনেই ছেলের মা কোকিলাকে গিয়ে
বুকের দুধের জন্যে ধরলে প্রথমে সে মানা করেছিল, পরে ছ গণ্ডা পয়সাতে রাজি হয়েছিল।
তেমনি অনেককে জুটিয়েছিল কুলপতি মিতিকে দুধ খাওয়াবার জন্যে। এদের মধ্যে কোকিলা কয়লা
জোগাড় করতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মরেছে। ফুলমতী এক রাতে পালিয়ে গেছে। রাজরাণী গলায় ছুরি
বসিয়ে আত্মহত্যা করেছে। রামচরণের বৌ পরপুরুষের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। তাদের সবার কথা মনে রেখেছে
কুলপতি, এগুলোই মিতির ঋণ। ‘ এই সংসারে সবাই সবার কাছে ঋণী”। দেখা যাবে মরতে মরতেও সেই ঋণ মিটিয়ে
যেতে ভুল করছে না মিতি কোনো। কুলপতির দীক্ষা। কোত্থেকে পেল এই প্রেরণা সে?
কাকাদের ষঢ়যন্ত্রের কোন প্রতিরোধ করেছে বলে কোন সংবাদ নেই কুলপতির। কিন্তু মালতি
চলে যাবার ব্যাথা আছে। অর্থাৎ ক্রোধ কখনোই বিজয়ী হতে পারে না কুলপতির ভালোবাসার
কাছে। এই ভালোবাসার কোলে কুকুরের শীতকাতর বাচ্চারাও আশ্রয় পায়। একবার সে বংশীকে
বলছে, এই সংসারকে “ আমিও কম ভালোবাসি না গো। মুখ ফুইটে কইতে পারি না সিই কথাডা...।” এটা সে চিকিৎসক বাবার
উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে বলেই করবার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, সেরকম এক বিপন্ন
রোগীকে বাঁচাতে গিয়েই তার মালতীর সামনে প্রথম উলঙ্গ আবির্ভাব। দেখে শুনে মনে হবে
না, এই লোকটি কোন বাস্তব জগতে বাস করে বলে। তবু বাস্তব জগতের লোকজন বিপদে পড়লে সেই
পাশে দাঁড়ায় সবার আগে। অথচ, খুব যে একটা ঠাকুর দেপতা মানা লোক, তাও না। তাবিজ কবচ
দিলেও, শনি মঙ্গলবারের বিশ্বাসটা নেহাৎ বাবার থেকে শুনেছে বলে। যা উপন্যাসের শেষে
এসে ধ্বসে পড়ে। কিন্তু যে বিশ্বাসটি যায় না সে হলো, পরের জন্মে বিশ্বাস। একটাই তার আকাঙ্খা, সে
জন্মে মিতির সন্তান হয়ে জন্মাতে চায় সে, পুলের তলার এই সব মানুষেরই ভিড়ে। তখন
তাদের জন্ম আর এমন দুঃখের হবে না।
এক রাতে দু’দুটো দুঃসংবাদে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে
গেছে মিতির। প্রথম সংবাদটি ছিল নন্দী ড্রাইভারের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র। মিথ্যেই দিয়েছে
বংশী। দ্বিতীয় জানিয়েছিল কুলপতি যখন মেয়েকে পাশে নিয়ে গল্প শোনাচ্ছিল মালতির। মিতি
আসলে ওদের সন্তানই নয়। মিতি যখন কাঁদছিল, কারণ না বুঝতে পেরেই কুলপতি বলছিল, “শেতল
হইয়ে বিরাম লও। এ্যাই জন্মের লেগে মনে দুঃখ নিও না। আবার আমরা আসুম; মায়ে সন্তানে
আবার আমরা আসুম। তখুন...তখুন...” মিতির মৃত্যুর পরেও
রাজরানির আত্মহত্যার প্রসঙ্গ তুলে লেখক মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, কুলপতির আর্তি, “ য্যানো
আসি, আবার এ্যাই পিরথিমীতে আসি। তখুন এ্যাই, জন্মের কথা স্মরণ কইরে আমরা সক্কলে
মিলে য্যানো হাসি, প্রাণ পুন্ন কইরে হাসি।” মরতে চলেছে মিতি। নিতান্ত
বাবার বিশ্বাসকে সম্মান জানাতে বলে যাচ্ছে, “থাউক! তোমারে শেষবার দেইখ্যে যেইতে
পারলাম না। আমি তোমার কেউ না কিন্তু... তোমার চরণ আমার মাথায় ঠ্যাকাও, তোমারে
প্রণাম কইরে যাই। আবার যখুন...।” নিহিতার্থ কিচ্ছু না বোঝে কুলপতি মিতির শেষ
কথাটিকে টেনে বলে, “ আবার য্যানো আসি, তোমার কোলের সন্তান হইয়ে আসি মাগো” মিতির শব সৎকার না করেই কৌশল্যার প্রতি কর্তব্যের
ডাকে কুলপতির স্টেশনে যাওয়াটা অবিশ্বাস্য ঠেকে। এবং বসতির লোকেদের সৎকার করবার
অনুরোধ জানিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলে এই জন্মের জন্যে ‘শেষ নমস্কারডা’ দেয়াকে মনে হয়
পুরোটাই উন্মাদনা। এই জায়গাটাকে সামাল দেয়া কোন সাধারণ লেখকের পক্ষে প্রচুর কঠিন ছিল। কিন্তু দিনির
প্রশ্নের উত্তরে যখন কেউ না শোনবার মতো কৌতুক করে নিজের মনেই বলে,
আবার আসবে এখানে সে। তখন কেউ চিনবে না তাকে, “...এই পুলের তলের সনসারডারে দেইখে
যামু, দেইখে যামু গো।”আর খানিক পরে লেখকও সরাসরি যোগ দিয়ে লেখেন, “কুলপতি আবার
আসবে। জাতিস্মরের মতো বিগত জন্মের কথা স্মরণে রাখবে...।”--- তখন এটা স্পষ্ট হয়ে
যায় সুখের আগামী জন্মটা কুলপতি নিশ্চিত করতে চায়। এই জন্মের প্রতি তাই দৃশ্যত
এভাবেই সে নির্মোহ হতে পারে। মিতির প্রতি তার যত মমতা, মুহূর্তে তা কৌশল্যার জন্যে
প্রতিস্থাপিত হয়। পরজন্মের প্রতি বিশ্বাসটি তার এতোই প্রবল যে একসময় আশ্চর্য এক প্রশ্ন করে, “
দেখি আমার কাছের সকল মানুষ্য কান্দছেন। কিন্তু ক্যানে? ক্যানে?” কুলপতির এই
প্রশ্নটিই বোধ করি লেখকেরও, উত্তরের সন্ধানেই এই উপন্যাস! প্রশ্নটির দ্বিস্বর
নিবিষ্ট পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। এই জন্মের প্রতি প্রবল প্রতিবাদ, আর জন্মের প্রতি
প্রবল আশ্বাস যুগপৎ উচ্চারিত হয়।
গল্প এগুতে থাকে, ছোট বড়
আরো বহু গল্পের সঙ্গে জুড়তে থাকে। আর লেখক উন্মোচন করে চলেন কুলপতির হৃদয় রহস্য।
এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই গড়ে উঠতে থাকে কুলপতি। এই যেমন হলধরের গল্পে। কৌশল্যার বাবার
বুকে ডলে দেবে বলে কুলপতি নিজের সংগ্রহ থেকে খানিকটা তেল সিগেরেটের
কৌটোতে করে নিয়ে গেছিল পুলের তলার এক সাধুর ধুনির পাশে। দিনকতক এই সাধু এখানে আস্তানা গেড়েছে। সে তখন
গাইছে, “ তুমি সোনা থুইয়া রাঙের ব্যবসা রে/ মন করো কার লাগিয়া/ ও মন পাগেলা রে...” এই সাধুও আসলে পুলিশের তাড়া
খেয়ে গা ঢাকা দেয়া চোর। চুলে দাড়িতে মুখ ঢাকা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে
সিঁদুর লেপ্টে আছে। এক সন্ধ্যে বেলা যখন কেউ ফেরে নি সে এখানে এসে ধুনি বিছিয়ে
আগুন জ্বালবার ব্যবস্থা করছিল। হঠাৎ খটকা লাগতেই কুলপতি গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনে
কেডা?” সাধু জানায় সে এসছে পরশুরাম থেকে । পরশুরাম কুণ্ড অসমের তিনসুকিয়ার অদূরে
অরুণাচল প্রবেশের একটি পুরোনো শৈবতীর্থ। বিশ্বাস না করে কুলপতি বলেই
ফেলে, ‘আমার তো মনে হয় আপনেই আমাদের সিই হলধর।” হলধর এখানেই থাকত। বছর ছয় আগেই
পুলিশের তাড়ায় পালিয়েছিল। আবার ফিরে এসছে। কুলপতির নজর এড়াতে পারেনি। হলধর তার
পায়ে ধরে বলেছিল, কাউকে যেন না বলে। কুলপতি বলতে যায় নি। “কারে আর কমু কন। যার যা
হওনের কথা ছেল কেউই তো হইতে পারি নাই। তাড়নায় সকলেই এইখেনে এইসে রাজ্য পাতছি, এই
পুলের তলে।” এই যে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অন্য কিছু হয়ে পড়া, এমন কি চোরও –এও যেন
নিয়তি শুধু। অন্যায় নেই কিছু, কোনোখানে। এমন কি বাদসার যাদুবিদ্যার
আসরে লক্ষণের ষঢ়যন্ত্রে যে রাতে মিতিকে নিয়ে টানাটানি পড়েছিল, সে রাতে লক্ষণের
উপরে রাগ চড়েছিল। পরদিন লক্ষণকে কিছু বলবে বলে একবার ডেকেওছিল কুলপতি। কিন্তু সে রাগ উবে
যায়। কেননা, এখানে সবাই নিজের পরিচয় হারিয়ে অন্য কিছু হয়ে গেছে। মাথার উপরের
দুনিয়াটাকেতো দানব বলেই মনে হয়, এই ইঙ্গিতই কি দেয় না যখন রাতে কৌশল্যার শিশু
সন্তানকে শীতের থেকে বাঁচাতে পাশে নিয়ে শুয়ে মাথার উপরের ওভারব্রীজের কড়ি
কাঠগুলোকে দেখে তার মনে হয় ময়দানবের হাতের আঙুল। কারণটি যে খুব ভালো জানে সে
তা নয়, শুধু মনে হয় যেন এটাই চিরদিনের সত্য নয়। তাই সে কান্না সামাল দিয়ে হাসতে
পারে, কথায় কথায় সবাইকে হাসতে বলে, যদিও সে যে খুব রসিক লোক তা নয়। মালতির মৃত্যুর পরে মিতিকে
নিয়ে বেঁচে থাকা তার এই বিশ্বাসকে প্রবল করে থাকবে। এই নিয়ে তার ভাবনাটা রীতিমত
দার্শনিক। সে ভাবে, “মানুষের হৃদয়ে নিগূঢ় কেন্দ্রস্থলে ভালোবাসার শীতল জলে টলমল এক
হ্রদ আছে। সেই হ্রদের জল নানান জনকে শাখাপ্রশাখা করে নিয়ে নিজের অজ্ঞাতসারেই যে
ছড়িয়ে পড়ে কুলপতি তা ঠিক বুঝে না। বুদ্ধি দিয়ে, যুক্তিও দিয়ে হৃদয়ের এই একটানা
ব্যাপ্তির কথা কুলপতি বুঝতে পারে না; পারলে হয়তো সান্ত্বনার স্পর্শ পেতো মনেঃ না
বুঝে যে অভিভূত হয়ে যায়। ভাবে , এ কি অবিবেচনা, কি নির্বুদ্ধিতা তাকে কোন নিদারুণ
পরিণতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার কথা ছিল কাশী বৃন্দাবন, না গিয়ে এখনো এই
দীর্ঘদিন পরেও এখানে পড়ে আছে কেন? ঐ মিতির জন্যই তো!” মায়ের পরিচয় পাবার পরে মিতি যখন
আবার জিজ্ঞেস করে ,“...মা বইলে আর ডাক ক্যান?...” কুলপতির উত্তর, “ সিই কথাডা
আমারে জিগায়ো নাঃ আমি কিছু জানি না মাগো! না মিত্তিকা, ভেইবে ছিলাম, চাইলে কাশী
বেন্দাবন। তখুন তুমি মিটমিট কইরে যুঁই ফুলের পেরায় আমার পানে চেইয়ে থাকলে। টুকুন
টুকুন কইরে তুমি ডাগর হইলে। মনে হইলো তুমি য্যানো আমার সিই সতের সতীর মাঠ---এ্যাই
পিরথিমীতে তোমারও কোন দিশা নাই। তখুন মনে হয়, কান্দ ও কুলপতি, কাইন্দে লও। আমি
তখুন...।” কুলপতির চোখ থেকে ঝরঝর করে জল নেমে আসে। কুকুরগুলো শুয়ে আছে। ভাঙা
পায়ের যন্ত্রণাতে বংশী জোরে কোঁকাচ্ছে। বংশীর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কুলপতি নিজেকে আবার সংযত করে খানিক। আবার সেই
মিতির কাছে ‘এট্টাবার’ হাসির আবদার। বোঝাই যায় নিজের কান্নার চোটে অন্যের কান্না
বেড়ে যাক সেরকম কোনো ইচ্ছেই নেই তার। মিতিকে তার সময়ে অসময়ে হাসতে বলবার আব্দারটা
প্রায় বাতিকের মতো মনে হয় কখনো। কিন্তু যদি একই সঙ্গে এও মনে রাখি যে, সে নিছক
ভাবুক পুরুষ কিম্বা বাবা নয়, মিতির আসলে সে মাও—তখন আর বিভ্রান্তি থাকে না। মিতি
যখন মারা যাচ্ছে, ওদিকে তখন ভোরের আকাশে সূর্য উঠছে। “আবার আকাশের দিকে তাকালো
কুলপতি। কালো মেঘ দু’দিকে সরে যাচ্ছে আর মাঝখান দিয়ে সোনালী আলো এসে পৃথিবীতে
নেমেছে। যেন সোনায় মোড়া একখানি পথ মাটি থেকে উঠে আকাশের কোন এক দেশের উদ্দেশে চলে
গেছে।” মিতির যাত্রা পথে এই অপূর্ব বর্ণনা কুলপতির প্রতি আস্থা না জাগাক এক করুণা আর শ্রদ্ধা জাগিয়ে তোলে,
সেই সঙ্গে ভাষা এবং বিষয়ে লেখকের মুন্সিয়ানার প্রতি মুগ্ধতা। একটা বিষয়েই তার
সমস্ত আস্থা উবে যায়, সে হলো চিকিৎসা। এই চিকিৎসা দিয়ে সে কৌশল্যার বাবাকেও সুস্থ
করে তুলতে পারে নি, না পেরেছে মিতিকে বাঁচাতে। কৌশল্যাকে বিদায় জানিয়ে সে বলে,“
তুদের সঙ্গে আর দ্যাখা সাক্ষাৎ হইবো না, চিকিচ্ছা আর করুম না রে।” কবিরাজি
চিকিৎসার এরপরে আর দরকারও ছিল না তার, এটি শুরুও করেছিল নিজের নয় , বসতির মানুষের
দায়ে। সেই বসতিই ছেড়েছে, সুতরাং দরকারটাও রইল কই আর? কিন্তু তার আসল কবিরাজি যে প্রেমের
সেটি আর সে ছাড়তে পারল কৈ? কোনো রকম শাস্ত্রীয় সংস্কারে বদ্ধ না হয়েও কুলপতি শেষ
অব্দি এমন এক ফকিরের চরিত্র হিসেবে বিকশিত হয় যার বৈষয়িক নৈরাসক্তি এবং মানবতার প্রতি কর্তব্যবোধ
অত্যন্ত কঠোর। এর জোরেই শেষ অব্দি কৌশল্যার আস্থা অর্জন করে ফেলে সে । মিতির জন্যে তুলে রাখা ওর
মায়ের দেয়া বালা জোড়া কৌশল্যার হাতে তুলে দিলে এই জন্মকে নিয়ে প্রবল আতঙ্কিত
আত্মকেন্দ্রিক কৌশল্যার বুড়ো বাবাকে প্রতিস্থাপিত করে ফেলে কুলপতি। চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে যাবার
ইচ্ছে জানিয়ে কৌশল্যার কাতর মিনতি, “ওগো ! তুমি হামার ধরমের বাপ! হামাকে নামায়ে
লও। হোথায় আমি যাব নাই! হামি তোমাদের ঠিনেই থাকবো গো!”
দুপুর বেলা যে মিতি মুখে এক
গাল ভরা স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে পরনের জামা সেলাই করে, বাপ হতে যাওয়া দিনির উদ্বেগ দেখে
আর বাবার রসিকতা শুনে কৌতুক বোধ করে সে কী করে, রাত ভোর হবার আগেই বিষ মুখে দেয়
--মোটা দাগে দেখলে অবিশ্বাস্য ঠেকে বটে। কিন্তু এই বিস্ময়তো আরো বাড়ে, যখন জানা
যায় মাত্র মাসখানিক আগেই এই মেয়ে নিজের গর্ভজাত সন্তানের বুকে পা চেপে ধরে
পানডোবার নিচে মেরে ফেলেছে। দ্বিতীয় বিস্ময় অবশ্যি পাকা হয় না , কারণ আমরা জেনে
যাই সে আসলে কুলপতির কন্যা । তার পক্ষে অন্যরকম আচরণই ছিল বেমানান। গল্পের শুরুতেই
কৌশল্যাকে কাঁদতে দেখে সেও এসে বাবারই মতো বলছিল, “পিতার অসুখ দেইখে দারুণ ভয়
পাইছেন। তার লেগেই এই কান্দন...আপনে হাসেন দেখি। এ্যাই দেখেন আমিও হাসতাছি।” তাহলে আত্মহত্যাটাই মানালো
কী করে? এ হলো বাস্তববোধের বিড়ম্বনা—যেটি মিতির ছিল, কুলপতির প্রায় ছিল না বললেই
চলে। অথবা উলটো করে বললে, বৈষয়িক জীবনের প্রতি মোহ মিতি ততটা ছাড়তে পারে নি, যতটা
ছেড়ে বেঁচে গেছে কুলপতি। সেই রাতেই বিষ তাকে নিতে হয়েছে গল্পের দায়ে। কৌশল্যা
যাবার আগেই তাকে মরতে হবে। আর কৌশল্যার তাড়া আছে। বাবার কিছু হয়ে যাবার আগেই
দিলজানে স্বামীর ঘরে পৌঁছুতে হবে। আমরা আগেই লিখেছি, কৌশল্যা জুটি মিতি জুটির বিপ্রতীপ চরিত্র। এদের
গল্পও তাই। এক জুটি চলে গেলে অন্যজুটির উপন্যাসে কোন কাজ থাকে না। এই দু’টো ব্যাখ্যাই পুষ্টি পায়
লেখকের বর্ণনাতে, “...মিতির নীরব হাসি আর কৌশল্যার সরব কান্না, এ দু’এর মাঝে আছে
এক অদ্ভূৎ মিল। না, মিল ঠিক নয় । এক আশ্চর্য প্রতিযোগিতা। কৌশল্যা কাঁদে কেন?
এর পেছনে রয়েছে এক বিশ্বাস। এই বিশ্বাস যে তার কান্না শুনে কারো না কারো হৃদয়
দয়ার্দ্র হয়ে উঠবে। আর মিতি? সে কাঁদে না কেন? কুলপতি তাকে কাঁদতে দেয় না কেন?
কান্নার সময় এলেই তাকে হাসতে হয় কেন? এই জন্য যে তাদের জীবনের সকল বিশ্বাসের শেকড়ই
ছিঁড়ে গেছে। তাই কান্নার মতো বিড়ম্বনা আর আছে কি? তার চেয়ে হেসে যাও। জগতের প্রতি
হাস, নিজের প্রতি হাস। এ হাসি ঐ কান্নার চেয়ে ভালো দেখাবে।” এটা স্পষ্ট যে মিতির
হাসিটা অভিনয় মাত্র। কুলপতির মতো পরজন্মের বিশ্বাস সে অর্জন করে নি। লেখকের এই যে বিপ্রতীপ
কাহিনি এবং চরিত্র তৈরির বাধ্যবাধকতার খামতি-- সেটি পুষিয়ে দেয়া হয়েছে মালতি, নন্দী ড্রাইভার এবং
বংশী উপাখ্যান দিয়ে। প্রথম দু’জন স্মৃতি আর শেষের জন গল্পে সক্রিয় সত্তা।
নিত্যদিনের মতোই সন্ধ্যা নেমেছিল সেদিন। নিত্যদিনের মতো বাবার কাছে গল্পশোনার
বায়না ধরেছিল মিতি, তার জীবনে বিনোদনেরও আর কোনো বিকল্প নেই। তার উপরে আমরা আগেই
লিখেছি বাদসার যাদুবিদ্যার আসরে লক্ষণের ষঢ়যন্ত্রের পর থেকে রাতে
অন্তত তাকে কাছ ছাড়া করে না কুলপতি। মা হলে যা করত, দরকারে কোলে নিয়েও বসে থাকে। কুলপতি সে রাতে শুরু করেছিল
মালতির গল্প। যা আগেও বলেছে সে। কিন্তু এদিন একটু তলিয়েই গেল। সে এতোটাই যে মিতির
মৃত্যু অব্দি সেটি চলল থেমে থেমে। এবং মৃত্যুর শেষ কারণ হয়েও দেখা দিল এই গল্পই।
মিতি জানল, গল্পের মা মালতি আসলে তার মা-ই নয়। কুলপতি নয় বাবা। কিন্তু শুরুর কারণতো অবশ্যই
নন্দী ড্রাইভার। মালতি-কুলপতির সেই ঝিঙে ফুলের গল্পের পাশে সে বসাতে পারছিল না
ড্রাইভারের সঙ্গে নিজের প্রেমের গল্পকে। “মিতির অন্তর হুহু করে
কেঁদে ওঠে। কোথায় মিতি আর নন্দী ড্রাইভার আর কোথায় মালতী ও কুলপতি। কবে মরে গেছে
মালতী-তবু কুলপতির মনের মধ্যে সৌগন্ধের মতো বেঁচে আছে সে। মিতিরও মরে যেতে ইচ্ছে
হয়। মরে গিয়ে মালতীর স্মৃতির সৌরভের মতো কারো মনে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কে
ওকে মনে রাখবে? .. .” এই প্রথম মৃত্যুভাবনা এসে উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করে। এটি
পাকাপোক্ত হতে পারত না , যদি না বংশী চালাকিটা না করত।
বংশী এই পুলের তলার পুরোনো বাসিন্দা। সে
অনেকটা দিনির প্রতি চরিত্রও বটে। চোর দিনি যশোমতীকে বাঁচিয়ে দেয়। চোর বংশী মিতির
মৃত্যুর কারণ হয়। এককালে বৌ নিয়ে সংসার করত। সেই বৌ পরপুরুষের সঙ্গে পালিয়ে গেলে সেও চলে
গেছিল কোথাও হতাশাতে। এক সন্ধ্যাতে ফিরে এসে জানান দিল, “পারলামনা গো
মিত্তিকা...এই পুলের তলায় সনসারডা আমারে জাদু কইরেছে।” ধীরে ধীরে যে মিতির যাদুতেও
বাঁধা পড়ছিল। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে নি কোনদিন। সেই থেকে লোকের পকেট চুরি করেই বেঁচে আছে সে। প্রায়ই ধরা পড়ে মার খেতো,নইলে
পালাতে গিয়ে পা ভাঙত। প্রথম যে বিকেলে নন্দী ড্রাইভার এসে কুলপতির
কাছে বিয়ের প্রস্তাব রেখেছিল তখনো এই বংশীর পায়েই তেল মালিশ করে চিকিৎসা করছিল
কুলপতি। সে বৎসাধিক কাল আগের কথা। কিন্তু দিন কতক আগেও লোভে পড়ে আবার পকেট মেরে
চলতি ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়ে আবার চোট পেয়েছে। এই পায়ে ব্যথা নিয়েই
রোজগারে বেরোয়। আগেরদিনে পকেট চুরি করে সামান্য মুড়ি কিনেই খেতে পেরেছিল। তারপর
থেকে উপোস। আজ সন্ধ্যেবেলা ফিরে এসছে রোজগার ছাড়াই। সুতরাং খাবার কোনো ব্যবস্থা
নেই। সেই খিদের জ্বালা , পায়ের জ্বালা অনেকটাই ভুলে গেল বুকের জ্বালাতে। আজ তার
সঙ্গে দেখা হয়েছে নন্দী ড্রাইভারের। যে গল্পটি ও চাউর করেছে, কুলপতিকেও বলেছে মিতি
শুনতে পেল,--- তাকে দেখে নন্দী ড্রাইভার যেন চিনতেই পারে নি। গাড়িতে চড়ে পালিয়ে
যাচ্ছিল। রাগে বংশীর ইচ্ছে হচ্ছিল ওর টুঁটি গিয়ে চেপে ধরে। ভাঙা পায়ের জন্যেই পারে
নি শুধু। সংবাদটি মিতিকে প্রথম দেয় ললিতা। শুনে মেলার ঘৃণা উপচে পড়ে
এভাবে, “ মিত্তিকা বুঝছস, ইবার শালা হাজির হইলে তখন জামাকাপড় সব খুইলে ন্যাংটা
কইরে ছাইড়ে দিস। কইস, চিকিচ্ছার লেগে বহুত খরচ হইছে, সিইডা উঠাইয়া লইলাম। যদি কয়,
চিকিচ্ছাডা কি? তখুন কবি, বাচ্চা হওনের। উইখেনে পুঁইত্যে রাখছি চারাডারে। দেইখে আস
ডালপালা দিয়া চারাডা বিরিক্ষি হইলো নি? হিঃ হিঃ হিঃ, উইখেনে-হিঃ!” উইখেনে মানে
পানা ডোবার ওধারে। বছর তিনেক আগে মেলাকে ফেলে রেখে এই পুলের তলা থেকে পালায় ওর বর।
সেই থেকে বেশ্যাবৃত্তি আর ভিক্ষে করেই ওর জীবন চলে। পুরুষ জাতটার প্রতি ঘৃণারও তাই
শেষ নেই তার। এই সংবাদটির আগে অব্দি মনের কোনে কোথাও একটা আশা ছিল ড্রাইভার ফিরে
আসবে। মিতি-কুলপতি দু’জনারই। কুলপতি ভেবেছিল, ‘রাজেশ্বরী’র কন্যে মিতি বিয়ে করে
‘অন্নপূর্ণা’ হবে। মিতির আশা ছিল, স্বামীর ঘরে নিয়ে গিয়ে এই জন্মেই বাবাকে আবার
সুখের মুখ দেখাবে, বাকি জীবন আরামে আয়েসে কেটে যাবে –সে আর হলো না। এই সংবাদ
গল্পের এক বড় মোড়। শুধু দু’জন সংবাদটি পেয়েছে দু’জনের থেকে। তাই বাপে মেয়েতে
লুকোচুরি চলল, যেন মিতি জানতেই পায়নি। নিজের ছেলের কথা ভেবে মিতির চোখে জল এলো । যথারীতি সেই জল দেখে
কুলপতির তার কাছে ‘এট্টাবার’ হাসবার আবদার জানালো। কিন্তু এবারে সে হাসতে পারল না,
তার চোখ দিয়ে দর দর বেগে জল নেমে এলো। খানিক পরে ভাবল অভিনয় করেও
যদি কাউকে সত্যকার আনন্দ দিতে পারে তবে সে তাই করবে। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে
সে । তার হাসি দেখে কুলপতি জানায় আগামী জন্মে যেন সে জন্মায় মিতির কোলের সন্তান
হয়ে। এ কথা শুনে আবার কেঁদে ফেলে মিতি। অভিনয় বলেই হাসি কান্নার এই লড়াই মিতির
পক্ষে কঠিন হয়ে উঠল অনেক বেশি। এইদিকে সে অত্যন্ত সতর্ক স্বাভাবিক ভাবে রাতের সব
কাজই করল। বাবা রান্না চাপাতে বললে সে রান্না করল। বাবাকে খাওয়ালো, বংশীকেও
খাওয়ালো, কৌশল্যাদের গোটা পরিবারকে খাওয়ালো। নিজের জন্যে কিছুই রাখল না। মালতির
গল্পের বাকিটুকু শুনতে চেয়ে আসলে সে বাবাকে ভুলিয়ে ভালিয়েও রাখল যেন, আর তলায় তলায় ঠিকই
শুরু করল একটা শেষ যাত্রার প্রস্তুতি। শাড়ি গয়নাগুলো আর কোনো কাজে
লাগবে বলে কোন বিশ্বাসই অবশিষ্ট নেই সেগুলো বাবাকে পরিয়ে দিতে বলল । পরের বার
কান্না পেলে কুলপতির প্রশ্নের উত্তরে এভাবে ইঙ্গিত দিতে শুরু করে, ““আইজ রাইতে সকল
কান্দনের শেষ কইরে দিমু। সকল কান্দনের থিকে ছুট্টি লোমু।”
মেলার কথাগুলো দাগ কেটেছিল ওর
মনে। এক বিশ্বাসঘাতকের সন্তানকে গর্ভে ধরে তাকে আবার বিনা অপরাধেই মাটির তলাতে
চেপে ফেলার যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। তার মনে পড়ে গেল রাজরানির কথা। মরার
পরে কী হয় মানুষের ---প্রশ্ন ছিল তার। দিনি কুলপতি বিপরীত জবাব দিয়েছিল। সে কি
বুঝল, স্পষ্ট না করে সে রাতেই গলায় ছুরি চালাল রাজরানি। ভালো চালাতে পারেনি বলে
অনেক্ষণ কাৎরে কষ্ট পেয়ে মরেছিল সে। তার চেয়ে রেলের তলাতে কাটা পড়াই ভালো মনে হলো
মিতির। রেলের নিচেই প্রাণ দেবে মিতি। রেলের চাপায় ওর শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
টুকরোগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে নন্দী ড্রাইভারের দেয়া লাল শাড়ি আর টিপ । ড্রাইভার
আর চাইলেও ওকে খোঁজে পাবে না, এই ভাবে সে প্রতিশোধ নেবে। সবাই জানবে মিতি নন্দীর
কাছে পরাভব স্বীকার করে নি।
এটা স্পষ্ট যে ড্রাইভার
তাঁর খোঁজে আসতে পারে এই বিশ্বাসটা তখনো হারায় নি সে। সুতরাং সিদ্ধান্তটা কার্যকরি
নাকরলেও করতে পারত যদি মালতির গল্পে সে থাকত একটি চরিত্র হয়ে। কিন্তু শেষে এসে সে জেনে গেল এই
গল্পে তার আগমন মালতির মৃত্যুর পরে। আগে নয়। তার নিজের জন্মটাও হয়েছিল মরবার
জন্যেই। নিজে আত্মহত্যা করতে যাবার আগে তাকে এখানে ফেলে রেখে
তার মা আসলে সুযোগ একটা দিয়ে গেছে বেঁচে থাকার। কুলপতি সেই সুযোগ । সেই গিয়ে আটকেছিলো তার
জন্মদাত্রীরও মৃত্যু। কথাগুলো যখন বলছে কুলপতি, “হঠাৎ এক ঝলক জলো- হাওয়া এসে কুলপতি আর মিতির
মাঝখানের টিম টিম করে জ্বলা প্রদীপটি নিভিয়ে দিল।” এই সময়টাকে অন্যভাবে বর্ণনা
করাই কঠিন ছিল। একের পরে এক দু দু’টি বড় ঘা একই রাতে। গল্পের শেষটা সজ্ঞানে
বলবারও উপায় ছিল না। যেনবা থেকে থেকে কৌশল্যার বাবার যন্ত্রণাই অন্যভাবে প্রকাশ
পাচ্ছিল কুলপতির মধ্যে। নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল যেন । আর আন্মনে বলে ফেলেছে না বলবার কথা। যে
কথা এদ্দিন আলগে রেখেছিল। আলো নিভে যেতেই শুধু তার সম্বিৎ ফিরে আসে। পরিবেশটিকে
এভাবেই বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন লেখক। নিজের গোটা জীবনকে মুহূর্তে পুনর্নিমাণ করতে
হচ্ছিল মিতিকে। স্বাভাবিক ভাবেই সেও জ্ঞান হারিয়ে দঃস্বপ্ন দেখছিল। তার নিজের
সন্তানও এভাবে বেঁচে থাকতে পারত, অথবা সেও হতে পারত মাটিতে পোতা মানুষের
চারা।কথাটাকে এতো সরাসরি লেখেন নি লেখক। লেখকের দক্ষ উপস্থাপনাটি
ত্রিমাত্রিক, এরকম--গল্পের শেষটা শুনে মিতি জবাব দেবে কি, তার, “...চারদিকে যেন কারা একসঙ্গে হাজার কাঁসর
পেটাচ্ছিল। ঐ শব্দে সে বধির হয়ে গিয়েছিল।তারপর ধীরে ধীরে শ্রবণ-শক্তি ফিরে এসছে।
শুনতে পেলো, ডোবায় ব্যাঙ ডাকছে, ডোবার পারে অন্ধকারে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে; অন্ধকারের
একপাশে ঐ বিরাট পিপুল গাছের ডালে ডালে বাদুড়ের, প্যাঁচার ডানার ঝটপটানি আর
চেঁচামেচি। একবার ওদিকে চোখ ফিরিয়ে তাকিয়েছিল মিতি। কী জমাট অন্ধকার! মিতির মনে
হয়েছে সে ঐ অন্ধকার জগতের বাসিন্দা। তার হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যেন
থেৎলে, দুমড়ে ঐ ঝিঁঝিঁর ডাকে , বাদুড় প্যাঁচার ডানা ঝটপটানীর শব্দে একাকার হয়ে
গেছে। কাঁদতে চেয়েছিল মিতি, চিৎকার করে এই ওভারব্রীজের ঢাকনাকে ভেঙ্গে চৌচির করে
দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। মনে হচ্ছিল ঐ ওখানের অন্ধকার যেন তার দিকে
শ্যেনদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। টু শব্দটি করলেই টুঁটি চেপে ধরবে।” কুলপতি তখন কী করছে?
কুকুরের বাচ্চাগুলোকে শীতের থেকে বাঁচাতে নিজের বিছানাতে ঢেকে ঢুকে দিচ্ছে।
কৌশল্যারা যাবার জন্যে
বিদেয় নিতে এসে ব্যাপারটিকে আরো প্যাচালো করে দেয়। ইতিমধ্যে গোটা বিশ্বকে অবিশ্বাস করে যে কৌশল্যার
বাবা, মিতির দেয়া খিচুড়ি খেয়ে সে মত পাল্টেছে। ধন্যবাদ দেবার জন্যে এগিয়েছিল। তার
ধারণা ছিল, সময় থাকতে স্টেশনে গিয়ে রেলে চাপলেই হলো। কুলপতি রামচরণের নজির দিয়ে বলল সে ভুলও যেন
না করে। রামচরণ আগে পকেট মারত। এখন ভিক্ষে করে। সেদিন বিনা
টিকিটে ধরা পড়ে আচ্ছা মার খেয়েছিল। পিঠে কালশিটে দাগ পড়ে আছে, পেটে এখনো ব্যথা।
কুলপতি বলল, কৌশল্যার বাবার যা অবস্থা তাতে একবার মার খেলে হবে কী? বুড়ো মেয়েকে
স্বামীর জিম্মাতে দিয়ে আসতে পারবে না ভেবে কেঁদেই ফেলে। বাবার কান্না দেখে
কৌশল্যাও কেঁদে ফেলে। মিতির মনে হয় এই কান্না ব্যাপারটি মিথ্যা। ডোবার ওদিকে যারা
অস্বীকৃতির অন্ধকারে স্তব্ধ হয়ে আছে সে তো ওদেরই একজন। “মিথ্যাই তার কণ্ঠে স্বর
ফুটেছে, মিথ্যাই হৃদয় জেগেছে, মিথ্যা বুকের কান্না, চোখের জল” কোন অহংকারে সে প্রতিশোধ
নিতে যাবে নন্দী ড্রাইভারের উপর? সুতরাং সে বাবাকে গিয়ে জানায় , “আমি এট্টাবার
হাসুম।” না, সিদ্ধান্ত যে পাল্টায় নি। রাতে অন্নপূর্ণার মতো সবাইকে খাইয়ে বাঁচিয়ে
ছিল। নিজে ছিল অভুক্ত। এবারে, ঘটনাচক্রে যে জীবনকে পেয়ে গেছিল, তাকে আরো বড়ো এক
মহৎ কাজে নিবেদনের জন্যে তৈরি হলো। শাড়ি পরা তার হয়েছিল,
কৌশল্যার কান্নাকে গুরুত্ব না দেবার জন্যে বাবাকে বলল, টিপ পরিয়ে দিতে। ড্রাইভার
উপহার দিয়েছিল। কুলপতি টিপ পরিয়ে দিতে দিতে কৌশল্যার বাবাকে গল্পে ভুলিয়ে রাখবার
চেষ্টা হলো। কিন্তু কাজ হলো না, নিজের চোখেও কান্না আটকাতে পারছিল না। “আমি অক্ষণ
হাসি?” বলে মিতি সেই কান্না আটকাবার চেষ্টা করল। কিন্তু এবারে সেই ম্লান নিষ্প্রাণ হাসি
যেন “শেষ রাতের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে অবসন্ন চাঁদ।” হঠাৎ আবার কৌশল্যার বাবার
ভাবনা--- সে মরে গেলে মেয়ের কী হবে? সে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, “কবরাজ বল হামদের
কি হবেক?” ওর কান্না শুনে মিতি যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। কৌশল্যা তার দিকে তাকিয়ে
আছে যেন বা বলছে, “আমাকে বাঁচাও।” ধীরে ধীতে মিতি উঠে নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো
টলতে টলতে খামের ওপাশে চলে গেল। মিতির মায়ের দেয়া বালাজোড়া পরিয়ে দেবে বলে বের করে
কুলপতি পেলনা মিতিকে। অনেক্ষণ পরে মিতি এলো বটে। কিন্তু টলতে টলতে। পা টেনে টেনে ।
হাতের মুঠিতে কিছু টাকা ছিল। মুঠি আলগা করে কৌশল্যার কোলে ফেলে দিয়ে বলল, “তুমি
ঘরের মনুষ্য ঘরে ফিইরে যাও, উই টাকাগুলানে রেলের টিকট কিন্যো; আর...” আর ওর গলাতে
কথা ফুটতে চাইছিল না। কুলপতি ফিরেও তাকালো না। ওর সব আশা , সব স্বপ্ন মিশে গেছে ঘন
অন্ধকারে। শরীর বিক্রি করে এসছে মিতি কৌশল্যার জন্যে। অনেক কষ্টে মিতি বলে গেল, “
আর তোমার সোয়ামীরে বইল, সনসারে এট্টা পুল দেইখে আসছি, যিখেনে বহুত মনুষ্যের বিচি
রোপন হিয়ে আছে, সিই জায়গা দেইখে আসছি।” শ্লেষা জমে ওর কথা আটকে যাচ্ছিল, “...আর
দেইখে এইলাম উইখেনে এট্টা মানুষ্যের চারা ডালপালা মেইলে ডাগর হইছে—উই চারাডা কথা কয়
গো, উয়ার চক্ষু দিয়া জল পড়ে, উই চারাডার বুকে দুধ হয়, আর ... বইলো উই চারাডা
হাসতেও পারত গো!” দিন কয় আগে একটা
মালিশের ঔষধ তৈরির জন্যে তুঁতে এনেছিল কুলপতি। মিতি সেটিই খেয়ে ফেলেছে। ওর
কোমরের কাছে কৌটোটা পড়ে আছে। দিনি কুলপতিকে বলল, চিকিৎসা করতে। কুলপতি কিছু বলে
না, মিতির কপালে ঠোঁট ঘসে। ‘সন্তান শোকে আকুল পশুমাতার মতো সে মিতিকে শুঁকে শুঁকে
মূক বেদনা প্রকাশ করছে।”
বাকি কথা আমরা আগে লিখেছি।
যা লিখিনি, তা এই যে বংশী ড্রাইভারের কথাটা সত্য বলেনি। মিতির মৃত্যু হলে সে এসে
আর্তনাদ করে বলল, “ তোমার অন্তরে এ্যাতো দুঃখু ছিল, সিই কথাডা আগে ক্যানে কও নাই,
ক্যানে কও নাই?” থামের ওপাশে যাবার আগে বংশীর কাছে একবার গেছিল মিতি নিজে থেকে ভালো করে
বুঝে নিতে। জিজ্ঞেস করেছিল , “ড্রাইভার তোমাকে কী বইলেছিল?” বংশীর জবাব, “...উই পাজিডার
কথা ভুইলে যাও, উইডা এট্টা শয়তান।” সে আরো বলেছিল, “ মিত্তিকা! এট্টা কথা কই?...।
আমার লেগে তোমার অন্তরে টুকুন দুঃখু নাই? কও? ” আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত
করে মিতির চমক, “ আই এই কথা ক্যানে কও?” মিতিকে সে মনে মনে দীর্ঘদিন
ধরেই ভালোবেসেছিল, কিন্ত বলতে পারে নি। আজ বলল তাও ঘোরালো পথে। হাত চেপে ধরে ,
“চলো ইখান থিকে দূরে চইলে যাই। পালাই চলো।” মিতি নীরবে শ্বাস ফেলে , কান্না আটকে
কিছুক্ষণ পরে বলে, “পালামু বংশীদাদা, পালায়ে যামু গো” কিন্তু সে থামের ওপাশে পা
বাড়ায় টলতে টলতে। শেষবারে বলে, “ আমার লেগে দুঃখু নিও না, আমি আবার আসুমগো
বংশীদাদা।” বংশী শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছিল এবং মিতির ফিরে আসার অপেক্ষা করছিল। যথেষ্ট
ইঙ্গিত দিয়ে গেলেও সেগুলো বুঝবার মন এবং দক্ষতা কোনটাই ছিল না বংশীর। থাকলে সে
বলত, গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনার দায়ে নন্দীড্রাইভারের জেল হয়েছিল। ছাড়া পেয়েই বংশীর
সঙ্গে দেখা। চুল উস্কোখুস্কো। মুখময় দাড়ি,পরনে শতচ্ছিন্ন সার্ট। প্রথম দেখাতে বংশী
চিনতেই পারে নি। নন্দীই এগিয়ে এসে কথা বলে।বংশী এড়িয়ে যেতে চাইছিল। ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে
মিতির কথা। বংশী ভয় দেখায়, ও পুলের তলায় গেলে কুলপতি আর আস্ত রাখবে না। খুন করে
ফেলবে। ড্রাইভার বলল, সে একটা চিঠি লিখেও নিজের খবর দিতে পারেনি। কারণ কোন পিয়ন
সেখানে চিঠি বিলি করতে যাবে না। বংশীর এমনিতেই পায়ে ব্যথা, তার উপরে এইসব বুক
পোড়ানো কথা শুনতে চাইছিল না। বলল, মিতির বিয়ে হয়ে গেছে। সে আর বসে নেই। কার সঙ্গে?
ড্রাইভারের একবার মনে হলো নিবারণ ড্রাইভারের সঙ্গে নয় তো? সে কথা জিজ্ঞেস করতেই বংশীর
জবাব, “...মিত্তিকারে বিয়া করছি আমি। ওক্ষণে মিত্তিকা আমার বউ।”
কুলপতিকে ফেরাতে যখন দিনি
ব্যর্থ হলো বংশী গিয়ে ওর পায়ে লুটিয়ে পড়ল। তার এক মিথ্যের জন্যেই কুলপতির হাতে তার লাঠিটা
তুলে দিয়ে বলল, “...ধর, এই লাঠি দ্যা আমার শেষ চিকিচ্ছাডা কইরে দ্যে যাও।” এজন্মের
জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কুলপতির বিন্দু মাত্র অনুসন্ধিৎসা অবশিষ্ট ছিল না। তা
সত্ত্বেও বংশীর কথা শুনে সে তার মানে জিজ্ঞেস করে , কিছু বুঝে উঠতে পারে না। ভাবে
বুঝি পুলের তলার অন্যদের মতো সেও মিতিকে খুব ভালোবাসত। তার মৃত্যুতে পাগল হয়ে
গেছে।পাগলপ্রায় বংশীকে সান্ত্বনা দিতে কুলপতি খানিক বসে পড়ে ঘাসের ‘পরে। বংশীর
হাতে লাঠি ফিরিয়ে দিয়ে। বলে, “ দ্যাখেন মনডা হইছে যাইয়া য্যানো লাউডগা, মানুষ্যেরে
মাচান কইরে লইয়ে বিস্তর ছড়াইয়ে পড়ে। মিত্তিকার লেগে দুঃখু নিবেন না, আমিও নিমু
না।” কুলপতিকে সত্যটা বলে ফেললে আর শেষটা এতো সুন্দর হতে পারত না।
কৌশল্যার স্বাধীন সত্তা বলে
কিছু অবশিষ্ট নেই। সে আত্মহত্যাটাও মিতির মতো নিজ ইচ্ছেতে করতে পারে না। আরো তিনটি
জীবনের ভার তার কাঁধে। আর ওর বুড়ো বাবা কুলপতির সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রীক স্বার্থপরতা
ছাড়া আর কোন কিছুর উপরে তার বিশ্বাস আছে বলে মনে হয় না। মেলা সমস্ত পুরুষ প্রসঙ্গেই
বলেছিল, “...পুরুষের মগদুর কতডা আমার আন্দাজ আছে।” কথাটা এই বুড়োর সম্পর্কে
অত্যন্ত খাটি। সামন্তীয় পুরুষ সংস্কার তার রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে। দৃশ্যত মনে হয়
যদিও মেয়েকে সে স্বামীর ঘরে পৌঁছে দিয়ে মুক্ত হতে চাইছে, সেও মেয়ের স্বার্থে ততটা
নয়—যতটা নিজের বিবেকের কাছে । নইলে মেয়েকে গাঙে স্নান করতে
যাবার নির্দেশ দেবার আগেই বলত তার বিয়ে হচ্ছে, এবং হচ্ছে কার সঙ্গে। একটি আস্ত
মাতাল বর যে বিয়ের আসরেও জ্ঞান হারিয়ে বসেছিল। সন্তান গর্ভে দিয়ে লোকটি চলে যাবার
তিনবছর হয়ে যাবার পরেও বুড়োর সেই সংস্কারে বাঁধা জামাইর মোহ যায় নি । তার উপর,
জামাই চা-বাগিচার সর্দার এই অহংকারও আছে পুরো দস্তুর। তাই পঙ্গু হয়ে সংসার টানতে
অসমর্থ হলে শুরু হয় তার জামাইর সন্ধানে অভিযান। অভিযানইতো বলা চলে একে এক অনির্দিষ্ট মুক্তির
সন্ধানে। কাটিহারে বুড়োর পা মচকালো আবার। সেখানে থাকতে হলো এক মজুরের আশ্রয়ে।
যেহেতু এটা ঘটল বুড়ো নিজে বিপদে পড়ার ফলে, তাই এসবে যে বুড়োর কোন আপত্তি
ছিল মনে হয় না। নইলে আরেক সন্তান নিয়ে আসাটা কঠিন হতো কৌশল্যার পক্ষে। স্বপ্নতো
ছিলই একটা বিকল্প সংসার করবার। শুধু সেই মজুরটাও বিশ্বাসঘাতকতা করল বলেই আবার শুরু
হলো দিলজানের দিকে যাত্রা। এবারে শুধু মানুষের উপরে বুড়োর অবিশ্বাসটা আরো পাকা
হয়েছে । এই অবিশ্বাসের ভারে মেয়েও এখন জড় পদার্থে পরিণত হয়েছে। কাশিতে বাবা মর মর,
শুকনো হাতে বুক ডলছে অথচ কাছের একটা মানুষকেও ডেকে কিছু বলছে না। কুলপতি নিজে যেচে
কাছে যেতেই শুধু ড্যাব ড্যাবে চোখে তাকিয়ে আর্তি একটা ব্যক্ত করছে।
কুলপতি বেশ কষ্ট করেই তেল
মালিশ করে বুড়োর সেবা করছিল। কিন্তু সামান্য বোধ হতেই কিনা বুড়ো চেঁচিয়ে তাকে
বেইমান টেইমান বলে তাড়িয়ে দিতে চাইল। শিশুর সারল্যে ভয় পেয়ে যখন কুলপতি নালিশ করে,
“আপনার পিতা ই সব কি বলেন, দ্যাখেন।” কৌশল্যারও যেন জ্ঞান চক্ষু খুলল। সেও বলল, “
হোঃ হামার বাপ ঠিকই বইলেছে। তুয়ারা মরদগুলান হামার দুষমন। ওঃ, হামি কোথাকে
যাব?...হামি যে আউরৎ!” তার তখন বিশ্বাস বড় ছেলেটি দেখতে সর্দারের মতো। এই প্রমাণের
উপরে ভরসা করেই সে যাচ্ছে নিজের পরিবারে অধিকার বুঝে নিতে। কিন্তু রাতেই সে মিতিকে
জিজ্ঞেস করেছিল, দ্বিতীয় সন্তানটিকে দেখে কি আর সর্দার তাকে ঘরে তুলবে? এই
দ্বন্দ্বে সে জেরবার। ‘আউরৎ’কেইতো নিষ্কলুষ থাকতে হয়। এই অহংকারটি বুড়োরও তীব্র।
ললিতা কৌশল্যাকে বলেছিল , গিয়ে ভিক্ষে করে দুটো চাল নিয়ে আসতে। সেজে গুজে গিয়ে
বসলে বাবুর অভাবও হবে না বলে মেলাও তাতে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বুড়ো ক্রমাগত থেকে
থেকে বলে যাচ্ছিল, “ হিঁয়াসে হইটে যা! নাইতো তোদের খুন আমি পিয়ে লিব, ভাগ!” কিন্তু
উঠে বসতে পারে না, বুড়ো। তাই আবার কেঁদে কেঁদে বলে কৌশল্যাকে, “চ, হেথালে হমারা
ঘুচে যাই।” ওরা নিজেদের মধ্যে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলাবলি, হাসিঠাট্টা করলেও আতঙ্কে বুড়ো একই কথা
বলে যায়। এরা ‘রেণ্ডী’ বলে বুড়োর এক রাশ ঘৃণা। তাজ এক সময় জিজ্ঞেস করেছিল,
“উইঠে বসনের পারে না, আবার যাইবার নাম লয়! বুড়োর উত্তর, “ তুয়াদের মাফিক হাজার
মুরদের আউরৎ নাই আছে হামার বেটী। হোঁ। উ উয়ার সোয়ামীর ঘরকে যাবেক। দিলজান
চা-বাগিচার সর্দার বটে হামার জামাই...” শুনে পাশের কুকুরীটিও চেঁচিয়ে উঠে সে কথা
উল্লেখ করতে ভুল করেন নি লেখক।
আমরা বলেছি বটে, পরজন্মের উপরে অতি বিশ্বাস
কুলপতিকে বাস্তব বুদ্ধি দেয় নি বেশি কিছু। কিন্তু সেও নন্দী ড্রাইভারকে কথা দেবার
আগে ড্রাইভারের বন্ধু নিবারণ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে খবরা খবর নিয়েছিল। আর গল্পের
শেষে এসে আমরা জেনেছি, ওর সিদ্ধান্তে ভুল ছিল না কোনো। কিন্তু আত্মপর বুড়ো
কৌশল্যার বাবার সেরকম সামান্যতমও বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় মেলে না। নইলে যে বর গ্রহণ
করবে না বলে কৌশল্যার ধারণা পাকা , তাকে নিয়ে কি আর দিলজান নামের এক দুঃস্বপ্নের
দিকে যাত্রা করে! কৌশল্যাকেতো কাঁদতেই হবে। বিয়ের রাতেই সে কেঁদেছিল। বাবার এই
দুঃস্বপ্নের থেকে মুক্তি চেয়েছিল বলেই নিশ্চয় কাটিহারে মজুরটির সন্তানকেও গর্ভে
নিয়েছিল। কিন্তু মুক্তি তার মিলেছিল সেই ফকির কুলপতির কাছে এসেই। কুলপতি নিজে যখন
জানাচ্ছে, চিকিৎসা সে জানে না কৌশল্যা তখনই তাকে ডাকছে ‘ধরমের বাপ’ বলে! মিতির
জন্মান্তর হচ্ছে তার মধ্যে! পুনর্জন্ম এভাবেই হয়, এই সংবাদটাই কি দিতে চাইলেন লেখক
শেষে এসে? এই খানে এসে, আমরা ভাবছিলাম যদিও তখন সংখ্যাতে কম, অসমের কথাসাহিত্যে
ধর্ম আর সতীত্বের ধারণার এক গুণগত উল্লম্ফন ঘটে গেল। আমাদের মনে পড়ছিল শিলচরের সুরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর
আরো প্রায় আধা শতকের বেশি সময় আগে ১৮৮৬তে লেখা উপন্যাস ‘অশ্রুমালিনী বা
নারীশক্তি’র কথা । যে উপন্যাসেরও কেন্দ্রীয় ধারণাতো নারীর অবমাননাই বটে, কিন্তু
যোগমায়া সেই অবমাননার বিরুদ্ধে লড়ছে বঙ্কিমী হিন্দু জাতীয়তাবাদী পুররুত্থানবাদের
‘সতীত্বে’র পথে। পীড়ক স্বামী শাশুড়ির উপরে তার বিজয় আনন্দের অশ্রু , “ এই ভারতের প্রত্যকে
নারীকণ্ঠে যেন শোভা পায়—এই শান্তিজল এই অত্যাচার কলুষিত বঙ্গভূমিকে প্লাবিত করিয়া
যেন গৃহে গৃহে শান্তি আনয়ন করে।” মিতি কিম্বা কৌশল্যার দেশ-রাষ্ট্র বহির্ভূত জীবনে
যেখানে ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের পিয়ন চিঠি পৌঁছে দেয় না, এহেন ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’
শান্তিজলের আবাহান যেন মৃতের কানে সংস্কার-জড় ব্রাহ্মণের মন্ত্রোচ্চারণের মতো শোনায়। যাদের
কোন ঘরই নেই, এই আবাহন তাদের ‘ঘরে ঘরে শান্তি’ নিয়ে আসার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা রাখে
না বোঝা গেল।
দিনি বাপ মেয়ের এই দুই জুটির
মাঝে একটি সংযোগ রেখার মতো ব্যাপ্ত হয়ে আছে গোটা গল্প জুড়েই। তাকে দিয়েই গল্পের
শুরু। খুবই বাজে সংলাপ দিয়ে শুরু। যে কিনা আসন্নপ্রসবা বৌএর প্রসবে দেরি দেখে উদ্বিগ্ন তার রোজগারের কী
হবে? গল্পের শেষেও আছে সে। কুলপতি চলে যাচ্ছে বলে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভালো মানুষটির
মতো পেছন ডেকে বলছে, “ মিত্তিকার লেগে দুঃখ নিও না। এইসো, আমরা সক্কলে মিলে
আবার...” তার প্রথম সংলাপ, ব্যবহার আর আঁতুড় ঘরের বর্ণনা দিয়ে আসলে শুরু থেকেই এই সমাজের
পরিবেশটি লেখক গড়ে দিয়েছেন, যেমন তিনি গড়ে গেছেন মেলা, ললিতা, তাজ, হলধর, লক্ষণদের
গল্পে। কিন্তু এই মানুষগুলোর কেউই তো এই জীবন বেছে নেয় নি। একে যাপনের দায় বর্তে গেছে তাদের উপর।
ওভারব্রীজের উপরতলার থেকে এসে বর্তেছে এই সংবাদটার বাইরে এই নিয়ে বেশি বাক্য ব্যয়
করেননি স্বয়ং লেখকও। কুলপতি এই নিয়ে ভেবে গেছে, উত্তর পায় নি কিছুই। কিন্তু এটা
স্পষ্ট হয়ে গেছে শুরুতেই যে মনুষ্যত্ব সংক্রান্ত উপর তলার বোধ দিয়ে এই মানুষগুলোকে
চেনা যাবে না। তাই বলে এই জীবনকে মেনে নেয় নি কেউই। যে যার মতো, এর সঙ্গে লড়ে গেছে। প্রায় সবার ভেতরেই একটি
মানুষ তার সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে টিকে আছে। মেলা, ললিতা, তাজেরাও যখন কৌশল্যার
বাবাকে নিয়ে ঠাট্টা করছিল বা গালি দিচ্ছিল, আসলে এই টিকে থাকার পথ বাৎলে দিচ্ছিল।
সেই পথে ধরে রাখতে চাইছিল। এদের সবার ভেতরের ভালোয় মন্দয় মেশানো স্বাভাবিক আসল
মানুষটির ছবি স্পষ্ট করেছেন শুধু লেখক দিনিকে দিয়ে। এই জন্মের প্রতি তার বিদ্বেষও
খুব প্রবল নয়, আবার মোহও নেই বড় বেশি। আবার যদি এমন জন্ম নিয়েই জন্মাতে হয়, তাই
রাজরানির প্রশ্নে আর সশঙ্ক জবাব, “না না, আর আসুম না, আর আসনের কাজ নাই মাগো।” কিন্তু যে জন্মটি পেয়েছে,
তাকে যথাসম্ভব সুখের করে তুলতে তার চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। তার বাস্তববোধটিও অতি
সাধারণ মানুষের মতো স্বাভাবিক। কারণ, দিনের রোজগার নষ্ট হচ্ছে বলে
আসন্ন প্রসবাকে সে গালি দিচ্ছিল বৌ যশোমতী আর নবজাতিকার জন্যেই। মেয়ে জন্মানো যে
খুব সুখের নয় তার গল্পের শুরুতেই এই বোধের জন্ম দিতে লেখক তাকে ব্যবহার করেই ছুটি দিয়েছেন। পরপুরুষে যে নিয়ে গেছে তার
নিজের মেয়েকে। এই নিয়ে বাবার ব্যথাটি স্বাভাবিক। এহ বাহ্য। একই সঙ্গে এই পুলের তলার একটা ছোটখাটো
অর্থনীতির ব্যাখ্যার ভূমিকাও দিনি পালন করে ফেলে। ছেলে হলে, তার রোজগারের সঙ্গী
হতে পারত, বুড়ো বয়সের আশ্রয়ও বটে। মেয়ে হলেই তো চলে যায়! কোথায় কেউ জানে না! এর বেশি
কোন ক্ষোভ তার নেই বলে, সাতটি বেহালা বিক্রি করে ফিরে তার মনে হলো, মেয়ে তার
পয়মন্ত বটে। মনের আনন্দে সে পরের দিনের জন্যে বেহালা সাজতে বসে যায়। বৌ এটা ওটা
খেতে চায় বলে বেগুন পোড়া, লংকা দিয়ে মেখে খাইয়ে দেয়। প্রসূতিকে বন শীতলার কাহিনি
শোনায়, যেন সন্তানের মঙ্গল হয়, “যতেক মনুষ্য আছ দ্যাখ চক্ষু কইরে, /ব্যাঘ্র পলাইয়ে
যায় শিরিগালের ডরে।।/ ব্যাঘ্র কয়, আরে ভাই শিরিগালের ছাও...।” আর সব কাজ শেষ হলে, বিড়ি
জ্বালিয়ে মনের আনন্দে গান জুড়ে, “ও নগরবাসী, দেইখে যাও রে/কামরাঙা সূর্য উঠছে নদীর
উই পারে।” তখনো রাত গভীর হয় নি। গানের কলির সঙ্গে বাইরের বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক
নেই। কিন্ত তার স্বপ্নের সঙ্গে আছে। এমনিতেও আমরা দেখেছি, যশোমতীকে নিয়ে সে
চরণদাসের থেকে পালিয়ে গেছিল বটে, কিন্তু যশোমতী যখন ফিরে আসবার বায়না ধরল প্রেমের
পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। এখনো, যে দুটো ভালো খেতে পরতে দিতে পারে না এই ব্যথাতে চিন
চিন করে তার বুক। মিতির আকস্মিক মৃত্যুতেও বিদীর্ণ হয়ে যায় এই হৃদয়। সে গিয়ে হলধর
সাধুর ঘুম ভাঙালো। বলল, এর মুখে সাধুর জল দিক, যেন মিতিকে আর এই পৃথিবীতে না আসতে
হয়। এ ভাবে সে আসলে কুলপতির অতিবিশ্বাসের বিরুদ্ধেও একটা প্রতিবাদ জানিয়ে
রাখে। অথবা এমন এক পৃথিবীর প্রতি যে মিতিদের বেঁচে থাকতে দেয় না। দিনিদের স্বপ্নকে
করে বিচূর্ণ!
নটে গাছটি মুড়োলে, তখন ...
আমার নিজের এবং লেখকের দেয়া প্রতিলিপি পাশাপাশি |
তাই বলে, কোথাও কোন ত্রুটি
বিচ্যুতি নেই বলে বলা যাবে না। গোটা উপন্যাসটি পড়ে ঐ তিনসুকিয়া, ডিব্রুগড়, দিলজান,
আর পরশুরামের উল্লেখ বাদ দিলে বুঝবার উপায় নেই এটি আসলেই অসমের কোন উপন্যাস।
অসমিয়া সহ অন্য কোন প্রতিবেশী সমাজের কোন নাম গন্ধ নেই। কথাটা আমরা এই কথা মনে
রেখেই লিখছি, যে ষাটের দশকের শুরুতে মনে হয় না বাঙালি, বিহারি, আদিবাসি এবং কিছু
জনজাতি বাদ দিলে আর কাউকে এ রাজ্যে বস্তিবাসী হতে হয়েছিল। কিন্তু শহরে গেলে যে
সমাজের সঙ্গে এই লোকগুলোর ভাব কর্মের বিনিময় হয় তাদের সূত্রে ভাষা ব্যবহারে, আচারে
আচরণে প্রভাব কল্পনা করাটা মনে হয় না অস্বাভাবিক হবে।
তেমনি, ষাটের দশকে একটি বাঙালি পুরুষকে কেন কাকার
ষঢ়যন্ত্রে ভিটে ছাড়া হতে হবে? দেশভাগের মতো এতো বড় একটি বিষয়তো ছিলই। একে লেখক
এড়িয়ে গেলেন কেন? এই প্রশ্নতো উঠেই। তার উপর, আগের দু’বছরেই বাংলা এবং অসমিয়া
ভাষাআন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছোট বড় হত্যালীলা হয়ে গেছে। বহু বাঙালি এবং জনজাতিই
অসমেই ভিটে ছাড়া হয়ে শহরাঞ্চলে ভিক্ষে করতে বেরিয়েছেন, বা উত্তরবাংলা চলে গেছেন
নতুন জমি এবং জীবনের সন্ধানে। বহু নারীও বিপন্ন হয়েছিলেন। এইসব সত্যকে বয়ান করবার
সাহস তখনতো বহু লেখকের হয় নি, এখনো আছে অতি কম লেখকের। এর কারণগুলোর অনুসন্ধানও
শুরু হয়েছে সম্প্রতি। এই সেদিন এবছরেই গুয়াহাটির ‘নাইন্থ কলাম’
কাগজ একটি সংখ্যা করল, ‘দেশভাগ-দেশত্যাগঃ প্রসঙ্গ উত্তরপূর্বভারত’, পরে ভিকি
সেটিকে বই হিসেবে বের করে। বস্তুত সত্যের উচ্চারণ নিজেই না লেখকদের ভিটে ছাড়া
করবার কারণ হয়ে পড়ে এই বাস্তবতাতে বাস করেই লিখতে হয়, এখনো অসমের বাংলা ভাষার
লেখকদের। এখনো ডি-ভোটারের অভিশাপ তাড়া করে অসমের হিন্দু-মুসলমান বাঙালিকে। বিশেষ
করে, নিম্নবর্ণ দলিত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরতো বটেই। যাকে বিষয় করে সাম্প্রতিক
উপন্যাস ‘লোহিত পারের উপকথা’ লিখেছেন সমর দেব। সেরকম লেখাও ব্যতিক্রম, খুব বেশি
নেই। স্বয়ং সমাজ কোনো রাজনৈতিক অর্জনে এর জন্যে ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়ও নি।
এভাবেই শুধু, সমর্থন যুক্তি তোলে ধরা যেতে পারে নির্মল চৌধুরীর পক্ষে। এরজন্যেই তাঁর কেন্দ্রীয়
চরিত্র জন্মান্তরের মতো একটি বিষয়ের বাইরে, মুক্তির কোন ভাবনা ভাবতে পারে না। কিন্তু তারও পর আছে। কাকার
ষঢ়যন্ত্রের শিকার হলোই যদি কুলপতি, তারকি কোন প্রতিবেশি ছিল না
যে তাঁর সমব্যথী হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবার কথা বলবে, বা গ্রামে আটকাবার উপায়
করবে—যে একেবারে ডিব্রুগড়ে আত্মীয় বাড়ির কথা মনে করে রেলে চড়তে হবে ? সেরকম
নিস্পৃহ গ্রাম এখনো এই বিশ্বায়নের যুগেও কল্পনা করা কঠিন।
ঠিক তেমনি স্কুল মাস্টার
কুলপতি ছুটির সময়ের হিসেব রাখতে পারে না বলে মালতি গিয়ে ঝিঙে ফুলের চারা রোপন করে
এলো—এই বৃত্তান্ত দু’জনার প্রেম কাহিনি হিসেবে পড়তে যত ভালো লাগে, মাস্টারের সঙ্গে
ছাত্র-অভিবাবকের সম্পর্কে বুঝতে ততই মন্দ লাগে। সন্ধ্যে হয়ে যায় ছাত্র পড়াতে
পড়াতে! আর কোন ছাত্র মাস্টারের এই উন্মাদনা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না? কোন অভিবাবক আসে
না খবর নিতে? তাকে নির্ভর করতে হয় পাশের বাবুদের রাজবাড়ির শঙ্খঘণ্টার উপর!
এবং সর্বোপরি উপন্যাসের নাম । ১৯৬২তে প্রকাশিত একটি উপন্যাসের এই নাম
খানিক দূর-কল্পনাই হয়ে গেছিল। আমরা যখন লেখকের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম, তিনি
জানিয়েছিলেন এটি আসলে গুয়াহাটি রেল স্টেশনের কাছে নতুন নির্মিত ওভারব্রীজ। যার
তলার জীবনকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালীন সময়ে খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন। এটা
সম্ভব যে তিনি গুয়াহাটিতেই এই সমাজটিকে কাছে থেকে দেখার শ্রম স্বীকার করেছিলেন,
কিন্তু এই নামে সেখানে কোন সেতু ছিল না। এখন যদিও একাধিক সেতু আছে,
ওই নামে একটিও নেই। তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু। তাঁর একমাত্র কন্যা হবার সুবাদে
আড়ালে থেকে ইন্দিরা গান্ধি অনেক নীতি নির্ধারণ করতেন বটে। তাই বলে, তাঁর নামেই কোন
সেতু এসে তিনিই উদ্বোধন করবেন, এমন রাজনৈতিক অধঃপতন তখনো দেশের হয় নি। স্বাধীনতা
আন্দোলনের আবহ তখনো মিলিয়ে যায় নি, চক্ষু লজ্জা অবশিষ্ট ছিল। লেখক কি কল্পনা করতে
চাইছিলেন যে এই লজ্জাটুকু সত্যি থাকবে না? ‘দেশসেবিকা’র উন্মোচিত
পুলের তলায়ও পুতে রাখা হয় মানব জীবন এই সত্যকে নিয়ে পড়লেন কি এরই জন্যে? হবেও বা।
কিন্তু এর পরেও যখন সেতুটি নির্মিত হবার আঠারো বছর পরের গল্প আমাদের পড়াতে শুরু করেন,
আমাদের সময় বোধ একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে যায়। আঠারো বছর আগে দেশ স্বাধীনই হয় নি।
দেশের এবং শাসক দলের নেতৃত্ব দেবেনটা কে নিশ্চিত হয় নি। ইন্দিরা গান্ধি তখন প্রথম
সন্তানের মা হয়ে গৃহিণী জীবন যাপন করছেন। কিন্তু যে নামই হোক এই দেশসেবিকার, তিনি
যে নিজে নারী হলেও মিতি, মেলা, কৌশল্যাদের প্রতিনিধিত্ব্ব করেন না, বরং তাঁর তৈরি
ওভারব্রীজ এদের সভ্যতার মাটির তলাতে চাপা দিয়ে , এড়িয়ে উপর দিয়ে ছুটে চলে যায়, নগরের সঙ্গে
নগরকে জুড়ে--এই বার্তাটি দিয়ে যেন উপন্যাসের নাম এক কৌতুক হিসেবে ঘিরে রাখে গোটা
উপন্যাস ।
মালতির গল্পে যখন কুলপতি মালতির শ্মশান কর্মের
কথা বলছে, তার পরে একবার মিতির সংজ্ঞা ফিরে পাবার কথা আছে। তার আগে এক বিভৎস
স্বপ্ন দৃশ্যও আছে। কিন্তু সংজ্ঞা হারাবার কথা নেই। এটি অবশ্যি ছাপার ভুল হলেও হতে
পারে। কিন্তু বংশীর কাছে ড্রাইভারের সত্য জানতে গেলে, যে বংশী এদ্দিন মিতিকে
ভালোবাসার কথা বলতে ভয় পাচ্ছে, সে হঠাৎ তাকে প্রায় কোলে করে নিচ্ছে –এটিও হজম হতে
চায় না। মিতির দিক থেকে অবশ্যি বংশীকে ধরা দেয়াটা কৌশল হিসেবেই বোঝা যায়। কিন্তু
বংশীকে মনে হয় খুব দ্রুত এগুচ্ছে। এই দ্রুতির সামনে আমাদের শুধু একটাই দৃশ্য মনে
পড়ে, সেই রাজসিংহ উপন্যাসের নির্মল কুমারী আর মানিকলালের ‘কোর্টশিপ’। বঙ্কিম
যুক্তি সাজিয়ে লিখছেন, “বোধ হয়, কোর্ট শিপ্টা পাঠকের বড় ভাল লাগিল না। আমি কি
করিব? ভালবাসাবাসির কথা একটাও নাই–বহুকালসঞ্চিত প্রণয়ের কথা কিছু নাই–“হে প্রাণ!”
“হে প্রাণাধিক!” সে সব কিছুই নাই–ধিক্!” ওখানে যুদ্ধের তাড়া এখানে মৃত্যুর তাড়া।
কত বয়স ছিল তখন লেখকের? কজন সহৃদয়সংবেদী লেখক
কিম্বা পাঠক ছিলেন অসমে এই লেখকের পাশে তখন? লিখে বই প্রকাশ করাটা কত সহজ ছিল? তিন প্রশ্নেরই উত্তর , অতি কম।
তাই এই সব সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি আমাদের ভাবায় না। বরং এতো নিষ্ঠা, আর ভালোবাসার
বাংলা ভাষার একটি রচনাকে যখন অনাদরে অবহেলাতে পড়ে হয় পঞ্চাশটি বছর এই আসামের
মাটিতে, তখন মনে হয় যেন উপন্যাসের শেষে লেখকও তাকিয়ে থাকেন, তাঁর সিদ্ধিকে উপলব্ধি
না করে, কুলপতির মতো, “কুলপতি কৌশল্যার অপসৃয়মাণ মূর্তির দিকে সজল চোখে চেয়ে থাকে।” কুলপতি শুনতে পায়নি
কৌশল্যার গাড়ি থেকে নামিয়ে নেবার কাতর মিনতি। আরো একটি মেয়েকে এইভাবে হারায় সে। আমাদের এই লেখা যদি লেখকের
সঙ্গে তাঁর সিদ্ধিকে মিলিয়ে দিতে পারে আধা শতক পার করে এসেও ---তবে সত্যি আমাদেরও হয়ে যাবে
জন্মান্তর।
উপন্যাসটি দেখে এবং তাঁর কথা শুনে কবি সঞ্জয় চক্রবর্তী একই নামে এই কবিতাতে সম্মান জানিয়েছেন। আমরা সেটি দিয়েই থামি তবেঃ
আমাদের ময়লা আলোয় আমরাই উজ্জ্বল
আমাদের ভাঙা ঘর দুয়ারে আমরাই রাজা।
এই তো টুক করে নেমে পড়েছি মায়ের কোলে
এই তো দেশ আমার...সুজলাং সুফলাং।
ধুলো মাখো, মাখো আরো মৃত্তিকা জননী
আমি মায়ের মলিন ধুলোর আদরাকাঙ্খী
মুখে ফুটে উঠেছে যে 'মা' ডাকটি বাংলা ভাষায়
সেতো উজ্জ্বল আলো উত্তর পূর্বে, গর্বে।
ডিগবয়ে বিদ্যুৎ আছে কি, আছে তার চাবুক
কোন সে ভালোবাসায় কীসের টানে
নির্মল আনন্দে, নির্মল প্রাণ, নির্মল আঙুলে
লিখে চলেছেন, ইন্দিরা ওভারব্রীজ
ইন্দিরা, সে কি ঠাকুরুণ রবীন্দ্রনাথের
জওহরলালের তনয়া, লালগোলাপের কণ্টক আলোয়
শিশুটি হাত পা ছুঁড়ে শুধু, কাঁদে আর ঘুমিয়ে কাদা হয়
সে কি জানে, লণ্ঠনের নরম আলোয়
একা, নির্জনে , ভালোবাসার অনন্ত ধারায় ভিজে যেতে যেতে
এক অসম্ভব প্রাণ লিখে চলেছেন
তার ভবিষ্যৎ, তার উত্তরাধিকার, তার জড়ানো বাংলাভাষায়
আমাদের ময়লা আলোয় আমরাই উজ্জ্বল
আমাদের ভাঙা ঘরদুয়ারে আমরাই রাজা।
~~~০০০~~~
আমাদের ময়লা আলোয় আমরাই উজ্জ্বল
আমাদের ভাঙা ঘর দুয়ারে আমরাই রাজা।
এই তো টুক করে নেমে পড়েছি মায়ের কোলে
এই তো দেশ আমার...সুজলাং সুফলাং।
ধুলো মাখো, মাখো আরো মৃত্তিকা জননী
আমি মায়ের মলিন ধুলোর আদরাকাঙ্খী
মুখে ফুটে উঠেছে যে 'মা' ডাকটি বাংলা ভাষায়
সেতো উজ্জ্বল আলো উত্তর পূর্বে, গর্বে।
ডিগবয়ে বিদ্যুৎ আছে কি, আছে তার চাবুক
কোন সে ভালোবাসায় কীসের টানে
নির্মল আনন্দে, নির্মল প্রাণ, নির্মল আঙুলে
লিখে চলেছেন, ইন্দিরা ওভারব্রীজ
ইন্দিরা, সে কি ঠাকুরুণ রবীন্দ্রনাথের
জওহরলালের তনয়া, লালগোলাপের কণ্টক আলোয়
শিশুটি হাত পা ছুঁড়ে শুধু, কাঁদে আর ঘুমিয়ে কাদা হয়
সে কি জানে, লণ্ঠনের নরম আলোয়
একা, নির্জনে , ভালোবাসার অনন্ত ধারায় ভিজে যেতে যেতে
এক অসম্ভব প্রাণ লিখে চলেছেন
তার ভবিষ্যৎ, তার উত্তরাধিকার, তার জড়ানো বাংলাভাষায়
আমাদের ময়লা আলোয় আমরাই উজ্জ্বল
আমাদের ভাঙা ঘরদুয়ারে আমরাই রাজা।
~~~০০০~~~
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন