“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০২০

কোরেন্টিন ডে'জ

।। শরীফ আহমদ ।।
 

"কোরেন্টিন ডেজ - প্রিলিউড'


         সপ্তাহ খানেক আগেই টিকিট করে রেখেছিলাম। কিন্তু যে হারে রোজ রোজ নন-মেট্রো শহরে যাওয়া ফ্লাইটগুলো বাতিল হচ্ছিল তাতে কিছুটা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কখন যে আমার ফ্লাইট বাতিল হয় আর এরপর কী করব ভাবতে ভাবতেই এয়ারলাইন্সের নোটিফিকেশন এলো। না, কেন্সেল নয় টাইম টেবল বদলে দিয়েছে বেটারা। তিরিশ চল্লিশ পার্সেন্টের বেশি ফ্লাইট চলছে না তাই এই এডজাস্টমেন্ট মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। 

         সকাল পাঁচটায় উঠে কলকাতা হয়ে এক‌ই ফ্লাইটে গন্তব্যে পৌঁছার কথা ছিল দশটায় এখন দেখছি সেই থ্রু ফ্লাইট আর নেই। এবার বিকেল সাতটায় বসে সাড়ে নয়টায় হায়দরাবাদ এয়ারপোর্ট আর সারা রাত মোট আট ঘন্টা দীর্ঘ লে-অভার কাটিয়ে পরের দিন সকাল পাঁচটার ফ্লাইটে যেতে হবে। বলা নেই কওয়া নেই, নতুন টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছে এয়ারলাইন্স। আগের দিন সন্ধ্যায় যাত্রা শুরু করে গন্তব্য এয়ারপোর্টে পৌঁছার রাইট টাইম পরের দিন সকাল আটটা, তাও সময়মতো পৌঁছলে। এখন এক ফ্লাইটের জায়গায় দুটো ফ্লাইটে চড়ে সারারাত এক অপরিচিত এয়ারপোর্টে কাটিয়ে পরের দিন আটটায় গন্তব্যে পৌছব বা পৌঁছার সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতেই দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেলো। 

          হাজার হাজার মানুষের ভীড়ের মধ্যে দিয়ে একাধিক রাজ্য সফর করে বাড়ি পৌছা পর্যন্ত সংক্রমিত না হলেই বেঁচে যাই। এর মধ্যে আট ঘন্টা হায়দরাবাদ এয়ারপোর্টে কী করব, কী হতে যাচ্ছে তাও শঙ্কাজনক। এমনিতে মহামারী না থাকলে এসব নরমাল ব্যাপার ছিল আমার কাছে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাত্রা করেছি কতবার। ঘন্টার পর ঘন্টা অচেনা অজানা দেশের এয়ারপোর্ট লঞ্জে কাটিয়েছি কোনো শঙ্কা ছাড়াই। এখন তো আর সেই সময় নয়। 

          পিপিই কিট পরে কেউ একজন মেশিন লাগিয়ে তাপমাত্রা মাপবে, জ্বর কাশির সামান্য লক্ষণ পেলেই যাওয়া যাবে না, এয়ারপোর্টে সোস্যাল ডিসটেন্স, বিমান কর্মি ও সিআইএসেফের অস্পৃশ্য ভাব, এসব ভাবতে পারছি না। কয়েকমাস এক ভুতুড়ে ফ্লেটে নিজেকে লকডাউন করে রেখেছি। আর সহ্য হচ্ছে না। এবার ভালোয় ভালোয় বাড়ি পৌঁছলেই হলো। কিন্তু মাঝখানে কয়েকহাজার মাইল, দুটো ফ্লাইট, তিন রাজ্যের তিনটি এয়ারপোর্ট যার মধ্যে হয়তো গিজগিজ করছে করোনার জীবাণু। ফ্লেটে বসে বেগটেগ ঠিক করছি আর ভাবছি এ খুব সাধারণ এক বিমান সফর না, রিতিমত অভিযান। থাকছে ভয়, রোমাঞ্চ আর দুশ্চিন্তা। তাই প্রয়োজনের থেকেও বেশি সাবধানতা অবলম্বন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

           এয়ারপোর্টে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা দেখা হবে, সোয়াব টেস্টের জন্য নমুনা নেয়া হবে আর এরপর পাঠানো হবে কোরেন্টিনে। এতেই লেগে যাবে কয়েক ঘন্টা। রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত অন্তত ছয় সাতদিন সরকারী কোরেন্টিনে থাকতে হবে এরপর বাড়িতে গিয়ে আর‌ও সাতদিন ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে। বাড়ির বাচ্চা-কাচ্চাদের থেকে দুরে থাকতে হবে, সিনিয়র সিটিজেনদেরকে হয়তো আত্মীদের বাড়িতে পাঠাতে হবে কদিনের জন্য। এসব ভাবছি আর ঘেমে উঠছি। এতো সব সাবধানতা অবলম্বনের পর বাড়িতে সংক্রমণহীন হয়ে পৌঁছতে পারলেই কেল্লা ফতে। তবে আগামী পনেরো দিন দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকছি এতে সন্দেহ নেই।

"কোরেন্টিন ডে'জ - যাত্রা'


            করোনা কালে এয়ারলাইন্স গুলো চেক-ইন ব্যাগেজের সর্বোচ্চ ওজন পনেরো কেজ থেকে বাড়িয়ে ‌বিশ কেজি করে দিয়েছে। বিশ কেজি পর্যন্ত কোনো আলাদা টাকা দিতে হবে না। সফরকারিদের মধ্যে বেশিরভাগই এক অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়ি চলে যাচ্ছেন বলেই সম্ভবত এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ফ্লাইটের ভেতরে হাতে করে এখন একটাই ব্যাগ নিয়ে যেতে পারবেন। তাও বেশি বড়ো হলে চলবে না। এতোটা ছোটো হ‌ওয়া চাই যাতে সিটের নিচে রেখে দেয়া যায়। লেপটপের ব্যাগ হলে‌ সমস্যা নেই। উপরের ব্যাগ রাখা জায়গা এখন আর ব্যবহার করা যাবে না যাতে এক ব্যাগ আরেক ব্যাগের সংস্পর্শে না আসে,‌ বা ব্যাগ রাখার আর বের করে আনার সময় হুড়োহুড়ি না হয়, একজনের হাত আরেকজনের হাতে লেগে না যায়।

          বাজার থেকে কিছু দরকারী জিনিস কিনে নিয়ে আসলাম। হ্যান্ড সেনিটাইজার, কিছু স্ন্যাক্স, হাতমোজা, অতিরিক্ত মাস্ক ইত্যাদি। এখন নিজে নিজে চেক ইন করাও বাধ্যতামূলক। সঙ্গে বোর্ডিং পাস, ব্যাগেজ ট্যাগ ইত্যাদিও প্রিন্ট করে নিতে হবে। সকালেই করে নিলাম এই কাজগুলো। একটা সমস্যা দেখা গেলো। আমার ট্রলি ব্যাগ যে মেটেরিয়াল দিয়ে তৈরি তাতে আঠা লাগছে না। অনেকবার চেষ্টা করে দেখলাম ট্যাগগুলো‌ লাগানো যায়‌না। ব্যাগেই রেখে দিলাম। এয়ারপোর্টে নিশ্চয়ই সমাধান থাকবে। কাপড়চোপড় ও দরকারি জিনিস ভরে হ্যান্ড হেল্ড বাটখারা দিয়ে ওজন করে দেখলাম। ১৬ কেজি। লেপটপ ব্যাগে ল্যাপটপ, হার্ডড্রাইভ, চার্জার ইত্যাদি নিয়ে নিলাম ভুলে যাওয়ার আগেই। 

        ওলা বুক করে রেখেছিলাম। যথাসময়ে ড্রাইভার এসে গেলো। নির্ধারিত সময়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তা শুনশান। এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে ছুটছিল টয়োটা। ড্রাইভার কিছুটা বাচাল টাইপের। অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল স্থানীয় একসেন্টে, অর্ধেক কথা মাথায় ঢুকছিল না। এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম ৪৫ মিনিটের মধ্যে। ড্রপ পয়েন্টে পৌঁছতেই মাস্ক পরা একজন এগিয়ে এসে  ব্যাগ স্যানিটাইজার বুথের দিকে ইশারা করে যেতে দিলেন। কয়েকজন আমার আগে দাড়িয়ে আছেন। আমার পালা আসতেই ব্যাগ টেবিলে রেখে দিলাম। উগ্র গন্ধযুক্ত ক্যামিকেল মেশানো তরল স্যানিটাইজার স্প্রে করে একেবারে ভিজিয়ে দিল ব্যাগ। ভাবছিলাম আমারটা তো ওয়াটার প্রুফ, কেউ কাপড় বা কেনভাসের ব্যাগ নিয়ে আসলে সমস্যায় পড়বেন। একেবারে জবজবে করে ছাড়বে। 

        রাস্তার মতো এয়ারপোর্ট‌ও শুনশান। গেটে কাঁচের ক্যাবিনের ভেতর থেকেই টিকিট আর আইডি চেক করে ভেতরে যেতে দিলেন সিআইএস‌এফের মহিলা। আমি মনে করিয়ে দিলাম আরোগ্য সেতুর কথা। ভদ্র মহিলা হয়তো ভুলে গেছিলেন নাহলে এই আরোগ্য সেতু এখন ফর্মালিটি হয়ে গেছে সম্ভবত। মনে করিয়ে দেয়ায় জিজ্ঞেস করলেন সবুজ দেখাচ্ছে তো। মাথা নাড়িয়ে হাঁ বলতেই ভেতরে যেতে দিলেন। এয়ারলাইন্স কাউন্টারে দু মিনিটেই ব্যাগ সমঝে দিলাম। কাউন্টারে বসা মেয়েটি নতুন ব্যাগেজ ট্যাগ প্রিন্ট করে ব্যাগের হেন্ডেলে লাগিয়ে দিল। সিকিউরিটি চেক ও তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। 

            আমার ফ্লাইটের এখনও অনেক বাকি। বোর্ডিং গেটের পাশে একটি চায়ের দোকান। আমি প্রতিবার এখান থেকেই চা খাই। ষাট টাকার চায়ের কাপ আশি টাকা হয়ে গেছে। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা মাস্ক সরাতেই চিনতে পারলো। চা বানাতে বানাতে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাচ্ছি কবে ফিরছি ইত্যাদি। বললো ব্যবসা ভালো যাচ্ছেনা। সারাদিনের মধ্যে আমিই নাকি দ্বিতীয় গ্রাহক। ফ্রীতে বিস্কুট দিতে চাইল। চায়ের সঙ্গে আমার বিস্কুট পছন্দ নয় তাই মানা করলাম। চা নিয়ে এসে ওয়েটিং হলে বসলাম। 

          হলুদ স্টিকার লাগিয়ে দুটো চেয়ারের মাঝখানে এক একটা চেয়ার খালি রাখা হয়েছে যাতে সোস্যাল ডিসটেন্স মেনটেইন করা যায়। নিউজ স্ট্যান্ডগুলো খালি। পত্রিকা ম্যাগাজিন কিচ্ছু নেই। যে এয়ারপোর্ট সবসময় হ‌ই হট্টগোলে ভরে থাকতো আজ হাসপাতাল লাগছে। সবাই এক একজন রোগী বা রোগীর অভিভাবকের মতো দুশ্চিন্তায়। সবাই চাইছেন নির্বিঘ্নে সংক্রমিত না হয়ে বাড়ি পৌঁছে যেতে। একটু পর পর‌ই অনেক লোক প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে হ্যান্ড সেনিটাইজার ঘষে চলছেন। সাফাইওয়ালারা ফ্লোর সাফাই করছেন বারবার। সব মিলিয়ে তীব্র অষুধ অষুধ গন্ধ। যেন কোনো ডাক্তারখানায়  বসে আছি। এর‌ই মধ্যে আর‌ও ঘন্টা খানেক বসে থাকবে হবে ফ্লাইটের জন্য। কাঁচের দেয়ালের বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। শব্দহীন কিন্তু ছন্দময়।

"কোরেন্টিন ডে'জ - যাত্রা - ২'


           আমাকে দুখানা বোর্ডিং পাস দেয়া হয়েছিল।‌ এখান থেকে গন্তব্যে নতুন বোর্ডিং পাস লাগবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বোর্ডিংয়ের ঘোষণা হলো । সবাই দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে‌ পড়লেন। প্রথমে এক থেকে দশ, তারপর এগারো থেকে বিশ আর সবশেষে একুশ থেকে তিরিশ নম্বর লাইনের যাত্রীদেরকে দাড়াতে হবে। করোনার মাত্রাতিরিক্ত প্রচারে মানুষ ভয় পেয়ে গেছে‌‌ এটা বোঝা যাচ্ছে সহজেই। সবাই সন্ত্রস্ত, কোনো হুড়োহুড়ি নেই। হলুদ আকারের গোল গোল চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে দাঁড়ানোর জন্য, (ছবিতে দেখুন) যাতে গা ঘেষাঘেষি মোটেই না হয়। বিমানে উঠার আগে একটি প্যাকেট দেয়া হলো। তাতে একটি হালকা নিল রংয়ের মাস্ক, একটি ফেস সিল্ড (প্লাস্টিক দিয়ে বানানো, কিছুটা হেলমেটের মতো) আর কয়েক পাউচ হ্যান্ড সেনিটাইজার। সবাই মাস্ক আর শিল্ড পরেই প্লেনে উঠেছেন।‌ একটু সময় লাগলো। দুর থেকেই টিকিট আর আইডি দেখিয়ে একে একে সব যাত্রী উঠে পড়লেন।

         আমরা যে বিমানে সফর করছি সেটি এ৩২০ মডেলের। এটিই বেশিরভাগ চলছে আজকাল। সম্ভবত কুমিরের দৈহিক গঠন দেখেই এই বিমান বানানো হয়েছে তাই অনেকে একে এলিগেটর এয়ারবাস‌ও বলে থাকেন। উভয় দিকে তিনজন তিনজন করে তিরিশ লাইনে মোট ১৮০ জন যাত্রী বসার জায়গা আছে। উঠে দেখলাম অর্ধেক সিট খালি। আমার সিট ছিল ১৩এ। ইমারজেন্সি একজিটের লাগোয়া। পাশে আর কোনো সহযাত্রী এলোনা। এয়ার হোস্টেস এসে বুঝিয়ে দিলেন ইমারজেন্সিতে কী করে দরজা খুলতে হবে। আমার বিপরীত দিকের ইমারজেন্সি একজিটের পাশের ছেলেটা সম্ভবত নাইজেরিয়ার। দীর্ঘক্ষণ ওকে বুঝানোর পর হোস্টেসকে বললো ও ইংরেজি ছাড়া অন্য কিছু বুঝে না! অথচ ইংরেজিতেই বুঝিয়ে দিচ্ছিল পিপিই পরা মেয়েটি। সম্ভবত দেশি একসেন্টের জন্য ও বুঝতে পারছিল না। পরে ওকে অন্যত্র বসিয়ে ওর সিটে  অন্য আরেক ব্যক্তিকে বসানো হলো। সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ইমারজেন্সি একজিটে এমন ব্যক্তিকেই বসানো নিয়ম যিনি সব বুঝে নেন আর আপদকালীন পরিস্থিতিতে পাইলটের নির্দেশ বুঝে ইমারজেন্সি দরজা খুলতে পারেন।

         কোবিড১৯ এর জন্য‌ই বিমানে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা নেই। এয়ার হোস্টেসদের সাজগোজ, বাহারি চুলের ডিজাইন এমন কি মুখমন্ডল‌ও সম্পুর্ন ঢেকে গেছে মাস্ক ও শিল্ডের আড়ালে। অপারেশন থিয়েটারে যেরকম ডাক্তাররা আপাদমস্তক ঢেকে রাখেন এখানেও তাই। নিশ্চয়ই এখন আর বারবার মেকাপের দরকার পড়ছে না ওদের। আগে এয়ার হোস্টেসরা সবাইকে হাসিমুখে ওয়েলকাম বলে বলে সবাইকে আমন্ত্রণ করে নিতো। এখন ইশারায় কাজ চালানো হচ্ছে। বললেও মাস্কের ভেতর থেকে শোনা যাবে না। হাঁসি‌ও দেখা যাবেনা! তাই ইশারায় কাজ চালানো হচ্ছে। একটু পরেই ফ্লাইট টেক অফ করলো। বাইরে বৃষ্টি। আমার ঘুম পাচ্ছিল।

           রাত দশটায় হায়দরাবাদ পৌঁছে গেলাম। সবার ব্যাগ এসে গেছে কিন্তু একি, আমার ব্যাগ ক‌ই! সবাই ব্যাগ নিয়ে চলে গেলেন আর একসময় মোটরচালিত বেল্ট‌ও রুখে দাঁড়ালো। কিন্তু আমার লাল রঙের ট্রলি ব্যাগের খবর নেই। চিন্তিত মনে কাস্টমার কেয়ার ডেস্কে এলাম। ওরা বললো আমার ব্যাগ ডেস্টিনেশন এয়ারপোর্টে সোজা চলে যাবে। ওহ, তাই তো! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আমাকে এখানে ব্যাগ নামাতে হবে না। ওরাই কানেক্টিং ফ্লাইটে ব্যাগ তুলে দেবে। ভালোই হলো। 

           হায়দরাবাদ এয়ারপোর্ট‌ও জনমানবহীন। নামতেই দেখি সহাস্য বদনে প্রধানমন্ত্রী মোদীজি। মানে ইয়া বড় পোস্টারে মোদিজীর সহাস্য বদন।  উজ্জ্বলা প্রকল্পে ফ্রীতে গ্যাস সরবরাহের বিজ্ঞাপন। বুঝলাম না এয়ারপোর্টে এতো খরচ করে বিজ্ঞাপন লাগালে পাবলিকের কী লাভ হবে। দরিদ্র সীমার নীচে থাকা লোকরা তো এখানে এই সুমহান কর্মকাণ্ড দেখে তালি বাজাতে আসবেন না। এখন তো তালি নয় থালা বাটি বাজানোর মরশুম চলছে। আরেকটি কথা মোদীজীর এই ছবিটি অন্তত দশ বছর পুরনো ন‌ইলে ফটোশপ করে সুন্দর করা হয়েছে। এই তো সেদিন টিভিতে দেখলাম। এখন প্রধানমন্ত্রীকে অনেক বয়স্ক লাগে। সত্তর বছর তো কম নয়।
 
          ডমেস্টিক ট্রান্সফার হলে মাত্র কয়েকজন যাত্রী সকালের ফ্লাইটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি বাইরে বেরিয়ে খেয়ে আসব ভাবলাম কিন্তু গেটে গার্ড বললো একবার বেরোলে আর সকাল চারটার আগে এয়ারপোর্টে ঢুকা যাবে না। একথা শুনে বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করলাম। ভেতরে ফুড কোর্টে একটি কফির দোকান ছাড়া বাকি সব বন্ধ। যাকগে কিছু একটা খেয়ে অন্তত চা খেতে পারবো। একটা চেয়ারে বসে ব্যাগ রেগে জল খেয়ে দেখি কফির দোকান‌ও বন্ধ করে দোকানদার চলে যাচ্ছে। কী আর করা। সঙ্গে স্ন্যাক্স ছিল। সামান্য খেয়ে সময় কাটানোর জন্য লেপটপ খুললাম। ছয় সাত ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে এয়ারপোর্টে।

          হায়দরাবাদ থেকে সময়মতো প্লেন উড়লো। কয়েকখানা আসন ছেড়ে সব আসন ভর্তি। সময়মতো পৌঁছে গেলাম। এতক্ষণ সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু নামার আগে সবাই ডিসট্যান্স নর্ম ভুলে গিয়ে একসাথে নামতে শুরু করে দিলেন। রিতিমত ধাক্কাধাক্কি। আমি আর হাতে গুনা কয়েকজন বসে র‌ইলাম। সবাই নেমে যাওয়ার পর আমরাও নামলাম। 

         এর পর শুরু হলে স্ক্রীনিং। দীর্ঘ লাইন। দুখানা ফর্ম ফিলাপ করতে হয়। দেখলাম এয়ারপোর্টের কর্মীরা প্যাসেঞ্জারদেরকে রিতিমত ধমকাচ্ছেন যাতে ওরা দুরে সরে থাকে। ওরা হয়তো ভাবছে সব যাত্রীই এক একজন করোনা বোমা। এই জিনিসটা কিন্তু খুব খারাপ হচ্ছে। এত দুর থেকে নিজের রাজ্যে এসে এরকম অমানবিক ব্যবহার দেখলে খারাপ লাগে। আমি যথেষ্ট দুরে দাড়িয়ে কাগজগুলো দেখালাম। ওরা মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে নিল। সম্ভবত ছবি দেখেই কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রি করে নেবে। 

         এখানকার ফর্মালিটি শেষ করে যার যার জেলায় নির্ধারিত বাসে বসে যেতে হবে। প্রতিটি জেলায় এরজন্য অফিস বানানো হয়েছে। ওখানে গিয়ে সোয়াব সেম্পল দিয়ে যেতে হবে নির্ধারিত কোরেন্টিন সেন্টারে। আমার গন্তব্য এয়ারপোর্ট থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে। বাসে গিয়ে দেখি একমাত্র আমিই ওখানকার যাত্রী। বাস কখন যাবে কোনো ঠিক নেই। ট্যাক্সির ব্যবস্থাও আছে। ভাড়া জনপ্রতি ১৫০০ টাকা। অনেক লোক আসছে দুর দুরান্ত থেকে। কেউ কেউ কাজ হারিয়ে বাড়ি ফিরছে, কেউ কেউ হয়তো খুব গরিব। এরকম লোকের জন্য ১৫০০ টাকা অনেক বেশি, কিন্তু এরপরও লোক ট্যাক্সিতে যাচ্ছে কারণ রাজ্যিক সড়ক পরিবহনের বাস কখন যাবে কোনো ঠিক নেই।  আমিও ট্যাক্সিতে বসলাম। তিনজন যাত্রী নিয়ে মারুতি স্যুইফট যখন যাওয়া শুরু করলো তখন সকাল প্রায় দশটা। বৃষ্টি নেই কিন্তু হাইওয়ের দুপাশে বন্যার জল। ডুবিয়ে রেখেছে বাড়ি ঘর, ক্ষেতের ফসল। 


"কোরেন্টিন ডে'জ - ডে ১'


         একটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম জোনাল রেজিস্ট্রেশন কাম টেস্টিং সেন্টারে।  করোনা সংক্রমণ পরীক্ষা ও কোরেন্টিন সেন্টার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই জেলা ভিত্তিক অফিস বানানো হয়েছে। এটি একটি মিনি ইনডোর স্টেডিয়াম ছিল। এখন জোনাল কন্ট্রোল রুম। গেট থেকে পায়ে সাতশো মিটার ভেতরে অফিস। রাস্তায় কাঁদা। বেগ নিয়ে কাঁদার মধ্যে পায়ে হেঁটে অতি কষ্টে পৌঁছলাম রেজিস্ট্রেশন কাউন্টারে। ভেতরে শয়ে শয়ে লোক এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে বসে আছেন ইতস্তত। সোস্যাল ডিসটেন্সের বালাই নেই এখানে। এরকম জায়গায় ভাইরাস আরো বেশি ছড়াবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

            রেজিস্ট্রেশন কাউন্টারের লাইনে আমার আগে অন্তত পঞ্চাশ জন দাঁড়িয়ে আছেন। প্রায় দুঘন্টা পর আমার পালা এলো। জীবনেও এতক্ষণ একনাগাড়ে দাঁড়িয়ে কোথাও অপেক্ষা করিনি। পায়ে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে কিন্তু উপায় নেই। কোরেন্টিন বাধ্যতামূলক, সিস্টেম ফলো করতেই হবে। কোনো শর্টকাট নেই। রেজিষ্ট্রেশন শেষ করে একখানা চেয়ার পেয়ে বসে র‌ইলাম। আমার নাম ডাকলে কালেকশন সেন্টারে গিয়ে লালারসের স্যম্পল দিতে হবে। ঘেমে নেয়ে উঠেছি। বেগ গুলো এক কোণায় রেখে কেন্টিন থেকে ফুড প্যাক সংগ্রহ করলাম। ডিম পোলাও আর এক বোতল জল। ক্ষুধার জ্বালায় স্বাদহীন খাদ্য কোনোমতে গিলে নিলাম। কিছুক্ষণ পর নাম ডাকা শুরু হলো। প্রথম ব্যাচে আমার নাম এলো না। যাদের এলো তারা নমুনা দিয়ে কাগজে লেখা কোরেন্টিন সেন্টারে চলে গেলো। বাইরে আগে থেকেই বাস আর পুলিশ এসকর্ট প্রস্তুত ছিল। আমি বসে র‌ইলাম। গরমে অবস্থা খারাপ। এর পর তিনটার সময় দ্বিতীয় ব্যাচের নাম ডাকা শুরু হলো। এবার‌ও আমার নাম এলো না। কাউন্টারে গিয়ে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু কাঁচের দেয়ালের ওপারে বসা বাবুরা ইশারায় অপেক্ষা করতে বললো। আমার কথা ওদের কাছে পৌঁছেনি মোটেই। দশ মিনিট পর আবার গেলাম। একজন ওখান থেকে আমার ফোন নম্বর নিলেন। মোবাইলে টাইপ করে দেখালাম। উনি কাঁচের দেয়ালের ওপার থেকে ফোন করলেন। বললাম আমি কয়েক ঘন্টা আগে এসে নাম নথিভুক্ত করিয়েছি। এখনও নাম আসেনি। ভদ্রলোক অপেক্ষা করতে বললেন। দশ মিনিট পর এসে বললেন আমার কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না, হয়তো ডাটা এন্ট্রি হচ্ছে। আরও আধা ঘন্টা অপেক্ষা করতে বললেন। আশ্বাস দিলেন উনি দেখছেন। 
             আধা ঘন্টা পর ফোন করলাম। বললেন ভুল বশত আমার ফর্মগুলো রয়ে গেছিল। এখন ডাটা এন্ট্রিতে পাঠানো হয়েছে। ঘন্টা খানেক পর পরবর্তী ব্যাচে আমার স্যাম্পল নেয়া হবে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলাম। খুব পরিশ্রান্ত আর অসহ্য লাগছিল। ভাবলাম কিছু বন্ধু বান্ধবের কাছে ফোন করি। নেতা টাইপের অনেকেই চিনি, সাহায্য নেই। কিন্তু কোনোদিন কারুর কাছে সিস্টেম ডিঙ্গিয়ে সাহায্য চাইনি। তাই ধৈর্য ধরে বসে র‌ইলাম। পরের ব্যাচের নাম ডাকা হয় যখন তখন দিনের আলো শেষ হয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে। প্রায় একশ জন লোকের পর আমার নাম এলো। সাড়ে সাতটা হবে সম্ভবত। আমার মুখের লালা ও নাকের ভেতর থেকে কাগজের স্ট্রিপ ঢুকিয়ে নমুনা নেয়া হলো। এরপর হাতে দেয়া হলো কোরেন্টিন সেন্টারের কাগজ। এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে যেতে হবে। এখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। দেখেই আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। আগের ভদ্রলোককে অনুরোধ করলাম পাশাপাশি কোনো হোটেলে ব্যবস্থা হবে কি না। বললেন কোথাও জায়গা নেই। বন্যার জল ঢুকায় অনেক কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। হোটেলে কোথাও জায়গা খালি নেই। অত‌এব আমাকে ইতিমধ্যে বরাদ্দ করা জায়গায় যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। ভারাক্রান্ত মনে মেনে নিলাম। আমার সমস্যা দূরের জায়গা এটা নয়। চিন্তা একটাই ছিল থাকার ব্যবস্থা বিশেষ করে সেনিটেশন ঠিকঠাক থাকবে কি না। 

          এর পর বাসের জন্য অপেক্ষা শুরু হলো। আবার পায়ে হেটে কাঁদা ঠেলে এলাম পিক‌আপ পয়েন্টে। অপেক্ষার পর অপেক্ষা, যেন শেষ হয়না। এতো পরিশ্রান্ত কখনও হয়নি।  রাত এগারোটা নাগাদ বাসে উঠার হুকুম এলো। দুটি টাটা স্টারবাসে মোট চল্লিশ জন নিয়ে বাস ছুটলো নির্ধারিত কোরেন্টিন সেন্টারের উদ্দেশ্য। বেগ উঠাতে গিয়ে পিঠে কোথাও লেগেছে সম্ভবত। পিঠের বামপাশে ব্যথা করছিল। ডাইক্লোফেনেক ট্যাবলেট আছে ব্যাগে। খেয়ে নিলে ঠিক হয়ে যাবে। রাত বারোটা নাগাদ কোরেন্টিন সেন্টারে পৌঁছলাম। আরেকপ্রস্ত লেখালেখির পর আমাদেরকে বেড সমঝিয়ে দেয়া হলো।

            এখানের অবস্থা মোটামুটি ভালোই। একখানা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলকে মোটামুটি হাসপাতাল বানিয়ে দেয়া হয়েছে। যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে বিছানা লাগানো হয়েছে। সবাইকে নতুন নতুন কম্বল, বালিশ, বিছানার চাদর আর মশারি দেয়া হলো। সাথে একটি করে বালতি, মগ, সাবান, সার্ফের প্যাকেট, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদিও দেয়া হলো। বিছানায় এসে ব্যাগ রেখে আগে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। অনেক বাথরুম টয়লেট বানানো হয়েছে। জলের অসুবিধা নেই। পাওয়ার বেক‌আপ‌ও আছে তাই বিদ্যুৎ গেলেও সমস্যা হবে না। এর পর রাতের খাবার দেয়া হলো। গরম গরম ভাত, মুগ ডাল আর একখানা সবজি। সুস্বাদু খাবার। এতো রাতেও এখানকার লোকেরা তাদের দায়িত্ব যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছে দেখে খুব ভালো লাগলো। শেষ হলো প্রথম দিনের কোরেন্টিন। পিঠের ব্যাথা বাড়ছে। ট্যাবলেট খেয়ে বিছানায় আসতেই সারা দিনের ক্লান্তির কাছে হার মানলাম।


"কোরেন্টিন ডেজ - অপেক্ষা'


             আমাদের ব্যাচে মোট ৩২ জন বোর্ডার। তিনটি রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন‌। এই কদিন বন্যার প্রকোপ চার দিকে। পাশাপাশি অনেক কোরেন্টিন সেন্টারে বন্যার জল ঢুকে পড়ায় আমাদেরকে অনেক দূরের এই সেন্টারে পাঠানো হয়েছে। আমার বাড়ি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার হবে সম্ভবত। এটি একটি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। জায়গাটা পাশাপাশি অঞ্চল থেকে উঁচু। তাই এখানে আপাততো জল ঢুকার সম্ভাবনা নেই। স্কুলের বাউন্ডারি থেকে দেখা যায় পাশের মাঠ ও ঘরবাড়ি জলমগ্ন। শুনলাম স্কুলেরই এক সহকারী শিক্ষকের বাড়ি জলের তলায় চলে যাওয়ায় উনি নিকটস্থ ত্রাণ শিবিরে উঠেছেন। এটি চর অঞ্চল। ব্রহ্মপুত্রের পার্শ্ববর্তী বিস্তির্ণ এলাকা। বন্যার জল এখানকার লোকদের গার্হস্থ্য জীবনের অঙ্গ। প্রতি বছর বন্যায় এদের যন্ত্রণা দেয়। তাই একটু সচ্ছল যারা তারা নৌকা রাখেন। উঁচু পাঁচিলের ওপারে রোজ দেখি নৌকা চালিয়ে লোক যাওয়া আসা করছে। আরেকটি জিনিস লক্ষ্য করলাম এখানকার লোকদের বেশিরভাগ টিনের বেড়া দিয়ে ঘর বানিয়ে রেখেছেন। ইটের দেয়াল খুব কম। এর কারণ কী জানিনা। 

           আমাদের এখানকার স্বল্পকালীন জীবন গৎ বাঁধা। সকাল ৮ টায় প্রাতঃরাশ, দুটোয় দুপুরের খাবার, বিকেল পাঁচটায় চা আর রাত নয়টায় রাতের খাবার। দিনে একবার সাফাইওয়ালা আসে পিপিই পরে। এসে সাফাই করে অষুধ ছিটিয়ে দিয়ে যায়। বেশিরভাগ সময় আবাসিকরা শুয়ে থাকেন। যতক্ষণ জেগে থাকেন মোবাইলে ব্যস্থ। আমি একটা রুটিন বানিয়ে ফেলেছি। ভোরের আজান কানে আসলেই উঠে পড়ি। আর বাউন্ডারির ভেতরেই ঘন্টা খানেক হাঁটি। এরপর ফ্রেশ হয়ে একটু সময় পড়াশোনা করি। প্রাতঃরাশ করার পর দু ঘন্টা খানেক শুয়ে যাই। এর পর উঠে স্নান করে দুপুরের খাবার। তার পর লেপটপে ইন্টারনেটে একটু সময় কাটাই। ইচ্ছে হলে একটু ঘুমিয়ে নেই। বাকি সময় বসে, হেঁটে, শুয়ে কাটিয়ে দেই। যথেষ্ট বোরিং। বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই ন‌ইলে ব্রহ্মপুত্রের জলে সাঁতার কাটতে যেতাম। এক কিলোমিটার দূরেই মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র। 

           আমাদের রিপোর্ট আসেনি এখনও। মোবাইলে রোজ চেক করে থাকি। কোথাও কোথাও শুনছি দুই তিন দিনের মধ্যে‌ই রিপোর্ট এসে যাচ্ছে। আমাদের আজ চতুর্থ দিন। কখন আসে কে জানে। ততক্ষন পর্যন্ত এখানে থাকতে হবে। তবে সর্বাধিক সাতদিনের মধ্যেই এসে যাবে এমন বলছেন অনেকে।


            কোরেন্টিন সেন্টার যারা চালাচ্ছে তাদের এক জনের সঙ্গে গতকাল কথা বললাম। এখানকার মানুষদের জীবন যাপন নিয়ে অনেক কথা বললেন। এটি চর অঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। আগের দিনের থেকে এখন শিক্ষা দিক্ষায় এখানকার মানুষ অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক লোক বাইরের রাজ্যে যায় কাজের জন্য। এরা খুব নিষ্ঠার সাথে সেন্টার চালিয়ে যাচ্ছে। বাসরতদের কোনো অসুবিধা হলেই এরা সমাধান করে দিচ্ছে। আসামের বিভিন্ন কোরেন্টিন সেন্টারের ব্যবস্থাপনায় খামতির খবর দেখি রোজ রোজ। কিন্তু এখানে আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। সেন্টারের চারপাশে প্রচুর গাছপালা, ঝোপঝাড়। গ্রাম্য সৌন্দর্য। গত দুদিন বৃষ্টি হচ্ছিল, কাল থেকে হচ্ছে না। 

            যত‌ই অসুবিধা না থাকুক যেহেতু কোনো কাজ নেই আর বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না তাই সময় কাটছে না। দিনগুলো বিরক্তিকর। এরকম সময় পেলে আমি শারিরীক অনুশীলন করতে পারি। কিন্তু ভারি ব্যাগ উঠিয়ে সেই যে পিঠে ব্যাথা হয়েছিল তা এখনও ভালো করে সারেনি। তাই খাওয়া, হাটা আর শুয়া আর মোবাইল বা লেপটপে এটা ওটা দেখে পড়ে সময় কাটানো ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই। রোজ রোজ ওয়েবসাইটে দেখছি রিপোর্ট আপডেট হলো কি না। পজিটিভ হলে কোভিড হাসপাতালে আর নিগেটিভ হলে আর‌ও সাতদিন বাড়িতে গিয়ে সেল্ফ কোরেন্টিনে থাকতে হবে। এখন শুধু অপেক্ষা। বিরক্তিকর অপেক্ষা। কখন যে শেষ হয়...


"কোরেন্টিন ডে'জ - বাড়ির ফেরার কথা'


          কোরেন্টিনের তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় আমাদের ব্যাচের মোটামুটি সবার রিপোর্ট এসে গেলো। সবার‌ই নিগেটিভ। তিন চারজনের মোবাইলে রেজিস্ট্রেশন করার পর‌ও পাসওয়ার্ড না আসায় রিপোর্ট চেক করা গেলো না। এবার নিয়মমতে আমাদের সবাইকে বাড়িতে গিয়ে ১৪ দিন পুর্ণ না হ‌ওয়া পর্যন্ত হোম কোরেন্টিনে থাকতে হবে। রিপোর্ট দেখেই সেন্টারের ইনচার্জের সঙ্গে দেখা করলাম। বললেন,‌ ওদের কাছে কোনো খবর আসে নি। সার্কেল অফিস থেকে রিলিজ অর্ডার আসলেই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো খবর এলো না। ওরা বললেন কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। সঙ্গে এটাও বললেন আপনাদেরকে সম্ভবত সাত দিনের কোরেন্টিন এখানে পুর্ণ করতে হবে। মানে আমাদেরক আরও তিনদিন এখানে থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা। অথচ এই কথার কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না। আমার একটু সন্দেহ হচ্ছিল। এটা তো ওদের মন মর্জি কাজ হয়ে যাচ্ছে না! রিপোর্ট আসার পর তো আর কোরেন্টিন সেন্টারে রাখার কোনো যুক্তি নেই। তবে কেন এরা সাতদিন থাকার কথা বলছে?

          রাতে সব বোর্ডারদের একটাই কথা। কাল‌ বাড়ি যাওয়া পাক্কা। তিনদিন বাড়িঘর ছেড়ে একটি স্কুলের অস্থায়ী বিছানায় রাত কাটানো যে চাট্টিখানি কথা নয় এটা ভুক্তভোগীরাই জানবেন। অন্তত আমার মতো অনেকের এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি। অবশেষে রিপোর্ট আসায় আমাদের কোরেন্টিন শেষ হতে যাচ্ছে তাই সবাই স্বস্তিতে ছিলেন। মাঝরাত পর্যন্ত লুডু খেললাম। আমার পাশের বেডের ছেলেটি ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার। পাঞ্জাবের মোহালিতে থাকে। ওর একটা ছোট্ট প্রজেক্টে একটু সাহায্য করলাম। 

       রাতের খাবার দারুন ছিল। শুদ্ধ নিরামীষ কিন্তু খুব স্বাদ। বাইরে গরম হাওয়া ব‌ইছিল। বার বার লাইন যাচ্ছিল। অবশেষে বৃষ্টি এলো। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। স্কুলের টিনে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়ে ঝনঝন করে শব্দ করছিল। ঘুম আসছিল না। পরের দিন বাড়ি যাচ্ছি। ঈদ‌ও আসছে। মাথায় বিভিন্ন পরিকল্পনা ঘুরাঘুরি করছিল। খুব ভোরে বিছানা থেকে উঠলাম। আটটায় নাস্তা করেই অফিসে গিয়ে ইনচার্জের সঙ্গে দেখা করলাম। ওদের এক‌ই উত্তর। ওরা জানে না।‌ রিলিজ অর্ডার এলে‌ই যেতে দেবে। সঙ্গে এরা এটাও বলছে যে আপনাদেরকে সাতদিন তো থাকতেই হবে। এর আগে যাওয়া হবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম এব্যাপারে কি কোনো লিখিত নিয়ম আছে? রিপোর্ট আসার পর‌ও সাতদিন থাকাটা কি বাধ্যতামূলক? ও বললো স্থানীয় সার্কেল অফিস বা ডিসি অফিস থেকে যা বলে দেওয়া হবে তাই হবে। ওরাই নিয়ম নীতি ঠিক করেন। আমার শুনে মাথা খারাপ। তবুও বিকেল অবধি শান্তভাবে অপেক্ষা করলাম। আমি এটা বুঝতে পারছি যে আমরা যত বেশি এখানে থাকবো এদের বিল লম্বা হবে। আমদানি বেশি হবে। শুনেছি একজনের জন্য একদিনের খাবারের জন্য পাঁচশ টাকা বরাদ্দ হয়। আমাদেরকে দুইবেলার খাবার মিলিয়ে অবশ্যই পাঁচশ টাকার খাবার দেয়া হচ্ছে না। সাতদিন থাকলে ওদের নিশ্চয়ই ভালো। বেশি লাভ। তবুও নিয়ম কানুন তো একটা থাকবে।

          সরকারি ওয়েবসাইট থেকে বিমান যাত্রীদের কোরেন্টিন সংক্রান্ত এস‌অপি ডাউনলোড করে পড়লাম। স্পষ্ট লেখা আছে  the period of institutional qurantine of a passenger will be 7 days or till his/her RT-PCR COVID 19 test results are declared, whichever is earlier, followed by home qurantine for remaining period of qurantine. মানে সাতদিনের মধ্যে যখন‌ই রিপোর্ট আসবে তখন‌ই বাড়ি যাওয়া যাবে আর ১৪ দিনের বাকি দিনগুলো হোম কোরেন্টিনে থাকতে হবে। আমাদের রিপোর্ট আসার আসার দ্বিতীয় দিন ছিল। কর্তৃপক্ষের হেলদুল নেই। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষার পর কোনো খবর এলো না। রাত্রে ঘুম আসছিল না। এক স্থানীয় রাজনীতিবিদকে জানতাম। ফোন করলাম। ভদ্রলোক চেষ্টা করলেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে নিয়ম বুঝাতে ব্যর্থ হলেন। ওরা স্পষ্ঠত ঠিক করে রেখেছে সাতদিন এখানে থাকতেই হবে। এটা তো নিয়মের উল্টো। মানুষগুলো মিছেমিছি কষ্ট করবে কেন? রিপোর্ট আসার পর‌ও জেলের মতো একটি জায়গায় দিনের পর দিন কেন বন্দির মতো রাখা হবে! লোকগুলো এখানেও তো সংক্রমিত হয়ে যেতে পারে। দিল্লি মহারাষ্ট্র গুজরাটে আসামের থেকে অনেক বেশি সংক্রমণ কিন্তু এরকম জেলের মতো বন্দি করে কাউকে রাখা হচ্ছে না। এয়ারপোর্টে টেস্ট করে বাড়িতেই হোম কোরেন্টিনে পাঠানো হচ্ছে। আসামের বিষয়টি কিছুটা অদ্ভুত লাগছিল। এর পেছনে যে অনেক টাকা ও কাটমানির কথা আছে তাও সোস্যাল মিডিয়ায় শুনা যায়। 


          পরের দিন সকালে আর সহ্য হলোনা। গুয়াহাটির এক ভাইকে জানালাম। উনি উপর মহলের কয়েক জায়গায় ম্যাসেজ করলেন। আমি ট্যুইটার খুলে আসামের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী সহ সরকারের এক সচীবকে ট্যুইট করে বিষয়টি জানালাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার ফোন নম্বর চাওয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থানীয় আধিকারিক সহ জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে ফোন আসলো কয়েকবার। বিষয়টি বুঝেই তড়িঘড়ি কোরেন্টিন অফিসে লোক আসা শুরু হয়ে গেলো। হুলস্থুল ব্যাপার আর কী! দুঘন্টার মধ্যে‌ই আমাদের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো। তবে বেরোতে বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেল। টাটা স্টার বাস যখন স্কুল থেকে আমাদেরকে উঠিয়ে ছাড়ে তখন রাত নয় টা। স্কুল বাসের মতো জায়গায় জায়গায় লোকজন নামিয়ে অবশেষে আমাকেও নামিয়ে দিল। একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছিল। বন্যায় বিধ্বস্ত সারা অঞ্চল। বাড়ির নিকটস্থ মাঠে জল থৈ থৈ। মাছ ধরার দারুন সুযোগ। কিন্তু আমি আসামে আসার দিন থেকে শুরু করে মোট ১৪ দিন কোরেন্টিন বাড়িতে পুর্ণ করে তবেই বেরোতে পারবো।

(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই: