।। শিবানী দে ।।
(C)Image:ছবি |
আমাদের মেয়েদের
জন্য আস্ত একখানা দিবস ধার্য করা হয়েছে । আমাদের জানমালের মালিকদের দেওয়া তোফা ।
জানতে তোমরা সবাই ?
আজকের দিনে কী
করছ গো দিদি? বোন? মাসিমা ? মেয়ে ? রোজকার মতই ঘুম
থেকে উঠে রান্না ঘরে ঢুকেছ, তাই না ? ছেলেমেয়েকে সামলে, বরকে, ছেলেমেয়েকে, শ্বশুর শাশুড়িকে
খেতে দিয়ে বাসন মেজে ঝাড়পোছ করে সকলের নোংরা জামাকাপড় কেচে চান করে সবার শেষে
খেতে বসেছ, নিজের জন্য একটুকরো মাংসল চিকেন লেগ
কিংবা মাছের দাগা রেখেছিলে, না চিকেনের গলা
বা মাছের কাঁটাসর্বস্ব ল্যাজা দিয়েই একথালা ভাত সাবাড় ? তায় আবার ইনি আলু
খান না তো উনি খান না মাছের ছাল, উনার পাতে আবার
দুটো ভাত বেশি পড়ে গেছে, আবার বাসি তরকারি ভাতও খানিকটা আছে ।
তুমি তো আবার ফেলতে জানোনা, খাবার নষ্ট হলে মালক্ষ্মী পাছে রাগ করেন, যদি তোমার
সংসারের পানে কোপদৃষ্টিতে দেখেন, সেই ভয়ে তুমি
নিজেই ফ্যালনা খাবার সব খেয়ে ফেললে, কাজেই ভুঁড়ির
বৃদ্ধিসহ বদহজমের রোগ । সন্ধ্যায় বাড়ি বাড়িতে যা যা হয়ে থাকে, সেইরকমের ঘটনার
উপর বেশ কয়েক পোঁচ রঙ চড়িয়ে বানানো ন্যাকাবোকা সিরিয়াল দেখে সময় কাটিয়ে দিলে । কই, একটু পার্কেও যাও নি ? একটু রাস্তায়
হাঁটো নি ? সন্ধ্যায় বেরিয়ে একটু রেস্তোঁরা, সিনেমা, নিদেনপক্ষে
কয়েকজন সমবয়সী বন্ধু একজোট হয়ে নির্ভেজাল আড্ডা দিতে পারতে, কিন্তু সময় হয় না
। সেজন্যে তোমাদের জন্য টিভিতে ন্যাকাবোকা সিরিয়ালের আয়োজন, ঘরে থেকে যাতে
অন্যদের প্রয়োজনমতো উঠতে পার; আর সিরিয়াল মিস
হলে উঠোনের ওপারের মহিলাটির থেকে পরে সারাংশ জেনে নেবে । আকাশের দিকে মুখ তুলে শেষ
কবে তারা দেখেছিলে, দেখেছিলে আকাশের চাঁদটা এখনো রাস্তার
হাজারটা নিয়ন বাতির থেকে উজ্জ্বল, কিংবা সন্ধ্যার সূর্য
কি সুন্দর কমলা রঙ মাখায় মেঘের গায়ে, সারা পৃথিবীটাও যে
তখন রঙিন হয়ে ওঠে ? সূর্যোদয়ের সময়ে তুমি তো রান্না ঘরে
ঢুকে যাচ্ছো, সবাই সকালে অফিসে কাজে স্কুলে বেরোবে, তাই সকলের আগে
উঠলেও তুমি কখনো দেখতে পাওনা লাল সূর্যটা
কিভাবে ভোরবেলা একটু একটু করে আলো ছড়িয়ে গাছের, বাড়িঘরের ফাঁক
দিয়ে উঁকি দেয়; পাঁচটা মিনিটও যদি তুমি সময় করতে পারতে, মনে হত সূর্য
দেখেছি, আজকে সারাটা দিন আমার ।
পারোনি, সময় পাও নি, ভাবতেও ভুলে গেছ
যে তোমার এই সংসারের বাইরে ও আর বিশাল সংসার আছে । তোমাকে কেউ ফুরসত্টুকুও দেয় নি, একটু অন্য দিকে
তাকাতে, তুমিও ভেবেছ ঘরের কাজ ছেড়ে অন্যদিকে
তাকানো পাপ । সারাটা দিন অন্যের সেবা, অন্যের ভাবনা, অন্যের অপেক্ষা ।
কোনো ধন্যবাদহীন সেবা গ্রহণ করে সবাই তোমাকে কৃতার্থ করেছে, তুমি তাতেই
চরিতার্থ হয়েছ । তোমাদের তো অনেকেই স্কুল কলেজে পড়েছ, কেউ কখনো একখানা
বই দিয়ে বলেছে, এখানা পড়ো? দেশে কত কিছু
ঘটছে, খবরের কাগজ পড়ে কত আলোচনা হচ্ছে, তুমি শুনছ, কিন্তু কোনো
আলোচনায় তোমার অংশ নেই, কারণ তুমি তো কাগজটা পাবে বিকেলে, ততক্ষণে খবর বাসি, সবার আলোচনা শেষ, তোমার মত তো কেউ
শুনলই না । কাজেই তোমার কোনো মত আছে বলে কেউ কিছু ভাবলই না । তুমি হয়ে গেলে ‘কিছু জানিনা/বলতে
পারব না’ পাবলিক ।
তোমার ধর্ম হল ষষ্ঠী, সাবিত্রীব্রত, শিবরাত্রি, এমনি সব উপোসের ও
অঞ্জলি দেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ, ঠাকুরের
কুলুঙ্গির বাইরে বেশি কিছু অর্থবহ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পুরুষের জন্য, তোমার জন্য মানা
। পুরুষ পুরোহিত পুজো সেরে নেবার পর খেলনা ঠাকুরকে সিঁদুর মাখানোর জন্য তোমাদের ছেড়ে
দেওয়া হয় । মন্দিরে মসজিদে ঢুকতে তোমার মানা, রজস্বলা হলে
ধর্মগ্রন্থ পড়তে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মানা, গার্জেনদের মতে, তুমি তো কথায়
কথায় অপবিত্র হও । তবুও যে কেন ওইসব ধর্মস্থানে তীর্থস্থানে যাবার জন্য তোমাদের
ছোঁকছোকানি । যেখানে সম্মান নেই সেখানে তোমার মাথা
ঠোকাবার দরকারও নেই, সেই দেবতাকে মানবারও দরকার নেই, তোমাদের মাথা এত সস্তা
নয়, একথা কেন তোমরা বলতে পার না ?
জানি কেন বলতে পার না । হয়তো ইচ্ছে
করে, কিন্তু ইচ্ছেটাকে ধরে রাখ, কারণ নাহলে হয়তো
মাথাটা জোর করে নুইয়ে ঠুকে দেওয়া হবে । শারীরিকভাবে যদি জোর করা না হয়, তাহলেও নানাভাবে
বোঝানোর চেষ্টা হবে, মেয়েরাই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, ধর্মের, সমাজের নিয়মগুলো
মায়ের কাছ থেকে ছেলেমেয়েরা শিখবে, কাজেই মায়েরা না
মানলে সমাজ উচ্ছন্নে যাবে । শুনতে শুনতে
তোমার একসময় মনে হবে, এইসব নিয়মনীতি বোধহয় অপরিবর্তনীয়, অলঙ্ঘনীয়; তোমার চিন্তার
শক্তি ঠুঁটো করে হয়ে যাবে ।
তোমাকে বলা হয় বেশি
রাতে একা বেরোতে নেই, দূরে বেড়াতে একা যেতে নেই; কেউ তোমার বলের
উপর বুদ্ধির উপর বিশ্বাস করে না, কিন্তু আসলে একা
থাকার জন্য তোমার বিপদ ঘটেনা; বিপদ হয় যখন
হিংস্র হায়নার মত মাংসলোভী পুরুষ তোমাকে
আক্রমণ করে, লোভের বলের সঙ্গে তুমি পেরে উঠবে কেন, সেই কথাটা
অভিভাবককুলকে বোঝানো যায় না । ও/ওরা কেন আক্রমণ করবে সেটা কেউ বলবে না । বলবে, আক্রমণ করাটাই
ওদের স্বভাব; সেই স্বভাব পালটানো আমাদের দ্বারা সম্ভব
নয় । বলবে, তুমি মেয়ে, তাই দুর্বল, তাই তুমি ঘরে
থাকবে । উহ্য অর্থ, নইলে আর কেউ তোমাকে দখল করে ফেলবে, আমার অধিকার নষ্ট
হবে । মনুষ্যত্ব নয়, তোমার লিঙ্গ হয়ে ওঠে তোমার পরিচয় ।
তোমার যোনিই তোমার ইজ্জত, একথা সমাজের সব
মানুষকে জন্ম থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয় । তাই সেই ইজ্জতেই
ঘা দিয়ে অত্যাচারী মাংসলোভীরা বলে, কেমন দিলাম । ইজ্জত
গেল, বাকি থাকল কি? সেই কথা বেদবাক্য
মেনে বোকা মেয়েরা কেউকেউ আত্মহত্যা করে, পুরুষাঙ্গ বা
যোনি যে শুধুমাত্র হাত পা চোখ কানের মত একটা শারীরিক অঙ্গমাত্র, সেটা মনে থাকে না
। ওরে মেয়ে, জীবন তো তোর একটাই। হাত পা চোখ কান যদি
কোনো অবস্থাতে আহত অকেজো হয়ে যায়, তুই কি মরার কথা
ভাবিস ? তুই তো সেটা সারানোর কথা ভাবিস । তাহলে
ওই একটা অঙ্গের ক্ষেত্রে কেন অন্যরকম চিন্তা ? সেটা ক্ষতবিক্ষত
হলে সারা শরীরই কেন বাতিল হয়ে যাবে ? সারানোর কথা কেন
ভাববি না ?
আজ আস্ত একখানা নারী দিবস । হল তো
একশ বছরের বেশি । কিন্তু শুধু উদযাপন ছাড়া আর কিছু পরিবর্তন হয়নি গো দিদি, মাসিমা, বোন, মেয়ে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন