“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২ আগস্ট, ২০২০

উলু-খাগড়ার গল্প


।।তৃণময় সেন।।

 
 
(C)Image:ছবি


  "আটসট হাজ্জার ক্রোর কে করজ...."

          রমুজের মতো বড় মুখওয়ালা আদমির ছবির নিচে কয়েকটা শব্দ পড়ে আবার হোয়াটসঅ্যাপ স্ক্রল করে শরবন। বেছে বেছে জাহিল ক'টাকে গ্রুপ থেকে বের করতে হবে। ফটো-ভিডিও একটাও নেই, কোথাকার কত ক্রোর! স্ক্রিন ভাঙা মোবাইল হ্যাং করলে রিস্টার্টের দাওয়াই দিয়ে লম্বা চুলে আঙুল চালায় সে। কালো স্ক্রিনে নিজের থোবড়া পরখে নেয়। তামাটে রঙের উজ্জ্বলতা কমেছে, চোখ দুটো বেশ কোটরে, গোঁফ ঠোঁটের সীমানা পার হয়ে মুখে ঢুকে যেতে চাইছে। এই দুর্দিনে কেউ ছেড়ে কথা কইছে না, আধপেটা শরীরের অনেকটা পুষ্টি তো এই নাছোড়বান্দা চুল শুষে নিচ্ছে! যেন ইউরিয়া সার পড়েছে সব কিছুতে! শাহরনপুর দেহাত থেকে খেতি-বাড়ি ছেড়ে মজদুরি করতে আসার সাত বছর হয়ে গেলো, কিন্তু পটাশ-ইউরিয়া-ফসফেট, নানা ধরনের খাদ বানানোর কথা আজও মনে পড়ে শরবনের।

         -- ইয়ার, ঘরমে অ্যায়সে বন্ধ রেহনে সে আবাদি বড় হি না জায়েগা..

        খয়েরি দাঁতের খিকখিক হাসি ইজ্জতে আঘাত করে সুশীলার। সাত-আট গজ দূরত্বের মকানের এই ছোকরাটার ছুকছুকানি বাকিদের থেকে একটু বেশি। ফোনে কথা বলছে, অথচ কামুক চোখ দুটো পাশের মকানের সুশীলার ওপর আটকে আছে। ভাবিজি বলে দু-একদিন গায়ে পড়তে চাইলে পাশ কাটিয়ে গেছে সুশীলা। বাবুলোগের সোসাইটিতে ঠেলাগাড়িতে করে ডাবের জল ফেরি করে এই ছোকরা। নাকের ডগা অবধি ঘোমটা দিয়ে থাকলেও, রেহাই নেই এদের কাছ থেকে। শরবনকে বলায় সে খেঁকিয়ে উঠে সব দোষ সুশীলার ঘাড়ে চেপে দিয়েছে। এই ছেলে-ছোকরারা তার গ্রুপের লোক, অ্যাডমিন হয়ে ছোটখাটো জিনিসে ওদের বিগড়ানো যাবে না। দায়িত্ব বলে একটা জিনিস আছে কি না! দেড় বছরের মেয়েটা ভ্যা ভ্যা করে উঠলে বিরক্তিতে মেয়ের মুখে বুকটা চেপে ধরে সুশীলা।

         লক ডাউন অবধি ঠিক ছিল, কিন্তু মুশকিল হয়েছে গলি সিল করে দেওয়ার পর থেকে। বাইরে বেরোনোর সব রাস্তায় সটান দাঁড়িয়ে আছে হলুদ ব্যারিকেড। বুটের গম্ভীর শব্দে থেকে থেকেই টহল দিচ্ছে পুলিশ। মোড়ের বিল্ডিংয়ে একটি পজিটিভ কেস পাওয়া গেছে। পরিবারের মোট সাতজনকে নিয়ে গেছে অ্যাম্বুলেন্স, বাকিদের জন্যে দেওয়া হয়েছে হোম কোয়ারেন্টাইনের কড়া আদেশ। দু'তলা থেকে নিজের নীল-সাদা টোটোর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে শরবন। শেষবার কবে চালিয়েছে মনে করতে পারে না। ব্যাটারির চার্জ কবেই হয়তো শেষ হয়ে গেছে।

            "চালিশ ক্রোর বেরোজগারী কা দাবা..." পাশের ঘরের টিভির শব্দে বিরক্তি ধরে গেছে। নোংরা বহুতল বাড়িটিতে ঘুপচির সমাহার। প্রতি তলায় অন্তত চার পরিবার নিত্যদিনের বচসা-অশান্তি নিয়ে বসবাস করছে। দুটো করে টয়লেট-বাথরুম নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার (!) মাধ্যমে ভাগ করে নিতে হয়। বাড়ির মালিককে কেউ দেখেনি, প্রতি দশ তারিখ মাথায় ফেট্টি বাঁধা গুণ্ডা মতো দু’জন এসে ভাড়া আদায় করে নেয়। খাওয়া-খরচের টাকা ফুরিয়ে এসেছে, এই মাসে ভাড়া কোথা থেকে দেবে তা কেউ জানে না।

            লক ডাউনের এতটা দিন পেরিয়ে গেলো, কিন্তু টাকা-পয়সা পাঠানো তো দূর কেউ একটা বারের জন্যে একটু ফোন বা মেসেজ করে খবর নিলো না। গ্রুপেও কি একটা মেসেজ করা যেত না, অ্যাডমিন হিসেবে ছেলে-ছোকরাদের কাছে মুখ দেখানো মুশকিল হয়ে গেছে শরবনের! অথচ এই লক ডাউন শুরু হবার ক’দিন আগে পর্যন্ত ভালোই নাম-ডাক হয়ে গেছিল তার। ভাইয়াজি উত্তরীয় পরিয়ে দিতেই সেইদিন সদস্যদের হাততালিতে গমগম করছিল সারাটা ঘর। গ্রুপ এডমিন অ্যাডমিন বানিয়ে দেওয়ার সাথে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন ছাই রঙের দুটো পাঁচশো টাকার নোট। সম্মানে বুক ফুলে উঠেছিল শরবনের, তারপর একের পর এক কুপিয়ে নালাতে ফেলে দেওয়া, গাড়িতে আগুন ধরানো, উন্মত্ত ভিড়ের গণপিটুনিতে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার ভিডিও খুঁজে খুঁজে পোস্ট করেছে গ্রুপে। দিল্লি দাঙ্গার তীব্র উষ্ণতা শুধু আঙুলের ছোঁয়ায় দেশের প্রতিটা কোণে ছড়িয়ে দেওয়ার নগ্ন খেলায় অজান্তেই সামিল করে নিয়েছিল নিজেকে।

         জীবনে আসা আকস্মিক পরিবর্তনের ছোঁয়ায় একটা সময় রঙিন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিল শরবন। ভাবছিল টোটো চালকের একঘেয়ে জীবিকা ছেড়ে ভালো কিছু একটা করবে। দাওয়ায় বসে লম্বা দাড়িতে হাত বুলিয়ে অলীক স্বপ্নকে রোমন্থন করে সে। দাড়িগুলো হয়তো হাশিমের দাড়ি থেকেও লম্বা হয়ে গেছে। হঠাৎ করে পুরানো বন্ধুর নাম মনে আসায় কিছুটা আশ্চর্য হয় শরবন। একটা সময় ছিল, বুধ-শনিবারে গাজীপুর আড়ত থেকে সবজি আনতে ভোরবেলা হাশিমের সাথে সে বেরিয়ে পড়তো। আলু-পেঁয়াজ-টিন্ডা-লউকি টোটোতে ভরে বেলা দশটার মধ্যে ফিরে আসতো দুই দোস্ত। হাশিমের সাথে থেকে নিজেও বেচা-কেনার শিল্পটা আয়ত্ত করে নিয়েছিল শরবন। কোনো ঝগড়া-বিবাদ ছাড়াই দূরত্বের দেওয়াল কবে ভিত শক্ত করে নিয়েছিল, তা শরবন-হাশিম কেউই বুঝতে পারেনি। কিন্তু দু’দিন আগে দোকান খোলার দায়ে যখন পুলিশ হাশিমকে লাঠিপেটা করলো, তখন মনটা কেমন করে উঠেছিল শরবনের।

           লক ডাউন আর সিল হয়ে যাওয়ার তফাৎটা জানলে দোকান খোলার দায়ে বেধড়ক মার খেতে হতো না অর্ধশিক্ষিত হাশিমকে। এতগুলো দিন শাক-সবজি বিক্রি ভালোই চলছিল, কিন্তু দু’দিন আগে মাত্র একটি করোনা কেস পেয়ে পুরো গলিটা বন্ধ করে দিল। রমজান মাস শুরুয়াতের দিনগুলোতে মার খেয়ে দু'দিন নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল হাশিম। আজকে সকালে যখন কাঁধে করে একবস্তা পচা করলা পৌরনিগমের ময়লার গাড়িতে ফেলতে গেলো, তখন তার চোখ ছলছল করছিল। আজকে একটা ঠেলাগাড়ি থাকলেও সোসাইটিতে গিয়ে করলা, পেঁয়াজ-পাতাগুলো অনায়াসে বিক্রি করতে পারতো সে।

           আধপেটা হয়ে থাকার চেয়ে খালি পেটে থাকা ভালো। সামান্য কিছু পেটে পড়লে অবাধ্য খিদেটা আরো চাগাড় দিয়ে ওঠে। বাচ্চা দুটোকে খাইয়ে দিয়ে জল দিয়ে দুটো শুকনো রুটি গেলে সুশীলা-শরবন। দু'দিন আগে প্রশাসন খাদ্যদ্রব্য বণ্টন করে গেছে, আজকে বিকেলে আবার আসবে। মোবাইলে ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে, আজকে চার্জেও বসায়নি শরবন। গ্রুপে কি চলছে কে জানে, খালিপেটে কোনো আকর্ষণ খুঁজে পায় না সে। দুপুরবেলায় ধুলোর ঝড় হয়েছে, বালতিতে কাপড় ভিজিয়ে একমনে টোটো খানা সাফ করে।

            সপ্তাহ-দিন চলে যাওয়ার মতো রেশন দিচ্ছে আজকে। তিন-চার মিটার ফাঁক রেখে দাঁড়ানো লাইনখানির শেষ প্রান্ত প্রায় দেখা যাচ্ছে না। সামনের অচেনা দু'জনের পরে দাঁড়িয়ে আছে শরবন, ইচ্ছে হলেও তাকে নাম ধরে ডাক দিতে আটকে যায় হাশিম। মাত্র কয়েকমাস পুরানো ক্ষত শুকিয়ে যায়নি এখনও। কাফেরদের এড়িয়ে চলতে অনেক অডিও-ভিডিও মেসেজ পেয়েছে সে। কিন্তু বিপদের সময় সেই জনাবরা তো একটিবারের জন্য কোনো খবর নেননি! আর একসময়ের ভালো বন্ধু শরবন তো ব্যক্তিগতভাবে কোনো ক্ষতি করেনি তার। দোটানায় পা পা করে এগিয়ে চলে হাশিম।


          জিনিসপত্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি সরে যাবার নির্দেশ দিচ্ছে পুলিশ। খৈনির ব্যাগে আটা-তেল-ডাল ভরে পা বাড়ায় শরবন। পেছন থেকে থপ করে কিছু পড়ে যাবার শব্দে ঘাড় ফেরায় সে। ফেটে যাওয়া পলিথিনের ব্যাগ দুহাতে গোছাচ্ছে হাশিম। এবার বেশি করে রেশন দেবে জানলে একটা বড় ব্যাগ নিয়ে আসত আজকে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে শরবন। আধকিলো মতো আটা মাটিতে পড়ে গেছে। ধরাধরি করে খৈনির বড় ব্যাগটাতে সব সামান ভরে এগিয়ে চলে দু’জন।

            নয়ডা সেক্টর সাতাশের সোসাইটিতে সন্ধ্যা নেমে গেছে। কয়েক কিলো আলু-পেঁয়াজ ছাড়া হাশিমদের সব সবজিই বিক্রি হয়ে গেছে। সারাদিন চালানোর জন্য শরবনের টোটোতে আর খুব একটা চার্জ বাকি নেই। হাতের গ্লাভস খুলে একটু জল আর পোহা খেয়ে ইফতার সারে হাশিম। কাল সকালে তাহলে আবার আড়তে যাওয়া হচ্ছে। কাগজপত্র সবকিছু আছে হাশিমের কাছে। শ্রমিক দিবসের সন্ধ্যায় শুধু বাঁচার তাগিদে উলু-খাগড়ারা বেরিয়ে এসেছে রাজাদের শীতল যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে। হৃদয়ের দ্বার খুলে আবার ভালোবাসার নীড় গড়তে কুড়িয়েছে কিছু খড়কুটো। অনেক হয়েছে, আর বেঘোরে প্রাণ দেবে না তারা। গুনগুন হাওয়া কেটে খালি পথ বেয়ে চলে শরবনের টোটো।

 

কোন মন্তব্য নেই: