“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০১৩

শুধু কবিতার জন্যে



(ঊর্ধ্বেন্দু দাস অসম তথা পূর্বোত্তরের অন্যতম শক্তিশালী কবি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'শুধু কবিতার জন্যে' কবিতাটির অনুপ্রেরণা নিয়ে এক অন্য বয়ান তিনি হাজির করেছিলেন এই কবিতায়। আমার ভালো লাগা কবিতা তাই এখানে দিলাম।)
ঊর্ধ্বেন্দু দাস
 
তিনটি স্লোগান কারা গেঁথে দিয়ে গেল, কাল
মধ্যরাতে দেয়ালে আমারঃ
‘শুধু কবিতার জন্যে বেঁচে থাকা সম্ভব।’—
‘শুধু কবিতার জন্যে তোমার অস্তিত্ব অর্থবহ।’
‘শুধু কবিতার জন্যে দেহের পতনও তুমি
হেলায় নস্যাৎ করতে পারো।’—

এবার দেয়াল ভেঙে ফেলাটুকু বাকি-ই যা---
তাবৎ ভাষ্য আর তত্ত্বের পচন থেকে ভালোভাবে বাঁচতে হলে,
           এবং বাঁচাতে হলে সবটুকু স্বকীয়তা---
কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ এবং মাৎসর্যের তাপ,
স্বপ্নাতুর অস্তিত্বের স্পর্ধিত বিলাস,--
কবিতার উৎসে এসে স্থির-চিত্তে বসতে হবে,
নগ্ন পদ; নতশির---
রক্তছোপ বাস ছেড়ে জন্মের পথম ত্রিবেণীতে।

শুধু কবিতার জন্যে বেঁচে থাকা চলতে পারে শতেক জীবন---
শুধু কবিতার জন্যে হত্যা করা যেতে পারে সহস্র জীবন---
শুধু কবিতার জন্যে কেড়ে নেওয়া চলে রোজ ভিখিরির উঞ্ছ-রোজগার,-
কবিতার জন্যে ফের মায়ের হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে, প্রেমিকার পদতলে
দেওয়া যেতে পারে উপহার।---

কবিতার জন্যে আজো শেয়ার বাজারে রোদ ধুলোর চেয়েও কমদামি,
কবিতার জন্যে আজো বিশ্বাসঘাতিনী নারী সোনার থেকেও লোভনীয়,
কবিতার জন্যে, দেখো , ঈশ্বরবিহীন দেউলে অভিজাত মাতামাতি চলে—
শুধু কবিতার জন্যে রক্তাক্ত ললাট মুছে , অশ্রু চেটে, প্রিয়াকেও
প্রতিপক্ষ প্রেমিকের হাতে সঁপা চলে।–

কবিতার জন্যে কেউ চেয়েছে সবৎসা ধেনু, রমণী ও ভূমি;
কবিতার জন্যে কেউ চেয়েছে অক্ষয় কীর্তি, অনন্ত জীবন;
শুধু কবিতার জন্যে স্বচ্ছা-নির্বাসনে কেউ হয়েছে শহীদ,-
কবিতার জন্যে ফের অস্তিত্বের দৃপ্ত ঘোষণায়
যৌবন-বাউল কেউ অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছে।...

কবিতার জন্যে আজো মধুময় মরুৎ , সলিল—
কবিতার জন্যে আজো মধুময় অস্তোদয়-সূর্যের অয়ন;
শুধু কবিতার জন্যে মধুময় এ ধরণী, এ –জীবন এবং মরণ, --
শুধু কবিতার জন্যে সাগরে স্তম্ভন, মেঘে অশনি –দহন। ...
কবিতার জন্যে শুধু শিশুর মুখের হাসি এত অনুপম,
কবিতার জন্যে শুধু নারীর দুচোখ জুড়ে রহস্য অপার---
কবিতা হয়েছে, তাই সৃষ্টি হলো স্বর্গ ও নরক;
কবিতা হয়েছে তাই জন্ম নিল দেবতা , দানব;--
শুধু কবিতার জন্যে ঈশ্বরের ভাবমূর্তি এত জ্যোতির্ময়ঃ
কবিতার জন্যে ফের প্লাবনের তোরে বসে যুগে যুগে ঈশ্বরের
                          স্খলনকে ক্ষমা করে এসেছে মানব। ...

কবিতা লিখেছি আমি ঘাম, রক্ত, পাপ, ব্যাধি, পতন ও মৃত্যুর ছায়ায়;
কবিতা লিখেছি আমি অর্ধাশন –উপবাস-অপমান-নির্যাতন সয়ে;--
মাতাল-দাঁতাল হয়ে , উন্মত্ত ধীমান শান্ত তীব্র উদাসীন
সম্ভ্রান্ত ক্ষুধার্ত ক্রুদ্ধ অতৃপ্ত ধার্মিক সৎ মগ্নও চতুর
ভূতগ্রস্ত ভয়ংকর আত্মনাশী একদল স্বপ্ন-বিলাসীর
 সাগ্নিক মিছিলে মিশে , নারীর স্ফুরিত ওষ্ঠ,
                     স্তনাগ্র, সরোম ঊরু,
 যোনি খুঁড়ে খুঁড়ে
কবিতার ধমনিতে এনেছি লোহিত ঊষ্ণ –শোনিতের সফেন প্রবাহ। ...


শুধু কবিতার জন্যে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় অপার –জীবন,--
শুধু কবিতার জন্যে আটকে রাখতে ইচ্ছে হয় আসন্ন –মরণঃ

মেষ –পালকের গানে বহুরাত পৃথিবী জেগেছে---


মেষ-পালকের গানে বহুদিন পৃথিবী ঘুমোবে।

( কাব্য গ্রন্থঃ শরসয্যা)

কোন মন্তব্য নেই: