“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৩০ মে, ২০২০

একটু নিজের কথাই বলি


।। সাদিক মোহাম্মদ লস্কর ।।

    
(C)Image:ছবি
     পৃ
থিবীতে আমার আসাটাই এক দুর্ঘটনা মাত্র। এক অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার। আমার জন্যে কেউ বুক বেঁধে অপেক্ষা করেনি, বরং এক আপদ হিসেবে দেখাটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ আমার জন্মের সময় আমার দাদার বয়স ছিল মাত্র এক বছর। দাদার প্রাপ্য যত্ন, খাদ্য সবকিছুই আমার কারণে কমে গেল। বাঁশকান্দির অদুরে আলিপুরের বারোজ মেমোরিয়াল খ্রীস্টিয়ান হসপিটাল-এ আমার জন্ম। তারপর বড় হয়ে ওঠা বাঁশকান্দির পৈতৃক বাড়িটিতে। শিলচর-ইম্ফল জাতীয় সড়কটি আমাদের বাড়ি আর ১৯০৪ সালে স্থাপিত বাঁশকান্দি মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ের সীমারেখার মত মাঝখান দিয়ে গেছে।

         আমার দান বা প্রাপ্তি কোনোটাই তেমন বড় নয়। এরকম মানুষের নিজের কথা লেখা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং হাস্যকর হতে পারে অনেকের কাছে। যদি তাই হয় তবে বুঝে নিতে হবে এই একটা কাজের কাজ হল আমার জীবনে, মানুষকে হাসানোর মত একটা বড় কাজ আমি করতে পেরেছি। কেউ আড়ালে বিদ্রূপ করলেও বুঝে নেব আমি কিছু কাজ করেছি। কেউ গালি দিলে বুঝব আমার শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন।

             আমার জীবনে অনেক অনেক অভিজ্ঞতা আছে যা ঐতিহাসিক না হলেও কিছু ছবি তুলে ধরতে পারে। অনেক পারিপার্শ্বিক ব্যাপার হতে পারে সময়ের দলিল। আমার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পেশা, গ্রামের খুঁটিনাটি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির পরিচয় পর্যায়ক্রমে তুলে ধরতে চাই। আশা করি এসব আমার আত্মপরিচয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আর শুধু শুধু বড়লোকের কথাই শুনব কেন? আমাদের জীবনেও তো অনেক উত্থান পতন আছে। আমাদেরও তো কিছু না বলা কথা আছে।

         সমাজকে অনেক কিছুই দেয় একজন ব্যক্তি। তার লক্ষে অলক্ষে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে একজন সাধারণ ব্যক্তি পাওয়ার চাইতে দেয় বেশি। কারণ সে যে রোজগার করে তার একটা বড়ো অংশ সে এই সমাজের স্বার্থে ব্যয় করে। শুধু অর্থ নয়, তার সময়, শক্তি, সুখ, স্বাধীনতা অনেক কিছুই সে সমাজের জন্য বিসর্জন করে। সমাজ তার দায়িত্ব নেয় ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যায়। তো দাঁড়ালো এই যে প্রত্যেক ব্যক্তি সচেতনভাবে সমাজকে দেয় না। যারা দেয় না তারাই শীর্ষ আসনে বসে বাকিদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের দান প্রাপ্তির চাইতে অনেক কম। কিন্তু হিসেবের তালিকায় সেই নাম বড়ো হরফে লেখা থাকে। অথচ যারা নানা দ্বিধায় নিজের প্রাপ্তির রাশিকে বড়ো করতে পারে না তাদের দান তালিকায় বাদ পড়ে যায় এই বলে, যে ভিক্ষা তারা পেয়েছে এ তারই প্রতিদান মাত্র। অথচ মানুষ সমাজে বাস করে এই আশায় যে সমাজ তাকে সুরক্ষা দেবে প্রতি মুহুর্তে আর আপদকালে এই সুরক্ষা এতো বড়ো হবে যে তা দেখা যাবে সহজে। কিন্তু তা হয় না। হয় না বলেই বড়লোকদের বাড়ি ফেরাতে গিয়ে সারা দেশ তালা মারতে হল আর গরিব বাড়ি ফিরতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ে, সরকারি লাঠির আঘাতে বা অনাহারে মারা পড়ে। বড়লোকের হাজার কোটি টাকার ঋণ মকুব হয় অনায়াসে আর কৃষক ঋণ খেলাপির দায়ে আত্মহত্যা করে।

            কিন্তু তারপরেও তো ছোটলোকের লাশের উপর পা রেখে বেশিদিন চলতে পারে না বড়লোক। ছোটলোক ঘরে বসে মরলে বড়লোকের গাড়ি চলে না, বাড়ি চলে না, কল-কারখানা চলে না। পিরামিডের নিচের সারিতে যারা আছি আমরা আমাদের কথাও কিছু বলি। এখানে কাদা আছে, জোঁক কামড়ায়, নোংরা ধুলা শরীরে লাগে। কিন্তু এই সব এক একটা দলিল।



একটু নিজের কথাই বলি – ১

          মার কাছে শুনলাম, জন্মের পর সুস্থই ছিলাম আমি। তিনি ঠাট্টা করে বলেন, বোধ হয় নজর লেগেছিল। চল্লিশ দিন পূর্ণ হতেই শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। স্থানীয় ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দেন। তখন যাতায়াত-যোগাযোগ ভালো ছিল না, শহরে নিতে গেলে হয়তো মৃত্যু হতে পারত। এমন সময় এগিয়ে এলেন খলিল মৌলবি নামের এক হোমিও চিকিৎসক। তাঁর ওষুধে অলৌকিক ভাবে সুস্থ হয়ে উঠলাম। সেই থেকে শরীরের সঙ্গে আমার যুদ্ধ লেগেই আছে, প্রত্যেক বারই আমার জিত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ মানেই হত বা আহত হওয়া। তাই প্রতিটি যুদ্ধে কম-বেশি আহত হয়েছি।

          বাবা আমাকে সাইকেলের বেবি সিটে বসিয়ে নিয়ে যেতেন আলিপুর। পুরাণ বাজার ছেড়েই রাস্তার দুপাশে ছিল বিস্তীর্ণ মাঠ – কখনও সবুজ, কখনও সোনালি। সেই নির্জন জায়গায় পৌঁছে বাবা কী বিড়বিড় করতেন আর ফুকফুক করে কাঁদতেন। চোখের জলের ছিটে এসে পড়ত আমার শরীরে। আমি বুঝতে পারতাম না, জিজ্ঞেস করে যে উত্তর পেতাম তা বোঝার বয়েস ছিল না আমার। বাড়িতে আমার বিছানা, থালা-বাটি সব আলাদা ছিল। খেলা-ধুলা করা নিষেধ ছিল। রোজ ডিম-মাংস খেতাম। একদিন সেই হাসপাতালে এলেন এক ডাক্তার – শাদা চামড়া, লম্বা শক্ত শরীর, বড় বড় আঙুল। বাবার কাছে জানলাম তাঁর নাম জীন বারোজ। আমাকে পরীক্ষা করে লাফ মেরে উঠে এত জোরে গর্জন করলেন যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ‘লা মি না আ আ ....!’ এই আওয়াজে হাসপাতাল চত্বর যেন কেঁপে উঠল। ব্যস্ত হয়ে দরজার পাশে এসে হাজির হলেন ডা. লামিনা। তারপর দুজনে কী সব কথা হল। আবছা আবছা মনে পড়ে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে হেসেছিলেন তখন। বড় হয়ে বাবার কাছে জানলাম ডা. জীন বারোজ সেদিন ডা. লামিনাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা কি টিবি রোগের লক্ষণ? চেহারা দেখে বোঝো না? এতদিন ধরে ছেলেটাকে কড়া ওষুধ দিয়েছ!!...’

            এর পর সর্দি কাশি লেগেই থাকত। শীত এলে বাবা আমাকে এমনভাবে কাপড়ে মুড়ে দিতেন যে লোকে আমাকে এস্কিমো বলে বিদ্রূপ করত। নয় বছর বয়সে আমার হয়ে গেল এগজিমা। দুটি পা ফেঁটে পুঁজ রক্ত বের হত শীত এলে। অনেক ওষুধের পর একজন কবিরাজের চিকিৎসায় সেও কমল প্রায় তিন বছর পর। কিন্তু তখন এল শ্বাসকষ্ট। ফলে খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে খুব বাছ-বিচার চলত। মাস-দুমাস পর পর কী যন্ত্রণা। এরই মধ্যে একদিন ইসলামিক শিক্ষার এক প্রতিযোগিতামুলক পরীক্ষায় বসে ধরা পড়ল আমি চোখে কম দেখি। আমি দূরের বস্তু কম দেখতাম, কিন্তু ‘চালাকি’ করে কাউকে সেটা বুঝতে দিতাম না। ক্লাসে প্রথম বেঞ্চে বসতাম তাই কেউ বুঝতে পারত না। কিন্তু সেদিন হলের পেছন দিকে বসতে হয়েছিল। আমাদের মসজিদের ইমাম সেটা বুঝতে পেরে আমাকে আগে নিয়ে যান আর আমার বাড়িতে জানান। ধরা পড়ল আমার মায়োপিয়া ২.০। চশমা লাগাতে হল এগারো বছর বয়সে। আমার চশমা দেখে অনেকেই আঁতকে উঠতেন। ‘তুমি কি চশমা খুললে দেখতে পাও না?’ ‘কি হল চোখে?’ এ ধরণের অনেক প্রশ্ন আমাকে বড় কষ্ট দিত। এছাড়াও ঝগড়া হলে ছোট বড় অনেকেই গালি দিত ‘কানা’ বলে।

           তেরো বছর বয়সে হাতে আসে এক যোগ ব্যায়ামের বই। সেটা পড়ে শুরু করে দিলাম যোগচর্চা। বদলে দিলাম খাদ্যাভ্যাস। শ্বাসকষ্ট থেকে রেহাই পেয়ে গেলাম এক বছরের মধ্যে। জীবনটাকে একটু ভোগ করার ইচ্ছে জাগল। কিন্তু প্রায়ই সর্দি-কাশি লেগেই থাকত। ডা. সুব্রত পাল প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়েছেন। কমছে না দেখে আমি নিজে নিম-তুলসি-মধু মিশিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। অনেকটা কাজও হল। অনেক পরে জানলাম আমার এলার্জি আছে, ধুলো, বাক্সবন্দি কাপড়-কাগজ এসব নাকের কাছে গেলেই সমস্ত শ্বাসযন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে এখনও। ব্যাপারটা আগে জানলে হয়তো এত কষ্ট পেতে হত না।

           ডা. চৌধুরীর কাছে আমার চোখের চিকিৎসা চলত। চশমার পাওয়ার বাড়তে থাকল। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বের হওয়ার কয়েকদিন আগে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে গিয়ে একটা ব্যাপার দেখে চিন্তায় পড়লাম। স্টাম্পগুলো মাঝখানে যেন ভাঙা মনে হল। এরপর যেদিকে তাকাই সব ভাঙা। বুঝলাম কিছু একটা সমস্যা আছে। পরদিন মনে হল সমস্যাটা নেই। আর কাউকে বললাম না। মাধ্যমিকের ফল যেদিন বের হল সেদিন আবার এই সমস্যা দেখা দিল। আমি জানতাম আমার রেজাল্ট কী হবে। তাই স্কুলে না গিয়ে ওরিয়েন্টাল হলে সিনেমা দেখতে গেলাম। দেখলাম পর্দাটা যেন ভাঙা। বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি তুলনামূলক ভালো ছিল। সেই চোখেই ভাঙা দেখছি। পরদিন ডা. চৌধুরির কাছে এলাম। কয়েকদিন পরীক্ষার পর তিনি বললেন, রেটিনাল ডিটাচমেন্ট হয়েছে বাম চোখে। অপারেশন করতে হবে। যেতে হবে দূর মাদ্রাজে অবস্থিত শঙ্কর নেত্রালয়াতে। মাথায় যেন বাজ পড়ল সবার। কোন কলেজে কী বিষয় নিয়ে ভর্তি হবো এই পরিকল্পল্পনা নিয়ে সবাই যখন মশগুল, সবাই যখন আমাকে আর আব্বাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে সায়েন্স পড়লে ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে, ঠিক তখনই ডাক্তার বললেন আমার পক্ষে পড়াশোনা আর হবেই না।

            মাদ্রাজ যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হল। আব্বার বাইরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই কৃষ্ণপুরের আমার আত্মীয় তথা আব্বার সহকর্মী ফইজুল মামা আমাদের সঙ্গে যাবেন বলে স্থির হল। রেলের টিকিট বুক করা হল। ডাক্তারের পরামর্শে কমপ্লিট বেডরেস্ট। এরই মধ্যে ডাক্তার জানালেন একটা উপায় আছে, রোগ কমে যেতে পারে। আশায় বুক বেঁধে বিছানা পত্তর নিয়ে ভর্তি হলাম শিলচর মেডিকেল কলেজের আই অয়ার্ডে। আমার চোখ বেঁধে রেখে দেওয়া হল বিছানায়। দিনে কয়েকবার মেডিকেলের পড়ুয়ারা এসে বন্ধন খুলে ওটিতে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করত। মেয়েরাই বেশি উৎপাত করত। কেউ কেউ অযথা ঘেঁষাঘেঁষি করত, আমি বড়ই বিরক্তি বোধ করতাম। অবশ্য কারো কারো স্পর্শে জীবন ফিরে পেতাম। হিফজুর চাচা, আদিমা আন্টি দিনরাত লেগে থাকতেন। দশদিন এভাবে রাখার পর জানিয়ে দেওয়া হল মাদ্রাজ যেতেই হবে। পরে জানলাম এই দশদিন আমার চিকিৎসা হয়নি, ছাত্রছাত্রীদের গিনিপিগ ছিলাম আমি।

           সেও এক অভিজ্ঞতা। চক্ষু বিভাগে তেমন গুরুতর রোগী নেই। বেশির ভাগ ছানির অপারেশন। করিমগঞ্জের এক রসিক বৃদ্ধ ছিলেন। জীবনের অপ্রাপ্তি নিয়ে এমন রসিকতা বোধ হয় সবাই করতে পারে না। আমাকে ডেকে বলতেন, ‘বুঝলায় নি নাতি, আমরার আর কদর নাই। সুন্দরী অখল তো পাল্লা, আমার বাড়ির এইনও আইন না। আইতাউ কিলা, পয়সা লাগে যেন।’ তিনি হাসপাতালের খাদ্য নিয়ে ব্যঙ্গ করতেন, ‘সরখারে সুয়াবি (সোয়াবিন) ইতা কিতা দি যেন বানাইল। অউ যেন গিলার রোজ। ভাতর লগে কামড় দিতে কচাৎ কচাৎ করে। গন লাগি গেছে।’ একদিন ভাত খেয়ে চরম তৃপ্তিতে ঘোষণা করলেন,’বুইচ্ছনিবা! আইজ এক কাম করছি। তলে নামিয়া হাগাই মরিছ লইয়া আইনছি। সরকারর ভাত আর সুয়াবি থালো লইয়া কান্দাবায় সাতগু হাগাই মরিছ থইছি। কামড়র লগে একোগু… হালার সুয়াবি… এবলাকু খাইতায় নায় আবার… ঝালে খালি ঠেলি ঠেলি হারার।‘ চক্ষু বিভাগের ওয়াশরুম তুলনামূলক ভাবে পরিষ্কার ছিল। আমার দাদা একদিন সেই ওয়াশরুম থেকে ফিরে বললেন, ‘এখানে পায়খানা করতে গেলে বমি করে ফিরতে হয়।’

          তারপর একদিন অজানা দেশের উদ্দেশে পাড়ি দিলাম। বাস থেকে দুচোখ ভরে মেঘালয়ের পাহাড়, ঝরণা দেখলাম। ভাবলাম, আর এই চোখ দিয়ে এই রূপ দেখা হবে না বোধ হয়। গুয়াহাটি দেখে বিস্মিত হলাম, এতো লোক, এতো গাড়ি, অট্টালিকা। দিসপুরের যে আত্মীয়বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম তা এখন আর চেনাই যায় না। তখন ছিল মাটির গলিপথ, কচুরিপানায় ভরা বিস্তীর্ণ জলাভূমি। তারপর আরেক যাত্রা। এই প্রথম রেলভ্রমণ কোচিন এক্সপ্রেস চড়ে। গান গেয়ে, গানের দল গড়ে কামরায় কামরায় নিমন্ত্রণ খেয়ে কেটে গেল ৬০ ঘন্টা। প্লেটফর্ম পেরিয়ে মাদ্রাজ নগরী দেখে হতভম্ব। উঠলাম এস এম লজিং হাউসে। আব্বার কোনও অসুবিধে হল না। ইডলি, দোসা, সাম্বার গোগ্রাসে গিলছেন। আমি তো ফাঁপরে পড়লাম। কিছুই খেতে পারি না। পরিচয় হলো সোনাইর মিলন মামার সঙ্গে, সিনেমায় কাজ করতেন। আরো অনেকের সঙ্গে দেখা হল। এত আদর যত্ন সহযোগিতা মানুষ পরের জন্য করতেও পারে এই ব্যস্ত নগরিতে!

             নেত্রালয়ে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলাম। এক মহিলা জন্ম থেকে শুরু করে তখন পর্যন্ত অসুখ আর ওষুধের বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করলেন। অদ্ভুত সব যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হল চোখ। ডাক্তার পি চাল্লা বললেন, দুচোখেই ডিটাচ হয়েছে কয়েক বছর আগে। বকাবকি করলেন, ‘দৃষ্টিশক্তি দ্রুত কমছে দেখেও তো ডাক্তারের বোঝা উচিত ছিল।’ যাই হোক বাম চোখ অপারেশন হল। ওটিতে যাওয়ার সময় গান গেয়ে গেয়ে ঢুকলাম। এক তামিল মহিলা হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন, কর্মীদের একজন আমার দিকে দেখিয়ে কী বলল মহিলাকে। বোধ হয় মহিলাকে সাহস দিল। আমি গর্বিত হয়ে একটু জোরে গান গাইলাম, ‘জিনা য়াহাঁ, মরনা য়াহাঁ’। বোধ হয় একটু আগে নেওয়া একটা ইঞ্জেকশনের প্রভাবও হতে পারে। তারপর একটা সেলাইন, ধীরে হাত থেকে শুরু করে মাথা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে সব শেষ। জ্ঞান ফিরে আসার পর টের পেলাম আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী যন্ত্রণা আর অস্বস্তি। জানলাম আনেস্থেসিয়ার কারণে নাকি এসব হয়। তিনদিন পর চোখ খুলে দেওয়া হল। এলাম লজে, বেডরেস্ট। কিন্তু সেই ভাঙা দেখাটা থেকেই গেল। ডাক্তার বললেন, অপারেশন না হলে দৃষ্টিশক্তিই চলে যেত। আশ্বস্ত হলাম।

          তারপর হল ডান চোখের অপারেশন। এই চোখটি এখন ভালো, কারণ বাম চোখে তো আমি ভাঙা দেখি। অপারেশন করলেন ড। রবি। মনে পড়ে অপারেশন চলার সময় হঠাৎ আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিল। সবাই চিৎকার করে আমাকে ঝাপটে ধরেছিল। বাড়ি ফিরে আসার পর কয়েক মাস পর আবার সমস্যা দেখা দিল। ডান চোখটাতে কিছু জ্বালা যন্ত্রনা হয়। গেলাম ডা. চৌধুরির কাছে। তিনি পরীক্ষা করে বললেন, বাকলটাতে চোখের পাতার ঘষা লেগে ক্ষত হয়ে গেছে। আবার গেলাম মাদ্রাজ। এবার বাকল রিমুভ করার জন্য ডান চোখে আবার অপারেশন করলেন ডা. মুনা পি ভেন্ডে। তিন মাস পর আবার যেতে বললেন। এরই মধ্যে সমস্যা দেখা দেওয়ায় ডা. চৌধুরির কাছে আবার গেলাম। তিনি শিলচর মেডিকেল কলেজের ওটিতে নিয়ে কীসব করলেন। পরে বললেন চোখের ক্ষতস্থানে একটা ফাঁক হয়ে গেছে, কিছুতেই জোড়া লাগছে না। নেত্রালয়াতে গেলে ডা. মুনা হেসে বললেন, এ আর জোড়া লাগবে না। প্লাস্টিক সার্জারি বা গ্যাস্প করা যেতে পারে। কিন্তু দরকার নেই। বছরে একবার পরীক্ষা করতে হবে। এবার এই চোখটাও আর ভালো রইল না। মনে হয় জ্ঞান ফিরে আসায় তড়িঘড়িতে কী একটা গণ্ডগোল হয়েছে, তবে সেটা আমার অনুমান মাত্র। এই কারণে লেন্স লাগানো সম্ভব নয়। লেজার তো আর সম্ভবই নয়।

              একবার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি ব্যায়াম করতে পারি? মাথা নেড়ে জানালেন পারব। আবার জিজ্ঞেস করলাম, খেলাঘুলা? পারবে। পড়াশোনা? তিনি একরকম রেগে গিয়ে বললেন, ‘ইউ ক্যান ডু এভরিথিং। হোয়াই আর ইউ আস্কিং? হু টল্ড ইউ দ্যাট?’ বললাম, আমাদের ওখানকার ডাক্তার বলেছেন। রেগে গিয়ে আমাকে ইংরাজিতে বললেন, ‘ওসব আজগুবি চিন্তা বন্ধ কর। কী হয়েছে তোমার যে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? তাহলে অপারেশন কেন করা হল?’ বহুদিন পর যেন মুক্তির স্বাদ পেলাম। এখনও আমি চলছি জীবনের জঙ্গল কেটে। এখনও আমি পড়ি, পড়াই, ব্যায়াম করি, কাজ করি। তবে জীবনের চাকাটাকে আগের গতি দিতে যেন দ্বিগুণ শক্তি দিতে হয়। কারণ দুর্ঘটনার পর গাড়ি মেরামত করে নিলেও আর আগের মত চলতে পারে না।


কোন মন্তব্য নেই: