“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

বোলতা ঢোকার পর



 ।। শিবানী দে ।।


ফাল্গুনের দমকা হাওয়ার সাথে ঘরে ঢুকল একটা বোলতা । ফাল্গুনের ফুরফুরে বাতাসে কত কিছু ভেসে আসে ---- আলো আসে, রঙ আসে, আবেগ আসে, উচ্ছলতা আসে, সুবাস আসে, কুহুতান আসে । ভরদুপুরে যখন চারদিকে বসন্তের উথালপাতাল, তখন আমার ঘরে বোঁ করে একটা বোলতা ঢুকে গেল।

             আমি পাখি, প্রজাপতি, এমন কি মৌমাছিও আমার ঘরে ঢুকতে দেখলে ভয় পাই না । কিন্তু বোলতা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম । তার একটা বিষাক্ত হুল আছে, সেটা নাকি সে সামান্য অজুহাতেই বিঁধিয়ে দিতে কসুর করে না । যদিও আজ পর্যন্ত কোনো বোলতা আমাকে এবং আমার পরিবারবর্গের কাউকে  কামড়ায় নি, তবে আমার প্রতিবেশীর শ্বশুরমশাইয়ের দাদাশ্বশুরকে এবং আমার ছেলের বন্ধুর মার মামাকে কামড়েছিল তাই আমার বিশ্বাস, সে হিংস্র, যে কোনো মুহূর্তেই আক্রমণ করতে পারে ।

               সে এলো, কিন্তু আমার গায়ে বসল না । আমার চারপাশে ঘোরাঘুরিও করে নি । হয়তো কোনো  কোণ খুঁজছিল, কোনো নিভৃত কোণ, যেখানে সে বাসা গড়তে পারে । যেভাবে কোনো পাখি খোঁজে; কোনো জন্তু খোঁজে ; আমার নিজের ঘরটাও তো আমি এভাবেই খুঁজেছিলাম ।

               তার বাসা ! ওরে বাবা, সে তো হুলের ছড়াছড়ি হবে । ওকে ঘরে বাসা তৈরি করতে দেওয়া যায় ? যদিও আজ পর্যন্ত কোনো বোলতা আমার ঘরে ডেরা বাঁধেনি যে আমার সে সম্পর্কে কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হবে । তবুও, লোকের কথা তো অবিশ্বাস করা যায় না ।

             বোলতা ঘরে ঢুকে ওড়াওড়ি শুরু করতেই আমি তালপাতার পাখাটা (লোডশেডিং চলছিল) হাতে নিলাম । পাখাটা শূন্যে জোর চালালাম, সে দিগ্‌ভ্রষ্ট হয়ে অন্য ঘরে ঢুকল  সারা ঘরময় চক্কর কেটে জানালা দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছিল বুঝি, কাচের জানালা বন্ধ, তাই একসময় বেরিয়ে এল, কিন্তু বাইরে নয়, এবার আমার দিকে আমি আবারো ভয় পেলাম । পাখা তুলে তাড়িয়ে দিতেই দেওয়ালে গোত্তা খেয়ে আবার আমার দিকে উড়ে এল, আবার পাখা দেখে ঘরের অন্য দিকে চলে গেল । গায়ে বসবার চেষ্টা এখনো করে নি, হুলও ফোটায় নি । কিন্তু বেরোচ্ছেও না । বিশ্বাস নেই । না: একে আর দয়া করা যাবে না ।  এবার যখন কাছে এল, আমি পাখাটা একেবারে নিশ্চিত লক্ষ্যে ছুঁড়লাম । মানুষের ঘরে ঢোকা ! ভয় দেখানো ! যা, মর গে । পাখার ঘায়ে মাটিতে ফেলে ক্ষান্ত হলাম না, ডাঁটি দিয়ে মাথাটা চ্যাপ্টা করে ফেললাম, যাতে আর উঠতে না পারে । একটা হিংস্র দংশক পতঙ্গ । উপকারী হলে না হয় কথা ছিল । হুল সহ্য করা যেত ।

            একটা ছোট পতঙ্গ মরাতে কিই বা আসে যায় ? রক্ত বেরোয়নি, কাতরায় নি মৃদু ফরফর শব্দের আর্তনাদ আমার কানের পর্দায় আঘাত করে নি, কাজেই মরমেও ঢোকে নি । নিরুদ্বিগ্ন মন, পরিষ্কার মগজ । ও যদি মরণ-চীৎকারে গগন ফাটাত, আমার রি-অ্যাকশনও বেশি হত । যদি কোনো বাঘ চিতাবাঘ বা হাতি লোকালয়ে ঢোকে, জনতা তাকে ঢিল ছুঁড়ে, খুঁচিয়ে, পিটিয়ে মারে, আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়, আমারও কষ্ট হয় । যত হোক, ওরা বড় প্রাণী, ওদের দেহের সঙ্গে আমাদের দেহের অনেক মিল, রক্ত বেরোয় গলগল করে, ব্যথায় আর্তনাদ করে । যারা তাদের মারে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, কিংবা নেহাতই ভয়ে, যে ওই জন্তুরা হিংস্র, তাই (অথবা মারার নেশায়ও হতে পারে) মারে, যেভাবে আমি বোলতাটাকে মারলাম । 

            রইল উপকারী অনিষ্টকারীর কথা । আমরা জানি, শৈশব থেকে গরু সম্বন্ধে রচনা পড়ে আসছি, গরু  অতি উপকারী প্রাণী । সেকথা মহিষ, ছাগল, স্থানবিশেষে উট ভেড়া সম্পর্কেও প্রযোজ্য । সেই উপকারীদলের মধ্যে একজন মান্য, পূজিত, মাতা-আখ্যাত, বাকিদের কেটে খেলে দোষ নেই । একই ধরণের উপকারী, তবুও কেটে ফেলা যায় । তাহলে হত্যার জন্য অনিষ্টকারী উপকারীর যুক্তি খাটে না ! এখানে ধর্মীয়-মান্যতাযুক্ত খাদ্যাখাদ্যের বিচার । কিন্তু কারো গোমাতা তো অন্য কোনো গোষ্ঠীর খাদ্য হিসেবে পরিগণিত । সে ক্ষেত্রে খাদকদের মাথায় অখাদকদের ডাণ্ডা সেটা ঠিক হিংসা বলা যায় না, বরং ধর্মরক্ষাই বলা যেতে পারে ।  উত্তরাখন্ডে গোমাতা-সন্তানদের একজন (ইনি আবার জনপ্রতিনিধি, জনতার একজন নন) লাঠি দিয়ে মেরে একটা ঘোড়ার ঠ্যাং খোঁড়া করে ফেললেন, ঘোড়া বেচারার অপরাধ ছিল সে পুলিশকে পিঠে করে জনপ্রতিনিধিদের ধরণাসভার কাছে (স্বেচ্ছায় নয়) এসেছিল । গোমাতার মত 'অশ্বপিতা' হলে হয়তো বেচারার মার খাবার সম্ভাবনা কিছু কম হত । মনে হচ্ছে জীবজন্তুর প্রতি হিংসা কমাতে হলে ওদের এখন থেকে মাতাপিতাই বানাতে হবে ।

           আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি ও তো কোনো উপকারী জীব নই । প্রকৃতির সংসারে কোনো উপকারই করি নি, বরং আমার ঘর বসাতে হাজার হাজার প্রাণী ধ্বংস হয়েছে, বাসা, খাদ্য, পরিবেশ নষ্ট হওয়াতে পরোক্ষভাবে আরো কত প্রাণী বিপন্ন হয়েছে । আমার খাবার যোগাতে, সখের বস্ত্রের জোগান দিতে কত প্রাণ গিয়েছে । বোলতা ঘরে ঢুকলেই মারি, জোঁক, বিছে, সাপ দেখলেই মনে হয় মেরে ফেলা উচিত । ওদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে, তারা যদি কোনো একদিন আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে, এই মানুষটা কোনো কম্মের নয় । এ কোনো উপকার করে না । বেশি বাঁচলে বেশি ধ্বংস করবে । হুল না থাকলেও হুলের চাইতে মারাত্মক হাতিয়ার গড়ার, জোগাড় করার ক্ষমতা এর আছে । একে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি ? সেদিন আমি, আমার মত মানুষ কোথায় যাব ? ভাগ্যিস, ওরা এখন পর্যন্ত বলে নি ।

কোন মন্তব্য নেই: