।। সাদিক মোহাম্মদ লস্কর ।।
আব্বা
মা-বাবা
সব জানে – শৈশবে এই বিশ্বাস থাকে আমাদের। কৈশোরের শুরুতে এই বিশ্বাস দুর্বল হতে থাকে,
আর এক সময় মনে হয় মা-বাবা বোধ হয় কিচ্ছুই জানে না। যৌবনের শুরুতে এই অবিশ্বাসের ভিত্তিটাও
দুর্বল হতে থাকে। মাঝ বয়সে এসে আবার মনে হয় মা-বাবা বোধ হয় সব জানে। এই ধারণা কম-বেশি
সবার হয়। আমার ক্ষেত্রেও অনেকটা এরকমই। তবে আব্বা একেবারেই জানেন না, এই ধারণা বোধ
হয় তেমন প্রশ্রয় পাওয়ার সুযোগ পায়নি। তিনি শিক্ষকই ছিলেন, আর কিছু না। কিন্তু এই একটি
পেশায় এত বৈচিত্র আনা শুধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। শরীর ও মনে দৈবশক্তি না থাকলে বোধ
হয় একজন পার্থিব মানুষের পক্ষে এতকিছু করা সম্ভব নয়।
সহপাঠীদের সঙ্গে আব্বা |
আব্বার
জন্ম হয় বাঁশকান্দি গ্রামেই। স্বনামধন্য শিক্ষক কামু মিয়া লস্কর ও আকলিমা বেগমের চতুর্থ
সন্তান ও দ্বিতীয় ছেলে তিনি। নাম ময়ীনুল হক লস্কর। দলিল মতে তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৮
ফেব্রুয়ারি। তবে একটু এদিক সেদিক হতেও পারে। অর্থাৎ ১৯৪০-৪২ সাল হওয়ারও সম্ভাবনা আছে।
আমার দাদাজি ৯৮ নম্বর বাঁশকান্দি এল পি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, সেখানেই তিনি পড়তেন।
তারপর বাঁশকান্দি মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে। তখন সেখানে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত
বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। এরপর পড়েছেন শিলচর সরকারি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
কনকপুরের মাফিক চৌধুরির বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করেছেন কিছুদিন। তারপর চলে আসেন
বোর্ডিংয়ে। তারপর সাইকেল কেনা হলে সাইকেল চড়ে কাশিপুর-বাদ্রিঘাট হয়ে শিলচর। তখনকার
দিনে সাইকেল কেনা অনেক বড় ব্যাপার ছিল। আব্বা বলতেন, হাত একটু বাঁকা করে অনর্থক ক্রিং
ক্রিং বেল বাজানোর এক আলাদা মজা ছিল। ১৯৬২ সালে উচ্চতর মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৪ সালে
কাছাড় কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৬৭ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। আব্বা কী একটা বৃত্তি পেতেন,
তা দিয়েই তাঁর পড়াশোনার খরচ চলত।
বিদায় বেলার কথা |
স্নাতক হওয়ার পরই আব্বা চলে যান বাগপুর হাইস্কুলে। তাঁর মামা শিক্ষক মোজাহিদ আলি চৌধুরির ডাক এলো। প্রত্যন্ত বাগপুর এলাকায় স্থাপিত একটা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে হবে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে কাজে যোগ দেন ১৯৬৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। প্রত্যন্ত হলেও প্রাচীন বসতি এই গ্রামে শিক্ষার সম্ভাবনা ছিল। তাই এই মিশন সফল করতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরে প্রধান শিক্ষক আলিম উদ্দিন চৌধুরির সঙ্গে সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন সর্বশক্তি দিয়ে। প্রথমে বেতন ছিল ১৩০ টাকা। প্রায় ১৫ বছর পর ১৯৮২ সালের ১ জানুয়ারি স্কুলটি প্রাদেশিকরণ হয়। বেতন হল ৬২০ টাকা। সহকারি প্রধান শিক্ষক পদ সরকারি ভাবে পেলেন ১৯৮৬ সালের ৪ ডিসেম্বর। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুন তিনি প্রধান শিক্ষক হন। ২০০৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন। এই দিনটি যেন তাঁর কর্মজীবনের অন্তিম দিন ছিল। যেন শুধু স্কুল থেকে নয়, বিশ্বসংসারের সব বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে দিলেন। বেসরকারি স্কুলগুলোর তরফ থেকে লোক এলেন, টাকা-সম্মান সবকিছুর প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু তিনি সবিনয়ে সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। ফ্রি কোচিং ওয়ার্কশপও বন্ধ করে দিলেন। কেন যে তিনি সুস্থ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে গুটিয়ে নিলেন তার কারণ খুঁজতে হলে তাঁর অবসর গ্রহণের সময়কার বিদায়ী ভাষণটা পড়তে হবে।
সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে |
সংসারে
অভাব অনটন লেগেই ছিল। তবুও পিছুটান ছিল না। বাগপুরের মানুষ তাঁদের অ্যাসিস্ট্যান্ট
স্যারের সাইকেলের বেল শুনে ঘড়িতে দম দিতেন। আমার জ্যাঠু আইনুল হক লস্কর বাঁশকান্দি
নেনা মিয়া উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতা করেছিলেন। পরে সমবায়
বিভাগের পরিদর্শক পদে চাকরি পেয়ে চলে যান। তিনি আফসোস করতেন, ‘কতবার বললাম, আয় আমার
বিভাগে। এল না। বললাম, ফিটনেস আছে, পুলিশে যা। গেল না। আজ এস পি হতে পারত।’ আব্বাকে
জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘কথা ঠিক। কিন্তু আমি তো শিক্ষাব্রতী।’ সেই ব্রত নিয়ে ভেঞ্চার
স্কুলে কাজ করেন। প্রাদেশিকীকরণ হওয়ার পরেই যে অভাব মিটে গিয়েছিল তা নয়। ১৯৭৬ সালে
একটা সাইকেল কিনেছিলেন আর বোধ হয় কিনলেন ১৯৯৯ সালে। একটা ট্রানজিস্টার কেনার ইচ্ছে
ছিল, কিন্তু পারেননি। জমিজমা তো আর কেনাই হল না। ঘর বানালেন দীর্ঘ ২৫ বছরে (১৯৮৪-২০০৯)।
কিন্তু মানুষ গড়ার স্বপ্ন এক মুহূর্তের জন্যেও ফিকে হয়ে যায় নি।
প্রয়াত নবদ্বীপ সিংহ ও অন্যান্যরা |
ছোটবেলায়
দেখেছি আব্বার অনেক রকমের বন্ধু ছিলেন। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়তেন। নামাজ আদায় করে
সব্জি-বাগান, গোয়ালঘর এইসব সামলে দাড়ি কাটতে বসে পড়তেন। তখনই এসে পড়তেন নানা বয়সের
তাঁর বন্ধুরা। সৈয়দ চাচা, মকু ঠাকুর, মামুজি বলে ডাকতেন তাঁদের। এদের প্রায় সবাই ছিল
দিনমজুর, কৃষক, অসহায় বৃদ্ধ ইত্যাদি। মনে হত যেন এরা এক একটা বিষয়ে বিশারদ। সব জরুরি
পরামর্শ যেন তারাই দিতেন আব্বাকে। চুটিয়ে আড্ডা মেরে ভালো করে প্রাতরাশ করে ঢেঁকুর
ছেড়ে বিদেয় নিতেন তাঁরা। এদের সঙ্গে পরামর্শ করাটা আব্বার আসল উদ্দেশ্য ছিল না। আসলে
এদের পেটের (ক্ষুধার) খবর তিনি জানতেন। এছাড়াও অর্থ সাহায্য করার সময় যেন কেউ (এমনকি
পরিবারের সদস্যরা) দেখতে না পায় সেই সুযোগটাও তো পাওয়া চাই। তাঁর মরদেহের পাশে বসে
এক রিক্সাচালক হাউ হাউ করে কেঁদে বলে ফেলেছিলেন, ‘আমাকে সাহায্য করে বলতেন, কাউকে বলো
না।’ এমন অনেক কিছুই আছে যা কেউ জানে না, আর কোনও দিন জানতেও পারবে না।
জয়পুরে সম্মানিত |
এইসব বদান্যতায় হয়তো তাঁর মন ভরেনি। বাগপুর হাইস্কুলে শিক্ষাদান করেও মন ভরেনি। তাই বৃহত্তর বাঁশকান্দি এলাকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের উপায় হিসেবে শুরু করলেন ফ্রি কোচিং ওয়ার্কশপ। ১৯৯৩ সালের ১ মে বাঁশকান্দি মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে শুরু করেন গরিব শিক্ষার্থীদের বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাদান। পরে অভিভাবকদের দাবি মেনে সবার জন্যেই খুলে দেওয়া হয় এই মানুষ গড়ার কারখানা। ১৯৯৪ সালের ৩০ আগষ্ট লক্ষীপুর খণ্ড প্রাথমিক শিক্ষাধিকারিকের লিখিত অনুমতি নিতে হয়। দিনে অমানুষিক পরিশ্রম, রাত জেগে খাতা দেখা ইত্যাদি ছিল তাঁর রোজকার রুটিন। একটা মহল প্রবল বিরোধিতা শুরু করল। কিছু সরকারি শিক্ষক কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে টিউশনির বাজার খুলে তা রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্যে নানা ফন্দি ফিকির করতেন, তাঁরা এবং আরও অনেকেই বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তিনি পেয়ে গেলেন এলাকার এক বিজ্ঞান স্নাতক সাজ উদ্দিন লস্করকে। সাধারণ পরিবার থেকে শিক্ষিত হওয়া এই নওজোয়ান কী বুঝে আব্বার উল্টো রথের সারথি হয়ে গেলেন। প্রতি বছর ঘটা করে অনুষ্ঠিত হত পুরস্কার বিতরণ। শুরু হল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। যোগ দিলেন ইমাথৈ সিংহ, বিজন চক্রবর্তী, হীরাকুমারী সহ আরেক দল। তাতেও তৃপ্তি না পেয়ে শুরু করলেন কামু মাস্টার স্মৃতি মেধা পুরস্কার। বাগপুর থেকে বরথল বাগান – নানা জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা আয়োজন করা আর পুরস্কার বিতরণ। তারপর একে একে এলেন জাফরুল হাসান বড়ভুঁইয়া, আবুল হুসেন বড়ভুঁইয়া, আব্দুল মতিন লস্কর, মাহমুদ, কবির সহ অনেকেই। কয়েকটি গাড়ি ভাড়া করে দলবল নিয়ে যাওয়া হত। বছরে সামান্য টাকা ফি ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু বাধ্যতামুলক না হওয়ায় বেশিরভাগ অভিভাবক এই টাকা দিতেন না। ফলে এই বিরাট ব্যয়ভার বহন করতে হত তাঁকেই। এইসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হতেন ডা. কুইন্টিন ডেলবার্ট কেনোয়ার, মন্ত্রী শহিদুল আলম চৌধুরি, উপায়ুক্ত পবন কুমার বড়ঠাকুর, বুদ্ধিজীবী অতীন দাশ, মকব্বির আলি বড়ভুঁইয়া, ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, শিখা বড়ঠাকুর প্রমুখ। মন্ত্রী দীনেশ প্রসাদ গোয়ালা কথা দিয়েও একবার এলেন না, শুনেছি স্থানীয় কংগ্রেস কর্মীরা নাকি মানা করেছিলেন তাঁকে। অবসর গ্রহণের পর ফ্রি কোচিং ওয়ার্কশপ বন্ধ করে দেন আব্বা। কিন্তু কামু মাস্টার স্মৃতি মেধা পুরস্কার অতি গোপনে চালিয়ে গেছেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত। তাঁর ফাইল ঘাটতে গিয়ে দেখলাম ১০০১ টাকা করে মেধাবি ছাত্র-ছাত্রীদের পুরস্কার দিতেন তিনি।
ধমকি ভরা চিঠি |
আব্বা কর্তব্য সম্পাদন করতেন পঞ্চাশ আনা, ষোল আনায় তাঁর মনের ক্ষুধা মিটত না। অর্থাৎ বাগপুর হাইস্কুলে তিনি শুধু রুটিন মাফিক চলা এক শিক্ষকই ছিলেন না। দায়িত্বের বাইরে অনেক কাজ তিনি স্বেচ্ছায় করে যেতেন। খুব আরামে এসব কাজ করতে পারতেন, তা কিন্তু নয়। বাঁশকান্দি থেকে বাগপুরের রাস্তা খুব একটা মসৃণ ছিল না। এঁটেল মাটির রাস্তা, মাঝে সাইকেল চলার ‘লিক’, দুপাশে গভীর নালা। সেই রাস্তায় সাইকেল চালাতে গিয়ে কতবার পড়েছেন, কতবার গরু-মহিষের ধাক্কা খেয়ে নালায় পড়ে কাদা-জলে একাকার হয়েছেন। সহকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীরা সেকালে যে ফিরিস্তা ছিলেন, তা কিন্তু নয়। অনেকবার অনেক কিছু মোকাবেলা করতে হয়েছে তাঁকে। বাগপুর হাইস্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক শুক্কুর আহমেদ বড়ভুঁইয়া এক সভায় বলেছেন, ‘একদিন গরমে অতিষ্ট হয়ে শিক্ষকরা ছুটির আবেদন করলাম। গরম আবার কী – এই বলে চক-ডাস্টার নিয়ে মইন স্যার ক্লাসের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। এই প্রৌঢ়ের মনের জোর দেখে লজ্জিত হয়ে তাঁর আগে গিয়ে ক্লাসে পৌঁছলাম।’ হয়তো তিনি নিজের শিক্ষক হিসেবে সমীহ করেছেন; সবাই তো আর করত না। এরকম কোনও এক কারণে তাঁর কাছে আসে এক বেনামি ধমকি ভরা চিঠি। সামলে রেখেছিলেন, এই সেদিন পেয়ে গেলাম সেই চিঠি। এমন আরও কত প্রতিবন্ধকতা ছিল।
আব্বা ,আমরা ও এক তুতোভাই |
আমরা
ভাই-বোন একটু দেরিতে ৬ টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠতাম। আমাদের প্রাতরাশ হয়ে গেলে পড়ানো শুরু
করতেন আব্বা। ততক্ষণে তাঁর প্রথম সারির বন্ধুরা বিদেয় নিয়ে নিয়েছেন। ফজরের নামাজের
সময় দেখা করে নিতেন তাঁর প্রায় সমবয়েসী বন্ধু রিয়াজুল হক লস্কর (দারোগা), মশরফ আলি
বড়ভুঁইয়া (ব্যবসায়ী), সাজ্জাদুর বড়ভুঁইয়া (সইজ্জা পাটোয়ারি) সহ গ্রামের তখনকার মুরব্বিদের
সঙ্গে। তখন সাড়ে ১০ টায় স্কুলের ঘন্টি বাজত।
৯ টা নাগাদ আমাদের শিক্ষাদান শেষ করে স্নান করাতেন। গরমের দিনে আমাদের স্নান করাতে
নিয়ে যেতেন বাঁশকান্দি আনুয়ায়। আনুয়ার ফটিক স্বচ্ছ জলে সাঁতার দেওয়া, হাঁস আর পরিযায়ী
পাখির লীলা, ঊর্মিমালায় সকালের রৌদ্রের বিচ্ছুরণ, হাঁটুজলে বালির উপর মাছের ঘোরাঘুরি,
দুরের ঘাটে ধোপার কাপড় আছাড় মারার অনেক পর আওয়াজ শোনার কারণ এইসব দেখানো আর শেখানো
ছিল তাঁর আনুষঙ্গিক কাজ। সন্ধ্যার পর থেকে রাত নটা অবধি আরেক দফা পড়াশোনা। সন্ধেবেলা
মাও কিছু পড়ানোর সময় পেতেন। ১৯৮৫ সালে আমাদের প্রতিবেশির সঙ্গে এক ছোটখাটো যুদ্ধ হয়ে
গিয়েছিল। মামলা মোকদ্দমা ছাড়াও এতদিনের সুহৃদ বা বন্ধুদের একাংশের অপর পক্ষ অবলম্বন
বা নেতিবাচক ভুমিকা দেখে বেশ আহত হয়েছিলেন মানসিকভাবে। আমাদের বংশের কেউ এখানে নেই
বলেই হয়তো অনেকেই জনবল থাকা গোষ্ঠিতে যোগ দিয়েছে – এই ধারণা থেকেই শুরু হয় ফুলবাড়িতে
বা ডবকায় থাকা আমাদের শেকড়ের খোঁজ। আমাদের পড়াশোনা একটু ব্যাহত হল তখন। ১৯৯০ সালে আমার
চোখের সমস্যা নিয়ে আবার তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। আর ১৯৯৪ সাল থেকে ফ্রি কোচিং শুরু
করার পর পরিবারের প্রতি তাঁর দায়িত্ব আস্তে আস্তে কমে যেতে শুরু করল। কিন্তু আমাদের
সামান্য অসুবিধা দেখলেই তাঁর কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট ধরা পড়ত।
মেয়ের কাছে লেখা চিঠি |
পুরষ্কার বিতরণে.ডা. কেনোয়ার |
নিজের
জন্যে কিছু করেননি আব্বা। সহজ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। কোনও বদ অভ্যাস বা নেশা ছিল
না তাঁর। উপরি কামাই করার ধান্ধাও ছিলনা। তাঁকে নিয়ে মনে মনে হাসতাম যখন তিনি সগর্বে
কিছু উপরি কামাই হয়েছে বলে ঘোষণা করতেন। এই উপরি কামাই ছিল মেট্রিকের ইনভিজিলেশন, সুপারভিশন
বা উত্তরপত্র দেখা বাবদ। তবে জানিনা কেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন না। অনেক
দুনম্বরি তাঁর চোখের সামনে ঘটত, প্রতিবাদ করতেন না। আমি ধরিয়ে দিলে হেসে বলতেন, ‘ওসব
চলে, আমি তো আর করিনা।’ যখন বলতাম, ‘আপনার তো বদনাম হতে পারে।’ রাগ সামলে নিয়ে বলতেন,
‘আমাকে সবাই জানে।’ নিজের চাকরি সংক্রান্ত অনেক ব্যাপারে ঘুষ দিতে হয়েছে তাঁকে, শেষমেষ
তাঁর পেনশন পাওয়ার জন্যেও। সরকারি অফিস ওসব বুঝে না। ঘাপটি মেরে বসে আছে সবাই, কোথায়
কোন ফাঁক পাওয়া যায়। তারপর তিলকে তাল করে দিনের পর দিন ঘুরিয়ে বৃদ্ধ মানুষকে হয়রান
করে দুটি পয়সা কামানো আজও চলে। সেই দুঃখ-সুখ সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিন মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে ২০২০ সালের ১১ জুন আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন