“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৩

আত্মদর্শন / সুদীপ নাথ



                সুদীপ নাথ
 অতি অল্প বয়েসেই পিতৃহারা ব্রজলাল নাথ। শহরে মাঝে মধ্যে আসেন। থাকেন শহর সংলগ্ন এক গ্রামে। বাবার অবর্তমানে সংসারের দায়িত্ব  সুন্দর ভাবেই পালন করেছেন। দেখতে দেখতে ষাটে এসে পৌঁচেছেন। বাবার মৃত্যুর পর পর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা ক্লাশ নাইনের পর আর এগোয়নি। কিন্তু নাথ সমাজের সব স্তরেই ওনার পরিচিতি আছে। এক ডাকে সবাই চেনে। একবার ওনাদের রাজ্য সন্মেলনে আমি সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। উনি ডায়াসেই বসেছিলেন। সুদর্শন তো বটেই, কথাবার্তাও খুবই মার্জিত এবং যখন ভাষণ রাখলেন, তখন বোঝা গেল তিনি এখনও বিভিন্ন বইপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করেন।
           মধ্যাহ্ন ভোজের সময় ওনার পাশে খেতে বসার সুবাদে, পরিচয় মুহূর্তে অন্তরঙ্গতায় চলে যায়। আমার অন্য এক পাশে আর একজন সাংবাদিক বন্ধুও ছিল। কোন একটা কথা প্রসঙ্গে আমার সাংবাদিক বন্ধুটি মন্তব্য করেছিল- হিন্দু ধর্মের সৃষ্টির আগে ভারতে সবাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। আমার বন্ধুর কথার উত্তরে আমি বলছিলাম- ‘না,না, তোমার কথাটা ঠিক নয়। তবে এক সময় হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য খর্ব করে বৌদ্ধ ধর্ম খুবই প্রাধান্য অর্জন করেছিল বটে, কিন্তু পরবর্তিতে হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান হয়েছিল”।

               ব্রজলাল বাবু মনযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছিলেন। উনি আমাদের কথায় স্থির থাকতে পারলেন না। চঞ্চল হয়ে উঠলেন আমাদের কথাবার্তা শুনে। ওনার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল এই কথাগুলোঃ এক সময় হিন্দু ধর্ম ছিল, আবার নেই, আবার ফিরে এল। ব্রজলাল বাবু  প্রশ্ন তুললেন- ‘আমরা তো জানি হিন্দুধর্ম সনাতন’। তখন আমি বিন্দু মাত্রও বুঝতে ভুল করলাম না যে, উনি বদ্ধ জলাশয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। তবে দুয়েকটা কথা বলার পরেই বুঝতে অসুবিধা হলনা যে, উনি জ্ঞানলিপ্সু।

খেতে খেতে কথাবার্তা চলল। --
আমিঃ সনাতন বলে বিশ্বসংসারে কেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেও কিছু নেই। সবই পরিবর্তনশীল।
ব্রজঃ সব বলতে আপনি ঠিক কী বোঝাচ্ছেন?
আমিঃ আপনি যা কল্পনায় ধরতে পারেন, তার থেকেও অনেক অনেক বেশি। হয়তো বা অসীম।
ব্রজঃ এই পৃথিবী, এই বাতাস, গাছপালা, মানুষ, জীব্জন্তুসবই পরিবর্তনশীল? কী বলছেন?
আমিঃ সমস্ত পৃথিবেতে যা আছে তা তো বটেই, মেঘমুক্ত রাতের আকাশে যে অগণিত গ্রহ-নক্ষত্র দেখতে পান, সেগুলো পর্যন্ত।
ব্রজঃ জীব জগতের পরিবর্তনটা কেমন?
আমিঃ এই ধরুন, ঐ যে সুপুরি গাছটা দেখতে পাচ্ছেন, সেগুল হয়তো চার- পাঁচ ফুট বেঁটে হয়ে যাবে। সুপুরি এক একটা হয়তো আরও ছোট বা বড় হয়ে যাবে। পাতা অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। মানুষ হয়তো অনেক লম্বা হবে। দাড়ি গজাবেই না, বা চুল প্রয়োজনীয় মাপে ছোট থাকবে। গরম সইতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা হয়ত অর্জন করতে পারবে। অনেক রোগ হয়ত চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে ইত্যাদি। তবে, একটা পরিবর্তন সম্পূর্ণ হতে কমবেশি কয়েক লক্ষ বৎসর লাগতে পারে। একে বলে বিবর্তন।
ব্রজঃ এই পরবর্তন কতদিন চলতে থাকবে? কোনদিন থামবে না ?
আমিঃ না এবং হ্যাঁ – দুটোই। অর্থাৎ, পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে, তাদের পরিবর্তন থামিয়ে দিয়ে, পৃথিবী নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
ব্রজঃ পৃথিবীর আবার মৃত্যু ?  সে কী ?  এসব কী বলছেন আপনি ?
আমিঃ “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথ রবে?” এ তো সোজা কথা মশাই। পৃথিবীও জন্মেছে একদিন, তাই তাকেও মরতে হবে। ঐ যে নক্ষত্রের কথা বলছিলাম, এদেরও মৃত্যু হচ্ছে।
ব্রজঃ তাহলে পৃথিবীর আয়ু কত?
আমিঃ এই ধরুন প্রায় নয়শ কোটী বছর।
ব্রজঃ এখন বয়েস ?
আমিঃ এখন পৃথিবীর বয়েস সাড়ে চারশো কোটী থেকে চারশো ষাট কোটী বছর। আর পৃথিবীতে জীবনের সৃষ্টি তার একশ কোটি বছর বয়েসে। সেই এমিবার মত একটা কোষ দিয়ে শুরু। বিবর্তনের হাত ধরে, ধীরে ধীরে বহুকোষী প্রাণী। তারপর গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ ।
ব্রজঃ এতক্ষন আপনার সব কথা শুনলাম। শাস্ত্রের কথা কি সব মিথ্যা? আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা আপনার এসব কথা। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে পৃথিবীর বয়েস কত।
আমিঃ দেখুন শাস্ত্র তৈরি হয় কল্পনার উপর, অনুমানের উপর ভিত্তি করে। সীমিত জ্ঞান নিয়ে যখন কোন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, তখন আন্দাজের উপর নির্ভর করে অনেক কাল্পনিক তত্ত্ব গজিয়ে উঠে মনকে আশ্বস্ত করার জন্যে। একে শুদ্ধ ভাষায় বলে ভাববাদ। চাক্ষুষ ঘটনাও অনেক সময় সত্য নয়। তা মায়াও নয়। যেমন, আমরা চাক্ষুষ করি সূর্য পৃথিবীর চারদিকে অনবরত ঘুরছে। আর তার ফলেই দিন-রাত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে অনবরত ঘুরছে। আর মনে করি, তার ফলেই দিনরাত হয় পৃথিবী নিজে ঘুরছে বলে।
ব্রজঃ পৃথিবীর বয়েস কত প্রমাণ করা কঠিন আছে।
আমিঃ না, না, মোটেই কঠিন নয়। খুবই সোজা। ইউরেনিয়ামের নাম শুনেছেন কখনো?
ব্রজঃ ক্লাশ নাইনেই তো পড়েছি মনে হচ্ছে। এখন পরমাণু অস্ত্রের খবরে প্রায়ই ইউরেনিয়ামের কথা বলা হয়। এটা তো একটা মৌলিক পদার্থ, তাইনা ?
আমিঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, ইউরেনিয়াম সবথেকে ভারী মৌলিক পদার্থ ও ধাতু। এটা অত্যন্ত তেজস্ক্রিয়। ইউরেনিয়াম  তেজস্ক্রিয়তা ত্যাগ করতে করতে সীসায় পরিবর্তিত হতে থাকে । আর এই পরিবরতনের হার সুনির্দিষ্ট। পৃথিবীর যেকোন স্থান থেকেই ইউরেনিয়াম নিয়ে পরীক্ষা কলেই দেখা যায়, তাতে সীসার পরিমাণের অনুপাত সমান। এই পরিমাণের অনুপাত মেপেই, জানা যায় কতদিন আগে এই ইউরেনিয়াম সৃষ্টি হয়েছিল। এই সূত্র ধরেই, পৃথিবীর বয়েস মেপে বার করা হয়েছে- সাড়ে চারশো কোটী থেকে চারশো ষাট কোটী বছর। শুধু ইউরেনিয়াম নয়, সবকিছুই নিয়মিত বদলে যাচ্ছে । এইসব বদলের চিহ্ন দিয়েই প্রমাণ করা যায়, অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রের মত পৃথিবীরও একদিন মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং তা প্রায় আরও সাড়ে চারশো কোটী বছর পর।
(C)ছবি
 ব্রজঃ জীবনের প্রতি আমার ধারনাটাই পাল্টে গেলো। তবুও একটা প্রশ্ন আছে । তাহলে জ্যোতিষীরা কীভাবে গ্রহ-নক্ষত্রের বিচরণ বলতে পারে ? জ্যোতিষ শাস্ত্র কী ? একটু বলবেন?
আমিঃ জ্যোতিষ শাস্ত্র আর জ্যোতিঃশাস্ত্র এক নয়। জ্যোতিঃশাস্ত্র হচ্ছে, জ্যোতির্বিজ্ঞান বা জ্যোতির্বিদ্যা। আর জ্যোতিঃশাস্ত্র হচ্ছে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে ভেজাল মেশানো মনগড়া এক তত্ত্ব ।
          জ্যোতিষ শাস্ত্রের প্রবক্তারা এখনও বলে থাকেন যে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে অনবরত ঘুরছে, চাঁদ একটা গ্রহ, সূর্যও একটা গ্রহ, রাহু ও কেতু নামে দুইটা গ্রহ আছে ইত্যাদি । অপরদিকে, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, চাঁদ গ্রহ নয়, সূর্য গ্রহ নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে অনবরত ঘোরে; রাহু ও কেতু নামে কোন গ্রহের অস্তিত্ব নেই ।
ব্রজঃ আপনি অনেক কিছুই জানেন দেখছি।
আমিঃ  না, না, তা ঠিক নয়। তবে আমি একটা বিষয় ভালো করেই জানি যে, আমি কিছুই জানিনা। আর এটাই আমার আত্মদর্শন।

কোন মন্তব্য নেই: