।। রণবীর পুরকায়স্থ ।।
(C)Imageঃছবি |
আমার বাবা খাস সিলেটি ।
সিলেটি তো বুঝি, বাংলাদেশের একটি
জেলা সিলেট, সেই জেলার আধিবাসী হলেই সিলেটি । খাস যোগ করলে নাকি সিলেটি ভাষার
অকৃত্রিম রূপের কথক বোঝায় । বাবা বুঝিয়েছে, আমি বুঝি নি । আমার জন্ম শিলচরে, মামার বাড়িতে
১৯৮৩ র দুসরা মার্চ । দুমাস বয়স হতেই চলে যাই বাবার কর্মক্ষেত্র ডিব্রুগড়ে । বাবা ব্যাঙ্কের কর্মচারী । প্রথমে ছিল ক্লার্ক, তারপর পরীক্ষা
দিয়ে অফিসার । আসামের অনেক শহরে
কাজ করেছে । তৈলশহর ডিগবয় দিয়ে শুরু তারপর
গৌহাটি লামডিং যোরহাট শিলচর ডিব্রুগড় । আমি দুবছর ছিলাম আসামে । তার আগে ১৯৮৫ এর
১৫ অগাস্ট আসাম আন্দোলনের
নেতাদের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির আসাম সমঝোতা নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে
ওঠে বাবা । সে বছরই স্বেচ্ছা বদলি নিয়ে চলে
আসে কলকাতায় ব্যাঙ্কের প্রধান কার্যালয়ে । পরে, বড় হয়ে বাবাকে প্রশ্ন করায় বলে আমার জন্য নাকি
কলকাতায় আসা । আমি বুঝি নি । বাবা বলে আসাম তার দ্বিতীয়
স্বদেশ, অসমিয়া ভাষা
বলতে পারে মাতৃভাষার মতো । রাজনৈতিক আসামে দুটি নদী উপত্যকা, ব্রহ্মপুত্র আর
বরাক । বাঙালির মুখের কথায় ব্রহ্মপুত্রই আসাম নামে পরিচিত । বরাকে মূলত বাংলা
ভাষীদের প্রাধান্য । চাকরিসূত্রে বাবা দুই
উপত্যকাতেই বসবাস করেছে, তাই বাবার মুখের
কথায় অনেক অসমিয়া শব্দ । বাবা মানে না । বলে আৎরানো মানে সরিয়ে রাখা, সিলেটিতেও আছে, অসমিয়ায় মাকে আই
বলে, সিলেটের গ্রামেও
বলে, বিষহরি পূজার
মনসা ঠাকুরানিকেও বলে আই মনসা । বলে, সিলেট কাছাড়ের সঙ্গে কামরূপ
জেলার ভৌগোলিক দূরত্ব বেশি না থাকায় অসমিয়ারাও পর্যন্ত কামরূপের ভাষাকে সিলেটিয়া
বলে । এসব কথায় এখন দাঙ্গাবীজের বিতর্ক থাকে বলে প্রকাশ্যে বলে না । বাবা
বলে আসামে তাকে তিন রকমের কথ্যভাষার মোকাবিলা করতে হয় । এক অসমিয়া । দুই বাংলার
লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা এক জগাখিচুড়ি, যা কারো মাতৃভাষা নয় । ঢাকাই সিলেটি চাটগাইয়া
নোয়াখালি ময়মনসিংহ কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারো নয় । কলকাতারও নয় । তবে কলকাতা
ঢাকার প্রতাপ বেশি, সিলেটি তিন
নম্বরে । আর তিনে সিলেটির খুব দুরবস্থা, রামেও মারে রাবণেও মারে ।
অসমিয়াদের কাছে সব কোন্দলের ঘটি হল সিলেটি, বরাকের মানুষ । স্বাধীনতার আগে
যখন পুরো সিলেট আসাম রাজ্যে তখন তো বাঙালির আধিপত্য ছিল একচেটিয়া । সিলেটি
প্রাধান্য ছিল আসামের রাজধানী শিলং এ, গৌহাটিতেও । আসামের সংখ্যাগুরু হওয়ার প্রবল দাবিদার সিলেটকে পরিকল্পিত চক্রান্ত করে
দিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানের হাতে গণভোটের প্রহসনে । আর তার পরই আসামের রাজ্যপাল, সাংবিধানিক
প্রধান আকবর হায়দরি বলেন, যাক বাঙালি আর
ক্ষমতার ধারে কাছে রইল না । এর আগে আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈও আনন্দে
আত্মহারা হয়ে বললেন, আসাম অসমিয়ার । ব্যথিত মহাত্মাজী একথা শুনে আক্ষেপ করে বলেন, আসাম যদি অসমিয়ার
ভারত তবে কার । আমার বাবার আক্ষেপ নেই, আছে রাগ । বলে আসামে বাঙালি
বিদেশি হলে অসমিয়ারা তবে কী । এরাও তো ব্রহ্মদেশ থাইদেশ থেকে এসেছে ।
আমি ওসব বুঝিনি, আসাম নিয়ে আমার
কোনো মাথাব্যাথা নেই
কারণ আমি বড় হয়েছি কলকাতায় । বড় হলেও কলকাতা আমাকে খুব একটা ছুঁয়ে দেখেনি । যদিও
পড়াশুনার সঙ্গে গান বাজনা নাটক সিরিয়েল করে ফেলেছি বারো ক্লাস অব্দি । বঙ্গসংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত ঝাঁকিদর্শন । খুব ভাল নয়
আবার খুব খারাপও ছিলাম না পড়াশুনায় । যেহেতু কলকাতার প্রতি তেমন টান ছিল না তাই
বারো পাশ করেই বায়না ধরি ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার । আমার বয়সী সবাই যেমন করেছে । কারণও একটাই, পশ্চিমবাংলায়
শিক্ষার পরিবেশ নেই । তার উপর আমি তো কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পাশআউট, ভর্তিটর্তির
ব্যাপারেও একটু বৈষম্য হয় । সিবিএসসির আশি নম্বর আর কলকাতার ষাট
কে এক বন্ধনীতে রেখে ভর্তি হয় ।
কলকাতার প্রতি না
থাকলেও, শিলচরে আমার
মামার বাড়ির প্রতি একটা টান আছে । একটা আবেগের ব্যাপার, জন্মভূমি বলে
কথা । আসলে তাও নয়, আমার ছোট মামার বাড়ি বরাক
উপত্যকার এক গ্রামে যেখানে আমার দাদু দিদা ছিলেন । আমার তিন মামা তিন মাসি, একজন ছাড়া সবাই
থাকে শিলচরে । ছোটমামার বাড়ি গিয়ে একবার বৃষ্টির শব্দ শুনেছিলাম সারারাত জেগে ।
ইসপল্টুর টিনে জল তরঙ্গ বেজেই গেছে সারারাত । আমার বাবার বাড়ি ছিল বাজারিছড়া নামে
এক গ্রামে । বাবা বলে ওটাও তাঁবু, পরের জমিতে শনবাঁশের বাড়ি । আমার বাবার কোন স্থায়ী আস্তানা
হয় নি আসাম দেশে, নিজের কোনো বাড়ি
ছিল না । বাবার জন্ম দেশভাগের দুবছর পর, বাবা কিন্তু উদ্বাস্তু নয় ।
যদিও বাবার পৈত্রিক বাড়ি সিলেটের পাড়াগাঁয়ে । গ্রামের নাম রাউলি, পরগণা ছাতক ।
বাবার দাদু চাকরি করতেন মেদলি চা বাগানে এখন নাম পাল্টে হয়েছে শিপানজুরি টি এস্টেট । আমার ঠাকুরদা কিছুই করতেন না, তাই কোন বাড়িঘর
ছিল না । ভাড়াবাড়িতে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবন । বাবা বলে
উদ্বাস্তু হলেই বা কী না হলেই বা কী, ওরা নাকি জন্ম বেদুইন । দেশের
বাড়ি রাউলি এত অনুন্নত যে ওখানে বাস করা যায় না । বাবার অনেক আত্মীয় স্বাধীনতার পর
থেকে বরাক উপত্যকায় এবং আসামে এসে বসবাস করেছে । শরণার্থীর সুযোগ সুবিধা জায়গাজমি পেয়েছে । বাবার বাবা
ওসব কিছুই করেন নি । কেন করেন নি বলতে পারে নি বাবা, তবে আমাকে মজা করে বলেছে তার
বাবা রবীন্দ্রনাথের আদর্শ বাঙালি ছিলেন । তিনি যেরকম বলেছেন হুবহু তেমন, তৈলঢালা
স্নিগ্ধতনু নিদ্রারসে ভরা , মাথায় ছোট বহরে
বড়ো বাঙালি সন্তান ।
এখানে একটা কথা
বলে নেওয়া ভাল ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার পর আমায় নিশি পায় । নিশির ডাকে
পড়াশুনা ছেড়ে দিই । মনি হাজরিকা নামে আমার রুমমেট আসামের মেয়ে, আমাকে অসমিয়া
শেখায় । আর দুই বন্ধু মিলে শহর তোলপাড় করি
। এক বছর গোল্লায় যায় । পরের বছর পাশ করে ফিরে আসি কলকাতায় । এক বহুজাতিক
প্রতিষ্ঠানে চাকরিও পেয়ে যাই । কলকাতায় মন বসে না বলে ফিরে যাই ব্যাঙ্গালোর আবার ।
আবার চাকরি । প্রেমটেম করি কয়েকটা, দক্ষিণ ভারতের সব ভাষাভাষী
ছেলের সঙ্গে প্রেম করেছি, কিন্তু বিয়ের
ব্যাপারে হিসেবি থেকেছি । শেষ পর্যায়ে একটি পাঞ্জাবি ছেলে কৃপালকেই বিয়ে করব বলে
ঠিক করে ফেলি । নারকেল তেঁতুল আর কারিপাতার গন্ধ থেকে তো
মুক্তি । আপাতত থাক আমার প্রেম কথা ।
বাবার কথা বলতে
গিয়ে এদিক ওদিক হয়ে যাচ্ছে । বাবা কেন কলকাতা চলে এল সে কথা তো শেষ করি নি । যখন
শুনল ছাত্রনেতাদের সঙ্গে অ্যাকর্ড হয়েছে রাজীব গান্ধির, বাবার খুব মন
খারাপ হয়ে গেল ।
সমঝোতার শর্তে ২৪ মার্চ ১৯৭১ এর পর যারাই আসামে এসেছে সবাই বিদেশি । এ যেন গুপী
গাইন বাঘা বাইন সিনেমার সকাল আর মধ্যাহ্নের সীমারেখা । যদ্যপি এই যষ্টি দণ্ড ঐ
প্রস্তর খণ্ড স্পর্শ না করিবে তদ্যপি সকাল । খুব আনন্দ হয়, খুব উল্লাস আসামে
। ছাত্রনেতা প্রফুল্ল মহন্ত মুখ্যমন্ত্রী ভৃগু ফুকন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে আসামের
রাজ্যপাট দখল করে । বাঙালিও কেন যেন খুশি হয় । প্রবাদেই আছে গালাগালি খেলে বাঙালির
আনন্দের সীমা থাকে না । বাঙালি খুশি, কারণ হয়তো সে সমঝোতার শর্ত নাকচ
করেছে মনে মনে । বাঙালি কিন্তু বাঙালি তাড়ানোর মিছিলে হাঁটে। স্লোগানও দেয়, খেদিব লাগিব
মানে তাড়াতেই হবে । স্লোগানকে বিদ্রূপও করে । বলে, বুঝলাম তো, যাইতাম কৈ ।
কোথায় বিতাড়ন । বাংলাদেশ নেবে না এক পিসও, ধাক্কা দিলেও
নেবে না । বুদ্ধিমান বাঙালি বলে, বাচ্চা ছেলেদের
বুঝিয়েছে, ওরকম হয় নাকি । এক দেশে দুরকম
নাগরিকত্ব, সব কেন্দ্রীয়
ধাপ্পা ।বাবা কিন্তু এত সহজে বোঝে নি ।
বাবারও এই এক দোষ
আমার মতো । এককথায় অন্যকথায় চলে যায় । তাই বাবাকে আবার ফিরিয়ে এনেছি পূর্বকথায় ।
কেন বলল আমার জন্য ছেড়ে এল তার স্বদেশ আর দ্বিতীয় স্বদেশ । বাবা বলেছে ১৯৭১ যদি ভিত্তিবর্ষ
হয় তাহলে প্রমাণ করতে পারবে না অনেকেই । গ্রামের মানুষ কিংবা
ছোট ছোট শহরের মানুষ কোথায় নথিপত্র নিয়ে সচেতন । যদিও বা প্রমাণিত হয়
নাগরিকত্ব তাহলে দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণির হয়ে থাকতে হবে । সন্তান সন্ততিরা সরকারি
চাকরি পাবে না । ভাল পড়াশুনার সুযোগ পাবে না, একটা বৈষম্য থাকবে । আমার বাবা
কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ আউড়ায় বলে তিনিই স্থায়ী ঠিকানা । তিনিই জানিয়েছেন জাতি
বৈষম্যের বিষফল কথা । বলেছেন, জাতি প্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায়, ধর্মেরে ভাসাতে
চায় বলের বন্যায় ।
কলকাতা আসার পর বাবা শুধু ঠিকানা যোগাড় করে গেছে । প্যানকার্ড ভোটারকার্ড
অফিসের আই ডিকার্ড রেশনকার্ড । ড্রাইভিং
লাইসেন্স করিয়েছে কিন্তু গাড়ি নেই, এখন তো আধারকার্ডও আছে । প্যান
ছাড়া সব কটাতেই ঠিকানা । আমি বাবাকে বলি তাহলে আর এত আতান্তর কেন । বাবা মেনে নেয়
। বলে চাকরির প্রথম দিনের কথা । ব্যাঙ্কের ডিগবয় শাখার ম্যানেজার কাকতিবাবু
বলেছিলেন ফর্ম ফিলাপ করে দিতে । তারপর বললেন পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস ।স্থায়ী ঠিকানা বলে তো কিছু নেই । বাবা তখন হতভম্ব । ভাবছে
চাকরিটা গেল । নেই স্যার শুনে কাকতিবাবু
বললেন দিয়ে দাও
কিছু একটা । তখনই মনে পড়ে বাবার পিসির বাড়ির কথা । লক্ষীপুরে নদীর পারে দোতালা
বাড়ি । প্রায়ই যেত শিলচর থেকে পিসিমার হাতের রান্না খেতে আর ভাইবোনদের সঙ্গে
হুল্লোড় করতে । বাবা সাহসে ভর করে লিখে দেয় মিছে কথায় তার স্থায়ী ঠিকানা ।
লক্ষীপুর কাছাড় আসাম । সেই দাগটা খুব খচখচ করে বাবার । আমি বলি সে তো চুকে গেছে ।
ওটা মুছে গেছে । এখন তো ঠিকানা কলকাতা । মহানগরের নাগরিক ।
আমার মুখে মুছে
যাওয়ার কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলেছিল বাবা । মুছে যে যায় নি সে কথাটাই বলে । বলে
সেই মিথ্যে কেই একদিন সত্য করে তুলেছিল । আমাকে অবাক করে বাবা তখন গল্পের ভেতর
নিয়ে এল এক মোচড় । সে এক গল্প বটে । সঠিক কবে বাবার কাছ থেকে শুনেছি মনে নেই ।
একবারে বলেছে, নাকি কিস্তিতে কিস্তিতে বলেছে
কে জানে । কারণ আমার কাছে গল্পটার বাস্তবতা আমার নিজের । পুরোটাই যেন আমি চোখের
সামনে ঘটতে দেখেছি । তাই বাবার মুখ্য বয়ানে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বলে যাব বাবার
স্থায়ী ঠিকানা মুছে না যাওয়ার গল্প । মূল কথক হিসেবে আমিও মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে যাব
যাতে বিষয়ান্তরে না যায় কথাবস্তু ।
বাবার এক সহকর্মী আই লোরেন্দ্র সিং । সহকর্মী শুধু নয় সহপাঠীও, শিলচর কাছাড় কলেজে একসঙ্গে পড়েছে বি
কম । ডিগবয় মিশন পাড়াতে দুইবন্ধু একসঙ্গে থেকেছে বাসা ভাড়া নিয়ে । লোরেন্দ্রকাকু
লক্ষীপুরের স্থায়ী বাসিন্দা । বাবা বলে
লক্ষীপুর শহরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই মণিপুরি । লোরেন্দ্রকাকুও তাই । বাবা কাকুকে
প্রায়ই বলত তার স্থায়ী ঠিকানার কথা । অফিস রেকর্ডে তার মিথ্যে তথ্যের কথা । বলে
বলে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল । শেষমেশ বলল একটা জমি কিনবে লক্ষীপুরে কমদামে, নদীর পারে হলে
খুব ভাল হয় । বাবার মনে তার পিসিদের বাড়ির শৈশবস্মৃতি সৌন্দর্যে তখনও অপরূপ । বাবা
বলত, বলতে বলতে হারিয়ে
যেত দোতলা বাড়ির অন্দরে । কখনও বাড়ির উঠোনে কামিনী গাছের নীচে । কী আকুল করা ফুলের
গন্ধ, বাবার পিসিমা
বলতেন কামিনী ফুলের গাছে সাপ থাকে । গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে চলে আসে । কখনও ভরা বর্ষার
দোতলা থেকে দেখতে কী বিশাল লাগত ঘোলা জলের ফোঁসফোঁসানো বরাক নদীকে । হাত বাড়ালেই
যেন নদীর জলে নৌকো । একদিন রাতে মেজদা বলল চল । বৃষ্টির রাতে হাফপ্যান্ট পরেই
বেরিয়ে গেল দাদার হাত ধরে মাছ ধরতে । ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে ছিল বাবা, শুধু খলুই এগিয়ে
দেওয়ার কাজ করেছে মেঘেঢাকা পূর্ণিমার রাতে । মেঘ সরে গেলে, সেকি এক অপার্থিব
দৃশ্য জলে । রুপোলী মাছেরা সব উঠে এসেছে নৌকো ঘিরে । ওরকম দৃশ্য আর দেখে নি বাবা ।
বাবার মনোবাসনা পূর্ণ করে লোরেন্দ্র কাকু একদিন বলল পাওয়া গেছে জমি । নদীর পারে
এবং শহর থেকে একটু দূরে । কাকু অর্ধেক, বাবা অর্ধেক দিয়ে
কিনে নেয় খুব
সস্তায় । এক হাজার করে কাঠা, এক বিঘা জমির জন্য দুই বন্ধু দেয় দশ দশ কুড়ি হাজার ।
দুজনেই জমি দেখে উকিল কাছারি স্ট্যাম্প পেপারে
রেজিস্ট্রি করে চলে এল শুভক্ষণে । জমিটা কিনেছে তাদেরই পরিচিত এক
মোগলাইর কাছ থেকে । বাবা বলেছে মণিপুরি মুসলমানকে মোগলাই বলে। হয়তো তাচ্ছিল্য
করেই বলে । নুরুদ্দিনের এক পিসিমা ছাড়া আর কেউ নেই, জমিটা তার
পিসির । অনেক
চেষ্টা করেও একটা পিআরসি
যোগাড় করতে পারেনি বলে নূর চাকরিবাকরিও পায় নি । বাবা বলে এসব চক্রান্ত, অসমিয়া ছাড়া যাতে আর কেউ চাকরি না পায়
তাই শাসকপক্ষীয় চালাকি । আমি বাবাকে বলি নূরউদ্দিন তো বাঙালি নয় । তাতে কী , বাবা বলেছে অসমিয়া ছাড়া সবাই
বিদেশি আসামে ।বাবাকে বলি , তো পিআরসি টা কী, কী তার ব্যবহার ।
খায়, না সাজিয়ে রাখে
ফুলদানিতে । বাবা পিআরসি জানে । বলেছে, পার্মানেন্ট রেসিডেন্সিয়াল
সার্টিফিকেট, স্থায়ী ঠিকানার
শংসাপত্র । বাবাকে বলি, থাকলে কী হয় ।
বলে, না থাকলে অনেক ফ্যাঁকড়া । বাবা রেগে গিয়ে মজা করে বলে হাড়মুড়মুড়ি হয়, বাঘে ছোঁয় । বলি, কোন আইন কানুনের
বালাই নেই । না, সোজা ডিটেনশন
ক্যাম্পে পুরে দেওয়া হয় । ওটা আবার কী । আমার চমকে দেওয়া প্রশ্নে বাবা আবার রাগে ।
রেগে বলে মুরগির খাঁচা । নুরুদ্দিন
পিসির সম্পত্তি বিক্রি করে চলে যায় মণিপুরের থউবালে ।
বাবা লক্ষীপুরের জমিটা কিনে খুব তৃপ্তিতে আছে এটা বোঝা যায় । বলে মাঝেমাঝেই
চলে গেছে নদীর পারে নিজের জমিতে বেড়াতে । অন্তত যতদিন আসামে ছিল । বাঁশের বেড়া
দিয়ে ঘিরে দিয়েছে সীমানা , নামজারি করিয়েছে
। বাবার পিআরসি নেই । বলেছে পিআরসি দিয়ে কী হবে, চাকরিটা তো আছে, নদীর পারের
বাড়িটা আছে । আসলে আসাম অ্যাকর্ড হওয়ার আগে ভাবে নি এরকম হবে । বাবাকে বলি তাহলে
আর কিনলে কেন জমি । বাবার মাথায় তখন মিথ্যে তথ্য লেখার পোকা । পরের দিকে লোরেন্দ্র
কাকুও বলেছে জমিটা বিক্রি করে দেওয়ার জন্য । বলেছে নদীর পারের জমির দাম বাড়ে না, কোনও দিন নদীর
গর্ভে চলে যাবে । বাবা বিক্রি করবে না, কাকুকেও বিক্রি করতে দেয় না ।
কাকু বাবার জমি দেখাশোনা করে । বাবাকে বাঁশ বিক্রির টাকাও দিয়েছে একবার । এখন আর
দেয় না । জমিটাতো দেখাশোনা করে, এতেই খুশি বাবা । বলে বেড়াটেড়া দিতেও খরচা আছে । কাকু
খুব ভাল মানুষ, আমাদের কলকাতার
বাড়িতে এসেও থেকে যায় । বাবা বলে রিটায়ার করে দেশে গিয়ে বাড়ি করবে, থাকবে । আমি যে
ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে কোথাও যাব না এনিয়ে বাবার একটা মনোব্যাথা আছে । এটা তো ঠিকই
ভারতের বড় শহর গুলির মধ্যে ব্যাঙ্গালোরের আকর্ষণ ভিন্ন । এমন নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ভারতের কোন বড় শহরে
নেই । তাইতো বলা
হয় ব্যাঙ্গালোর পেনশনভোগীদের স্বর্গ, বলা হয় বাগাননগর । বাবাকে বলি
অবসর গ্রহণের পর কর্ণাটকে চলে আসুক, আর একটা স্থায়ী ঠিকানা হয়ে যাবে
। তবে লক্ষীপুরের জমি নিয়ে বাবার আবেগ দেখে আমিও দুম করে মত বদলে ফেলি । বলি থাকব
না গার্ডেনসিটিতে । আমার জন্মদেশে চলে যাব । শিলচরে থাকব, মাঝেমধ্যে যাব
বাবার সঙ্গে লক্ষীপুর ।
আবার ফিরে আসি
আমার প্রেমপর্বে । এতসব হেতু আমার সামনে, কোনটা রাখি কোনটা ছাড়ি ।
নাগরিকত্ব নিয়ে আসামের এই সমস্যা আমাকেও জর্জরিত করে ফেলেছে । এক অপমান এবং
পরাজয়ের মুখোমুখি । একটা
লড়াই করারও দরকার । আমি কলকাতায় থাকি বা ব্যাঙ্গালোর থাকি আমার শেকড়টা তো বরাক উপত্যকায় । আমার বাবার তাঁবুবাড়ি বাজারিছড়ায়, আমার মামার বাড়ি
শিলচর এবং ভুবনগ্রামে আর লক্ষীপুরে আমার বাবার স্থায়ী ঠিকানার জমি । ভোলেভালা বাবা
মানুষটার স্বদেশ নিয়ে এক আবেগের চাপ ।আমি জানি
অবসরের পরে
কিছুদিনের জন্য হলেও বাবা ফিরে যাবে তার স্বদেশে । আমি তাই এমতাবস্থায় চাপের মুখে
পড়ে যাই । মামার বাড়ির ঢেউটিনে টাপুরটুপুর বৃষ্টির ধ্বনি, শহর শিলচরের
শৈশবগন্ধ , বাজারিছড়ার না
দেখা শনবাঁশের বাড়িতে ঠাকুমার কোলে বসে দোল খাওয়া বাবার নাদুসনুদুস মূর্তিটাও যে ডাকে,
আয় চলে আয় মেয়ে ।
খুব মজা হবে ভেবে আমার সর্বভারতীয় বাঁধন আলগা করি । কৃপালকেও বলে দিই
টাটা । বাবাকে
বলি কাছাড়ের খাস সিলেটি ছেলে চাই ।
এতে আমার কোন
অভিসন্ধি নেই । আসলে কম বয়সে বাড়ির বাইরে চলে যাওয়ায় একটু বেশি পেকে যাই । সমলিঙ্গ
থেকে বিপরীতের প্রতি আকর্ষণে একটু বেশি মাখামাখি হয় ছেলেদের সঙ্গে । অচিরেই বুঝে
যাই, ইংলিশ হিন্দি
কিংবা দক্ষিণী ভাষায় প্রেম করায় ভাষাপ্রেমের ব্যাপার থাকে, কিন্তু বড় কষ্ট
হয় ব্যবহারে । মানিয়ে নেওয়ায় একটু চাপ হয় । মাতৃভাষায় হৃদয়াবেগ যত তাৎক্ষণিক হয়, অনুবাদের ভাষায়
হয় না । ধরা যাক খাওয়া দাওয়ার কথা, সিলেটিদের খাদ্যাভ্যাস একেবারেই আলাদা, পশ্চিমবঙ্গীয়দের সঙ্গে পর্যন্ত
মেলে না । আমি সিদল ভর্তা খেতে ভালবাসি, ১০০ রকম ভর্তার রেসিপি আনিয়েছি
বাংলাদেশ থেকে । তবে আমার মা রেসিপি বই দেখে রাঁধে
না । চালকুমড়ো
পাতায় সিদলের পুর দিয়ে একরকম পাতুরি বড়া করে । জিভে জল এসে যায় । সিদল হল পুঁটি
মাছের একরকম নরম শুঁটকি । মা সেদ্ধ ডিমের রসা করে আধফালি করে চালের গুঁড়ি দিয়ে
ভেজে । কী যে অমৃতপদ হয় । এসব আছে আমাদের । দুপুরের পদে শাক শুক্তো থাকে । থানকুনি পাতা বাটা
কিংবা হিঞ্চে বা পলতাপাতার বড়া । ইংরেজি বলা ঝকঝকে সুদর্শন ভিনদেশী পাত্ররা পারবে খেতে কিংবা বলতে, শাকের মধ্যে রুই আর মাছের মধ্যে রুই । রকগানের সঙ্গে
আমি নাচতে পারি উদ্দাম, বল্লে বল্লেও
পারি, কিন্তু মাঝেমধ্যে
ধামাইল নাচতেও তো মন চায়, চায় সোহাগ চাঁদ
বদনির সুরে শরীর
দোলাতে । তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা বলে কেউ একজন পাশে দাঁড়াবে না শ্রাবণ বিকেলে । এসব
তো খুব কম চাওয়া, স্বভূমি ছাড়া আমি
পাব না কোথায়ও । আমার সন্তান হামটি ডামটি শিখুক হাট্টিমাটিম টা কেন শিখবে না ।
লালকলম নীলকলমের ঝুলিঝাড়া কথকতা, ঠাকুরমার পায়ের বাড়ৈএ দোলে দোলে কিচ্ছা শুনবে না
সিলেটি মায়ের সন্তান ।
আমি কিন্তু দেখতে
অসুন্দর নই মোটে । আমি জানি আমার রেটিং । কয়েকজনের মাঝখানে থাকলে এমনকি অনেকজনের
মধ্যে থাকলেও পুরুষরা আমাকে দেখে মুগ্ধ হয় পুরুষদেখায় আর মেয়েরা দেখে হিংসেচোখে ।
শিলচরের দীপঙ্কর ভট্টাচার্য পাত্র হিসেবে হয়তো দুর্লভ ছিল, এরচে ভাল পাব না । আই আইটির প্রাক্তন, নিজের কোম্পানি
দিল্লিতে । শিলচর থাকে দিল্লি যায় । শিকড়ের টানও বলে । প্রভূত ধনসম্পত্তি । ভেবে দেখলাম হবে না । আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা মাঝারি
মানের, মার্কশিট দেখানো
যাবে না । এসব ছেলেরা ডমিনেটিংও
হয় । আজ দিল্লি কাল শিলচর করছে, একদিন বলবে
স্টেটসে যাবে, সেটল করবে । তাই ফাৎনা উঠিয়ে নিয়েছি
।
পাওয়া গেল সুসিতকে । অনেকটাই
মনের মতো । দেখেই মনে হয় খুব কেয়ারিং । গগনচুম্বী উচ্চাশা নেই
আবার যথেষ্ট অর্থবানও বটে । মাঝারি পসারের ডেন্টিস্ট । বেড়ানোর শখ আছে, ড্রাইভার থাকলেও
নিজে গাড়ি চালাতে পছন্দ করে । আমি পাশে থাকলে মনটা গুনগুন করে, শিলচর ছাড়িয়ে
শিলকুড়ির পথে গিয়ে সুরের বানী মুখে আনে । এই পথ যদি না ইত্যাদি । খাদ্যরুচিতেও
বেজায় মিল । থাক পুনরুক্তি দোষেরই হয় । তবে ডিট্টো, সেম টু সেম । শুধু দাঁতের
স্বাস্থ্য নিয়ে একটু জ্ঞান দেওয়ার বাতিক আছে । প্রথম পরিচয়েই বলে ফোকলা দাঁতের
মানুষরাই কেন দশলাখ খরচ করে মড্যুলার কিচেন সাজায় । যারাই রান্নাঘর সাজাতে পয়সা
খরচ করে তাদের সবারই দাঁতে নাকি
ক্যাভিটি নয় গাম সমস্যা । কী দিয়ে খাবে কিচেনের মাল । মাল শব্দটায় একটু
রুচিদোষ আছে । তবু আমার শেষ স্বয়ংবর সুসিতকেই নির্বাচন করে । সুসিত বলে বিয়ের পর
চাকরি ছাড়তে হবে । আমি বলি না । সে বলে আচ্ছা । মহা ফ্যাসাদ । এত বাধ্য হলে কী চলে, একটু তো ঠুকঠাক
করতে হবে । আমি না বলতেই আচ্ছা হয়ে গেল । আমিই কী ঘোড়ার ডিম চাকরি করতে চাই । এক
কথায় বললে কী হ্যাঁ করা যায় । আমিতো আর ওর মতো আনকোরা পিস নই । আমার সঙ্গে বিচিত্র সব চার দেওয়া বড়শি থাকে, খেলিয়ে খেলিয়ে
ওঠাই । আসলে সুসিত তখন যে কোন শর্তেই রাজি । এই পাত্রীকেই বিয়ে করবে । শুধু বলল এনআরসি লাগবে ।
আমি পিআরসি জানি এনআরসি জানি না । তাই বলে দিলাম নেই । সে বলল করতে হবে । আমি বললাম, কেন লাগবে, বিবাহসূত্রে
স্থায়ী বসবাসকারি হয়ে যায় সবাই । সে বলল আসামে হয় না । আমি তো আমার পিআরসির জ্ঞান
নিয়ে চালিয়ে দিয়েছি এতক্ষণ । বুঝতে পারছি এনআরসিটা জটিল । কারণ সুসিতকে এই প্রথম তার
বিয়ে নিয়ে চিন্তান্বিত লাগল ।
আমি আবার বাবার শরণাপন্ন হই । বাবাও জানে না, জানলেও তার আসাম যোগসূত্র সব
জানে । ক্লিক করে । আই লোরেন্দ্র সিং । এবার সংলাপের আকারে বাবা আর কাকুর
ফোনবার্তা সাজিয়ে দিই । লোরেন্দ্রকাকুর সংলাপগুলি আভাসে আর যুক্তিতে পুনর্গঠন
করেছি । বাবার প্রশ্নছিল এতসব কাণ্ড ঘটে গেছে বাবাকে জানায় নি কেন । কাকু বলে,
--- এখন তো তুই পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক তাই দরকার নেই ।
--- নেই কেন? আমি যেকোনো সময় ফিরে যেতে পারি
। আমার জমি আছে । অবসরের পর বাড়ি করব, খেতখামার করব । আমার মেয়েও আসবে
। পাসপোর্ট লাগবে নাকি ? আমি এদেশের
নাগরিক, ভারতরাষ্ট্রের ।
--- এসব চলবে নারে ভাই । আসামের নাগরিকপঞ্জি নবায়ন হচ্ছে এবার ৬৪ বছর পর ।
আসামে বেআইনি অনুপ্রবেশ নিয়ে চুক্তি হয়েছিল ভারত সরকার আর আসাম ছাত্র
ইউনিয়ন আর আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ।
--- জানি । এনআরসি টা কী বল ?
---ন্যাশেনেল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস । ১৯৫১ র পর আর নবায়ন হয় নি । রেজিস্টারে
নাম উঠলে একটা মাদুলি দেওয়া হবে, পরে
থাকতে হবে আইডি
কার্ড ।
--- এদিকে তো হচ্ছে না, ওটা কী শুধু
আসামের জন্য ?
--- আসাম এনআরসি । ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১ র ২৪ মার্চ মধ্যরাত্রি পর্যন্ত ।
--- মাঝরাত পেরিয়ে গেলে ?
--- বিদেশি । শনাক্ত করণ হয়ে গেলে বিতাড়ন । বিতাড়নের দুরকম উপায় আছে । এক, ডিপোর্টেশন , দুদেশের মধ্যে কথাবার্তা বলে ।
দুই, ঘাড়ধাক্কা । সীমান্তে নিয়ে গিয়ে ঠেলে দেওয়া । পোশাকি নাম পুশব্যাক
।
--- আচ্ছা লোরেন্দ্র তুই কে ? আমার বন্ধু,
না ঐ
উগ্রজাতীয়তাবাদি আসাম সরকারের দালাল । ওদের ভাষায় কথা বলছিস ?
--- আমি মণিপুরি ।
--- শোনরে মণিপুরি গী মচা । ১৯৫১ র নাগরিকপঞ্জি আর ১৯৭১ এক মধ্যরাত্রি দিয়ে
আমার কী হবে ? তোর আমার তো নামই
নেই, ভোটার হইনি তখনও । যাদের নাম
আছে বেশির ভাগ তো মরেই গেছে ।
--- বাবা মা ঠাকুর্দা কারো নাম তো থাকবে । ওটাই উত্তরাধিকার। লিগ্যাসি । বের
করতে হবে কম্প্যুটার থেকে ।
--- আমি কম্পূটার জানি না । গ্রামের চাষা জানে না ।
--- তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিতেই ওরা আটঘাট বেঁধে নেমেছে । সেবাকেন্দ্র খোলা হয়েছে
। লিগ্যাসি ডাটার সঙ্গে একটা এগারো সংখ্যার কোড দেওয়া থাকবে ।
--- বেশ ।
--- এবার লিগ্যাসির সঙ্গে তোকে জুড়ে দে । প্রমাণ কর তুই প্রদোষ বিশ্বাসের ছেলে
। তারজন্য তথ্য দিতে হবে । চৌদ্দটি সহায়ক নথির যে কোন একটি তো চাই ।
--- যেমন ?
--- জমির পাট্টা দাগ ইত্যাদি ।
--- মারদিস কেল্লা । আমার আছে । তুই বের করে দিতে
পারবি আমার লিগ্যাসি ডাটা ? আচ্ছারে
লোরেন্দ্র আসাম সরকার তো সবতাতেই ছিল ধীরগতি, বলা হয় ল্যান্ড অফ লাহেলাহে, মানে ধীরে ধীরে ।
হঠাৎ এই সক্রিয়তা কেন ?
--- আমি তো মণিপুরি দালাল । বলব কেন ? এই তো গতকালই আসামের এক বিধায়ক, বরাক উপত্যকার, বললেন এনআরসি
অবাস্তব । এসব শুধু বাঙালিকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা । ভাতে মারার প্রকল্প ।
জানে মারারও । ইতিমধ্যে লিগ্যাসি ডাটা না পেয়ে ছসাতজন চাষি পরিবার আত্মহত্যা করে
ফেলেছে ।
--- আর এত রেকর্ড কী আছে আসামের । ৫১ র নাগরিকপঞ্জি, ৬৬ র ভোটার লিস্ট
?
--- আছে কিছু । শুধু বাঙালির নাম গুলো নষ্ট হয়ে গেছে । আছে ডি ভোটার ।
সন্দেহজনক, ডি মানে ডাউটফুল ।
সন্দেহের বসে বন্দী করে রাখা, নির্যাতন ।
ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে পুলিশি নির্যাতন হচ্ছে । যখন যাকে পছন্দ হচ্ছে
না তখন তার নামের পাশেই ডি লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে । একটাও সন্দেহজনক ভোটারকে বাংলাদেশ
ফেরত পাঠানো যায় নি । ডিটেনশন ক্যাম্প নামের খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ।
হিটলারের জার্মানির ইহুদিদের মতো । ওরা নিজের মাতৃভাষা ভুলে জার্মানিতে কথা বলত, তাও কী বাঁচল ? আসামেও বাঙালিরা
হয়ে গেল অসমিয়া, চর এলাকায় মানুষ
অসমিয়া হয়েও বাঁচতে পারে নি । শুধু বাঙালি নয় রে, অসমিয়া ছাড়া সবাই, এই মণিপুরি
দালালও লিগ্যাসি ডাটার পেছনে দৌড়চ্ছে, কিছুই পাই নি এখনও ।
আরও অনেক কথা হয়
দুই বন্ধুতে মান অভিমানের । তবে একটা কথা বুঝে যাই যে, নেট ঘাঁটলে কিছু
পাওয়া যাবে । এবং পাই । বাজারিছড়ায় নেই
মেদলিতেও নেই, মায়ের বাড়ি ভুবনগ্রামে
নেই । তাহলে অনুসন্ধানের এলাকা একটু বড়
করে নিই । কাছাড়
জেলার প্রদোষ বিশ্বাসের নাম । পাওয়া যায়
ঠাকুর্দার নাম
ঠাকুমা ও জেঠুর নাম ও বাবা নেই । এগারো সংখ্যার লিগ্যাসি ডাটা কোড লিখে রাখি
৩১০-৪০৩৮-৮৮২৮ । ১১ নং শিলচর চক্র, শিলচর টাউন
ওয়ার্ড নং ৭ ইলেক্টরেল খণ্ড ৭ । বাবাকে দেখাই, বাবার কী আনন্দ । বলে, সবাই নাকি
পরিচিত, শ্রদ্ধেয় জন ।
প্রণয় কাকুর নাম আছে, প্রণয় কুমার চন্দ, দ্বিজেন্দ্রলাল
সেনগুপ্ত, কম্যুনিস্ট ছিলেন
বিসি গুপ্তর বাড়ির সবার নাম, ব্রজমোহন গুপ্ত বাবার মাস্টারমশাই , স্কুলের সবচেয়ে ভালমানুষ স্যার । অঞ্জলি সোম সমর
আদিত্য বাবার মামা রাধিকা রঞ্জন দাম দিদিমা মানদা সুন্দরী দাম । চায়ের দোকান অমর
ভ্রমর দুই ভাই । বাবা ফিরে যায় লুপ্ত সময়ে । দুদিন ধরে ৬৬ এর ১১ নং নির্বাচন
কেন্দ্র ঘুরে বেড়ায় । বারবার দেখে পরিচিত নামগুলি । একসময় ফিরে আসে স্বসময়ের
বাস্তবতায় । লোরেন্দ্র কাকুকে ডাকে । বলে,
--- শুধু আসাম কেন ? নাগরিকপঞ্জি তো
হবে ভারতের । রাষ্ট্রের ?
--- হবে হয়তো । এটা আসাম এনআরসি । বিশেষ আইন ।
--- তাহলে আর দেশ কী ? কিসের নাগরিকত্ব
আইন ১৯৫৫ ?
--- অ্যাকর্ড হয়েছে বলে নবায়ন ।
--- বুঝলাম । আমার তো সব আছে । সহায়ক নথিও । লক্ষীপুরের জমি আছে । ফিলাপ করে
তোর কাছে পাঠিয়ে দেব । জমা করে দিস ।
--- অনলাইনেও হয়ে যাবে ।
বাবা আমাকে সব
তথ্য দেয় । আমি একে একে সব আপলোড করি মনের আনন্দে । এনআরসি হয়ে গেলে আর বিয়ের বাধা থাকবে না । যতদিন না এনআরসি হচ্ছে আমার আর সুসিতের বিয়ে সূক্ষ্ম
সুতোয় ঝুলে থাকে । সুসিত বলেছিল এনআরসি হয়ে যাবে । কী বুঝে বলেছিল কে জানে ।
তার তরফ থেকে চেষ্টার ত্রুটি করেনি । শেষ পর্যন্ত হাত তুলে দেয় । বলে হবে না ।
রাষ্ট্রহীন মানুষকে কী করে বিয়ে করবে সে নিয়ে ফাঁফরে পড়ে । আমি কিন্তু নেট ঘেঁটে
জেনেছি এরকম বিয়ে হতে পারে, ভিন রাজ্যের
নাগরিকের ক্ষেত্রে সদর্থক সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার । তবে আমার ক্ষেত্রে
বিষয় অন্য। ওকে আশ্বস্ত করে বলি লিগ্যাসি ডাটা পাওয়া গেছে, সহায়ক তথ্য ও আছে
। সুসিত আবার খুশি হয়ে
বলে এবার এলে করিমগঞ্জের খাই খাই হোটেলে পেটপুরে খাবে দুজনে ।
বাবার পাঠানো তথ্য
বাতিল হয়ে যায় । ওরকম কোন দাগ পাট্টার সংখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় নি লক্ষীপুরে । বাবা
রেগে যায়, বললেই হল নাকি ।
কাকে নালিশ করলে সুরাহা হবে বুঝতে না পেরে
লোরেন্দ্র
কাকুকেই বলে,
--- এ কী করে হয় ? আমাদের জমি, দুজনে মিলে
কিনলাম , বেড়া দিলাম, নামজারি হল । আমিন
ডেকে জরিপ পর্যন্ত করানো হল । এখন বলছে দাগ পাট্টা নেই ।
লোরেন্দ্র কাকু চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ । তারপর বলে,
--- নেইরে । নতুন জরিপ হওয়ায় দাগ পাট্টা মুছে গেছে ।
--- মুছে গেলেই হল । দাগ পাট্টা মুছে যায়, শেলেটের লেখা নাকি ? তুই মেরে দিয়েছিস
শালা । মণিপুরিরা সব পারে ডাকাতের জাত ।
বাবার দেওয়া সব
অপবাদ কাকু মেনে নেয় । আমি তো শিশুবেলা থেকে দেখছি, কাকু বাবার সঙ্গে তঞ্চকতা করবে না । কাকুর
কাছ থেকে যুক্তিসঙ্গত উত্তর না পেয়ে বাবা অসহায় হয়ে পড়ে । যা নয় তা বলে বন্ধুকে । হঠাৎ
সব হারিয়ে গুম মেরে যায় বাবা । থতমত খেয়ে বসে থাকে উদাস দৃষ্টিতে । জমিটার
অর্থমূল্য কিছু নয়, কিন্তু এর সঙ্গে
যে আবেগ জড়িয়ে আছে কোটি টাকার । একটা গর্ব,
স্থায়ী ঠিকানার
মানসিক দলিল, ইচ্ছে করে ভুল
তথ্য লেখার শুদ্ধি প্রমাণ । বাবার ফ্ল্যাট বাড়ি একদম পছন্দ নয়, কলকাতা শহরটাকে
কোনদিন মেনে নিতে পারেনি নিজের বলে । তাই শেষ জীবনে একটা ছোট বাড়ি করবে ভেবেছিল, ইসপল্টুর চাল
দেবে আর বর্ষার রাতে বৃষ্টি পতনের শব্দ শুনবে । মানুষ তো একা থাকতে পারে না, তাই মুখোমুখি
বাড়িতে থাকবে ভেবেছিল দুই বন্ধু । বর্ষার টইটুম্বুর জলে নৌকো করে মাছ ধরবে । আর
শীতের সময় নদীর চরে লাইশাক সিম ধনে ফুলকপি বাঁধাকপির বিচরা করবে । লোরেন্দ্র
কাকুকে বলেছে বাড়ির সীমানা নিয়ে ওর সঙ্গে ঝগড়াও করবে । স্বপ্নের সঙ্গে যে বাবার
হৃদয় জুড়ে ছিল তার পরিচয় আর স্থায়ী ঠিকানা । আমারও ভাবতে অবাক লাগে লোরেন্দ্রকাকু
পর্যন্ত কী করে মেনে নিল দাগ পাট্টা হারিয়ে যাওয়ার গল্প । কিছু একটা তো আছে রহস্য
।
বাবাকে লুকিয়ে আমি টেলিফোন করি । কাকু আমার গলা পেয়েই ঝরঝর করে কাঁদে । বলে,
--- তোর বাপটা একটা বোকা, মাথামোটা । আমাকেও তার বোকামির সামিল করে নিয়েছিল ।
আমাদের জমিটা বড় সুন্দর ছিল রে । দুদিকে দুটো বাঁশ ঝাড় ছিল । তোর বাবা বলত বাঁশের করুল আর চেঙ মাছের পোনা দিয়ে কড়ু হয় । আমরাও খাই, ইরম্বায় দিই ।
হারিয়ে গেল ।
--- জমিটার কী হল কাকু ?
--- সে কি আজকের কথা ? অনেক বছর আগেই
বরাক নদী নিয়ে নেয় তোর বাবার পরিচয়, স্থায়ী ঠিকানা ।
--- বাবাকে জানাও নি কেন ?
--- তোর বাবাকে জানিস না ? কেমন আবেগপ্রবণ । তুইও থাকিস ব্যাঙ্গালোর । বুড়োবুড়ি
দুজন একা একা । আমার উপর এত ভরসা করেছিল । রাখতে পারলাম না । শুনলি
না আমাকে কত কথা শুনিয়ে দিল ঠগ জোচ্চার ।
--- ওসব তোমাদের কথা,
আমি কি জানি ।
--- পাগলের কথায় আমিও কান দিই না । শুধু দেখে রাখিস। কোন কাণ্ড না
ঘটিয়ে দেয় ।
বাবা কাণ্ড একটা
ঘটিয়েছে সত্যি । রিটায়ার করে কলকাতার ফ্ল্যাটবাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে । সব টাকা
পয়সা নিয়ে রওয়ানা দেয় শিলচর অভিমুখে।
আবার শিলচর শহরের
উপকণ্ঠে রামনগরে নদীর পারে চারকাঠা জমি কেনে । বাড়ি বানিয়ে বসবাসও শুরু করে দেয় ।
বাবাকে কেউ এনআরসি র কথা বললে চুপ মেরে থাকে । বাবা আমাকে বলে দেখি কে তাড়ায় তার
স্বদেশ থেকে ।
সুসিতও বাবার অনুগত
হয়ে আসাম এনআরসিতে নামহীন আমাকে বিয়ে করে । সুসিতের অনুরোধে অনেক
নকল গাঁইগুই করে ব্যাঙ্গালোরের
চাকরিও ছেড়ে দিই ।
এখানে
আমার নামটা জরুরি নয় । কিন্তু আমার বাবা স্বদেশ
বিশ্বাসের নামটা জরুরি । কারণ গল্পে নায়ক নাম থাকাটা দস্তুর ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন