“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৩

বিরহ যখন মধুর : গ্রাম বরাকের লোকায়ত জীবনের এক অধ্যায়

 (  প্রকাশ : প্রতাপ - সমাজ ও সাহিত্যের প্রতিভাস, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা)

                                                                      ।। চন্দ্রানী পুরকায়স্থ ।।
  নিঝুম রাতের শেষ সীমানায়, বরাকের বুকে ছলাৎ ছলাৎ ভালোলাগা, নাম না জানা পক্ষী কণ্ঠের  কাতর আকুতি, নির্ঘুম ঝিঁঝিঁর রাতজাগা তন্ময়তা, এরই মাঝে কোনও গ্রাম্য গায়কের ভাবময় করুন অভিব্যক্তি “তুমি আমারই মতন কান্দিও কান্দিও/ কৃষ্ণ কৃষ্ণ নাম বদনে বলিও/ যাইও যমুনার ঐ ঘাটে যাইও/ তুমি আমারই মতন জ্বলিও জ্বলিও/ বিরহ কুসুম হার গলেতে পরিও/ তুমি বুঝিবে তখন/ নারীর কি বেদন/ রাধার প্রাণে ছিল কত ব্যথা/ বনমালী গো, তুমি পরজনমে হইও  রাধা”। তখন আকাশে বিরহের বিষাদ, মিলনের ব্যাকুলতা, প্রকৃতির কানায় কানায় বিরহিণী রাধিকার অশ্রুধারার চোরাস্রোত ফল্গুধারা। এই তো প্রেম, বেদনার  সমুদ্র রোমন্থন পরবর্তী অমৃতধারা। পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসারের পর যখন একদিন ধ্রুব সত্যের মত ধেয়ে আসে বিরহের কালো মেঘ তখনও নিত্য শাশ্বত প্রেম জন্ম-মৃত্যু, বিরহ-মিলনের ওপারে রচে নেয় আপন ইতিহাস। তখনই তো পরম প্রাপ্তি, ব্যবধানহীন একাত্মতা। তাইতো স্বয়ং ঈশ্বরও বাঁধা পড়েন অনাদি অনন্ত প্রেমের বাঁধনে, বিরহ মিলনের গীতি কবিতায় ভেসে বেড়ায় তাঁর অসীম ঠিকানা। সেই বিরামহীন সুর লহরী ঢেউ তোলে বিরহের তীব্রতায়, তিতিক্ষার সাধনায় যুগে যুগে মীরাবাঈ, তুলসীদাস, রামদাস, সুরদাস, কবীর, নানক, খৈয়াম এর কণ্ঠে । পাগল গোরার প্রেমগাঁথা ছুঁয়ে যায় গ্রাম বাঙলার মরমিয়া মন। বুকে ঝড়, চোখে অবিরাম বৃষ্টিধারা বাঙলার মাটিকে করে তোলে সরস, মনের মাধুরি মিশিয়ে জন্ম দেয় লালন-চণ্ডীদাস-রাধারমণ-হাসনরাজার। ওড়িশার কবি জয়দেব, মিথিলার কবি বিদ্যাপতি হয়ে ওঠেন গ্রাম বাঙলার  চিরআপন।   

অনুখন মাধব মাধব সোঙরিতে , সুন্দরী ভেলি মধাঈ :  বৈষ্ণব সাহিত্যে বিরহ

               রাধ্ ধাতু থেকে রাধা নামের উৎপত্তি। রাধ্ ধাতুর অর্থ আরাধনা। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি রাধার যে প্রেম সেখানে মূলতঃ প্রতিফলন ঘটেছে পরমাত্মা এবং জীবাত্মার স্বর্গীয় সম্বন্ধের, দ্বৈত অদ্বৈতের অপরূপ সম্মিলন পাখনা মেলেছে বিরহ মিলনের আলো আঁধারিতে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ মধ্যযুগে রচিত বাঙলা  ভাষার প্রথম কাব্য গ্রন্থ যার হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলীরা সুরে-তালে-ছন্দে-ভাবে হয়ে ওঠেছে ভাস্বর। কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ মূলতঃ সংস্কৃত প্রধান হলেও, একে ছুঁয়ে গেছে বাঙলার সরল মাধুর্য। বিদ্যাপতির পদাবলীরা যদিও ‘মৈথিলী’ ভাষায় আত্মপ্রকাশ করেছে, সেখানেও  রয়েছে  বাংলা ভাষার কাটাকুটি। বাংলার প্রধান পদকার চন্ডীদাস লিখেছেন প্রায় ১৩’শ  পদাবলী,  গোবিন্দ দাস,  জ্ঞানদাসের মত পদকার লিখেছেন প্রায় সাড়ে তিনশোর মতো পদাবলী। নরহরি দাসের পদাবলীর সংখ্যা প্রায় দুই’শোর মতো। শ্রীচৈতন্যদেব ভারতীয় শ্রেনীভিত্তিক, বর্নভিত্তিক সমাজকে পরিহার করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব ধর্মের সমন্ব্য় ঘটান। এর ফলে বাঙলার  মুসলিম কবিরাও আকৃষ্ট হয়ে নামে-ছদ্মনামে রচনা করেন পদাবলীর সম্ভার।  

আমারে বন্ধুয়ার মনে নাই  : বরাকের স্রোতে  বিরহের  তান

             গ্রাম বরাকের জনমানসে রাধা-কৃষ্ণের বিরহ যে কবে, কোন সুদূর অতীতে, হয়ে ওঠেছিল নিজ মনের অকথিত বয়ান, সুখদুঃখের ইতিহাস, আধ্যাত্মিক সাধনার কেন্দ্রবিন্দু; সেই কাহিনী আত্মগোপন করেছে  ধুসরালোকে, মহাকালের খাতার কোনো অপঠিত পাতায়। তবু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চোখের জলে লিখে রাখা হৃদয় নিংড়ানো বৈষ্ণব পদাবলীগুলোকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে জন্ম বিরহ-মিলনের আকুতি মেশানো কীর্তন, পালাগান এবং লোকসংগীতের, যা আজও লোকসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ হিসেবে ছড়িয়ে রয়েছে লোকমুখে, বরাকের লোকায়ত জীবনে। পালা শব্দের মানে একটি নির্দিষ্ট বিষয় ভিত্তিক কাহিনী। এটি বরাকের জনজীবনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে ওতঃপ্রোতভাবে। শেষ রাতে যখন নিঝুম প্রকৃতি নিদ্রাচ্ছন্ন দেহ মন, সেই সময় খেটে খাওয়া মানুষের দরদী কণ্ঠে বিরহের সুর জাল বুনে অপূর্ব মায়ার। গানে-কথায়-সুরে-সুরে  উপস্থাপিত হয় কৃষ্ণকথা।  মিলন এবং বিরহের আলো আঁধারিতে রচিত এই পালাগানগুলোতে রাধার বিরহ বিলাপের মুহূর্তগুলো মূর্ত হয়ে ফুটে ওঠে। সুরের যাদুতে মোহিত হয়ে শ্রীরাধার বিলাপে চোখের জল ঝরায় শ্রোতারা।  জীবাত্মা যেন এবার সত্যি সত্যি খুঁজে পায় আপন পরিচয়, পরমাত্মার জন্যে হয়ে ওঠে ব্যাকুল। “সই কেবা শুনাইল শ্যামনাম/ কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো আকুল করিল মন প্রাণ/ না জানি কতেক মধু শ্যামনামে আছে গো/ বদন ছাড়িতে নাহি পারে/ জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো কেমনে পাইব সই তারে”। সিলেট-বরাকের বৌনাচ, ধামাইল আদি নারী ভিত্তিক লোকগান, লোকনৃত্যেও ব্যক্ত বিরহ মিলনের সেই আবহমান স্রোত। "ধামা" শব্দ থেকে "ধামাইল" শব্দটির উৎপত্তি; এর অর্থ আবেশ বা ভাব। যা পূর্ণ রূপে ব্যক্ত হয়েছে কবি রাধারমণের অমুল্য লেখনীতে। ধামাইলের তালে তালে ভাটিয়ালী বৈঠার মাধুর্যেও মিলেমিশে একাকার রাধারমণের শ্যাম পিরীতি। গ্রাম বরাকের মেঘময় বর্ষায় যখন  চারিদিকে  অথৈ জলের সংসার তখন রাধারমণের দরদী গান সাজিয়ে তোলে ভাবময় ব্যাকুল পরিবেশ, বিরহ  মিলনের মনস্তাত্বিক মিশ্রানুভুতি- “ও ভ্রমর রে, ভ্রমর কইও গিয়া/ শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদে রাধার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া” অথবা “বন্ধুয়ারে- দুঃখিনীরে মনেতে রাখিও/ সাধেরো পিরিতে বন্ধু বিচ্ছেদ না ঘটাইও/ রাই কিশোরীর মরণ কালে সাক্ষাতে দাড়াইও/ দুঃখিনীরে মনেতে রাখিও”।

সোনা বন্ধে আমারে পাগল করিল : সূফী প্রাণের ব্যাকুলতা

        বাঙলার তৃতীয় ভুবন বরাকের মরমী প্রাণও সূফী গানে খুঁজে পায় অদ্বৈতবাদের মরমী ছোঁয়া।  আশেক এবং  মাশুক অর্থাৎ প্রেমিক-প্রেমিকারূপী আত্মা-পরমাত্মার  মিলন কামনাই সুফি সাধনার মর্মকথা। ইসলামের বাহ্যিক জীবন  ব্যবস্থার নাম শরীয়ত এবং আত্মার উৎকর্ষ  সাধনের নাম ত্বরিকত্। সূফী সাধনার তৃতীয় ধাপ মারফত। মারফতে পরিজ্ঞাত ব্যক্তিকে বলা হয় সুফী। অদৃশ্য বস্তুর সাধনা করতে করতে সুফীর হৃদয়ে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যা  তত্বজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে জগতের পরম সত্বাকে প্রত্যক্ষভাবেই  তোলে ধরে মনের আয়নায়।  সুফী সাধনায় চতুর্থ ধাপ হাকীকত। সুফি এই স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারলে পরম সত্যের সন্ধান ও স্বরূপ লাভ করতে পারেন এবং পরম প্রেমাম্পদের এই ভালোবাসায় নিজের অস্তিত্ববোধটুকুও হারিয়ে যায়। সুফী সাধনার পঞ্চম ধাপ ওয়াহ্দানিয়াত অর্থাৎ অদ্বৈতবোধ। বাংলায় সূফীতত্ত্ব ও সূফী সাধনা একটি স্থানিক রূপ লাভ করেছিল।  অদ্বৈত তত্ত্ব  ও যোগের প্রত্যক্ষ প্রভাবই এর মূখ্য কারণ। এই সাধনার  বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে জাতধর্ম আর ভেদবুদ্ধির উপরে ওঠা। সকল ধর্মের নির্যাস, সকল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যই আধ্যাত্ম-উপলব্ধির ভেতর দিয়ে সাধক আপন করে নেন। বাঙলা তথা বরাকের মাটিতে জন্ম হয়েছে অনেক প্রখ্যাত, অজ্ঞাত মরমী সাধকের, যারা হৃদয় বীণার তারে তারে, সুরে ছন্দে রচনা  করেছেন ঈশ্বরপ্রেমে ভরপুর অসংখ লোকসংগীত। মরমী কবি শাহনুর প্রেম বিরহে বন্ধু পাওয়ার আশায় লিখেন ‘বন্ধু তর লাইগা-রে আমার তনু জর জর/ মনে লয় ছাড়িয়া যাইতাম, থইয়া বাড়ি ঘর’। এই ধরনের অসংখ্য লোকগান আজ ও স্পন্দিত জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে গ্রাম বাঙলার দুয়ারে দুয়ারে।

যার জন্যে হয়েছি পাগল, তারে কোথায় পাব? : আবহমান কালের প্রশ্ন

               বৈষ্ণব ভাবধারাময় অমিয় নিমাইর প্রেম ফল্গুধারা এবং সূফী প্রেম এক হয়ে প্রেম-বিরহের অপূর্ব সমন্বয়ে জন্ম বাউলিয়া সাধনার। এখানে ঈশ্বর আল্লার একই সত্বা, একই পরিচয়। তাই তো বাউল কবি বদিউজ্জামাল গেয়ে ওঠেন “সবে বলে কালারে কালা আমি বলি শ্যাম/ কালার ভিতরে লুকাইয়ে রইছে মওলার নিজ নাম”।প্রেমানলে সুফি দরবেশ যেমন পাগল, বাউলও হয়ে ওঠেন বাতুল বা উন্মাদ। বাউলের এই উন্মাদ অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় বাউলিয়া  গানে  ‘আমার সাঁই দরদী আর কতদিন রব?/ দেশ বিদেশে ঘুরিয়া বেড়াই, আর বা কোথা পাব?/ যার জন্যে হয়েছি পাগল, তারে কোথায় পাব?/ মনের আগুন দ্বিগুন জ্বলে তারে কি দিয়ে নিভাব?’।  লালন সাঁই  বাউল সমাজের  ধ্রুবতারা, তিনি বাঙলার সেই প্রবাদ প্রতিম পুরুষ যার কণ্ঠ জাত ধর্মের প্রাচীর ভেদ করে গেয়ে উঠেছিল মানবতার গান ‘আসবার কালে কি জাত ছিলে/ এসে তুমি কি জাত নিলে/ কি জাত হবে যাবার কালে/ সে কথা ভেবে বলনা।‘। হাসনরাজাও আধ্যাত্মিকতা এবং দেহতত্বের নিরিখে ব্যক্ত করেছেন মনের উথালি পাথালি ‘রঙ্গিয়া রঙ্গে আমি মজিয়াছি রে। মজিয়াছি রে, আমি ডুবিয়াছি রে’। বাউল গানের এই গভীরতা আজও উঁকি দিয়ে যায় বরাকের লোক জীবনে।

তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিব, ছেড়ে দেবো না  : বিরহী পরানের চির কামনা 

             ঈশান বাঙলার ঘরে ঘরে, বিরহ-মিলনের চিরন্তন সুর বেজে ওঠে প্রতিবার, মন খারাপের মেঘলা ভোরে অথবা হাসি খুশীর দৃপ্ত রৌদ্রছায়ার। সাধু-সন্ত, আউল-বাউল, সুফি-দরবেশ, মরমিয়া কবিরা চরম প্রেমের করুণ-রঙিন অথচ প্রাণান্ত-কঠিন পথে সঁপেছেন নিজেদের দেহ মন প্রাণ, মানব মনের গভীরে আত্মার পরমাত্মাকে কাছে পাওয়ার আর্তি  যখন জাতি-ধর্ম-বর্ণের প্রাচীর ছাপিয়ে কুলুকুলু শব্দে বয়ে চলে অসীম অনাদির উদ্দেশ্যে তখন বিরহও হয়ে ওঠে মধুর, ঠিক তখনই মরমিয়া মন খরা শেষের বৃষ্টিধারার মতো গেয়ে ওঠে “সে যে আমার হোক বা না হোক সই/ আমি যে সই তার হয়েছি/ দিয়ে জাতি কুল মান এই দেহ প্রাণ গো সই/ আমি তার চরণে সব সঁপেছি ” -এখানেই প্রেমের সার্থকতা।



কোন মন্তব্য নেই: