।। সুশান্ত কর ।।
[লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে শিলচরের দৈনিক বার্তালিপিতে ১০ জুনের সংখ্যাতে। ৪ এর পাতাতে।]
আমরা দেখছি, অনেকে আবেগে বলছেন—‘আমাদের প্রজন্ম প্রেম করা শিখেছে--কেকে-র গান শুনে।' তা আমাদের প্রজন্মও প্রেম করা শিখেছে কিশোর লতার মতো বলিউড শিল্পীর গান শুনে। এতে নিজের গৌরব কোথায়? এহেন কেবলই বলিউড ছবির গান শোনে প্রেম শেখা লোকজন থাকলে কেউ কোনও দিন বাংলা গান শুনে প্রেম করা শিখবে না। আমাদের সময় যদিও লোকে প্রেম করা শিখেছে হেমন্ত সন্ধ্যার গলাতে ‘এই পথ যদি শেষ না হয়’—এমন অসংখ্য গান শুনে। এখন দেখে শুনে মনে হচ্ছে যেন--বাংলা গানে প্রেম শিখবার স্বপ্ন দেখানো ভুলিয়ে দেবেন কেকে--অনুরাগীরা। আমাদের কেকে-কে নিয়ে বলবার কিছুই নেই। তাঁর অবাঞ্ছিত করুণ অকাল মৃত্যুর প্রতি শোক এবং বিশাল প্রতিভার প্রতি সম্মান জানিয়েই লিখছি—আমাদের প্রতিটি শব্দ অনুরাগীদের জন্যে নিবেদিত।
‘প্রেম’ কাকে বলে? এই যে বুলডোজার নামছে গোটা দেশে--এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে প্রেম বলে না? হিংসার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে প্রেম বলে না? লোকে যে কাজ পায় না, রোজগার পায় না, বাসা পায় না --- এই নিয়ে প্রশ্ন করাকে প্রেম বলে না? কেকে বা কিশোর অনুরাগীরা তো প্রেমের সংজ্ঞাকেও খাটো করে এনেছেন। আমরা তো প্রেম করা শিখেছি চল্লিশ পঞ্চাশের সলিল চৌধুরী শুনে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস শুনে। অজিত পাণ্ডে, শুভেন্দু মাইতি শোনে। ভূপেন হাজরিকা শুনে। পরে সুমন নচিকেতা লোপামুদ্রা শুনে। শুনুন, সুমনের ‘পেট কাটি চাঁদিয়াল'। আর অনুভব করুন প্রেম কাকে বলে। শুনুন লোপামুদ্রার ‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে’। শুনুন ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানের গলাতে ‘ আমি সুন্দর হব’, শুনুন কৃষ্ণকলি ইসলামের গলাতে ‘ হাত ধরেছি হাঁটছি পথে’। তাদের তুলনাতে রূপঙ্করও খাটো। আমার মনে পড়ে না রূপঙ্করের এমন কোনও গান। কেকে বা বলিউডের অধিকাংশ শিল্পী--তাতে শ্রেয়া, শান, অভিজিত, শানু, বাবুল সুপ্রিয়র মতো বাঙালি শিল্পীদেরও নিতে পারেন--কতটা এই সব বড় প্রেমের গান গাইতে পারে? আমাদের কাছে তো সেরা প্রেমের গান বেজেছে --এই দুই বছর আগে-- ফয়েজ আহমদের ফয়েজের ... ‘হম দেখেঙ্গে'। যার কবিতা সম্প্রতি সিবিএসই- পাঠ্য থেকে বাদ পড়েছে। যারা দুই দশক ধরে এত ‘প্রেম'-এর পাঠ নিলেন--তাঁরা কজনে এর জন্যে সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুললেন? তখন তো জানা হবে, তাঁদের বাণী--সেই সব ‘প্রেম' নয়--রাজনীতি। ১৫ আগস্ট, ২৬শে জানুয়ারিতে নেতাজি জন্মজয়ন্তীতে খেয়াল করেন নি কি বাঙালি এখন ভুলে গেছে এই সত্য যে বাংলাতে অবিস্মরণীয় সব দেশপ্রেমের গান রয়েছে—ভারতে বাংলাদেশে? তাঁরা বলিউডের হিন্দি দেশপ্রেমের গানকেই গান বলে চেনে। সর্বত্র। সত্য বটে বলিউড সিনেমার গানে বহু ছেলে বা মেয়ে প্রেমের জন্যে প্রাণ দিতে পারে--কুলের কালি গায়ে মাখাতে পারে--তারা কজনে হাজার মানুষের ভিড়ে নেমে সাহস করে গাইতে পারে সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে...
‘যারা কাফেতে মোড়েতে বসে আছো
আমি তোমাদের ছেড়ে চললাম
তোমরা হতাশ-পেয়ালা ভরে নিলে
আমি রক্ত ঝরিয়ে কাঁদলাম ।
চারমিনারের ধোঁয়াতে
জীবন-পেয়ালা জমাট কুয়াশা
ফ্লুরেসেন্ট আলোর মোড়ে মোড়ে ঘোরে
তৃষিত মুক্তিপিপাসা ।
আজ ভেঙে যাব, কাল জুড়ে যাব
তবু ভাঙতে জুড়তে চলেছি
কালবোশেখিটা তোমাদের দেব
খুঁজে আনতেই চলেছি।
ওগো হতাশ তোমরা কেঁদো না
কোনও সান্ত্বনা আমি দেব না
সূর্য ডোবার সংকেতে দেখ
মুক্তি-রঙের নিশানা ।
সাহারা হৃদয় দাঁড়িয়ে যারা
মোড়ে মোড়ে আজও হতাশায়
আমার রক্ত ঝরে ঝরে যাক
তাদের শূন্য পেয়ালায় ।
আজ ভেঙে যাব, কাল জুড়ে যাব
তবু ভাঙতে জুড়তে চলেছি
বিদ্রোহী আমি বিপ্লবে ডাক
তোমাদের দিতে এসেছি।’
সেই ছেলেটিও গাইতে জানে না, যে কাজ পায় নি বলে প্রেমিকা পায় না। সেই মেয়েটি , যার রূপ ভালো নয় বলে কেউ ফিরেও তাকায় না। অথচ, জানা উচিত ছিল।
আর সব বাদ দিন-- এতো যে প্রেম--- এর ঠাঁইটা তো হৃদয়ে। কাগজে জানা যাচ্ছে ,দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন কেকে। তিনি অবহেলা করে গেছেন--এবং এই অবহেলাতেই তাঁর মৃত্যু। তাঁর ‘প্রেমের পাঠশালার' ছাত্রদের কী সেই সবেও সরব হতে মানা? আরও দশজনকে সতর্ক করবার দায় নিতে হবে না? অথবা ধরুন, প্রশ্ন উঠেছে--কলেজ ছাত্ররা এত লাখ লাখ টাকা পায় কই বলিউড শিল্পীকে এনে অনুষ্ঠান করতে? এই সব নিয়ে প্রশ্নে ভাবতেও মানা কি প্রেমের পাঠশালার ছাত্রদের? অনুষ্ঠানগুলোতে অব্যবস্থার চূড়ান্ত নিয়েও যে তর্ক উঠছে সেই সব নিয়েও ভাবতে নেই কি প্রেমিক ছাত্রদের বা প্রেমিকা ছাত্রীদের?
রূপঙ্কর খুব অন্যায় করেছেন--নিজেকে কেকে-র থেকে বড় শিল্পী বলে। তাঁর ‘ও চাঁদ শোনে' দুই চারটার বেশি ছেলে মেয়ে প্রেম শেখেনি মেনেই নিলাম। তাঁরও জানা দরকার--তিনি সব বাঙালির জন্যে গান করেনও না। বিশেষ করে যারা ‘হাণ্ড্রেড পার্সেন্ট লভ' বা দেবতা-প্রেমের গান ‘ঢাকের তালে' জন্মদিনের পার্টিতেও নাচবেন বলে চালিয়ে দেন। সেই সব বাঙালি শিল্পীর থেকেও তাঁর অনুরাগী কম--এর অন্যরকম হবার কথাই না।
এমনিতেই প্রাক-স্বাধীনতা আমল থেকে হিন্দি ভাষাকে কেন্দ্র করে এক কেন্দ্রিক রাষ্ট্র গড়বার এক পুঁজিবাদী চাপ চিরদিনই ছিল। বহু আগেই আমরা তার কাছে আত্মসমর্পণ করে রেখেছি। আমরা ধরতেও পারি না আমরা যাকে নিজের পছন্দ অপছন্দ বলি—সেটি একটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নির্মাণ। আর গত তিন দশকে তো আমরা বিশ্বায়নের স্বপ্নে মজেই আছি। কেকে, শান, শ্রেয়ারা তো এই বিশ্বায়ন যুগের শিল্পী। সেখানে বাংলা গান দাঁড়াবে কোথায়? তিনি কেকে হতে পারেন না, পারবেন না--আগামী অনেক প্রজন্মই পারবে না। সেখানে তাঁর এহেন ‘আমরা অনেক ভালো গাই' এমনিতেও দম্ভ--আর কেকের বিরুদ্ধে বললে বেশি বেশি দম্ভ বলেই শোনাবে। ভোটের সময় ভোট টানবার জন্যে ‘জয় বাংলা' বলে চেঁচানো--আর স্বজীবনে বিশ্বায়নের স্রোতে গা ভাসানোই এখন নতুন প্রজন্মের ধর্ম। সারা দেশেই। এরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে দেশে রাজনৈতিক হাঙামা করলেও ভজনের আসরেও এমন ভিড় করে না। এরা ভজনকেও ডিজে গান বানিয়ে যায় মসজিদে। কী করতে যায় সবাই জানেন। তারা কেকে কেন শুধু--- অভিজিৎ , শান , শ্রেয়াকে এনে--ভিড় জমাবার ভণ্ডামিটা করবেই। আর করে বলেই গায়ক রূপঙ্করকে ‘সভ্যতা’ শেখাতে গিয়ে এরা নিজেরা সভ্যতার সব সীমা ছাড়িয়ে যেতেও কুণ্ঠিত বোধ করে না । সেই ছাত্রেরা ফিরেও দেখবে না গান বেচে যাদের সংসার চলে--তাঁরা বাঁচলেন কি মরলেন যখন আর সিডি ক্যাসেট বাজারে চলে না। কোভিডে যাদের গান শেখাবার পাঠশালাও ছিল বন্ধ—সারা দেশেই। কালিকা প্রসাদের পরে ‘দোহার’-এর মতো দল টিকবে কি টিকবে না—এই নিয়ে তাঁদের তর্কটা অনেকটা রাশিফল মিলল কি না মিলল বিচার করবার আমোদের মতো। তাঁরা তো কালিকাকে চিনেছেন—জি-সারেগামা দেখে। জি চ্যানেল কী করে চিনেছে—সেই প্রশ্নও তাদের মনে দেখি না। এরা এখনকার দোহারের সংগ্রামের খবর রাখে না। রূপঙ্করও কি কোনোদিন এই সব নিয়ে বেশি ভেবেছিলেন? তাঁর গান শুনে মনে হয় নি কোনও দিন। আমাদের না-শোনা গান থেকে থাকতেও পারে। অগত্যা-- তাঁর মনের ক্ষোভকে গদ্যে জানাবার ভাষার সমস্যা হতেই পারে। তার উপরে তাঁকে বলতে হচ্ছিল যে দলকে সমর্থন করেন সেই দলেরই ছাত্রদের বিরুদ্ধে। সেই দলটি যে তিনি কেন করেন?—এমন আদর্শবাদী প্রশ্নও খুবই সরল প্রশ্ন। এও শিল্পীর অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি সর্বভারতীয় প্রশ্ন। অসমেরও হাল একই।
এর পরে নাহয় তিনি একই কথা--গানেই বলুন। কিছু হলেও লোক বেরোবে যারা শুনবে বুঝবে। তিনি বাংলা গানের অন্যতম সেরা শিল্পী ছিলেন আছেন। কোনও ট্রলই তা দমাতে পারবে না। এই কদিন আগেও ‘ইস্কাবন’ ছবিতে গাওয়া তাঁর গান ‘জোনাকি’ আন্তর্জালে লাখো মানুষ শুনছেন, এবং প্রশংসাতে ভরিয়ে দিচ্ছেন। আন্তর্জালের সব ক’টি মঞ্চে গানটি রয়েছে। এবং লাখো মানুষ শুনছেন। কেউ একটিও কটু কথা বলেন নি ফেসবুকে ছাড়া। তিনি আগামীতে গানেই বলুন তাঁর রাগের কথা, ক্ষোভের কথা, ক্রোধের কথা। এই যেমন কিছু বাঙালি শুনেছেন শিলাজিতের সেই গায়ে কাঁটা দেয়া গান ‘এই গিটারটা বন্দুক হয়ে যেতে পারে যদি ভয় দেখাও/ নীল আকাশটা লালে লালে লাল হয়ে যেতে পারে যদি চোখ রাঙাও!’
হ্যাঁ, আমরা নিশ্চিত তাঁর আক্রমণের অভিমুখ কেকে ছিলেন না। ছিলেন নিজের দলেরই এই সব কলেজ ফেস্টের আয়োজকেরা। যারা বাংলা গায়কদের ছেড়ে বলিঊডের দামী শিল্পীদের দিকে ঝুঁকেছেন। এটি ‘কে ভালো কে মন্দ শিল্পী’র তর্কই নয়--এক বাংলা গানের শিল্পীর জীবিকা সংকটের, বলা ভালো গান শ্রমিকের সংকটের চিল-চিৎকার। বাণিজ্যিক গানের কারিগরেরা তাঁদের কোনও পাঠশালাতেই এই সব সংকটের কথা বলতে শেখানই নি। এমন কি ভারতের গৌরব লতা মুঙ্গেশকরও না। একটিই গান মনে করতে পারি তাঁর --- তাও সলিল চৌধুরীর কথাতে। এর পরে আর কই? তবু সেই গানটি আমরা এখানে পুরোটাই তুলে দিতে পারি। যাতে কেকে-র মতো বলিউড শিল্পীদের , যারা বাঙালি হলেও হতে পারেন--প্রেমের পাঠশালার ছাত্রেরা ধরতে পারেন, আমরা বলতে কী চাইছি... আমরা কোন পাঠশালাতে বড় হয়েছি। কোন পাঠশালাকে আজকাল বলা হয়ে থাকে ‘দেশদ্রোহী'দের পাঠশালা। নইলে এই লেখককেও ছোটো করে হলেও ট্রলের শিকার হবার সম্ভাবনাই বেশি।
আজ নয় গুন গুন গুঞ্জন প্রেমে
চাঁদ ফুল জোছনার গান আর নয়
ওগো প্রিয় মোর খোল বাহু ডোর
পৃথিবী তোমারে যে চায়।
আর নয় নিষ্ফল ক্রন্দন
শুধু নিজের স্বার্থের বন্ধন
খুলে দাও জানালা,আসুক
সারা বিশ্বের বেদনার স্পন্দন
ধরণীর ধূলি হোক চন্দন
টিকা তার মাথে আজ
পরে নাও পরে নাও পরে নাও।
কার ঘরে প্রদীপ জ্বলেনি
কার বাছার অন্ন মেলেনি
কার নেই আশ্রয় বর্ষায়
দিন কাটে ভাগ্যের ভরসায়
তুমি হও একজন তাদেরই
কাঁধে আজ তার ভার
তুলে নাও তুলে নাও তুলে নাও।।
পুনশ্চ সংযোজনঃ গীতিকার সলিল চৌধুরী বা গায়িকা লতা মুঙ্গেশকর ‘সেকেলে’ হয়ে গেছেন। নতুন যুগের নতুন কথা নতুন স্বর চাই অনেকে দাবি করতেই পারেন। সলিল চৌধুরীর গানের কথা কি সত্যি ‘সেকেলে’ হয়ে গেছে, কেউ বুকে হাত দিয়ে বলুন দেখি। কাল কি সত্যিই এতো দ্রুত চলে?