“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৩

স্মরণঃ রমাপদ ভট্টাচার্য


।। সপ্তর্ষি বিশ্বাস ।।

   তাঁকে নিয়ে খুব বেশী কিছু বলা যাবে কি? জানিনা। মাঝারি একটি ভিটেয় একজন উঁচা-লম্বা মানুষ ইস্কুলে আর বাড়িতে ছাত্র পড়িয়ে গেলেন – কত বৎসর? মৃত্যুকালে বয়স যদি আশির মতো হয় তবে – পঞ্চাশেরো বেশী বছর ধরে... তারপর হারিয়ে গেলেন মহা অন্ধকারে, মহা নীলে ...
         ‘তোর মতো আমারো আসিল্‌ গল্পের বই পড়ার স্বভাব। রবি ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ পড়তে পড়তে রাইত হইযাইত। বাবায় গাইলাইতা। লেন্টন্‌ লইয়া যাইতাম গিয়া পড়ার টেবিলের তলে। তে বেড়ার ফাঁক দিয়া আলো কম বুঝা যাইত ...’ পড়তে যেতাম তাঁর কাছে। কেলাস সেভেন-এইট থেকে টেন্‌ অব্দি। পরেও গেছি কিছু জানবার, বুঝবার হলেই। জেনেছি, বুঝেছি আর শুনেছি তাঁর কথা। গল্প। ছাত্র পড়ানোর কোঠাটিতে কখনো। কখনো ভেতরের কোঠায়। তিনি যে ইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন আমি ঐ ইস্কুলের ছাত্র ছিলাম না। তাঁর বাড়িতে গিয়ে পড়তাম। তাঁকে দেখতাম ঠিক সাড়ে ন’টায় হেঁটে যাচ্ছেন। অথবা সকালে তাঁর হেঁটে যাওয়া ঘোষণা করত সকাল সাড়ে ন’টা। হেঁটেই যেতে দেখেছি সর্বদা। কদাচিৎ রিক্সায়। লঙ্গাই রোড থেকে নীলমনি ইস্কুল। সেই কুশিয়ারার পাড়ে। চিত্রবাণী সিনেমা পেরিয়ে। হাতে লম্বা, কালো ছাতা। কখনো মেলা। কখনো মুড়ে নিয়ে লাঠির মতন হাতে করে চলা। শাদা ধুতি, শাদা পাঞ্জাবী। চোখে চশমা। উন্নতনাসা। গৌরবর্ণ। সেই চলাই মর্মে জাগায় সম্ভ্রম।
       আমাদের বাড়ি পার হয়ে লঙ্গাই বাজারের দিকে গেছে যে রাস্তা ঐ রাস্তা ধরে এগোলে বাঁদিকে সেই বাড়ি – যা’তে ছিল আমাদের পাড়ার একমাত্র তালগাছ, তার উল্টো দিকের গলিতে স্যারের বাড়ি। ছোটো পুকুর ছিল একটা। তার সামনে শাক সব্জীর সামান্য বাগান। বাড়ির পেছনে ধূ ধূ মাঠ। উঠানের সামনের দিকে আমাদের পড়বার কোঠা। বিকালেই যেতাম বেশী। অংক পড়েছি তাঁর কাছে। পড়েছি সংস্কৃত। ব্যাকরণ। পড়তে পড়তে সন্ধ্যা ঘনাতো। শান্তুদাদের বাড়ির সুপারী গাছের ছায়ায় অন্ধকার জমাট বাঁধতো।স্যার পড়িয়ে যেতেন। মনেপড়ে ক্লাস সেভেনে সমান্তরাল সরল রেখার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন। ‘দুইটা রেখা, পাশাপাশি চলে। সমান দূরত্বে। কিন্তু মেলেনা কোনোদিন’ – একটু থেমে ‘মেলে। অসীমের কোথাও গিয়ে মিলে যায়’ ...মনেপড়ে সেই “মাঘ পন্ডিত কথা”র সেই শ্লোকের ব্যাখ্যা – যখন ভোর হচ্ছে, যখন কলি থেকে জেগে উঠছে ফুল ... হায়, মূল শ্লোকটা আজ মনেনেই –তবু যেন কানে বাজে রমাপদ ভট্টাচার্যের স্বর ...
          স্যারের মা ছিলেন অসুস্থ। শয্যাশায়ী। দীর্ঘকাল। স্ত্রী’ও ছিলেন অসুস্থ। ফলে মূলতঃ স্যারকেই করতে হতো মা’র শুশ্রূষা। মা’র মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই সম্ভবতঃ স্যারেও স্ত্রী’ও হন শয্যাশায়ী। তবু স্যারকে বিরক্ত বা রাগত দেখেছি বলে মনেপড়েনা। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে হেসে কথা বলেই শিখিয়ে নিতেন ণ’ত্ব-ষ’ত্ব বিধান, বাচ্য পরিবর্তন, কারক-বিভক্তি নির্ণয়। মূল সংস্কৃতে পড়েছিলেন রামায়ণ, মহাভারত। গল্প বলতেন তার। - জীবনের একটা সময়ে, হয়তো মধ্যবিত্ত সমাজ-নিয়মেই, যার সঙ্গেই দেখা হতো, সকলেই জানতে চাইত ‘কী চাকরি করি’, ‘কত বেতন’ – ইত্যাদি। কিন্তু এই স্যার, রমাপদ ভট্টাচার্য, দেখা হলেই বলতেনঃ ‘কী পড়ছিস্‌? কি লিখছিস্‌?” আমার লেখা প্রকাশিত হতো যেসব কাগজে জোগাড় করতেন। পরে আমিও কাগজ জমিয়ে রাখতাম তাঁকে দেওয়ার জন্য। কয়েক বছর আগে আমার প্রথম মুদ্রিত কবিতা সংকলনটি দিতে গিয়েছিলাম তাঁকে। আহ্‌, সে’কি আনন্দ। তাঁর চোখে জল। আর আমি ...
ঠিক হলো আমাদের উপনয়ন হবে। আমি তখন নাইন কেলাসে। ভাই এইটে। আমার আর আমার ছোটো ভাইএর। শুনলাম সেই উপনয়ন প্রক্রিয়াতে নাকি ‘গুরু’টির পায়ে মাথা ঠেকিয়ে ‘ওঁ ভূর্বস্ব...’ শিখতে হয়। জানিনা আমার মাথা আসলেই কত উঁচু তবু তাকে স্বেচ্ছায় যার তার পায়ে নামাতে না দেওয়ার মতো অহং আমার ছিল সেই বাল্যকাল থেকেই। কাজেই বাবাকে বল্লাম স্যারের সঙ্গে কথা বলে দেখতে। তিনি যদি ঐ “দীক্ষা” দিতে রাজি হন তাহলেই এসব হবে। নাহলে নয়। সানন্দে রাজি হলেন স্যার। দীক্ষা নিলাম তাঁর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে। সেই দীক্ষার কতোটা মূল্য দিতে পেরেছি কেজানে তবু স্যারের পায়ে মাথা রেখে ঐ সময়টুকু পেয়েছিলাম যে আশ্চর্য বোধের স্পর্শ তা আজো যেন টের পাই ।
       উপবীত, উপনয়ন ঘিরে আমার কোনো বিশ্বাস অদ্যাপি নেই। তাই দায়ও নেই কিছু। শুধু দায়, মনে হয়, আছে সেই “গুরু”টির প্রতি যাঁর পায়ে হাত দিয়ে নিয়েছিলাম সেই দীক্ষা যে দীক্ষার বীজ নিহিত স্যারের তাঁর মাকে করা, স্ত্রীকে করা নিরলস সেবায়।   সেই দীক্ষার বীজ নিহিত সমস্ত কিছুর পরেও তাঁর হাসিতে, তাঁর পাঠমনস্কতায়...সেইথেকে আমার বিয়ে থেকে আমার ছেলের মুখেভাত – সবকিছুতেই স্যারের কাছে বায়না ধরেছি পৌরহিত্য করার। শুধু স্নেহবশে স্যার এসেছেন। পালন করেছেন আপন ভূমিকা।
     সেই স্যার, রমাপদ ভট্টাচার্য, ‘রমা বাবু’ নামে সুপরিচিত। নীলমনি ইস্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। সারা শহরের সমস্ত ইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা তাঁর বাড়িতে এসেছে পড়তে। অনেক কৃতী ছাত্রছাত্রীর শিক্ষক তিনি। –চলে গেলেন। খবর পেলাম দূর শহরে বসে। জানলাম আমার আরেকটি আশ্রয়স্থল  গেলো উৎপাটিত হয়ে।
সোজন্যঃ  দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ
             জানলাম শুধু আমার নয় বর্তমান প্রজন্ম হারালো একটি উদাহরনকে – আদর্শ শিক্ষকের, আদর্শ মানুষের। মনেপড়ে ক্লাস সেভেনে সমান্তরাল সরল রেখার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন। ‘দুইটা রেখা, পাশাপাশি চলে। সমান দূরত্বে। কিন্তু মেলেনা কোনোদিন’ – একটু থেমে ‘মেলে। অসীমের কোথাও গিয়ে মিলে যায়’... আজ, দূর স্যারের সেই বসতবাড়ি থেকে, তাঁর চিতা থেকে বহূ দূরের শহরের মধ্যরাতে বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে ভাবি তবে কি সত্যি কোনোদিন, অসীমে, ঐ গম্যমান সরল রেখাটিরি মত, স্যারের সঙ্গে আবার দেখা হবে কোনোদিন? আবার কোনোদিন স্যার বলবেন কি সেই গল্পঃ          ‘তোর মতো আমারো আসিল্‌ গল্পের বই পড়ার স্বভাব। রবি ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ পড়তে পড়তে রাইত হইযাইত। বাবায় গাইলাইতা। লেন্টন্‌ লইয়া যাইতাম গিয়া পড়ার টেবিলের তলে। তে বেড়ার ফাঁক দিয়া আলো কম বুঝা যাইত ...’ ...
জানিনা







কোন মন্তব্য নেই: