(লেখাটি গত সংখ্যা 'অরুণোদয়ে প্রকাশিত)
।। মৃন্ময় দেব ।।
পটভূমি
বরাক, বঞ্চনার আরেক নাম - যদি বলি, তাহলে খুব ভুল বলা হবে কি? বোধহয় না। বরাক উপত্যকা যাদের বাসভূমি তাদের বৃহদাংশ নিঃসন্দেহে আমার পক্ষেই ভোট দেবেন। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে বিগত সাড়ে ছয় দশকে আর্থ-সামাজিক মাজাঘঁসা যেটুকুও বা হয়েছে তার কোনো চিহ্ন বরাক উপত্যকায় আঁতি -পাঁতি করে খুঁজলেও মেলা ভার। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃ সুলভ আচরণ তার জন্য নিশ্চয় বহুলাংশে দায়ী, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। প্রয়াত সুজিৎ চৌধুরীর অনুকরণে বলা যায় যে, উনবিংশ শতাব্দির শেষ পর্বে আধুনিকতার চিহ্ন কিংবা অগ্রগতির সোপান-স্বরূপ যে রেলপথ আমাদের ভাগ্যে জুটেছিল, সেই রেলপথ একবিংশ শতাব্দির এক দশক অতিক্রান্ত হবার পরও আদৌ টিকে থাকবে কি না তা-ই আজ এক বিরাট প্রশ্ন। ‘ভাষা শহিদ স্টেশন’ নামকরণের দাবি যতই জোরালো হোক না কেন এই বাস্তবতাও অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই।
বলা অহেতুক যে, এ হেন দুরবস্থার জন্য সম পরিমাণে দায়ী এক নিদারুণ সামাজিক উদাসীনতা, যে উদাসীনতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার রাজনৈতিক চালিয়াতি হল ‘শান্তির দ্বীপ’ নামক বিশেষণে এই উপত্যকাকে ভূষিত করা। ’৬১র ভাষা-আন্দোলনের পর এই উপত্যকা সে অর্থে সেভাবে উত্তাল হয়নি, হতে পারেনি। এর নানাবিধ কারণের মধ্যে একটা কারণ হয়ত এই যে, এ উপত্যকায় ‘অর্গ্যানিক’ (organic) বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উদ্ভব হয়নি। অর্থাৎ, সোজা কথায় বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক আধিপত্য কায়েম হয়নি। ভাষা-সাহিত্য কেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা বা সংস্কৃতি-চর্চা মূলত শহুরে এলিট শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়নি শহুরে সংস্কৃতি-চর্চায়। অর্থাৎ, সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলনের পথে পরিচালিত করার সদিচ্ছা বা সচেতন প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়নি, হয় না। গ্রাম বরাকের সঙ্গে সংযোগ তাই ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। আম জনতার রাজনৈতিক সচেতনতা ভোটের আগে হিন্দু-মুসলমান শিবির বিভাজনেই এযাবৎ সীমিত। চা-শিল্পকে কেন্দ্র করে যে বিকল্প অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারত তাও গড়ে ওঠেনি নানা কারণে। কাজেই রাজনৈতিক কোন আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণের উপযোগী পরিস্থিতি এবং পৃষ্ঠপোষক শ্রেণির অবর্তমানে ‘শান্তির দ্বীপ’ বিশেষণের আচ্ছন্নতায় আত্মপ্রসাদ লাভ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে বরাক উপত্যকার শিক্ষিত সমাজ।
তবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয়, এবারে খানিকটা নড়ে চড়ে বসতে হচ্ছে শহুরে এলিট শ্রেণিকে। জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হেনস্থার শিকার হয়ে, হতে হতে, বিশ্বায়নের সুডৌল মোয়াটি হাত ফস্কে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে ‘কিছু একটা না করলেই নয়’ অথবা ‘এভাবে চলতে পারে না’-গোছের এক মানসিকতা ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। এবং এটাও তারা উপলব্ধি করতে পারছেন যে শুধু মাত্র ভাষার আবেগ দিয়ে জনতাকে জড়ো করা যাবে না, গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তেমন দাবিদাওয়া নিয়ে হাজির হতে হবে, জনতাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হবে। এই বোধোদয়ের ফলেই ইদানীং ব্রডগেজ-মহাসড়ক ইত্যাদি দাবিগুলো ভাষাকেন্দ্রিক দাবিদাওয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে বা হতে পেরেছে, এবং এটা এক সুলক্ষণ বললেও ভুল হবে না। শহুরে এলিট বুদ্ধিজীবী শ্রেণির রূপান্তরের একটা সম্ভাবনা হয়ত দেখা দিয়েছে, দেরিতে হলেও ‘অর্গ্যানিক’ বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হওয়ার অবকাশ তৈরি হয়েছে তেমন ভাববার স্থল আছে। ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ গঠনের মধ্যে সে অঙ্কুরোদ্গমের ইশারা রয়েছে বলে মনে হয়।
করিমগঞ্জঃ সূচনাপর্ব
এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, গত কয়েক বছর ধরে শিলচরে ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ মধ্যবিত্ত- মানসকে অন্তত কিছু পরিমাণে হলেও চঞ্চল বা আন্দোলিত করার ক্ষেত্রে সক্ষম হতে পেরেছে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে। এবং তার ঢেউ বিলম্বিত লয়ে হলেও কুশিয়ারার কূলেও আঘাত করেছে অবশেষে। ‘শিলচরে তবু কিছু হচ্ছে, কিন্তু এখানে তার ছিটেফোঁটাও নেই’ - করিমগঞ্জের বৌদ্ধিক মহলে এজাতীয় আলোচনা গা ঝাড়া দিতে শুরু করে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের উদ্যোগে ও শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকদের সমর্থনে এবং সহযোগিতায় এখানেও, অতএব, গত ১৪ জুলাই, ২০১৩ তারিখে, ২১শে জুলাই-কে সামনে রেখে, আয়োজিত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ, করিমগঞ্জ’-এর অস্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়। তিন মাসের সময়সীমা ধার্য হয়, পুর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন সহ আনুষাঙ্গিক সাংগঠনিক কাজকর্মের জন্য। যাত্রা শুরু হয় ‘একুশের পথ চলা’ দিয়ে। নাগরিকদের তরফে প্রত্যাশিত সাড়াও পাওয়া যায়। অর্থাৎ, সম্মিলিত প্রয়াসের প্রয়োজন যে অনুভূত হচ্ছে সেটা অবশ্যই বাস্তব।
এমন নয় যে, নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্যকে সামনে রেখে দূরদৃষ্টিসম্পন্নতা নিয়ে সচেতন ভাবে ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলো এতে সামিল হয়ছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে উপযোগী চিন্তা-চর্চা রয়েছে নিশ্চয়, এমন কি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও। তা হলেও আপাতত অ-রাজনৈতিক (?) মঞ্চ হিসেবেই এর গ্রহণযোগ্যতা। ব্রডগেজ, মহাসড়ক সংক্রান্ত দাবিদাওয়া ইত্যাদি নিয়েই সরব হওয়ার ব্যাপারে একটা ঐকমত্য সাব্যস্ত হয়েছে। ভাষা-ধর্ম নির্বিশেষে সামগ্রিক ঐক্যের ভিত্তিতে ছোট-বড় সব ভাষা-গোষ্ঠীর সংরক্ষণ ও বিকাশের কথা বলা হয়েছে ঘোষণা-পত্রে। এক কথায় সুস্থ সামাজিক বাতাবরণ বজায় রাখার প্রশ্নে সকলেই একমত। আবার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতেও চায় করিমগঞ্জ, মানে শিলচরের শাখা-সংগঠন হিসেবে নয়, বরং এক স্বতন্ত্র সহযোগী সংগঠন হিসেবেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায় এই মঞ্চ। এক ‘নূতন প্রয়াস’ হিসেবে এই শুরুর এক তাৎপর্য অবশ্যই আছে, আগামীতে রূপরেখা কিভাবে নির্দিষ্ট হয় তার উপর নির্ভর করবে সংগঠনের ভবিষ্যৎ।
সমস্যাসঙ্কুলতা
শিলচর ও করিমগঞ্জের প্রেক্ষিত এক নয়, আলাদা। শিলচরে ধারাবাহিক সংস্কৃতি-চর্চার একটা পরিবেশ রয়েছে। বিভিন্ন দল, সংগঠন নিজেদের মত করে কাজ করে চলেছে। এখানে বিগত এক দশক যাবৎ এই চর্চার বিষয়টি স্তিমিত বা প্রায় অনুপস্থিত বলা যায়। নিয়মিত চর্চা বলতে যা বোঝায় তা চালিয়ে যাচ্ছে এমন কোন সংস্থা আপাতত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। উনিশ-একুশের বাৎসরিক আনুষ্ঠানিকতা, বিভিন্ন জন্মজয়ন্তী, সাপ্তাহিক/মাসিক সাহিত্য-আসর, নৃত্য-গীতের বিবিধ-ভারতী ছাড়া আর কিছু সেভাবে চোখে পড়ে না। নাটকের দল নেই-ই প্রায়। এরকম অবস্থায় মূলত ‘সম্মিলিত মঞ্চের’ ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্বের পরিবর্তে সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্রের শূন্যস্থানটি পূরণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াই আশু কর্তব্য বলে মনে হয়। অর্থাৎ, ব্যাপারটা এখানে ছোট ছোট বৃত্ত মিলে বড় গোলক সৃষ্টির ব্যাপার নয়, বিন্দু তৈরির প্রচেষ্টা মাত্র।
করিমগঞ্জের বৌদ্ধিক চিন্তা-চর্চার পরিসরটি এমনিতেই হঠাৎ করে যেন গুটিয়ে গেছে। এর একটা বড় কারণ এই যে, এখানে কোটিতে গুটিক যে ক’জন চিন্তাবিদ ছিলেন তাঁদের অধিকাংশ হয় প্রয়াত নতুবা পরবাসী। বৌদ্ধিক অভিভাবকত্ব বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। শূন্যস্থান পূরণের উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। দু’একজন থাকলেও আপাতত সামাজিক ভাবে সক্রিয় ন’ন। ফলে, আধিপত্যকামী বা যশোপ্রার্থীদের খপ্পড় থেকে সংগঠনকে বাঁচাতে বেশ কিছু বেগ পেতে হবে। সাংগঠনিক ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বজায় রাখাটা এক্ষেত্রে তাই খুব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেবে। এ বিষয়ে সচেতন থাকা আবশ্যক।
এও স্মরণ রাখা দরকার যে, বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের মত স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মোকাবিলা করেই ‘মঞ্চ’কে তার গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। কাজটা খুব সহজ হবে না বটে, তবে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ব্যতীত নান্য পন্থা। এক্ষেত্রে প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে ‘উনিশ-একুশের চেতনা’ নামক বায়বীয় ধারণার আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে ’৬১র ভাষা-আন্দোলনের নির্মোহ ও যথার্থ মূল্যায়নে ব্রতী হওয়া। প্রসঙ্গত, এখানে ১৭ই আগস্ট কিংবা ১৫ই মার্চও কেন উদ্ যাপিত হবে না, অর্থাৎ শহিদ বাচ্চু চক্রবর্তী (১৯৭২) ও সুদেষ্ণা সিনহাদের (১৯৯৬) আত্মবলিদান সম্পর্কে উদাসীনতা কেন প্রশ্রয় পাবে সেও ভেবে দেখা উচিৎ। এমন কি ২০১০ সালের আরেক ২১শে জুলাইয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বরপেটা জেলায় বাঙালির জাতিগত অধিকারের জন্য আত্ম-বলিদানের ঘটনার মূল্যায়ন আমরা কীভাবে করব তা নিয়েও চিন্তা-চর্চা জরুরি ভীষণ।
প্রশ্নগুলো একারণেই উঠছে, যেহেতু বরাক উপত্যকার মানুষের ভাষা-সংস্কৃতি সংক্রান্ত দাবিদাওয়াগুলোও শেষ বিচারে কেবল আঞ্চলিক বিষয় মাত্র নয়, এর সঙ্গে রাষ্ট্রনীতি তথা বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। একথা মাথায় রেখে ভাষাগত অধিকারের প্রশ্নটিকে ভাষাভাষী মানুষের জীবনযাপনের সমস্যা ও অধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারলে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে না। এক্ষেত্রে এনরেগা(NREGA), খাদ্য-সুরক্ষা(Food Security) ইত্যাদি বিষয়গুলিও ব্রডগেজ-মহাসড়কের দাবিদাওয়ার পাশাপাশি রাখা যায় কি না ভেবে দেখা উচিত। ছাত্র ও শিক্ষক, এবং অবশ্যই যুবসমাজকে - যার বড় অংশ হয় ক্যারিয়ার গড়ায় মগ্ন, নয়তো দলীয় রাজনীতির আবর্তে মুরব্বিদের ফ্যান-এ পরিণত - আকর্ষিত করতেই হবে। এই কাজটা জরুরি এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত যুবসম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভবপর বা কার্যকরী হবে না। এই দুর্বলতা সমূহ কাটিয়ে উঠতে পারা না-পারার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সম্মিলিত মঞ্চের সাফল্য-অসাফল্যের প্রসঙ্গটি।
আশা ও সম্ভাবনা
যে দুর্বলতার কথা এতক্ষণ ধরে আলোচনা করা হল তা থেকে নেতিবাচক কোন অবস্থান অথবা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ একেবারেই জরুরি নয়। জরুরি নয়, কেননা, করিমগঞ্জের এক সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। ’৬১র ভাষা-আন্দোলনের মূল উৎসভূমি ও নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই করিমগঞ্জ শহর। পরবর্তীতেও ’৭২ এবং ’৮৬ সালে এবং এমন কি ’৯৬ সালে সুদেষ্ণা সিনহার শহিদ হওয়ার সময়েও করিমগঞ্জ মুখ্য ভূমিকায় থেকেছে। এটা বারবার ঘটেছে, আমরা দেখেছি। দ্বিতীয়ত, করিমগঞ্জ জেলায় গ্রাম ও শহরের মধ্যে দূরত্ব ও ব্যবধান তুলনামূলক ভাবে কম। গ্রাম-শহরের মাঝে মানসিক ফারাক দুস্তর নয়। এটা একটা সুবিধের দিক, জন-সংযোগের ক্ষেত্রে।
‘করিমগঞ্জে নেতার অভাব’ – এরকম আক্ষেপ অথবা কানাঘুষো প্রায়শই শোনা যায়। অথচ তা সত্ত্বেও করিমগঞ্জে এখন পর্যন্ত কোনও দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবাজের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম হয়নি। (তার মানে এই নয় যে এখানে লুঠতরাজ চলছে না, সে তো আছেই, কেবল একচেটিয়া নয় !) বরাক উপত্যকায় এটা প্রায় ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে। আপাতভাবে ঢিলেঢালা মনে হলেও এক সূক্ষ্ম প্রতিরোধ-প্রবণতা এ শহরের নাগরিক সমাজে ক্রিয়াশীল থাকে বলেই আমার ধারণা। কাজেই এখানে ইতিবাচক নেতৃত্বের গড়ে ওঠা এবং ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা অধিক বলে ধরে নেওয়া যায়। বহু রকমের দুর্বলতা সত্ত্বেও এরকম আশা জাগানিয়া ব্যাপারগুলো আছে। আর সে কারণেই ঠিক মত হাল ধরতে পারলে তরী বাওয়া খুব কঠিন হবে না বলেই বোধ হয়, অন্তত ভরাডুবির ভয় সে তুলনায় কম।
মন্তব্য
শেষ করার আগে একটা বিষয় স্মরণ করিয়ে দেওয়া বোধহয় দরকার। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রান্তিক অবস্থানে টিকে থাকার লড়াইয়ে সামিল যারা, তাদের বহু রকমের বাধা টপকে চলতে হয়, চলার কৃৎ-কৌশল নিজেদেরই আয়ত্ত করে নিতে হয়। অর্থাৎ, লড়াইয়ের পদ্ধতিতে মৌলিকতা আবশ্যক হয়ে ওঠে। ফলে চিন্তার ক্ষেত্রেও মৌলিকতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। এর দৃষ্টান্ত এখানকার ইতিহাস হাতড়ালেই পাওয়া যাবে। বরাক উপত্যকার সমাজ-গঠন প্রক্রিয়াটি এখনো অসম্পূর্ণ, অন্তত ইতিহাসবিদদের এরকমই অভিমত। এই অসম্পূর্ণ বা থমকে থাকা সমাজ-গঠন প্রক্রিয়াটিকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ জরুরি অনুঘটকের ভূমিকা নিতে পারে বলেই মনে হয়। অবশ্য সবটাই নির্ভর করবে মঞ্চের আগামী রূপরেখা, কর্মপদ্ধতি ও কার্যসূচী কীভাবে নির্ণীত হয় তার ওপর। আপাতত সেদিকে সতৃষ্ণ ও তীক্ষ্ণ নজর রাখা ব্যতীত ভিন্ন উপায় নেই।
হালে ‘তেলেঙ্গানা’র রাজ্যের মর্যাদা প্রাপ্তির প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে অসম তথা উত্তরপূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিতে আরম্ভ করেছে। ভাষাভিত্তিক রাজ্য-গঠন ও ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক ভিত ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আবার পৃথক রাজ্যের দাবিতেও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সরব হচ্ছে, আন্দোলন জঙ্গি হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে রাষ্ট্র এর মোকাবিলা কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় করার চেষ্টা করে সেও লক্ষণীয় বিষয় হবে বটে। অসমের পুনর্বিভাজন যদি অনিবার্য হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে বরাক উপত্যকার বাঙালি সহ অন্য ভাষাভাষী মানুষকে নূতন করে ভাবতে হবে, ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করতে হবে হয়ত। এইসব বিষয়, পরিবর্তনশীল সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং গোটা প্রেক্ষিতটাকে মাথায় রেখে উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক পথ বেছে নিতে হবে। তবে চলতে শুরু করাটাই আপাতত সবচেয়ে জরুরি। চলতে গিয়ে হোঁচট খেতেও হতে পারে, কিন্তু তাতে ক্ষতি কিছু নেই, ওভাবে চলতে চলতেই একদিন হয়ত গন্তব্যে পৌঁছনোর পথ সম্মুখে এসে দাঁড়াবে।
.....................................................................................................................
।। মৃন্ময় দেব ।।
পটভূমি
বরাক, বঞ্চনার আরেক নাম - যদি বলি, তাহলে খুব ভুল বলা হবে কি? বোধহয় না। বরাক উপত্যকা যাদের বাসভূমি তাদের বৃহদাংশ নিঃসন্দেহে আমার পক্ষেই ভোট দেবেন। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে বিগত সাড়ে ছয় দশকে আর্থ-সামাজিক মাজাঘঁসা যেটুকুও বা হয়েছে তার কোনো চিহ্ন বরাক উপত্যকায় আঁতি -পাঁতি করে খুঁজলেও মেলা ভার। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃ সুলভ আচরণ তার জন্য নিশ্চয় বহুলাংশে দায়ী, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। প্রয়াত সুজিৎ চৌধুরীর অনুকরণে বলা যায় যে, উনবিংশ শতাব্দির শেষ পর্বে আধুনিকতার চিহ্ন কিংবা অগ্রগতির সোপান-স্বরূপ যে রেলপথ আমাদের ভাগ্যে জুটেছিল, সেই রেলপথ একবিংশ শতাব্দির এক দশক অতিক্রান্ত হবার পরও আদৌ টিকে থাকবে কি না তা-ই আজ এক বিরাট প্রশ্ন। ‘ভাষা শহিদ স্টেশন’ নামকরণের দাবি যতই জোরালো হোক না কেন এই বাস্তবতাও অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই।
বলা অহেতুক যে, এ হেন দুরবস্থার জন্য সম পরিমাণে দায়ী এক নিদারুণ সামাজিক উদাসীনতা, যে উদাসীনতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার রাজনৈতিক চালিয়াতি হল ‘শান্তির দ্বীপ’ নামক বিশেষণে এই উপত্যকাকে ভূষিত করা। ’৬১র ভাষা-আন্দোলনের পর এই উপত্যকা সে অর্থে সেভাবে উত্তাল হয়নি, হতে পারেনি। এর নানাবিধ কারণের মধ্যে একটা কারণ হয়ত এই যে, এ উপত্যকায় ‘অর্গ্যানিক’ (organic) বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উদ্ভব হয়নি। অর্থাৎ, সোজা কথায় বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক আধিপত্য কায়েম হয়নি। ভাষা-সাহিত্য কেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা বা সংস্কৃতি-চর্চা মূলত শহুরে এলিট শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়নি শহুরে সংস্কৃতি-চর্চায়। অর্থাৎ, সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলনের পথে পরিচালিত করার সদিচ্ছা বা সচেতন প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়নি, হয় না। গ্রাম বরাকের সঙ্গে সংযোগ তাই ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। আম জনতার রাজনৈতিক সচেতনতা ভোটের আগে হিন্দু-মুসলমান শিবির বিভাজনেই এযাবৎ সীমিত। চা-শিল্পকে কেন্দ্র করে যে বিকল্প অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারত তাও গড়ে ওঠেনি নানা কারণে। কাজেই রাজনৈতিক কোন আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণের উপযোগী পরিস্থিতি এবং পৃষ্ঠপোষক শ্রেণির অবর্তমানে ‘শান্তির দ্বীপ’ বিশেষণের আচ্ছন্নতায় আত্মপ্রসাদ লাভ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে বরাক উপত্যকার শিক্ষিত সমাজ।
তবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয়, এবারে খানিকটা নড়ে চড়ে বসতে হচ্ছে শহুরে এলিট শ্রেণিকে। জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হেনস্থার শিকার হয়ে, হতে হতে, বিশ্বায়নের সুডৌল মোয়াটি হাত ফস্কে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে ‘কিছু একটা না করলেই নয়’ অথবা ‘এভাবে চলতে পারে না’-গোছের এক মানসিকতা ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। এবং এটাও তারা উপলব্ধি করতে পারছেন যে শুধু মাত্র ভাষার আবেগ দিয়ে জনতাকে জড়ো করা যাবে না, গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তেমন দাবিদাওয়া নিয়ে হাজির হতে হবে, জনতাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হবে। এই বোধোদয়ের ফলেই ইদানীং ব্রডগেজ-মহাসড়ক ইত্যাদি দাবিগুলো ভাষাকেন্দ্রিক দাবিদাওয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে বা হতে পেরেছে, এবং এটা এক সুলক্ষণ বললেও ভুল হবে না। শহুরে এলিট বুদ্ধিজীবী শ্রেণির রূপান্তরের একটা সম্ভাবনা হয়ত দেখা দিয়েছে, দেরিতে হলেও ‘অর্গ্যানিক’ বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হওয়ার অবকাশ তৈরি হয়েছে তেমন ভাববার স্থল আছে। ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ গঠনের মধ্যে সে অঙ্কুরোদ্গমের ইশারা রয়েছে বলে মনে হয়।
করিমগঞ্জঃ সূচনাপর্ব
এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, গত কয়েক বছর ধরে শিলচরে ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ মধ্যবিত্ত- মানসকে অন্তত কিছু পরিমাণে হলেও চঞ্চল বা আন্দোলিত করার ক্ষেত্রে সক্ষম হতে পেরেছে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে। এবং তার ঢেউ বিলম্বিত লয়ে হলেও কুশিয়ারার কূলেও আঘাত করেছে অবশেষে। ‘শিলচরে তবু কিছু হচ্ছে, কিন্তু এখানে তার ছিটেফোঁটাও নেই’ - করিমগঞ্জের বৌদ্ধিক মহলে এজাতীয় আলোচনা গা ঝাড়া দিতে শুরু করে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের উদ্যোগে ও শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকদের সমর্থনে এবং সহযোগিতায় এখানেও, অতএব, গত ১৪ জুলাই, ২০১৩ তারিখে, ২১শে জুলাই-কে সামনে রেখে, আয়োজিত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ, করিমগঞ্জ’-এর অস্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়। তিন মাসের সময়সীমা ধার্য হয়, পুর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন সহ আনুষাঙ্গিক সাংগঠনিক কাজকর্মের জন্য। যাত্রা শুরু হয় ‘একুশের পথ চলা’ দিয়ে। নাগরিকদের তরফে প্রত্যাশিত সাড়াও পাওয়া যায়। অর্থাৎ, সম্মিলিত প্রয়াসের প্রয়োজন যে অনুভূত হচ্ছে সেটা অবশ্যই বাস্তব।
এমন নয় যে, নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্যকে সামনে রেখে দূরদৃষ্টিসম্পন্নতা নিয়ে সচেতন ভাবে ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলো এতে সামিল হয়ছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে উপযোগী চিন্তা-চর্চা রয়েছে নিশ্চয়, এমন কি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও। তা হলেও আপাতত অ-রাজনৈতিক (?) মঞ্চ হিসেবেই এর গ্রহণযোগ্যতা। ব্রডগেজ, মহাসড়ক সংক্রান্ত দাবিদাওয়া ইত্যাদি নিয়েই সরব হওয়ার ব্যাপারে একটা ঐকমত্য সাব্যস্ত হয়েছে। ভাষা-ধর্ম নির্বিশেষে সামগ্রিক ঐক্যের ভিত্তিতে ছোট-বড় সব ভাষা-গোষ্ঠীর সংরক্ষণ ও বিকাশের কথা বলা হয়েছে ঘোষণা-পত্রে। এক কথায় সুস্থ সামাজিক বাতাবরণ বজায় রাখার প্রশ্নে সকলেই একমত। আবার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতেও চায় করিমগঞ্জ, মানে শিলচরের শাখা-সংগঠন হিসেবে নয়, বরং এক স্বতন্ত্র সহযোগী সংগঠন হিসেবেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায় এই মঞ্চ। এক ‘নূতন প্রয়াস’ হিসেবে এই শুরুর এক তাৎপর্য অবশ্যই আছে, আগামীতে রূপরেখা কিভাবে নির্দিষ্ট হয় তার উপর নির্ভর করবে সংগঠনের ভবিষ্যৎ।
সমস্যাসঙ্কুলতা
শিলচর ও করিমগঞ্জের প্রেক্ষিত এক নয়, আলাদা। শিলচরে ধারাবাহিক সংস্কৃতি-চর্চার একটা পরিবেশ রয়েছে। বিভিন্ন দল, সংগঠন নিজেদের মত করে কাজ করে চলেছে। এখানে বিগত এক দশক যাবৎ এই চর্চার বিষয়টি স্তিমিত বা প্রায় অনুপস্থিত বলা যায়। নিয়মিত চর্চা বলতে যা বোঝায় তা চালিয়ে যাচ্ছে এমন কোন সংস্থা আপাতত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। উনিশ-একুশের বাৎসরিক আনুষ্ঠানিকতা, বিভিন্ন জন্মজয়ন্তী, সাপ্তাহিক/মাসিক সাহিত্য-আসর, নৃত্য-গীতের বিবিধ-ভারতী ছাড়া আর কিছু সেভাবে চোখে পড়ে না। নাটকের দল নেই-ই প্রায়। এরকম অবস্থায় মূলত ‘সম্মিলিত মঞ্চের’ ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্বের পরিবর্তে সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্রের শূন্যস্থানটি পূরণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াই আশু কর্তব্য বলে মনে হয়। অর্থাৎ, ব্যাপারটা এখানে ছোট ছোট বৃত্ত মিলে বড় গোলক সৃষ্টির ব্যাপার নয়, বিন্দু তৈরির প্রচেষ্টা মাত্র।
করিমগঞ্জের বৌদ্ধিক চিন্তা-চর্চার পরিসরটি এমনিতেই হঠাৎ করে যেন গুটিয়ে গেছে। এর একটা বড় কারণ এই যে, এখানে কোটিতে গুটিক যে ক’জন চিন্তাবিদ ছিলেন তাঁদের অধিকাংশ হয় প্রয়াত নতুবা পরবাসী। বৌদ্ধিক অভিভাবকত্ব বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। শূন্যস্থান পূরণের উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। দু’একজন থাকলেও আপাতত সামাজিক ভাবে সক্রিয় ন’ন। ফলে, আধিপত্যকামী বা যশোপ্রার্থীদের খপ্পড় থেকে সংগঠনকে বাঁচাতে বেশ কিছু বেগ পেতে হবে। সাংগঠনিক ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বজায় রাখাটা এক্ষেত্রে তাই খুব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেবে। এ বিষয়ে সচেতন থাকা আবশ্যক।
এও স্মরণ রাখা দরকার যে, বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের মত স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মোকাবিলা করেই ‘মঞ্চ’কে তার গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। কাজটা খুব সহজ হবে না বটে, তবে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ব্যতীত নান্য পন্থা। এক্ষেত্রে প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে ‘উনিশ-একুশের চেতনা’ নামক বায়বীয় ধারণার আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে ’৬১র ভাষা-আন্দোলনের নির্মোহ ও যথার্থ মূল্যায়নে ব্রতী হওয়া। প্রসঙ্গত, এখানে ১৭ই আগস্ট কিংবা ১৫ই মার্চও কেন উদ্ যাপিত হবে না, অর্থাৎ শহিদ বাচ্চু চক্রবর্তী (১৯৭২) ও সুদেষ্ণা সিনহাদের (১৯৯৬) আত্মবলিদান সম্পর্কে উদাসীনতা কেন প্রশ্রয় পাবে সেও ভেবে দেখা উচিৎ। এমন কি ২০১০ সালের আরেক ২১শে জুলাইয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বরপেটা জেলায় বাঙালির জাতিগত অধিকারের জন্য আত্ম-বলিদানের ঘটনার মূল্যায়ন আমরা কীভাবে করব তা নিয়েও চিন্তা-চর্চা জরুরি ভীষণ।
প্রশ্নগুলো একারণেই উঠছে, যেহেতু বরাক উপত্যকার মানুষের ভাষা-সংস্কৃতি সংক্রান্ত দাবিদাওয়াগুলোও শেষ বিচারে কেবল আঞ্চলিক বিষয় মাত্র নয়, এর সঙ্গে রাষ্ট্রনীতি তথা বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। একথা মাথায় রেখে ভাষাগত অধিকারের প্রশ্নটিকে ভাষাভাষী মানুষের জীবনযাপনের সমস্যা ও অধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারলে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে না। এক্ষেত্রে এনরেগা(NREGA), খাদ্য-সুরক্ষা(Food Security) ইত্যাদি বিষয়গুলিও ব্রডগেজ-মহাসড়কের দাবিদাওয়ার পাশাপাশি রাখা যায় কি না ভেবে দেখা উচিত। ছাত্র ও শিক্ষক, এবং অবশ্যই যুবসমাজকে - যার বড় অংশ হয় ক্যারিয়ার গড়ায় মগ্ন, নয়তো দলীয় রাজনীতির আবর্তে মুরব্বিদের ফ্যান-এ পরিণত - আকর্ষিত করতেই হবে। এই কাজটা জরুরি এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত যুবসম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভবপর বা কার্যকরী হবে না। এই দুর্বলতা সমূহ কাটিয়ে উঠতে পারা না-পারার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সম্মিলিত মঞ্চের সাফল্য-অসাফল্যের প্রসঙ্গটি।
আশা ও সম্ভাবনা
যে দুর্বলতার কথা এতক্ষণ ধরে আলোচনা করা হল তা থেকে নেতিবাচক কোন অবস্থান অথবা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ একেবারেই জরুরি নয়। জরুরি নয়, কেননা, করিমগঞ্জের এক সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। ’৬১র ভাষা-আন্দোলনের মূল উৎসভূমি ও নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই করিমগঞ্জ শহর। পরবর্তীতেও ’৭২ এবং ’৮৬ সালে এবং এমন কি ’৯৬ সালে সুদেষ্ণা সিনহার শহিদ হওয়ার সময়েও করিমগঞ্জ মুখ্য ভূমিকায় থেকেছে। এটা বারবার ঘটেছে, আমরা দেখেছি। দ্বিতীয়ত, করিমগঞ্জ জেলায় গ্রাম ও শহরের মধ্যে দূরত্ব ও ব্যবধান তুলনামূলক ভাবে কম। গ্রাম-শহরের মাঝে মানসিক ফারাক দুস্তর নয়। এটা একটা সুবিধের দিক, জন-সংযোগের ক্ষেত্রে।
‘করিমগঞ্জে নেতার অভাব’ – এরকম আক্ষেপ অথবা কানাঘুষো প্রায়শই শোনা যায়। অথচ তা সত্ত্বেও করিমগঞ্জে এখন পর্যন্ত কোনও দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবাজের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম হয়নি। (তার মানে এই নয় যে এখানে লুঠতরাজ চলছে না, সে তো আছেই, কেবল একচেটিয়া নয় !) বরাক উপত্যকায় এটা প্রায় ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে। আপাতভাবে ঢিলেঢালা মনে হলেও এক সূক্ষ্ম প্রতিরোধ-প্রবণতা এ শহরের নাগরিক সমাজে ক্রিয়াশীল থাকে বলেই আমার ধারণা। কাজেই এখানে ইতিবাচক নেতৃত্বের গড়ে ওঠা এবং ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা অধিক বলে ধরে নেওয়া যায়। বহু রকমের দুর্বলতা সত্ত্বেও এরকম আশা জাগানিয়া ব্যাপারগুলো আছে। আর সে কারণেই ঠিক মত হাল ধরতে পারলে তরী বাওয়া খুব কঠিন হবে না বলেই বোধ হয়, অন্তত ভরাডুবির ভয় সে তুলনায় কম।
মন্তব্য
শেষ করার আগে একটা বিষয় স্মরণ করিয়ে দেওয়া বোধহয় দরকার। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রান্তিক অবস্থানে টিকে থাকার লড়াইয়ে সামিল যারা, তাদের বহু রকমের বাধা টপকে চলতে হয়, চলার কৃৎ-কৌশল নিজেদেরই আয়ত্ত করে নিতে হয়। অর্থাৎ, লড়াইয়ের পদ্ধতিতে মৌলিকতা আবশ্যক হয়ে ওঠে। ফলে চিন্তার ক্ষেত্রেও মৌলিকতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। এর দৃষ্টান্ত এখানকার ইতিহাস হাতড়ালেই পাওয়া যাবে। বরাক উপত্যকার সমাজ-গঠন প্রক্রিয়াটি এখনো অসম্পূর্ণ, অন্তত ইতিহাসবিদদের এরকমই অভিমত। এই অসম্পূর্ণ বা থমকে থাকা সমাজ-গঠন প্রক্রিয়াটিকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ জরুরি অনুঘটকের ভূমিকা নিতে পারে বলেই মনে হয়। অবশ্য সবটাই নির্ভর করবে মঞ্চের আগামী রূপরেখা, কর্মপদ্ধতি ও কার্যসূচী কীভাবে নির্ণীত হয় তার ওপর। আপাতত সেদিকে সতৃষ্ণ ও তীক্ষ্ণ নজর রাখা ব্যতীত ভিন্ন উপায় নেই।
হালে ‘তেলেঙ্গানা’র রাজ্যের মর্যাদা প্রাপ্তির প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে অসম তথা উত্তরপূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিতে আরম্ভ করেছে। ভাষাভিত্তিক রাজ্য-গঠন ও ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক ভিত ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আবার পৃথক রাজ্যের দাবিতেও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সরব হচ্ছে, আন্দোলন জঙ্গি হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে রাষ্ট্র এর মোকাবিলা কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় করার চেষ্টা করে সেও লক্ষণীয় বিষয় হবে বটে। অসমের পুনর্বিভাজন যদি অনিবার্য হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে বরাক উপত্যকার বাঙালি সহ অন্য ভাষাভাষী মানুষকে নূতন করে ভাবতে হবে, ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করতে হবে হয়ত। এইসব বিষয়, পরিবর্তনশীল সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং গোটা প্রেক্ষিতটাকে মাথায় রেখে উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক পথ বেছে নিতে হবে। তবে চলতে শুরু করাটাই আপাতত সবচেয়ে জরুরি। চলতে গিয়ে হোঁচট খেতেও হতে পারে, কিন্তু তাতে ক্ষতি কিছু নেই, ওভাবে চলতে চলতেই একদিন হয়ত গন্তব্যে পৌঁছনোর পথ সম্মুখে এসে দাঁড়াবে।
.....................................................................................................................
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন