।।অরূপ বৈশ্য ।।
দৈনিক যুগশঙ্খের ২৩ আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত |
সম্পূর্ণ বৃত্ত
সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কথা আজকাল আর কেউ অস্বীকার করেন না। কিন্তু আমরা বিষয়টিকে যত সরলভাবে দেখি, বিষয়টি তার চেয়ে ঢের গভীর ও জটিল। রাজনীতির অবক্ষয়ের মডেল বোঝাতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ শামির আমিন লিখেছেন – যারা রাজনীতি বোঝে তারা রাজনীতিতে যোগ দেয় না, যারা বোঝে না তারা দাপিয়ে বেড়ায়। এই জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা একটু হালকা চালেই করা যাক। এই নিবন্ধকারের দু’চারটে হালকাচালে লেখা যুগশঙ্খের পাতায় ছেপে বেড়িয়েছে। কাছাড়ের জয়পুরের নিবাসী অশীতিপর বৃদ্ধ দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েও সামাজিক কাজে লিপ্ত আমার এক মামা এই লেখাগুলো পড়ে আমাকে বলেছেন – “তুই বড় কঠিন বাংলা লেখচ”। তাঁর কথার অন্তর্নিহিত অর্থের উত্তরে একথাই বলা যায় যে বাস্তব পরিস্থিতিতে আজ এত জটিলতা যে তার সহজ সরল ব্যাখাতেও খানিকটা জটিলতা থেকে যায়। আমার এই মামার কথা এখানে উল্লেখ করলাম এক ভিন্ন উদ্দেশ্যে। তিনি কংগ্রেস নেতা প্রয়াত মহীতোষ পুরকায়স্থের সম্পর্কে ভাই এবং নিজেও কংগ্রেস করতেন। শাসক শ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলোতে এধরনের সৎ, নিষ্ঠাবান ও গরিব-দরদি নেতা-কর্মী আজ বিরল প্রজাতি হিসেবেই গণ্য হয়। তাই প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে শাসকীয় রাজনীতিতে ও রাষ্ট্র পরিচালনায় কী এমন ঘটল যে মূল্যবোধের সংজ্ঞাই পালটে গেল? রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে শাসকীয় রাজনীতির সৎ, নিষ্ঠাবান ও গরিব-দরদি নেতা-কর্মীদের প্রায় সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্তি ঘটেছে। অনেকের মতে এ এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি – বৃত্ত আসলে সম্পূর্ণ হয়েছে – কেন্দ্রাতিগ শক্তির ঠেলায় বৃত ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়াও অবশ্যম্ভাবী।
আধুনিক ও সেকেলে চিন্তা
নেহরু ও গান্ধির উন্নয়ন চিন্তার দ্বৈরথ আজ অপ্রাসঙ্গিক। তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার স্তালিনীয় শিল্পোন্নয়নের আদলে নেহেরুর চিন্তা ও গান্ধির গ্রাম-স্বরাজের উন্নয়ন-চিন্তা বাস্তব প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কার্যকারিতা হারিয়েছে। নেহেরুর চিন্তায় বিড়লাদের মত তৎকালীন ভারতীয় বৃহৎ পুঁজিপতিদের আকাঙ্খারও প্রতিফলন ঘঠেছিল। আধুনিক পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় সামগ্রি যেমন তেল, বিদ্যুত, স্টিল, কয়লা ইত্যাদির উৎপাদন এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্য-যোগাযোগ ইত্যাদি সামাজিক ও পরিষেবামূলক ক্ষেত্র সরকারি মালিকানায় রাখার প্রস্তাব বিড়লাদের বোম্বে-ক্লাবের ছিল, কারণ সেই সময়ের পুঁজিপতিরা এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ছিল না। সুতরাং নেহেরুর উন্নয়ন চিন্তায় পুঁজির সাথে কোন দ্বন্দ্ব ছিল না, বরঞ্চ এই চিন্তায় পুঁজিপতিদের প্রভাব ছিল। নেহেরুর মডেলে উন্নয়ন ছিল বিদেশি আধুনিক প্রযুক্তির আমদানি নির্ভর, অন্যদিকে আধুনিকতার মানদণ্ডে গান্ধির চিন্তা ছিল সেকেলে এবং জাত-বর্ণভিত্তিক শ্রম-বিভাজনের ধর্মীয় রীতিভিত্তিক তথাকথিত স্বনির্ভর গ্রামের ধারণা-প্রসূত। এই উভয় ধারণাতেই কৃষির উদ্বৃত্ত আয় থেকে শিল্প-বিকাশের কোন পথের সন্ধান ছিল না। নানাধরনের পণ্য সামগ্রির বহির্বাণিজ্যিক চাপে গ্রামে একধরনের আধুনিকতার ছোঁয়া লাগল বটে, কিন্তু গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও স্বনির্ভর অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদা ও উৎপাদন-কাঠামো তৈরিতে এই ধারণা ব্যর্থ হল। এই ব্যর্থতা নেহেরু ও গান্ধি উভয়ের ধারণাকেই অসার প্রমাণিত করে ছাড়ল। এবং এর সাথেই অসার হয়ে গেল এই উভয় ধারণাতেই আদর্শগতভাবে নিহিত থাকা সামাজিক কল্যাণের ধারণাও। সুতরাং প্রয়োজন দেখা দিল এক নতুন নীতি ও আদর্শকে আঁকড়ে ধরা।
ধনপতির হাঁড়ি ও গরিবের লোহার চালের বাটি
নেহেরুর উন্নয়ন ও জনকল্যাণের ধারণা উবে গেলেও একটা বৈশিষ্ট আরও তীব্র আকারে মানুষের মননকে গ্রাস করে নিল। সেই বৈশিষ্ট্য হল আমেরিকা-ইউরোপের অনুসরণ, অনুকরণ ও তাদের কাছে ভিক্ষাবৃত্তি। বিশ্বব্যাপী নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির সাথে সেই আদর্শ একেবারে খাপে খাপে মিলে গেল। রাজনীতিবিদ-প্রযুক্তিবিদ-আমলা সবাই পাশ্চাত্যের চোখধাঁধানো নগরসভ্যতার মানদণ্ড অনুসরণ করতে গিয়ে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় না রেখে তাদের নীতি ও প্রযুক্তি প্রয়োগে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাদের এই প্রয়োগশালায় যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তার যোগান সুনিশ্চিত করতে সেই দেশগুলির নিয়ন্ত্রিত ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, আই-এম-এফের মত সংস্থা বা সেই দেশের বৃহদাকারের পুঁজি-মালিকদের কাছে ধার নিতে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে হাজির হতে হল। অর্থের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে ক্ষমতা – সুতরাং ধারের অর্থ যত বাড়তে থাকে নিজ দেশের ক্ষমতার লাগামও তার সাথে পাল্লা দিয়ে যেতে থাকে দেশের চৌহদ্দির বাইরে – সমুদ্রের ওপারে বহুদূরে। স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে যে ধনপতিরা রাষ্ট্রের সহায়তায় উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজত, আম্বানীদের মত সেই ধনপতিরা ফুলেফেঁপে অনেক বড় হয়েছে, তাদের মুনাফার হাঁড়ি পূর্ণ হয়েছে, এখন নতুন হাঁড়ি চাই। তারা সরাসরি এখন বিদেশি কোম্পানীদের হাত ধরে যাত্রা করতে পারে মালয়-সিংহল-নেপাল-আফ্রিকা ইত্যাদি অভিমুখে। অর্থ ও ক্ষমতা যাদের, আদর্শের মালিকানাও তাদের কাছে। তারাই শিক্ষা-মিডিয়া সহ মতামত তৈরির সমস্ত মূল প্রতিষ্ঠানের মালিক। তারা যাকে প্রকৃত মূল্যবোধ বলে বিবেচনা করবে তার পক্ষে শিক্ষিতশ্রেণির বৌদ্ধিক সায় আদায় করে নেওয়ার জন্য মগজ-ধোলাইয়ের কোন কসরতই বাকি থাকবে না। এভাবে শাসনের পক্ষে শাসিতের মত আদায় করে নিতে পারার পরিস্থিতিই গ্রামশিয়ান হ্যাগিমনি সূত্রে আধিপত্যের প্রথম ধাপ। উন্নয়নের মানদণ্ডটাই যখন বদলে গেছে তখন শপিং-মল গড়ে উঠতে লক্ষ টাকার কেলেঙ্কারি বা বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগে বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলতে কয়লা খনির বরাত নেওয়ার পেছনে কোটি কোটি টাকার তছরূপ নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলে তারা নিশ্চিতভাবে উন্নয়ন বিরোধী হিসেবে বিবেচিত হয়। বেড়াল সাদা হোক বা লাল – ইঁদুর ধরলেই হল (মাও পরবর্তী চিনের সরকারি মন্ত্র)। প্রকৃতি ভারসাম্য হারাক – আরো অনেক উত্তরাখণ্ড হোক – গরিব পেটে মরুক বা পিঠে মরুক – না জুটুক ‘লোহার চালের বাটি’ (চিনা উপমা), তাতে কী এসে যায়, উন্নয়ন হলেই হল। কারণ অর্থ ও ক্ষমতার মালিকরা এই ফরমানই জারি করেছে – তা আমাদের মানতে হবে। নাহলে তারা আমাদের দেশে বিনিয়োগ করবে না।
ডানে-বামে পাশাপাশি
শাসক শ্রেণির দল হিসেবে যারা পরিচিত, তাদের থেকে খানিকটা দূরে ( বিপরীত মেরুতে নয়) যে সব বামপন্থী দলরা তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে, তাদের এই বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ নিয়ে নীতিগত কোন আপত্তি নেই। তাদের একটাই আপত্তি – এই পুঁজি যাতে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ না হয়, সরাসরি শিল্পদ্যোগে আসে। সরাসরি বিনিয়োগে হয়ত সামান্য কিছু কর্মসংস্থান হয়, কিছু এলাকায় বিদ্যুৎবাতি জ্বলে, কারখানাকে কেন্দ্র করে কিছু রাস্তাঘাট হয়, এই রাস্তায় উপরতলার কর্মীদের নানাবিধ গাড়ি চলে। কিন্তু যা হয় না তা হলো – দারিদ্রদূরীকরণ, মজুরদের ন্যূনতম মজুরির সংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা, লাখ লাখ পেন্সনারদের বেঁচে থাকার গ্যারান্টি, গণ-ক্ষমতায়ন ইত্যাদি। এই অসংখ্য না-হওয়ার তালিকার শেষে যে বিষয়টি গম্ভীর সামজিক ব্যাধির জন্ম দেওয়ার জন্য একমাত্র হওয়ার তালিকায় যুক্ত হয় তা হল – অসাম্য বৃদ্ধি। কারণ এই বিনিয়োগ থেকে অতি-মুনাফা করাটাই যখন লক্ষ্য, তখন বিনিয়োগ আসে ‘সেজ’-এলাকাতেই যেখানে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানীদের জন্য এদেশীয় সমস্ত আইন অচল এবং তাদেরকে আনতে হয় জামাই আদর করে সরকারি অর্থ ব্যয়ে নানাবিধ ছাড় দিয়ে।
টানাপোড়েনের জটিল অঙ্ক
হওয়া, না-হওয়ার এই তালিকা বানাতে বানাতে পুঁজি-মালিকরা যাতে অপ্রতিরোধ্য গতিতে অগ্রসর হতে পারে – তারজন্যই শ্রমের সংগঠিত ইউনিয়নকে ভেঙে দেওয়া তাদের প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে দেখা দেয়। বেসকারিকরণ ও ক্যাজুয়েলাইজেশনের ধাক্কায় আমাদের পাবলিক সেক্টরগুলোর সংগঠিত ইউনিয়নগুলি মুখ থুবরে পড়েছে – এই ইউনিয়নগুলি এখন শুধুমাত্র ট্রান্সফার-পোস্টিং-এর জন্য ম্যানেজমেন্টের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যম। শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি এই বাস্তবতাকে মেনে নিলেও মেনে নিতে নারাজ নতুন শ্রমিকশ্রেণি যারা ন্যূনতম মজুরি পায় না, যাদের ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়া হয় না। মেনে নিতে নারাজ গরিব আম-জনতা যাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান-রুটি-রুজি-পুষ্টির সংস্থান হয় না। তাই বিদ্রোহ মারুতি-সুজুকি বা বাজাজ কোম্পানীর কারখানা চত্বরে – বিদ্রোহ চা-বাগানে, তাই যে কোন সুযোগে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ মেহনতি আমজনতার। এই টানাপোড়েনে সবহারাদের বিফলতা অনেক, আবার সফলতার পাল্লা ভারি হওয়ার সংকেতও অনেক। মারুতি-সুজুকিতে ইউনিয়নের অধিকার আদায়, কাজ-খাদ্যের বিষয়কে মৌলিক আইনি অধিকার করে নেওয়া, জমি অধিগ্রহণে গ্রামসভার মতামতে গুরুত্ত্ব আরোপ ইত্যাদি সফলতার সূচক। দুর্ভিক্ষপীড়িত হিসেবে খ্যাত ওড়িষ্যার কালাহাণ্ডি জেলার লাঞ্জিগড়ে ও ঝারসুগুদা জেলায় মাইনিং প্রজেক্ট খুলেছে বেদান্ত গ্রুপের বেদান্ত এল্যুমিনিয়াম কোম্পানী। সেখানকার আদিবাসীরা তাদের বসতজমি বলপূর্বক কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে জোর লড়াই করে আদায় করে নিয়েছে জমি-অধিগ্রহণে গ্রামসভার অনুমতির আইনি অধিকার। পুঁজি ও ক্ষমতা উদার-অর্থনীতির উন্নয়নের পক্ষে এদের সমর্থন আদায় করে নেবে, না সংগঠিত শ্রমশক্তি নতুন মতাদর্শের ধারক হয়ে উঠবে তা দেখার জন্য আমাদেরকে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। সংগঠিত এই শক্তি যতদিন না সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানোর মত শক্তি সঞ্চয় করে নেবে, ততদিন মাল্টিপ্লেক্স-শপিং মল-হাই স্যালারি ইত্যাদিকেই যারা উন্নয়ন বলে বিবেচনা করে এবং এসব ঠিকঠাক চললে অন্যক্ষেত্রে যারা দুর্নীতিকেই নীতি হিসেবে গণ্য করে তাদের আনুগত্য পাবে উদার-অর্থনীতির প্রবক্তারা, ততদিন অর্থনৈতিক স্বশাসনের ধারণা অর্থহীন হয়েই থাকবে। পরিস্থিতি এরকমই এক জটিল অঙ্কে কষা। তাই আমার মামাকে বলতেই হয় – “বাংলাটা তুই বড় কঠিন লেখচ”।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন