“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৯

আসামের জনবিন্যাস পরিবর্তন (Demographic change) এবং দুই সন্তান পলিসি।

 ।। দেবাশিস ভট্টাচার্য ।।
(C)ছবি
নেকেই বলেন আসামের জনসংখ্যা বিন্যাসের পরিবর্তনের কারণ হচ্ছে মুসলমানদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। তাই অনেকেই ভাবেন দুই সন্তান পলিসি দিয়ে এই পরিবর্তন রোধ করা সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হলো মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ কি এবং শুধু মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যই কি জনসংখ্যা বিন্যাসের পরিবর্তন হচ্ছে?

আসামে এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই অঞ্চলের হিন্দু এবং মুসলমানদের চাইতেও অনেক বেশি। ১৯৭১ থেকে ২০১১ অবধি আসামে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৯৭%, এর বিপরীতে খ্রিষ্টানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২০৬%। একই সময়ে (১৯৭১-২০১১) আসাম ছাড়া উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১১৭%, ২৭৫%, ৩৭৫% এবং ২১৪%। তাই আসাম ছাড়া উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যের পুরো জনসংখ্যায় হিন্দুদের আনুপাতিক হার ৬৬.৩৯% (১৯৭১) থেকে কমে ৫৩.৯৭% (২০১১)  এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ১৯৭১ সন থেকে ২০১১ সন অবধি হিন্দু জনসংখ্যা ১২.৪২% হ্রাস পায়। অন্যদিকে পুরো জনসংখ্যায় মুসলমানদের আনুপাতিক হার ৪.১৮% থেকে বেড়ে ৫.৫৭% হয়, অর্থাৎ ১.৩৯% বৃদ্ধি পায়। সবচাইতে বেশী বৃদ্ধি হয় খ্রিষ্টানদের, ২৮.৩৪% থেকে বেড়ে হয় ৪৭.৭৭%। অর্থাৎ পুরো জনসংখ্যায় খ্রিষ্টানদের আনুপাতিক হার ১৯.৪৭% বৃদ্ধি পায়। অথচ আসামে ১৯৭১ সন থেকে ২০১১ সন অবধি মুসলমানদের আনুপাতিক হার ৯.৬৬% বৃদ্ধি হতেই বাংলাদেশী প্রব্রজনকে কারণ হিসেবে দেখানো হয়। উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে খ্রিষ্টানদের অস্বাভাবিক আনুপাতিক বৃদ্ধির (১৯.৪৭%) জন্য অবৈধ প্রব্রজনকে কারণ হিসেবে দেখানো হয় কি? আসামে এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে শুধু হিন্দুদের আনুপাতিক হার কমছে কেন, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয় না। অন্যদিকে একই সময়ে ভারতবর্ষের অন্য অনেক প্রদেশেও মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আসামের থেকেও অনেক বেশি, যেমন হিমাচল (১৯৮%), মহারাষ্ট্র (২০৬%), রাজস্থান (২৫০%), হরিয়ানা (৩৩৯%), পাঞ্জাব (৩৬৮%) ইত্যাদি। একই ভাবে ১৯৭১ থেকে ২০১১ সন অবধি খাসি (১৯৯%), মিজো (২০৬%), মিরি (২৪৯%) এইসব ট্রাইবেল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার  আসামের মুসলমানদের চাইতেও বেশি।  কথাটা অনেকেই জানেন না। চিন্তা শুধু মুসলমানদের নিয়ে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্যই এর মূল কারণ।

মহিলাদের উর্বরতার হার বা টিএফআর (Total Fertility Rate) জনসংখ্যা পরিবর্তনের এক  গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসাবে বিবেচিত হয়। টিএফআর হলো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মহিলাদের সন্তান জন্ম দেওয়ার বয়েসে (১৫-৪৯) গড় হিসেবে কতজন সন্তান জন্ম দেন তার সংখ্যা। ২০১১ সনের সেন্সাস রিপোর্টে আমরা দেখতে পাই যে সামগ্রিকভাবে আসামে মুসলমান মহিলাদের টিএফআর (৩.১) হিন্দুদের (১.৭) তুলনায় ৮২% বেশি। নিম্ন আসাম এবং বরাক উপত্যকার কয়েকটি জেলায় (বিশেষত সীমান্ত অঞ্চলে) মুসলমানদের টিএফআর হিন্দু অধ্যুষিত উজনি আসামের  জেলাগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এই কারণেই মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি।

মুসলমানদের বেশি টিএফআরের  অনেকগুলি আর্থ-সামাজিক কারণ রয়েছে, যেমন গড় মাথাপিছু আয় per capital income), মহিলা সাক্ষরতা (female literacy), মহিলা কাজের অংশগ্রহণের হার (female work participation rate), পরিবার
পরিকল্পনা (Contraceptive prevalence), কিশোরী অবস্থায় গর্ভধারণ (Teenage Pregnancy) ইত্যাদি।

অসম মানব বিকাশের প্রতিবেদন ( Assam Human Development Report, 2014) অনুযায়ী  মুসলমানদের মাথাপিছু আয় ( Rs. 18,228)আসামের  হিন্দুদের তুলনায় অনেক কম ( Rs. 28,092)মুসলমানদের মধ্যে কিশোরী মেয়েদের বিয়ের হার (23.3%) হিন্দুদের তুলনায় দ্বিগুণ
 (11.1%)

জনসংখ্যা বিশারদরা একটি বিষয়ে একমত যে শিক্ষা একজন নারীর উর্বরতার আচরণকে (fertility behavior) সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। কারণ শিক্ষাই নারীকে আরও ভাল সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে, অর্থকরী কাজে অংশগ্রহণের হারকে উন্নত করে, পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সহায়তা করে। পরিবার এবং সমাজে শিক্ষিত নারীকে সম্পদ (Asset) হিসাবে বিবেচনা করা হয়, দায়বদ্ধতা (Liability) হিসাবে নয়। তাই অশিক্ষিত মহিলাদের অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়, হিন্দু, মুসলমান ব্যতিরেকে। স্কুল এবং উচ্চ শিক্ষায় বেশি সময় ব্যয় করার জন্য বিয়ে তুলনায় দেরীতে হয় যা মহিলাদের জন্য বাল্যবিবাহের (Adolescent marriage) হার হ্রাস করে। কিশোরী বয়েসে যে মহিলারা বিয়ে করেন তাদের সন্তানের সংখ্যা স্বাভাবিক ভাবেই বেশি হয়।  নেশনেল হেল্থ এন্ড ফ্যামিলি সার্ভে (2015-16) অনুযায়ী, কিশোরী বিবাহ (বয়স ১৫-১৯) সবচাইতে বেশি নিম্ন আসামের মুসলমান অধ্যুষিত ধুবড়ি (২৯.২%), গোয়ালপাড়া (২২.১%), দরং (২০.৬%), নগাঁও এবং বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দি (১৭.৬%)   জেলাগুলিতে। এই জেলাগুলোতে মহিলা শিক্ষার হারও অনেক কম (৫৩.৩% থেকে ৬৮%)। তুলনামূলক ভাবে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা, যেমন ডিব্রুগড়, যোরহাট, শিবসাগর, গোলাঘাট এবং কাছাড়ে মহিলা শিক্ষার হার অনেক বেশি (৭১% থেকে ৭৬.৪৫%)। তাই হিন্দু অধ্যুষিত এই জেলাগুলোতে কিশোরী বিবাহ অনেক কম (৮.৫% থেকে ১১.৮%)।
আবার ২০১১ সনের সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী আসামে মুসলমান মহিলাদের শিক্ষার হার (৫৬.৮%) হিন্দু (৭১.৩%) এবং খ্রিষ্টানদের (৬০.৫%) চাইতে অনেক কম। ভাটি আসাম এবং বরাক উপত্যকার কিছু জেলায় এই ব্যবধান অনেক বেশি। যেমন ধুবড়ি জেলায় মুসলমান মহিলাদের শিক্ষার হার ৪৮.১% আর হিন্দু মহিলাদের ৭১.৯%। আরেকটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো উজনি আসামের কিছু অসমীয়া হিন্দু অধ্যুষিত জেলায় মুসলমান মহিলাদের শিক্ষার হার হিন্দু মহিলাদের চাইতে বেশি যেমন যোরহাট ( হিন্দু - ৭৬.৪%, মুসলমান- ৮১.৩%), ডিব্রুগড় (হিন্দু - ৬৮.১%, মুসলমান- ৭৯.২%) , শিবসাগর (হিন্দু- ৭৪.১%, মুসলমান- ৮৪.৩%), এবং তিনসুকিয়া (হিন্দু- ৬১.৮%, মুসলমান - ৭১.৭%)। এই কারণেই এই জেলাগুলোতে মুসলমান মহিলাদের গড় সন্তান উৎপাদনের হার (TFR) হিন্দু মহিলাদের চাইতে কম - যোরহাট ( হিন্দু - ১.৬, মুসলমান- ১.৫), ডিব্রুগড় (হিন্দু - ১.৭, মুসলমান- ১.৬) , শিবসাগর (হিন্দু- ১.৮, মুসলমান- ১.৫), এবং তিনসুকিয়া (হিন্দু- ১.৮, মুসলমান - ১.৭)। এই পরিসংখ্যান থেকে একটা বিষয় প্রমাণ হয় যে বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণ মহিলাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি, ধর্ম নয়।  ভারতবর্ষের প্রায় ১২৫ টি জেলায় মুসলমান মহিলাদের টিএফআর হিন্দু মহিলাদের থেকে কম। কাজেই মুসলমান মানেই অধিক সন্তান, এই কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়।


আরেকটি কারণে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হিন্দুর চাইতে বেশি, সেটা হলো শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মধ্যে আনুপাতিক জনবিন্যাস। শহরে যারা বসবাস করেন, তারা মূলত চাকুরীজীবী। এর জন্য শিক্ষার প্রয়োজন, শিক্ষার ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত। তাই শহরাঞ্চলে শিক্ষার হার বেশি। ছেলেমেয়েদের জন্য খরচাও বেশি। এইসমস্ত কারণে শহরাঞ্চলের মানুষরা কম সন্তান চান। আবার গ্রামাঞ্চলের মানুষরা মূলত কৃষি নির্ভর। এর জন্য কায়িক পরিশ্রমের প্রয়োজন এবং লোকবলের প্রয়োজন। তাই গ্রামাঞ্চলে যারা বসবাস করেন তাদের বেশি সন্তানের প্রয়োজন। এই কারণেই গ্রামাঞ্চলের মানুষদের শহরের তুলনায় বেশি সন্তান হয়। জীবন ধারণের জন্য এখানে জনবলের প্রয়োজন। সেন্সাসের পরিসংখ্যান একই কথা বলে। ২০১১ সনের সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী আসামের ৯২% মুসলমান গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। সেই তুলনায় ৮২% হিন্দুরা গ্রামাঞ্চলে থাকেন। মুসলিম অধ্যুষিত জেলায় এই ব্যবধান অনেক বেশি যেমন ধুবড়ি (হিন্দু- ৭০%, মুসলমান- ৯৫%),বড়পেটা (হিন্দু- ৭৫%, মুসলমান- ৯৮%), হাইলাকান্দি (হিন্দু- ৮৬%, মুসলমান- ৯৭%) এবং নগাঁও (হিন্দু- ৭৮%, মুসলমান- ৯৪%)। কিন্তু হিন্দু অধ্যুষিত উজনি আসামের কিছু জেলায় এর বিপরীত চিত্র দেখা যায় যেমন যোরহাট (হিন্দু- ৮১%, মুসলমান- ৬১%), ডিব্রুগড় (হিন্দু- ৮৩%, মুসলমান- ৫৩%), শিবসাগর (হিন্দু- ৯১%, মুসলমান- ৮০%),তিনসুকিয়া (হিন্দু- ৮০%, মুসলমান- ৪৬%) এবং গোলাঘাট (হিন্দু- ৯১%, মুসলমান- ৪৫%)। তাই উজনি আসামের এসমস্ত জেলায় মুসলমান মহিলাদের মাথাপিছু সন্তান (TFR) হিন্দুদের তুলনায় কম।

একটা কথা পরিষ্কার যে শিক্ষা এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ছাড়া আসামের দরিদ্র পীড়িত জেলাগুলোতে, বিশেষ করে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানো সম্ভব নয়। এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র দুই সন্তান পলিসি দিয়ে এর সমাধান হবে কি?


শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৯

নৈবেদ্য

।। অভীককুমার দে।।

কবি, সেজেগুজে আসছেন
মুখোমুখি হবেন
হাসবেন ত্রিকালের হাসি,
এসব দেখে সাহিত্যের মৃত্যু হোক, ক্ষতি নেই
কবি তিনি, নিজেই কবিতার মতো
যুবক যুবতী হয়ে উঠবেন।

কবি যদি পাগল হয়ে যায়
নৈবেদ্য দিও,
রবি না হয় ঠাকুর খুশি হবেন।

এক চিলতে কাতর রোদ

।। অভীককুমার দে।।

কেন জানি বুঝেও বোঝে না কেউ !

দশে দশ মাতিয়ে পুড়ছে আতঙ্ক বাজি,
শব্দ টপকে গেলেই যন্ত্রণায় জনগণ।

এক চিলতে কাতর রোদ
চিতা সাজায়
প্রতিনিধি শরীর চিতায় উঠছে রোজ; এই আয়োজন...
মহড়া মনে করছেন কেউ ?

এই চিতা বাঘ নয়
বাঘ হলে হতে পারতেন বাঘা যতীনের...

মনের খাদ ভরে উঠছে ?
কতিপয় পরিভাষার তরঙ্গ যদি
বাসি লাশ কেটে চলে যাবে ট্রেন
সীমান্ত শহর সাব্রুম থেকে
অসমাপ্তের দিকে...

নির্ঘুম যাত্রী,
চোখ মুখে কাতর রোদ পরিবর্তনের সমানুপাতিক।

দেয়াল ঘড়ি

।। অভীককুমার দে।।

রাজা ও প্রজার মাঝে একটি দেয়াল আছে
পিঠ পেতে রাখেন প্রজা
রাজা পেরেক ঠোকেন
ঝুলিয়ে রাখেন ঘড়ি।

যদিবা গদির কাছে নত হয় সিংহাসন
প্রজাও অতি সাধারণ হতে থাকে যদি
বারবার কাঁটা ঘুরে ফিরে আসে রাজার সময়
ঘড়ির পিঠে অসহায় পিঠ, রক্তনদী
রাজা ঘড়ি দেখে বদলে নিতে পারেন ক্ষত এবং
ইচ্ছেমত পেরেক ঠোকেন জনগণের পিঠে।

প্রজার কাছে প্রতিরোধের কী আছে ?
জেগে ঘুমানোর ওষুধ পেতে পারেন বিনামূল্যে
না হয় শব্দ বন্ধ হয়ে যাবে নিঃশব্দে।

আসুন, ডি জে শুনে প্রার্থনায় বসি
একদিন আয়ু বৃদ্ধি হলে
মিছিল হবে
চেনা অচেনা লোকের মৃত্যু দেখে
মোমবাতি হেসে জ্বলবে, অন্ধকার
হাত পা ছড়াবে নপুংসকের দল।

ওদের পায়ে পা মিলিয়ে অভিযোজিত হবে মানুষ !

আমার উঠোন

।। অভীককুমার দে।।

অষ্টমী পেরিয়ে গেছে অবেলায়
কুয়াশায় ঢাকা ছিল শিউলিঝরা ভোর
এ সবকিছু সহজেই বুঝে নিতে পারে স্বাগতা ঋতু,
তবু কেন জানি চোখ মেলেছে জুঁই ফুলের কলি।

ভালোবাসী

।। অভীককুমার দে।।

বাসা বাসা চেনে
পাখি ডাকে
ভোর হয়

পাখি ভোর বাসা
আশা এক
ভালো হবে সবকিছু।

বাসায় আলো ঢোকে
চোখে পড়ে
রোদ মাখি,
গায়ে রঙ
হাসে কাঁদে

দিন গড়িয়ে রাত,
পরিবর্তন !

ভালোবাসবো বলেই
ভালোর ভেতর
বাসা খুঁজি।

প্রতিদিন
পূর্ণিমার উত্তাপ কমে,
গভীর রাত
শিশির পড়ে
শিউলি ঝরে
বুক পেতে মাটি,

ভালোবাসি বলেই
বাসার ভেতর ভালো
থাকি।

চোখ খোলো জুঁই
বাসায় যদি আশার আলো
ভোর হবে, হবেই
একদিন...

ভালো হবে
বাসা হবে,
ভালোবাসীর ভালোবাসা হবে।

হারাধন বৈরাগী

।। অভীককুমার দে।।

বন্ধু আমার রাতের তারা
স্বপ্নে ভরা ঘুম,
দিনে আলো চিনলো কারা
মনের ভেতর জুম।

বন্ধু আমার বনের কথা
সবুজ গাছের ছায়া,
পাহাড় শরীর নীরব ব্যথা
চোখের ঘরে মায়া।

বন্ধুমুখে কাঞ্চন আলো
জম্পুই ভালোবাসে
মাটির ভাষা বুঝেন ভালো
শব্দসুখে ভাসে।

বৈরাগী মন এলোমেলো
বড়োই আপনজন
কি পেয়েছি কি বা গেল
বন্ধু হারাধন।

নদীকূলের মানুষ

।। অভীককুমার দে।।

কবির কাছে নদী আছে
কাছে টানে,
কাছে যাই, ছুঁয়ে দেখি নদীকূলের মানুষ।

এখানেই থাকেন কবি সাচীরাম মাণিক
অভাবের সীমানা কাঁটাতার বুকে
গরীবের আমাজনের কাছে ফেনী
বুকে ভিন্ন দেশের জলকথা...

কথাজল হয়ে বয়ে যায়,
আশেপাশে হাঁটে কূল,
দুকূলের বনে মেরুকুম;
এখান থেকেই বলতে পারেন--
'আগুনটা উসকে দাও'।

আমি উপকূলের চাষি
বৃষ্টিজলে গা ভিজিয়ে পরাজয় চেয়েছি জয়ের কাছে।

পুতুলমানুষ

।। অভীককুমার দে।।


ধর্ষকের সীমানা থেকে মনোমণ্ডপ বেশি দূরে নয়,
তবু উৎসব জুড়ে পোশাক পরা পুতুল !

স্বচ্ছতার অভিযান শেষে অভিজাত রাস্তা
শকুন্তলা নগর,
খোলা আকাশ মায়াকান্না জানে
না বলেই মুখে কষ্টের কালো মেঘ, বৃষ্টি হচ্ছে খুব,
মানুষের চোখে চোখ রেখে দুর্গার শিশুটি দেখছে--
নতুন পোশাকের ভেতর পুতুলমানুষ।

সেজেগুজে ভিন্ন কাঠামো সব
মণ্ডপের আলোয় প্রতিমা মুখ দেখে হাসছে,
শিশুটিও মুখ বাড়িয়ে মুখ দেখছে অনেক
কেঁদে উঠছে বুক
প্রতিমার মুখ ধর্ষিতা মায়ের মতোই দেখতে !

অনতিদূরে

।। অভীককুমার দে।।

এখানকার আলো বাতাসে একমাত্র কৃত্রিম উপাদান রাজনীতি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় একে অন্যকে নিচে ফেলছে। আসলে টেনে নিচে নামানোর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ।

নষ্ট পরিবেশ পরিবেশন করছে নষ্ট রাজা। নীতির উপর অনবরত পর্যবেক্ষণ আর পরীক্ষণ। অস্বাভাবিক বিবর্তন ঘটছে মানুষের।

পরিবেশ বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে ! এই অভিযোজিত মানুষের মন ও শারীরিক গতিবিধি মানেই নিয়ন্ত্রণহীনতা, ভোগবাদে ভুগছে।

আশ্চর্যজনক রূপান্তর মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে। স্নায়বিক সংঘর্ষের পর প্রতিক্রিয়াশীল আসছে প্রজাতিকে 'মানুষ' বলা যাবে না অথবা বদলে দিতে হবে 'মানুষ' শব্দের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য।

অনতিদূরে আধুনিকতার চুড়ান্ত সময়। অসামাজিক ও বিশৃঙ্খল অবস্থা বন্য আদিমতায় জেগে উঠবে। সেদিন ফুল শিশু গান আনন্দের বদলে আতঙ্ক বহন করবে। কেননা,
ফুল দেখে নিশ্চিত হওয়া যাবে, কাছেই কারো লাশ,
শিশুর কান্না বলে দেবে, আরেকটি পশু সংগ্রামী হলো,
গান শুনেই শিখে নে'য়া যাবে, চিতা থেকে শুরু।

আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ

।। অভীককুমার দে।।

একটি সম্পূর্ণ অসামাজিক ঘটনা অবলম্বনে কিছুদিনের মধ্যেই কুনাগরিক মঞ্চে মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে ধারাবাহিক নাটক, 'বিচার'।

চোখ খোলা রাখুন, দেখবেন--

ধৃতরাষ্ট্রীয় কানা বসে আছেন বিচারকের গদিতে।

ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে পঞ্চনৈবেদ্যের পান্ডা। এই রাজনৈতিক জুয়ারিগুলো জুয়া ও সম্পদের নেশায় দিশেহারা। নাগরিক থেকে নিজের বৌ, কাউকে বাজারু করতে দ্বিধা থাকবে না এদের।

কুরবে গা ভাসিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার মতো সাহসী দেখবেন যাদের, তাদের মধ্যে দূর্যোধন যিনি বংশের টাকা গিলে নিজের অস্তিত্বই ভুলে যাবেন।

দুঃশাসনের আলাদা কোনও চরিত্র থাকবে না। কেননা, দুঃশাসনের ভেতরেই অন্তর্নিহিত থাকবেন দুঃশাসন।

দ্বাপর যুগের কৃষ্ণ ত্রেতায় এফিডেভিট করে জন্মালেন বলেই কলির মঞ্চে মায়া হয়ে বিরাজ করবেন মোবাইল ইন্টারনেট এবং আড্ডায়।

মঞ্চে অগণিত দ্রৌপদী লাশে পরিণত হবে। ওদের রক্তাক্ত শরীর ও লাশ ঘিরে ন্যক্কারজনক বিচার হবে।

'বিচার'-'বিচার'-'বিচার'
অবহেলায় বিবস্ত্র নারী ও নির্যাতন দেখার সুবর্ণ সুযোগ হাত ছাড়া না করে নির্লজ্জের মতো লক্ষ্য রাখুন কুনাগরিক মঞ্চের দিকে।

চুপ কেন !

।। অভীককুমার দে।।

মা মেয়ে বোন
ওরে কথা শোন
কোথায় যাবি ! দুর্গার রূপ ধর তবে;

অসময়ে রথ
অসুরের পথ
রাস্তায়, নিরাপদ কে কোথায় কবে ?

রক্তের নদী বয়,
কত আর প্রাণে সয় ?
ব্যথা, রাস্তার কাঁধে কার লাশ ?

ওদের মেয়ে নেই ?
ওদের বোন নেই ?
কাদের মা নেই !
চুপ কেন সব ! রাজনীতি চাষ ?

জলমাঠের খামারবাড়ি

।। অভীককুমার দে।।

আমরা যখন পৌঁছলাম, মেলাঘরের আকাশে কালো মেঘ জটলা পাকিয়েও জল ধরে রাখতে পারছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে দুএক ফোঁটা ঝরে পড়তেই সম্মিলিত মেঘ কেমন খেঁকিয়ে উঠলো। অবস্থা বেগতিক দেখে বিজনদা, মানে কবি বিজন বোস বাংলাদেশের বন্ধু আল মাদানী আর আমাকে বললেন, 'আর একটুও দেরি করা ঠিক হবে না, চলো'। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অটোরিক্সায় চেপে বসলাম। গাড়ি চলছে রুদ্রসাগরের দিকে।

শেষ বোটটি তখনও ঘাটেই ছিল। তাড়াহুড়ো করে টিকিট নিয়ে আমরা তিন জন চড়ে বসলাম বোটে। বসতে না বসতেই ঘাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। মনে হলো, আমাদের জন্যই বুঝি অপেক্ষা। প্রকৃতিগত সম্পর্ক ও টান আমাদের আসার খবর এই ভ্রমণের সাথে যুক্ত সবকিছুকেই জানিয়ে দিয়েছে বোধহয়। রুদ্রসাগরের বুক চিরে দ্রুত ছুটে চলছি। সামনেই নীরমহল। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। বড় হচ্ছে। কাছে আসছি। কাছে টানছে। কেন জানি, জলসীমানা শেষ হতেই চায় না। বিভূতিভূষণের পাহাড় যেন জলের রূপ ধরে কাছে দূরের খেলা খেলছে। দেখছি, বাঁদিকের জলসীমা হয়ে দলবদ্ধ বৃষ্টি ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। ডানদিকে নীরবতা। আমাদের বোট তখন রুদ্রসাগরের মাঝামাঝি, মেঘেদের ভিড় ঠেলে একটুকরো আলো নীরমহলের মুখে যৌবনের রঙ ঢেলে দিয়েছে।

সশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিল বোট। ঢেউয়ের পর ঢেউ মহলকে অগ্রিম জানিয়ে দিচ্ছিল আমাদের খবর। খবর দিয়েই ফিরে আসছে আবার। এই ঢেউগুলো সুশিক্ষিত প্রহরীর মতোই লুকিয়ে ছিল রুদ্রসাগরের জলে। এক অসাধারণ অভ্যন্তরীণ চলন জানে ঢেউ। বোট যখন প্রায় কাছাকাছি, ঢেউয়ের ভেতর ঢুকে পড়ছিল ফিরতি ঢেউ।

মহলের ঘাটে পা রাখার আগেই বৃষ্টিদল হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বোটের ছাদে। একপ্রকার হুড়াহুড়ি করে একবোট ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ঢুকে পড়লাম অন্দরমহলে। ভেতর সব মানুষ জটলা পাকিয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করলেও, আমরা তিনজন বৃষ্টি ভিজেই ছাদের গম্বুজে পৌঁছে গেলাম। এখান থেকে রুদ্রসাগরকে উন্মুক্ত মাঠের মতোই দেখাচ্ছিল। মেঘেরা ভিনদেশী চাষী, বৃষ্টিবীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে অনবরত। বৃষ্টি শেষে বীজতলার মতোই সেজে উঠেছে জলমাঠ। লাঙলের দাগ যেন জেগে আছে রুদ্রসাগরের বুকে। আমরা তিনজন ভীষণ খোশমেজাজেই তখন। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল বলে আর কেউ উপরে ওঠেনি। জলের মাঝখানে এই মহল চাষীদের খামারবাড়ির মতোই লাগছে। মনেহয়, জলমাঠের ফসল পাকলে এখানেই তুলবে। ছাদের গম্বুজের ভেতর থেকে চারদিক দেখতে দেখতে ছবি তোলার ঋতু লেগেছে সবার। ছবি উঠতে ওঠাতেই বদলে যাচ্ছিল আকাশের ছবি। আমরা যখন নেমে আসছি, তখন আর বৃষ্টি নেই বললেই চলে। ক্লান্ত আকাশের ঘাম শিশিরের মতোই ঝরছে।

একজন চা বিক্রেতা ডেকে বললেন, 'চা খাইবেন ?' বৃষ্টিতে ভিজে একটু ঠান্ডাও লাগছিল। পাশে বসে চা খেতে খেতে গল্প জমে উঠলো। তেমন তাড়াও নেই। কথায় কথায় জানতে পারলাম, তিনি অঞ্জন বর্মন। বয়স আটচল্লিশ। একটিমাত্র ছেলে। দশম শ্রেণীতে পড়ে। প্রায় চার বছর মহলের ভেতর চা বিক্রি করছেন। খুব চেনা মানুষের মতো ডেকে চা খাইয়ে সংসার চালাচ্ছেন। কত বৃষ্টিভেজা মানুষের গায়ে উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা নীরমহল জানে। ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন মহল ছেড়ে বেরিয়েছি, তখন আকাশের কাছে মেঘ আছে, যদিও কালো বুক সাদা হয়ে গেছে। পাখিরা বাসায় ফিরছে। আমরাও বোটে উঠলাম। বোট ছেড়ে দিতেই এক অপরিচিতা কন্ঠে শোনা গেল, 'চিকন গোয়ালিনী, রসের বিনোদিনী... '

মশা

।। অভীককুমার দে।।

বিরোধী কাউন্সিলার বা বিরোধী নেতার এলাকা বলে সেখান থেকে মশা বেরোবে না, এটা হতে পারে না। আবার শাসক দলের এলাকা বলে দাপিয়ে বেড়াতে পারবে না, এটাও কথা নয়। শাসক দলের এলাকার মশা কি বেঁধে রাখতে পারছেন ? মশাদের যা বার বেড়েছে !

যদিও মশাদের তেমন কোনও দোষ আমি দেখি না। কেননা, মশারাও গণতান্ত্রিক দেশের নোংরা ডোবা নালা বা সংরক্ষিত জলেই জন্মাচ্ছে। সাধারণ তন্ত্র মন্ত্র ওরা তেমন বোঝার কথা নয়।

মশারা ভালোবাসা বোঝে না। হাততালি ছাড়া ভালো ভাষা বোঝে না। হাতিয়ার চালাতে জানে। রক্ত চুষতে জানে। এদের সর্বজাতের সর্বশেষ শিক্ষায় শিক্ষিত করে ফেললেও আচরণ বদলাবে না। কারণ, মশারা গণদেবতার দেশে ক্ষুধার পেটে জন্মায়।

এই মশাদের গান পৃথিবীর সবচেয়ে আতঙ্কের গান হলেও বাধ্যতামূলক হাততালি দিতেই হবে। তা না হলে, মশারির মতো ডিটেনশন ক্যাম্পেই কেটে যাবে জীবন।

ঋতু পরিবর্তনের দিনে

।। অভীককুমার দে।।

ঋতু পরিবর্তনের দিনে এমন হয়,
এ সময় যত্নে রাখতে হয় শরীর।

ডাক-তার বলতে পারে না মুখ খুলে
সে কথা ভুক্তভোগীরা জানেন,

ডাক-তার মার খাওয়া এক সেবকের নাম
হাসঁ-পা-তালের জং
ডাকবাক্স থেকে বেশি কিছু নয়।

দাগ পড়া ভেতর পোশাক
গরম জলে ধুয়ে নাও
রোদে দিতে হবে,
এমন হয়, ভয় নেই।

এভাবেই ঢেলে যেতে হবে জীবনের রঙ
একদিন দেখে নিও শিশুর মুখ।

জাড্যদোষ

।। অভীককুমার দে।।

রাস্তার বুক ভারি রক্তে
প্রতিদিন, এখানে ওখানে দাগ
মানুষের !
বিশৃঙ্খল জীবন...

কার বুক খালি হলে কার বুক শূন্য
তা শুধু জানেই চাকা।

বরাবর বেড়ে যাচ্ছে গতি
যৌবনের দিকে,

সামনে, মূহুর্তেই মৃত্যু এক জাড্যদোষ।