“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২৯ জুন, ২০২২

ধর্মানুভূতি: আহত ও আঘাত এই কথা দুটিতে জড়িয়ে থাকে

।। জাহিদ রুদ্র ।।


"আমি হিন্দু" "আমি মুসলমান একথা শুনতে শুনতে কান ঝালা-পালা হয়ে গেলো।কিন্তু “আমি মানুষ” একথা কাহাকেও বলতে শুনি না। যারা মানুষ নয়, তারা হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক, তাদের দিয়ে জগতের কোনো লাভ নেই।"
                                  -----রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ধর্মান্ধতাই ধর্মের মৌলবাদ। এই মৌলবাদই দেশে দেশে শিল্প ও সংস্কৃতির জন্য হুমকি হয়ে পড়েছে। ধর্মান্ধতা মানুষের একটি কমন ত্রুটি। এর প্রধান ভিত্তি হচ্ছে কোন নির্দিষ্ট বিধিবিধান বা প্রথার প্রতি যাচাই বাছাই না করে অন্ধ আনুগত্য করা। তাইতো অভিজিৎ রায়ের কথায় ‘ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মতো জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি।’

প্রচলিত ধর্মগুলি মানুষকে হিংসা বিদ্বেষ শিক্ষা দেয়, সুস্থ মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, কর্মবিমুখ অলস পরনির্ভরশীল করে গড়ে তোলে, মানুষের মধ্যে তৈরি করে বিভেদ বিভাজন। এখনো এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে, জ্ঞান বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের সময়েও তা থেমে যায়নি। বিশ্বের সভ্য মানুষেরা যখন ধর্মের আদলে কর্মে মনোযোগ দিয়ে যাচ্ছে এগিয়ে, তখন কতিপয় ধুরন্ধর মতলববাজ পরজীবী শ্রেণী সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে বাড়িয়ে চালাচ্ছে তাদের পুঁজিবাদী ব্যবসা! ছড়াচ্ছে উন্মাদনা! মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারে! থামিয়ে দিচ্ছে উন্নতির অগ্রযাত্রাকে! মানুষ ঠকছে, হচ্ছে প্রতারিত! তাইতো কখনো 'রামের' নামে আবার কখনো 'গোস্তাকে রসুলের' নামে মারছে-মরছে।

সাহাদাত হোসেন মান্টো ধর্মান্ধতা নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন। তার ‘ঠাণ্ডা গোস্ত’ গল্পে দেখি,দেশভাগের সময়কার দাঙ্গায় মুসলমানের রক্তে হাত রাঙানো শিখ যুবক ঈশ্বর সিংহ ঘরে ফিরে কিছুতেই প্রেমিকার সঙ্গে সঙ্গম করতে পারছে না। প্রেমিকার সন্দেহ হয়, তার পুরুষ নিশ্চয় অন্য নারীসঙ্গে মজেছে। ঈর্ষার জ্বালায় ঈশ্বরের কৃপাণ কোষমুক্ত করে সে ক্ষতবিক্ষত করে তাকে। মুমূর্ষু ঈশ্বর স্বীকার করে, সে এক অচেতন মুসলিম বালিকাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারে আসলে সে বালিকাটির শবের সঙ্গে... আখ্যানের তীব্র সংবেদনশীলতা বোঝেনি পাকিস্তান। ‘আমরা মুসলমানরা এতই আত্মমর্যাদারহিত যে আমাদের মৃত কন্যাদেরও শিখরা ধর্ষণ করে যায়?’—এমন প্রশ্ন তুলে লাহোর আদালতে মামলাও ঠুকে দেয় পাক আমলাতন্ত্র। যাইহোক এই কথাগুলো বলার কারণ হলো আমরা আর কত এভাবে একে অপরের রক্তস্নানে নিজেকে পবিত্র করবো ?

অনেক বড় ধরনের দূর্ঘটনা দেখেও আমরা খুব শক্ত থাকতে পারি। সেটা যতই মানবাধিকার লঙ্ঘণ হোক, সেটা যতই দেশের উন্নয়নে বাধা হোক, জনগণের স্বাধীনতা হরণ হোক আমরা মাথা ঠান্ডা রাখতে পারি। শ্রেণী সংগ্রামের পথে না গিয়ে আমরা চলছি ভোটের রাজনীতিতে, তাতে কোন ভাবেই আমাদের অনুভূতিতে আঘাত আনতে পারে না। কিন্তু যখন দেখি ধর্ম নিয়ে একে অপরের মন্তব্য বা কেটে মেরে রক্ত ঝরায়, তখন আমাদের আবেগ তীব্র উল্কাপিন্ড হয়ে যায়। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়,শক্ত হয়ে যায়। মনে হয় নিজের শরীরে যন্ত্রনা হচ্ছে।পৃথিবীতে মনে হয় ধর্মের চেয়ে কেউ আত্মার এত কাছে থাকে না।

ধর্ম যে কতটা ঠুনকো কতটা ভঙ্গুর তার বারবার প্রমাণিত।মানুষ হতে ধর্মের কোনো প্রয়োজন নেই। একুশ শতকের আগের একটা মহান শিক্ষা আজ‌ও আমরা আমাদের বাচ্চাদের দিতে পারিনি - 'ধর্মের বেশে মােহ যারে এসে ধরে অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে'।

খারাপ মানুষকে ধর্ম ভালো করতে পারছে না। মানুষের ধর্ম নিজের ও মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা, ভালোকথা ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে খুশি করা। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারে, মনুষ্যত্ব মানবতাবোধ অর্জনের মধ্য দিয়ে, নিশ্চয়ই একদিন বিভাজন দূরীভূত হবে।

ছবিঋণ : জিষ্ণু রায়চৌধুরীর ফেসবুক ওয়াল থেকে।

1 টি মন্তব্য:

নামহীন বলেছেন...

যেদিন আপনাদের ধর্ম আর অন্য কোন ধর্ম সম্পর্কে আজেবাজে উস্কানীমূলক কথাবার্তা বলবে না, সেদিন থেকে পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসবে। নিজেদের বই থেকে অন্য ধর্ম সম্পর্কে বেয়াদপী কথাবার্তাগুলো মুছে দিন, অন্য ধর্ম ও তাঁর ধর্মাবলম্বীকে সম্মান দিতে শিখুন। অন্যের সাথে সেই আচরণ করুন, যা আপনি নিজের প্রতি প্রত্যাশা করেন।