আবহমানকাল থেকে নৌকা দৌড় প্রতিযোগিতা বাংলার লোকসংস্কৃতির নদী কেন্দ্রীক পরিচায়ক। বরাক উপত্যকার ঐতিহ্য বহন করে। বিশেষ করে আমাদের করিমগঞ্জ জেলায় এই নৌকা দৌড় প্রতিযোগিতা এই অঞ্চলের মানুষের আনন্দের সঞ্চার জোগায়। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেলেও জনপ্রিয়তা ও সমাদর লোক হৃদয়ে আজও আছে এক বিশেষ স্থান দখল করে।
এক সময় এ দেশে যোগাযোগ ছিল নদী কেন্দ্রিক আর বাহন ছিল নৌকা। নৌ শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন শিল্পকেন্দ্র। এসব শিল্পে যুগ যুগ ধরে তৈরি হয় দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগর।কালের বিবর্তনে পাশ্চাত্যের ভাবধারায় আধুনিক সুযোগসুবিধার সম্মিলনে কতক শহর গড়ে উঠলেও গ্রামবাংলায় নৌকা দৌড়ের কদর এখনও ব্যাপক। নৌকা বাইচে আমজনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই তার প্রমাণ।
এই নৌকা দৌড় প্রতিযোগিতা বিশেষ করে বর্ষাকালে হয়ে থাকে। নদীতে বা বিলে যখন জল ভর্তি হয় কানায় কানায়, প্রায় কিছু জায়গায় বন্যার আকার ধারন করে। ঠিক সেই সময় আনন্দ উপভোগ জোগাতে এই প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। তবে একসাথে সব জায়গায় এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়না। এক এক জায়গায় এক এক সময়ে হয়ে থাকে।করিমগঞ্জে বিশেষ করে শণবিল,বদরপুর ঘাট, শনিবাড়ি,সুতারকান্দী (কৈয়া বিল) এইসব অঞ্চলে হয়ে থাকে।
নৌকাবাইচের সময় মাঝি-মাল্লারা সমবেত কণ্ঠে গান গায়। এতে তাদের যেভাবে উৎসাহ বাড়ে ঠিক দর্শকদেরও বাড়ে আগ্রহ। তৈরি হয় এক মনোরঞ্জক পরিবেশ। প্রতিযোগিতায় আরও রয়েছে বিজয়ীদের পুরস্কারের ব্যবস্থা। পুরষ্কার হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে মোটা অংকের টাকা,টিভি, নৌকা ইত্যাদি। আমাদের এলাকায় এই দৌড় প্রতিযোগিতা হয় কৈয়া বিলে বা শনিবাড়ি লঙ্গাই এ। দৌড়ের নৌকাগুলোর নাম ও আছে যেমন সোনার তরী, অগ্রদূত, পঙ্খিরাজ, ময়ুরপঙ্খী ইত্যাদি।
এই জনপ্রিয় নৌকা দৌড়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু হলো জনপ্রিয় সারিগান। তাল, করতাল বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সারিবদ্ধভাবে চলে গান। শাহ আবদুল করিমের --
চন্দ্র-সূর্য বান্ধা আছে নাওয়েরই আগায়
দূরবীনে দেখিয়া পথ মাঝি-মাল্লায় বায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
রঙ-বেরঙের যতো নৌকা ভবের তলায় আয়
রঙ-বেরঙের সারি গাইয়া ভাটি বাইয়া যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
একটার পর একটা চলে
আল্লায় বলিয়া নাও খোল রে
ভাই সক্কলি।
আল্লাহ বলিয়া খোল।।
ওরে আল্লা বল নাও খোল
শয়তান যাবে দূরে।।
ওরে যে কলমা পইড়া দেছে
মোহাম্মদ রাসূলরে
ভাই সক্কল।...
বা এটাও
যাত্রাকালে বাধা দিওনা বিদায় দেওগো সকালে
আমার নীলগো রতন কাল রতন সাজাইয়া দে…
রাধিকা সুন্দরী জল ভরিতে যায় সোনার নুপুর বাজে রাঙা পায়।
দেখরে কার রমনী জলে যায়।
(এই গানগুলো এক প্রতিযোগির কাছ থেকে সংগ্রহ করা, নাম - গফুর চাচা)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন